প্রেম আমার পর্ব ৩

0
1402

#প্রেম_আমার

#তনিয়া

পর্ব:৩

একদিনের মধ্যে যে মানুষের জীবনের মোড় ঘুরতে পারে সেটা তন্নি নিজেকে দেখে বুঝতে পেরেছে।গতকাল যখন ভাই আর স্বামী নামক মানুষটার মধ্যে তন্নি চলে আসে আর আসার পর যখন আহত হয় তখনি প্রিয়ম সুযোগ বুঝে তন্নিকে নিয়ে আসে নিজের বাসায়। এমন না যে সুমন বা সুবাহ বাধা দেয় নি কিন্তু আফসোস প্রিয়ম বুদ্ধি খাটিয়ে সঙ্গে পুলিশ নিয়ে যায় আর আইন মোতাবেক বিয়ের রেজিস্ট্রি দেখালে তন্নিকে ছাড়তে তারা বাধ্য হয়।তবে আসার আগেই প্রিয়ম জানায়,বোনের শ্বশুর বাড়ি যেতে চাইলে তাদের জন্য দরজা সবসময় উন্মুক্ত থাকবে।

জিম করা শরীর প্রিয়মের সেই দিকে উল্টো হচ্ছে তন্নির শরীর। শুকনো শরীর, পাতলা গড়ন।তাই প্রিয়মের ঘুষিটা ভালোমতোই জখম করে তন্নিকে।প্রিয়মের ঘুষি খেয়ে তন্নি শুধু আহত হয়নি রাতে তার জন্য ডাক্তার আনার দরকার পড়েছিল কারণ মধ্য রাতে তন্নির কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে।একে তো সকালে ভাইয়ের হাতের থাপ্পড়, তার ওপর গত পরশু, গতকাল সারাদিন কান্নার দৌড় এরপর প্রিয়মের আঘাত।সবমিলে ভালোই স্ট্রেসের মধ্যে আছে তন্নি। দুইদিনেই তার জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে সেখানে আগামী দিন গুলো কীভাবে নিবে ভাবলেই কাটা দেয় শরীরে!

প্রিয়ম সারাদিনের মধ্যে হয়তো হাজারবার ফোন করেছে তন্নিকে। বিশেষ কাজের জন্য তাকে আজ অফিসে যেতে হয়েছে নাহলে তন্নিকে এভাবে রাখার কথা ছিলো না।প্রিয়মের একটা ভালো গুণ সে নিজের কাজকে সবকিছুর মধ্যেও প্রায়োরিটি দেয় তাছাড়া তার এ কাজের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে।

সন্ধ্যা নামার আগেই প্রিয়ম বাসায় ফিরে আসে আর এসেই তন্নিকে কয়েকবার ডাকে।তন্নির কোনো রেসপন্স না পেলে রুমে দৌড়ে যায় কারণ ভয় ছিল যদি সে পালিয়ে যায়, আবার এটাও জানতো পালালেও তাকে এখানে আসতে হবে তবুও কিঞ্চিৎ ভয় নিয়ে রুমে যায়। পুরো রুম অন্ধকার, প্রিয়ম কয়েকবার ডাকে তন্নি সাড়া দেয় না,প্রিয়ম আলো জ্বালায়।আলো জ্বলাতে ধ্বক করে উঠে প্রিয়মের বুক।তন্নি নেই, প্রিয়ম মাথায় হাত দেয় তাহলে কি সত্যি তন্নি পালিয়ে গেছে,?কি মনে করে প্রিয়ম বারান্দায় যায় দেখে তন্নি ইজিচেয়ারের ওপর শুয়ে আছে। একঝাঁক মশা মনের আনন্দে তার রক্ত শুষছে।মুখের মধ্যে মশা বসতেই প্রিয়ম আস্তে করে সেটাকে চেপে ধরে। হাতে নিয়েই বলে,

“আমার বউ যাকে আমিই এখনো ছুতে পারলাম না সেখানে তোর মতো একটা নিকৃষ্ট প্রানী তার রক্ত শুষছিস?ভাগ্যিস সামান্য একটা প্রানী হওয়ায় হাতের চাপে শেষ হলি যদি মানুষ হতি না তাহলে.”

