আঙুলে আঙুল পর্ব ১০

0
467

#আঙুলে_আঙুল
পর্ব (১০)

বাবার সংবাদ পেয়ে অরুণিমা ভয় পেল। মুখটা ফ্যাকাসে হলো। ভেতর-বাহিরে ক্রমাগত কম্পন তৈরি হতে অসহায় দৃষ্টিতে চাইল মাইমূনের দিকে। সে বুঝে গেল খারাপ কিছু শুনেছে। তাই জিজ্ঞেস করল,
” কী হয়েছে? ”

অরুণিমা মোবাইলটা ব্যাগে ভরতে ভরতে উঠে দাঁড়াল। দুর্বল স্বরে উত্তর করল,
” হাসপাতালে যেতে হবে। ”

মাইমূনও উঠে দাঁড়াল। পরবর্তী প্রশ্নটা করার সুযোগ পেল না। অরুণিমা ব্যাগ থেকে কিছু টাকা বের করে রাখল টেবিলে। বলল,
” বিলটা দিয়ে দিয়েন। আসি। ”

মাইমূন টাকা ফিরিয়ে দিতে চাইলে অরুণিমা শান্ত স্বরে বলল,
” আপনাকে আমি ডেকে এনেছি। তাহলে খরচটা তো আমার পক্ষ থেকেই হওয়া উচিত। ”
” তুমি তো কিছু খাওনি। ”
” তাই বলে কি, বিল মাফ পেয়ে যাব? ”

মাইমূন খাবারগুলোতে আরেকবার তাকাল। অরুণিমা দুপুরে দেখা করে বাড়ি যাওয়ার সময় পাবে না। খাওয়াটাও হবে না। তাই মেন্যুকার্ডের ভারী খাবারের দিকে চোখ বুলিয়েছিল। সেখান থেকেই চিকেন ফ্রাইড রাইস, মিক্স ভেজিটেবলস, প্রন ও চিলি চিকেন অর্ডার করেছিল। আলাপের ফাঁকে মেয়েটার পেটটাও ভরে যাবে এই ভাবনায়। মাঝখানে কল চলে আসায় আলাপ ও খাওয়া কোনোটাই সম্পূর্ণ হলো না। বিল নিয়ে এমন যুক্তি দেখাবে বুঝতে পারলে, এসব খাবার অর্ডারও দিত না। মাইমূনের যেমন রাগ হলো তেমন অনুতাপও। দুটোর মধ্য থেকে জিজ্ঞেস করল,
” তোমার সঙ্গে আসব ? ”

অরুণিমা ব্যাগের চেইন লাগানো শেষ করেছে। চেয়ার সরিয়ে বের হতে হতে বলল,
” না। আপনার ভাগের খাবারটা শেষ করুন। ”

মাইমূনও চেয়ার সরিয়ে বেরিয়ে এলো। সামান্য কঠিন হয়ে বলল,
” আমি খেতে আসিনি। ”

অরুণিমা এক ঝলক তাকাল। দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে দ্রুত বলল,
” আসি। ”

_________

অরুণিমাকে হাসপাতালে এসে খোঁজাখুঁজি করতে হলো না। সঞ্জয়ান সুন্দর করে ফ্লোর ও রুম নাম্বার বলে দিয়েছিল। কাঙ্ক্ষিত রুমটার সামনে পৌঁছাতে শুনতে পেল,
” তুমি অরুণিমা? ”

অরুণিমা চমকাল, অপ্রস্তুত হলো। ভীত ও শঙ্কিত দৃষ্টি নিয়ে সুধাল,
” বাবা কেমন আছে? ”

প্রশ্নকর্তা সামান্য হাসলেন। আশ্বস্ত চাহনি মেলে বললেন,
” ভালো। জ্ঞান ফিরেছে। কথাও বলছেন। চিন্তার কিছু নেই। ”

অরুণিমা আটকে রাখা নিশ্বাসটা ছাড়ল। মনে মনে সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে জিজ্ঞেস করল,
” আপনি সঞ্জয়ান স্যার? ”

সঞ্জয়ান আগের মতো হাসল। বিনয়ীভাবে বলল,
” আমি সঞ্জয়ান সাখাওয়াত। স্যার নই। ”

ফোনে নাম শুনে অরুণিমা চিনতে না পারলেও এবার চিনেছে। বাবার মুখে এই নামটা একাধিক বার শুনেছে। শুনতে শুনতে মনের মধ্যে শ্রদ্ধা ও সম্মান জমা হয়ে গিয়েছিল। সেটাই বুঝি ব্যবহারে প্রকাশ পাচ্ছে। সহজভাবে কথা বলতে পারছে না। ভীষণ লজ্জা ও অস্বস্তি হচ্ছে। তাই বলল,
” বাবার সাথে দেখা করা যাবে? ”
” অবশ্যই। হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যাওয়ায় আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। তাই একদম ভর্তি করে ফেলেছি। ডাক্তার পরীক্ষা করে জানিয়েছেন, এখানে থাকার প্রয়োজন নেই। বিকেলের মধ্যে ছেড়ে দিবেন। ”

