অলকানন্দার নির্বাসন পর্ব ৩৪

0
367

#অলকানন্দার_নির্বাসন
#মম_সাহা

৩৪.

ঘন মেঘের আস্তরণে আকাশের আলো নিঃশেষ প্রায়। তুমুল বেগে বর্ষণ তখন আনন্দ লীলা বর্ণনা করছে। কিসের আনন্দ তার? নন্দার কলঙ্ক ধুয়ে মিছে নেওয়ার আনন্দ কী? প্রকৃতি কথা বলতে পারে না, তাই হয়তো আনন্দ প্রকাশ করছে অন্য ধারায়। “অলকানন্দার নির্বাসন” মহলের চারপাশে রঙবেরঙের কাপড় টানানো হয়েছে। যেন বৃষ্টি না পড়ে কারণ আজ নির্বাসন মহলে বিরাট ভোজ হবে। স্টিফেনের পরিচালনায় ভোজের আয়োজন করা হয়েছে। পুরো গ্রামবাসীকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। এমনকি সকলের জন্য একটি করে স্বর্ণমুদ্রা এবং বস্ত্রেরও ব্যবস্থা করা হয়েছে। স্টিফেনের ভাষ্যমতে, তার ভালো সময়কে উদযাপন করতে তার সাথে যারা যুক্ত হবে তারা যেন সকলে আনন্দে আত্মহারা হয়। আর বর্তমান সময়ে কৃষকের ঘরে একটি স্বর্ণমুদ্রাই আনন্দের জন্য যথেষ্ট। আর বরাবরই যার যেটার অভাব সেটা দিলেই তার আনন্দ।

নন্দা দুচোখ ভরে দেখলো সেই আনন্দ। তার কলঙ্কের মৃত্যুতে কেউ এতটা খুশি হবে সে ভাবতেও পারেনি। পৃথিবীতে সবাইতো স্বার্থের জন্যেই ভালবাসলো, কাছে আসলো, আবার দূরে চলে গেল। অথচ এই একটা মানুষ যে নন্দাকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবেসে গেছে, পাশে ছিল শক্ত ভিত্তি হয়ে। অথচ নন্দা কখনোই মানুষটাকে তেমন মূল্য দেয়নি। কেন দেয়নি? কারণ সে একটি বিশ্বাসঘাতকের জন্য পথ চেয়ে বসেছিল, তার সবটুকু ভালোবাসা সেই আঙিনায় ঢেলেছিল– যে আঙ্গিনা আসলে সেই ভালোবাসার যোগ্যই না। নন্দা হতাশার দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বিবশ চোখে তাকিয়ে রইল বারান্দা দিয়ে আনন্দে আত্মহারা মানুষটার দিকে। মানুষটার এত আনন্দ, এত আয়োজন কেবল নন্দার জন্য। মানুষের মুখে হাসি ঝলমল করছে। সুখী সুখী একটি আবহাওয়া যেন তার চারপাশ জুড়ে।

নন্দা বারান্দা থেকে সরে বিশাল এক স্বস্তির শ্বাস ফেললো। বুকের ভেতর থেকে যেন বিরাট এক পাথর নেমে গেল। সব নিয়ে বাঁচা গেলেও চরিত্রে দাঁগ দিয়ে বেঁচে থাকা যায় না। বেঁচে থাকাটা কঠিন হয়ে পড়ে একজন নারীর জন্য। আর নন্দা এতদিন যাবত এই কঠিন কাজটাই করে আসছিল। বেঁচে অবশ্য ছিল কিন্তু মৃত্যুর মতো এই বেঁচে থাকা। যে বেঁচে থাকায় মানুষের চোখে চোখ রেখে কথা বলা যায় না, মানুষের থেকে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে হয় সেই বেঁচে থাকায় আসলে মহত্ব কোথায়? এমন বেঁচে থাকা মৃত্যুর সমান। আর নন্দা এই জীবিত মৃত্যু নিয়ে বেঁচে ছিল। একটি অভিশপ্ত জীবন বহন করে বেঁচে ছিল। অবশেষে আজ থেকে তার সত্যিকার অর্থে বেঁচে থাকার দিন শুরু। আর সে বাঁচবে। অন্তত যে মানুষটা তাকে এতটা ভালবাসে, যে মানুষটা তার জন্য সবকিছু বিসর্জন দিতেও রাজি নন্দা সেই মানুষটার জন্য বাঁচবে। বাঁচতে যে হবেই। না হয় বিশ্বাসঘাতকতা করা হবে।

নন্দার চোখে ভেসে উঠলো গত দিনের দৃশ্য। যে গ্রাম একদিন নন্দাকে মেরে ফেলতেও দু’বার ভাবেনি, কলঙ্ক ছেটাতেও দু’বার ভাবিনি সে গ্রাম কালকে নন্দার পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়েছিল একটু ক্ষমা ভিক্ষা চাইতে। যে গ্রাম থেকে একদিন মাথা নত করে বের হয়ে এসেছিল , কাল সেই গ্রামই সে মাথা উঁচু করে ক্ষমা ভিক্ষা দিয়ে এসেছে। জীবনে এর চেয়ে বড় কোন মহিমা হয় না। আর এই মহিমার পুরো কৃতিত্ব একজনের। কেবল আর কেবলমাত্র তার স্বামীর। গতকালের একটা দৃশ্যই নন্দা ভুলতে পারছে না। স্টিফেন কেমন গর্জন দিয়ে উঠেছিল গ্রামবাসীর বিপরীতে! আর নন্দাকে সেই গ্রামের কর্তৃত্ব অর্পণ করেছিল। সকলের সামনে যে মেয়েটা একদিন দুশ্চরিত্রার তকমা লাগিয়ে গ্রাম ছেড়েছিল সেই মেয়েটাই আজ গ্রাম চালাবে! এরকম একটা মহৎ ব্যাপার একমাত্র স্টিফেনের জন্যই সম্ভব হয়েছে। মায়ের মতন যেই শাশুড়ি মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল, সেই শাশুড়ি কাল নন্দার জন্য হাউ মাউ করে কেঁদেছে। নন্দার এই জীবনে আর কিছু চাওয়ার নেই। যা পেয়েছে তাই তার সারা জীবনের জন্য যথেষ্ট। এতেই সে আমরণ কৃতজ্ঞ থাকবে।

বেশ সময় নিয়ে সে স্নান করল। লাল টুকটুকে একটি শাড়ি জড়ালো শরীরে। সোনার ভারী গহনা গুলো দিয়ে সাজালো তার কোমল অঙ্গ খানি। শরীরের সুগন্ধি মাখতেও ভুললো না। নিজেকে রানীর মতো সাজালো। এতদিন পর স্টিফেনের বলা কথাটার মাধুর্যতা সে বুঝলো। সে আসলেই রানী। যার এমন একটা রাজা আছে সে রানী না হয়ে পারে!

“বড়ো সাজছো যে! কলঙ্ক ঘুচানোর আনন্দে নাকি অন্যকিছু?”

হুট করে নারী কণ্ঠ শুনতেই চমকে গেল নন্দা। পিছু ফিরে তাকাতেই দেখল বিহারিণী দাঁড়িয়ে আছে হাসি হাসি মুখ করে। চোখে মুখে তার প্রগাঢ় স্নিগ্ধতা। নন্দাও হাসল কিঞ্চিৎ। রহস্য করে বলল,
“তোমার কী মনেহয় বলো দেখি?”

“মনে তো কিছুই হচ্ছে না। তাই তো আমি জিজ্ঞেস করলাম।”

“হবেই একটা কারণ। তবে তুমি খুশি কেন?”

“যদি বলি তোমার খুশিতে?”

বিহারিণীর উত্তরে হাসল নন্দা। চোখে গাঢ় কাঁজল লাগাতে লাগাতে বলল,
“অনেক তো হলো লুকোচুরি। ধরা দিবে না এখন?”

নন্দার এহেন প্রশ্নের মানে বুঝল না বিহারিণী। অবাক কণ্ঠে বলল,
“কিসের ধরা দিব?”

“বিহারিণী মহলের তোমাকে প্রয়োজন এখন। মানুষ গুলো কেমন ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছে। তাদের তুমিই পারে গুছিয়ে নিতে। নিবে না?”

বিহারিণী চমকালো। বি স্ফো রি ত নয়নে চাইল নন্দার পানে। আমতা-আমতা করে বলল,
“বিহারিণী মহলে আমার কে আছে? কিছু না। কেউ না।”

“অথচ মহলের নামটায় অব্দি তোমার অস্তিত্ব। তবুও অভিমান কমবে না?”

“অভিমান না তো। কলঙ্ক। যে কলঙ্ক নিয়ে তুমি গ্রাম ছাড়া হয়েছ সে কলঙ্কের ভাগিদার তো আমিও হয়েছিলাম। তোমার কলঙ্ক মুছে গিয়েছে। এটা ক্ষণিকের আর আমারটা আজন্মের। এই কলঙ্ক নিয়ে আবার সেখানে যাওয়া যাবে না।”

নন্দা বুঝল, আন্দাজে ঢিল মারলেও যে সঠিক জায়গায় ঢিলটা পরেছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সে আগ্রহী হলো। কৌতূহলী কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
“কিসের কলঙ্ক? কে লাগিয়ে ছিল?”