সঞ্জয়ানের দেখানো পথে অরুণিমা হেঁটে বাবার সামনে উপস্থিত হলো। তিনি বসে আছেন। চোখ-মুখে ক্লান্ত, চিন্তার ছাপ। অরুণিমা পাশে গিয়ে বসতে তিনি জিজ্ঞেস করলেন,
” কত টাকা বিল হয়েছে রে? আমার পকেট তো একদম ফাঁকা। তোর কাছে আছে কিছু? ”

বাবার প্রশ্নে অরুণিমার দরদপূর্ণ মুখটা বিষণ্ণ হলো। তার ব্যাগে পঞ্চাশ টাকার দুটো নোট আছে মাত্র। বাকি টাকা রেষ্টুরেন্টের বিলে চলে গেছে। তার এত খারাপ লাগল! মনে হলো, রাতের চেয়েও দুপুরে দেখা করাটাই বেশি ঝামেলা হয়েছে। এখন হাসপাতালের বিলটা কীভাবে দিবে? ”

মেয়ের নিশ্চুপতায় অসীউল্লাহর চিন্তা বেড়ে গেল। অসহায় স্বরে বললেন,
” কেন যে অজ্ঞান হলাম! সঞ্জয়ান সাহেবের সামনেই হলাম! তার জায়গায় অন্য কেউ থাকলে চোখে পানি ছিটিয়েই সুস্থ করে দিত। এসব বড়লোকই চিকিৎসা কি আমাদের জন্য? ”

অরুণিমা এক মুহূর্তের জন্য টাকার চিন্তাটাকে এড়িয়ে গেল। জিজ্ঞেস করল,
” কী হয়েছিল তোমার? ডাক্তার বলেছে কিছু? ”

অসীউল্লাহ প্রশ্নটাকে তেমন গুরুত্ব দিলেন না। হালকা স্বরে বললেন,
” তেমন কিছুই না। প্রেশারটা বেড়ে গেছিল। ”
” কেন? ওষুধ কাজ করছে না? ”

অসীউল্লাহ উত্তর দিতে চাচ্ছিলেন না। দোষটা ওষুধের না, তার। চার দিন হলো ওষুধ শেষ। কিনতে চেয়েও কিনেননি। ভেবেছিলেন, বেতনটা পেয়ে একেবারে কিনবেন। মাসের শেষ কটা দিন, কাঁচাবাজারটাও মনমতো করতে পারেন না।

” তুমি আসো। আমি ডাক্তারের সাথে কথা বলে আসি। ”

অসীউল্লাহ হাত বাড়িয়ে মেয়েকে আটকাতে চাইলেন, পারলেন না। অরুণিমা ব্যস্তপায়ে নাগালের বাইরে চলে গেছে। মুখের নিষেধটাকে পাত্তায়-ই দেয়নি।

বাইরে বেরিয়ে সঞ্জয়ানকে পেল না। হয়তো চলে গেছেন। ব্যস্ত মানুষ, রোগীকে যে হাসপাতালে এনেছেন এটাই অনেক। অরুণিমার মনের ভেতরটা শ্রদ্ধায় পরিপূর্ণ হয়ে গেল। ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করার চেয়েও হাসপাতালের বিলের টাকা যোগাড় করা বেশি জরুরি। তাই বাসার দিকে ছুটল। মায়ের কাছে জমানো কিছু থাকতে পারে।

________
অরুণিমা বাসায় পৌঁছে বাবার সম্পর্কে মাকে কিছু বলল না। অন্য কারণ শুনিয়ে টাকার কথা তুলল। তিনি সঙ্গে সঙ্গে বলে দিলেন তার কাছে কিছু নেই। দুশো টাকার মতো ছিল, পরশু বাবা চেয়ে নিয়েছেন। অরুণিমা আশাহত হলো। চিন্তা দুশ্চিন্তায় রূপ নিল। বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ রুমে বসে থাকার পর যখন বাইরে বেরুল তখনই মল থেকে কল এলো। অরুণিমা ভাবছিল, কাজে ফিরে যায়নি তাই কল দিয়েছে। কিন্তু দোকানদার চাচা সেই প্রসঙ্গ না টেনে বললেন,
” শুনলাম, তোমার বাবা অসুস্থ? আমাকে বলোনি কেন? ওষুধপত্র কিনেছ? ”
” না। ”
” কত টাকা লাগবে? দোকানে এসে নিয়ে যেও। থাক আসতে হবে না। আমি আসছি তোমার কাছে। এই সুযোগে তোমার বাবাকেও দেখে নিব। ”

অরুণিমা বাঁধা দিতে চাইল, তিনি শুনলেন না। হাসাপাতালের সামনে দাঁড়াতে বলে কল কেটে দিলেন।

_______
দোকানদার চাচার অপেক্ষা করতে করতে অরুণিমার মনে সন্দেহ তৈরি হলো। কতগুলো প্রশ্নও জমা হলো। সে তো বাবার অসুস্থের কথা বলেনি, হাসপাতালের ঠিকানাও দেয়নি। তাহলে খোঁজ-খবর পেলেন কোথায়? এই সন্দেহ গ্রস্ত অবস্থায় দোকানদারের সাথে সাক্ষাত হলো। রিকশায় এসেছেন। হাসপাতালের মূল ফটকে পৌঁছাতে বেলা শেষ হয়। মাগরিবের আযানের ধ্বনি শোনা যায় আশপাশের মসজিদ থেকে।