“যে তোমাকে স্বাধীন হওয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছিল, সে-ই আমাকে স্বাধীন হতে বলে কলঙ্কিনী করে গিয়েছে। পার্থক্য একটাই, তুমি বেঁচে ফিরেছ আর আমাকে মরতে হয়েছিল।”

#চলবে

[ । ।]

#অলকানন্দার_নির্বাসন
#মম_সাহা

৩৪ এর বর্ধিতাংশ:

বাহিরে মৃদু ছন্দে বৃষ্টি পড়ছে। নন্দা বসে আছে আরাম কেদারায়। তার দৃষ্টি স্থির, অনুভূতি স্তম্ভিত। তার সামনেই বিছানাতে বসে আছে বিহারিণী। যার চোখে অশ্রু। ভাষারা মৃত। ক্ষানিক সময় পার হতেই নন্দা প্রশ্ন করল,
“তোমার সাথে ও বাড়ির সম্পর্কটা কিসের?”

বিহারিণী হাসল। মৃদু মন্দ বাতাসে তখন উড়ছিল বাতায়নের কোল ঘেঁষে থাকা মহা মূল্যবান পর্দা খানা। বিহারিণী সেইদিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে মেঘমন্দ কণ্ঠে বলল,
“তোমার সাথে যে সম্পর্ক ছিল ঐ বাড়ির, আমার সাথেও তাই ছিল।”

নন্দা বিস্মিত হল। বিস্ময়ে বিস্ময়ে টই টুম্বুর হলো তার চারপাশ। সে হাতড়ে বেড়ালো কণ্ঠ ধ্বনির ভাষাদের, অথচ তার ভাষারা আজ নির্বাক। কন্ঠে তার দেখা দিল ক্ষীণ কম্পন। সেই কম্পন যুক্ত কন্ঠ নিয়ে সে বললো,
“হেয়ালি করোনা, কৌতুহল বাড়ছে। আমাকে সবটা জানাও। আমি জানতে চাচ্ছি।”

বিহারিণী দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সেই দীর্ঘশ্বাসে যেন ভেসে এলো তার অতীতের দীর্ঘ যন্ত্রণার গান। আকাশ পানে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে সে বলল,
“সইতে পারবে না যে!”

“এমন একটা জীবন সয়ে বেঁচে ছিলাম আর তুমি বলছো সইতে পারবো না! হাসালে। আজকাল আমি সবই সইতে পারি। ভাগ্য শিখিয়ে দিয়েছে। সে আমার বেলা বড্ড নিষ্ঠুর কিনা!”

“আমি যদি বলি– আমি তোমার স্বামীর প্রথম ভাগিদার ছিলাম তাহলে তোমার অনুভূতি কেমন হবে? তুমি মানবে সেই কথা? বিশ্বাস করবে আমাকে? কষ্ট হবে না স্বামীর ভাগীদার ছিল জেনে?”

নন্দা বিস্ফোরিত নয়নে বিহারিণীর পানে চাইল। তার আকাশ-পাতাল উজাড় করে নিঃস্ব মনে হল নিজেকে। যেন মনে হলো সবটুকু ভ্রম। সবটুকু মিথ্যে কোনো মরীচিকা। এই বুঝি তার সকল ভ্রম কেটে যাবে। এই বুঝি সকল সত্য মুহূর্তেই মিথ্যে হয়ে যাবে এবং নন্দা বিশ্বাসঘাতকতার তোপ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে নেবে। অথচ না, তেমন কিছুই হলো না। সবটুকু ভ্রম বের হলো না। নন্দার ও আর কষ্ট কমলো না। বিশ্বাসঘাতকতায় ঘাতকতায় মেয়েটা ক্লান্ত। কন্ঠনালীর ভাষা ফুরিয়েছে। ফুরিয়েছে নন্দার সকল বিস্ময়। সে বিবশ কণ্ঠে শুধালো,
“তুমি কি সত্যি বলছো? মজা করছ না তো?”

“এমন একটা ব্যাপার নিয়ে কে মজা করে? যেখানে মেয়েরা স্বামীর ভাগ কাউকে দিতে পারেনা, সেখানে আমি স্বামী নিয়ে এমন ঠাট্টা করব? এত অবুঝ আমাকে ভেবোনা, আমি এতটাও বোকা না। আমি এতটাও ভারসাম্যহীন না।”

“কিন্তু তোমার কথা তো কখনো শুনিনি ওদের মুখে! এমনকি তিনিও তো বলেননি! শুধু জানতাম তার প্রেমিকা আছে। অথচ তার বউও আছে বা ছিল তা তো কখনো বলেননি! তুমিও কী কেবল তার বিছানার সঙ্গী হিসেবে ছিলে?”

“না নন্দা, না। আমি তার ভালোবাসার সঙ্গী ছিলাম। সে আমাকে ভালোবেসেই বিয়ে করেছিল। কিন্তু শেষ অব্দি তার ভালোবাসা টিকেনি এটাও আমার দুর্ভাগ্য।”

“ভালোবাসা স্থায়ী না হওয়ার কারণ কী? আর তুমি সাহেবদের কাছে এসে পড়লে কীভাবে? আর এসেছ মানলাম কিন্তু আর ফিরে যাওনি কেন?”

নন্দার অনবরত প্রশ্নে বুক ভারী হলো বিহারিণীর। চোখের সামনে ভেসে উঠল সোনালী অতীত। আনমনেই বলতে লাগল,
“আমার সাথে তোমার গত হওয়া স্বামী সুদর্শনের বিয়ে হয়েছিল বহু বছর আগে। তখন সে সদ্য তরুণ আর আমি সদ্য কিশোরী। আমাদের বাড়ি ছিল কলকাতা। আমার বাবার আমন্ত্রণে একবার সুদর্শন কলকাতা যান এবং সেখানেই তিনি আমাকে পছন্দ করেন। এবং অতঃপর খুব গোপনে আমাদের পত্র আদান-প্রদান চলে। প্রণয় জমে গিয়েছিল দারুণ ভাবে। তারপর আরও প্রায় ছয়বছর আগে তার সাথে আমার বিবাহ কার্য সম্পাদিত হয় বেশ জমজমাট ভাবেই। বউ হয়ে এলাম ‘সোহাগচড়ে’। সোহাগচড় হলো বিহারিণী মহলের পূর্ব নাম। আমাকে তিনি এতটাই ভালোবাসতেন যে আমার নামের সাথে মিলিয়ে এই বিশাল বাড়িটার নামকরণ করেছিল। আমাদের ভালোবাসায় পরিপূর্ণ সংসার ছিল। কোনো কিছুর ছিলনা অভাব। যদিও খুঁড়ো শ্বশুর একটু অন্য ধাঁচের ছিল কিন্তু বাকিরা ছিল দারুণ। কাটছিল সুখের দিন। কিন্তু হঠাৎ কালো নজর পড়ল সংসারটায় এবং সব এক মুহূর্তে শেষ। সব শেষ। আমার সংসার, আমার ভালোবাসা এমনকি আমিও।”

বাহিরের প্রকৃতি এতক্ষণ ভালো থাকলেও এখন কিছুটা আঁধার হয়ে এসেছে। আবার নন্দাদের নির্বাসন মহলে আজ একটা আনন্দ অনুষ্ঠান আছে। সেটার জন্য চলছে তুমুল আয়োজন। ঘন হয়ে আসা আকাশটার পানে চাইল নন্দা। গগন বক্ষ যেন তারই অন্তস্থলের বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছে। নন্দা হতাশার শ্বাস ফেলল। বিহারিণী মহলের মানুষগুলো নিখুঁত অভিনয় জানে। তা না হলে কি আর এমনভাবে একটা জলজ্যান্ত মানুষের অস্তিত্ব লুকিয়ে রাখতে পারতো! নন্দা বিশাল এক শ্বাস ফেলল। বলল,
“কী ঝড় এসেছিল?”