” চলো, তোমার বাবার সাথে আগে দেখা করি। ”

অরুণিমা তাকে সঙ্গে নিয়ে হাঁটা শুরু করতে মিয়াভাইয়ের মুখটা ভেসে উঠে মানসপটে। পা দুটোকে একটুখানির জন্য থাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
” চাচা, আপনার সাথে মিয়াভাইয়ের যোগাযোগ হয়েছে? ”

চাচা আকস্মিক থেমে গেলেন। থতমত খেয়ে বললেন,
” না তো। ”

অরুণিমা বিশ্বাস করল না। বলল,
” টাকা কি উনি দিচ্ছেন? আমি এ টাকা নিতে পারব না। আপনি যেহেতু এসেই পড়েছেন, বাবার সাথে দেখা করে চলে যান। ”

চাচা দ্রুত বললেন,
” না, না। মিয়া ভাই টাকা দিবে কেন? তুমি কি উনার দোকানে কাজ করো নাকি আমার? আমি দিচ্ছি। তোমার যদি বিশ্বাস না হয় ধার মনে করে বেতন থেকে কেটে নিও। ”

অরুণিমার ধার নিতে হলো না। হাসপাতালে বাবা নেই। রিসিপশনে খোঁজ নিয়ে শুনল, তাকে বিকেলে ছুটি দেওয়া হয়েছে। সকল বিলও পরিশোধ হয়ে গেছে। অরুণিমার বুঝতে বাকি রইল না এই কাজটি কার। সঞ্জয়ান চলে যায়নি, বিল পরিশোধ করতে গিয়েছিল। সেজন্যই তার সাথে দেখা হয়নি।

বাসায় পৌঁছে দেখল, বাবার বিছানায় ওষুধের সাথে একগাদা ফলমূল। শূভ্রা ও নিয়াজ ইতিমধ্যে একটা করে আপেল ও বাটি ভর্তি আঙুর নিয়ে খাওয়া শুরু করেছে। অরুণিমা সেখান থেকে বেরিয়ে এলো মুখ ভার করে। যে সাহায্যটা মিয়া ভাইয়ের কাছ থেকে নিতে চায়নি, সেটা কি সঞ্জয়ানের কাছ থেকে নেওয়া উচিত? অরুণিমা দ্বিধায় পড়ল। রাতের খাবারটা ঠিকমতো খেতে পারল না। ঘুমাতে যাওয়ার সময় সঞ্জয়ানকে কল না করে পারল না। ভীরুমনে খুব মনোযোগের সাথে রিং শুনতে শুনতে আচমকা পুরুষ কণ্ঠটা পেল। সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করল,
” চাচার শরীর এখন কেমন? ”
” ভালো। ”
” গলা এমন শোনাচ্ছে কেন? চিন্তা দূর হয়নি এখনও? ”

অরুণিমা স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করতে করতে বলল,
” আমার গলা এমনই। একটা প্রশ্ন ছিল। ”
” জি, বলুন। ”

অরুণিমার সঞ্চয় করা সাহসটা হারিয়ে গেল। অপরিচিত অবস্থায় মানুষটি তাকে ‘ তুমি ‘ সম্বোধন করেছিল। পরিচিত হওয়ার পর ‘ আপনি ‘ হয়ে গেল কেন? অরুণিমার মনে হলো, এত রাতে কল দেওয়ায় সঞ্জয়ান রাগ করেছে। বিরক্ত হয়েছে। সেজন্যই সম্বোধন বদলে গেছে। তাই প্রশ্নটা করবে কী করবে না বুঝতে পারছে না। একবার মনে হলো, কলটা কেটে দিলেই বেশি ভালো হবে। পরক্ষণে ভাবনা পাল্টাল। বার বার কল দিয়ে বিরক্ত করার চেয়ে একবার কল দিয়েই কাজটা সম্পন্ন করাই ঠিক হবে। সে একটা নিঃশ্বাস টেনে জিজ্ঞেস করল,
” হাসপাতালের বিল কি আপনি পরিশোধ করেছেন? ”
” হ্যাঁ, এটা তো উনার হক। ”
” কীভাবে? ”

সঞ্জয়ান বুঝাল, অসীউল্লাহ রুহানিয়াতে কর্মরত আছেন। সেই হিসেবে তার চিকিৎসার কিছু খরচের দায়ভার কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করতেই পারে। অরুণিমা বুঝতে পেরে চুপ হয়ে গেলে সঞ্জয়ান জিজ্ঞেস করল,
” আর কোনো প্রশ্ন? ”
” না। ”
” তাহলে রাখব? ”

অরুণিমা এই প্রশ্নের উত্তর করল না। চট করে কলটা কেটে দিল। ঠিক সেই সময় কলিংবেল বেজে ওঠল।

চলবে

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here