বিহারিণী সুদূরে তাকিয়ে করুণ স্বরে জবাব দিল,
“নবনীল নামক ঝড়। যে ঝড়কে আমি বন্ধু ভেবে ছিলাম। যেমন তুমি ভেবেছিলে। ওর সাথে আমার বন্ধুর মতন সম্পর্ক ছিল। আমি যেহেতু কলকাতা থাকতাম তাই অন্যান্যদের চেয়ে একটু বেশি স্বাধীনচেতা ছিলাম। নবনীল আর আমার সেজন্য প্রচুর ভাব হয়েছিল। আমার স্বাধীনচেতা ভাব আরেকটু বাড়াতে সে সাহায্য করেছিল। কিন্তু সেটাই আমার কাল হয়। একবার তোমার স্বামী শহরে গেলেন বাড়িতে কেউ নেই। আমিই ঘুমিয়ে ছিলাম। এত ঘুম সেদিন কোথা থেকে এলো নিজেও জানিনা। আমার যখন ঘুম ভাঙে তখন দেখি মধ্যরাত। আমাকে বাগানে বেঁধে রাখা হয়েছে। চোখের উপর অনবরত জল ছেটানো হচ্ছে। চোখ মেলে তাকাতেই দেখি সকলে দাঁড়িয়ে আছে। আমার শরীরে বস্ত্রের আবরণ খুব ক্ষীণ ছিল। লজ্জা নিবারণের জন্য ঠিক যতটুকু প্রয়োজন ঠিক ততটুকু। আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না। তার আগেই আমার শরীরে চাবুকের আঘাত পড়ল। আমি আৎকে উঠলাম। ব্যাথাটা শরীরে পৌঁছালেও উপস্থিত ঘটনা মস্তিষ্ক অব্দি পৌঁছালো না। তখন আমার খুঁড়ো শ্বশুর একদলা থুতু ফেলে কেমন ঘৃণিত স্বরে বলল, ‘আমরা বাড়িতে নেই আর তুমি পুরুষমানুষ নিয়ে এসে রেখেছিল! ছিহ্! শহুরে মেয়ে কি-না! বেলাল্লাপনা শুরু করে দিয়েছে।’ আমি তখন বুঝলাম আমার অগোচরে আমার সাথে অন্যকিছু হয়ে গিয়েছে। যার তাৎপর্য এমন— আমার কোনো প্রেমিক আছে যাকে আমি বাড়িতে এনেছিলাম এবং নবনীল সেটা সবাইকে খবর দিয়ে এনে জানিয়েছে। এবং সবাই লোকটাকে বের হতে দেখেছে। সেদিন নবনীলও বাড়িতে ছিল কিন্তু সে এমন মিথ্যা কেন বলল! আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। যদিও আমি বিশ্লেষণ করতাম কিন্তু সুদর্শনের চোখে আমি আমার জন্য সেদিন যে ঘৃণা দেখেছি তারপর আর বিশ্লেষণ করার ভাষা পাইনি। ভালোবাসার মানুষের কাছে নিচু হয়ে যাওয়াটা মৃত্যুর চেয়ে কষ্টকর। এটা নিয়ে বেঁচে থাকা যায়! তারপর উনার আদেশেই আমার শরীরে বেত্রাঘাত চলে এবং আমাকে নদীতে ফেলে দেওয়ার হুকুম সে-ই দেন। এরপর আর ব্যাখ্যা করিনি কাউকে কিছু। কেবল মেনে নিলাম সবটা। ভেবেছিলাম মরেই যাবে। হাত-পা বেঁধে নদীতে ফেলে দেয়। আমিও আমার মৃত্যু বরণ করে নেই। কিন্তু কোন ভাগ্যে এ গ্রামে এসে পৌঁছাই এবং তোমার বর্তমান স্বামী আমাকে রক্ষা করেন। এরপর অনেকদিন কাউকে চিনিনি। উন্মাদ হয়ে ছিলাম। পরে সুস্থ হলেও আর ফিরে যাইনি। কোথায় ফিরে যাব? যে সংসার আমাকে ত্যাজ্য করেছে সে সংসারে! আর যাই হোক, বিতাড়িত জায়গায় ফের যাওয়া হলো নিজের প্রতি নিজের করা সবচেয়ে বড়ো অপমান। তোমার বর্তমান স্বামী পর্যাপ্ত সময় ও সাহায্য দিয়েছে আমাকে। আমি সুস্থ হলেও তা আর প্রকাশ করিনি। সেও জানতে চায়নি। আসলে তুমি ভাগ্যবতী নন্দা, তাই এমন একটা স্বামী পেয়েছ। সামলে রেখ। ভালো যা কিছু আছে পৃথিবীতে, তার দিকে খারাপ দৃষ্টি সকলেরই পরে। হোক সেটা বস্তু, মানুষ কিংবা সম্পর্ক। যার যেটার অভাব, সে সেটা পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠে। সময় থাকতে ভালোবাসার মানুষটাকে আগলে নিও।”

কথা থামতেই বিহারিণী ছুটে বেরিয়ে গেল। নন্দা কিংকর্তব্যবিমূঢ়। বিহারিণীর বলা গল্পে তার মায়া হলো। অথচ একবারও সে ভেবে দেখল না, এ গল্পের পেছনে আদৌও কোনো গল্প আছে কি-না!

#চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here