হঠাৎ তন্নির ঘুম ভেঙে যায়। ফিসফিস কথাটা কানে লাগতেই সে চোখ খুলে আর প্রিয়মকে নিজের কাছাকাছি দেখেই ব্যাঙ লাফে দুই কদম পিছিয়ে যায়।

“আপনি,আপনি এখানে কি করছেন?”

“বেবি তোমার বরের তো রুমের অভাব নেই, বেডের অভাব নেই তবুও তুমি এ ভরসন্ধ্যায় এই মশাদের খাবারের জোগান কেনো দিচ্ছো বলবে?”

প্রিয়মের কথা শুনে তন্নি বুঝতে পারে সে চিন্তার মধ্যে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পড়েছে আর সেই জন্য সন্ধ্যা হওয়ার পরও তার কোনো খবর ছিলো না।প্রিয়ম বুঝতে পারে এটা অনিচ্ছা সত্ত্বে হয়েছে তবুও এমন ভাবে নিজেকে কেনো কষ্ট দেয় তন্নি?তন্নি প্রিয়মের দিকে অপরাধী হয়ে তাকায় প্রিয়ম কিছু বলে না তবে সতর্ক করে দেয় পরে যেন এ ভুল না হয়।তন্নি রুমে আসলে প্রিয়ম তন্নিকে প্রশ্ন করে,

“তন্নি এখন শরীরের অবস্থা কেমন,গতকালের ঘটনার জন্য আমি দুঃখিত।আসলে হঠাৎ এভাবে তুমি চলে আসবে ভাবি নি তাই অজান্তে তোমার গায়ে আঘাত লেগেছে। ”

“এটা আর নতুন কি,মানুষকে আঘাত করায় আপনার স্বভাবে।আপনার সাথে তো আমার প্রথম সাক্ষাৎ বৃষ্টির মধ্যে অথবা সুন্দর কোনো মুহুর্তে হয়নি,মা*রপিঠের মাধ্যমে আপনার সাথে পরিচয়,মা*রপিটের মাধ্যমে আমার বিয়ে আর আমার সামনের সময়গুলো হয়তো এভাবেই যাবে।আমি খুব ভালো করে জেনেছি আমার জীবন থেকে সুখটা পুরোপুরি চলে গেছে তাই আর সেসব নিয়ে ভাবি না।”

তন্নি কথাগুলো বলার সময় গলা ভারী শুনায় তবুও প্রিয়মের সামনে নিজের দূর্বলতা লুকাতে সে তাড়াতাড়ি রুম ছাড়ে।প্রিয়ম তন্নির যাওয়ার পানে চেয়ে ভাবে,এই মেয়ে তাকে শুরু থেকে ভুলই বুঝে গেছে, কখনো হয়তো তার ভালোবাসাটা দেখবে না,যদিও ভালোবাসার ফিলিংসটা সে তন্নিকে দেখানোর সুযোগ পায় নি কিন্তু শুরুটা এমন করে হলো যে দুজনের মাঝে একটা শক্ত দেয়াল গড়ে উঠেছে যা ভাঙা প্রিয়মের জন্য ক্রিটিক্যাল হয়ে গেছে।

দিন যায় রাত আসে,সেই রাত আবার দিনে পরিনত হয় অথচ তন্নির মনের মধ্যে প্রিয়মকে নিয়ে একটুও নতুন চিন্তা উদয় হয় না।হবে কি করে যেখানে তন্নি এখনো পর্যন্ত জানে না প্রিয়ম কে তার পরিচয় তার পেশা?এ বাড়িতে আসা অবধি সে একবারের জন্য এমন কাউকে দেখে নি যে কিনা প্রিয়মের পরিচয় বলতে পারে।হ্যাঁ প্রিয়ম তাকে সবরকম স্বাধীনতা দিয়েছে, তার যখন ইচ্ছে বের হতে পারে যেখানে ইচ্ছে যেতে পারে কিন্তু তার সাথে সবসময় একগাদা গার্ড থাকবে যেন সে স্কুল বাচ্চা হারিয়ে যাবে কোথাও?ভার্সিটি হোক, শপিং হোক বা ভাইয়ের বাসায় সব জায়গায় গার্ড থাকবেই।বন্ধুমহলে অলরেডি তাকে নিয়ে রং তামাশা শুরু হয়ে গেছে এমনকি অনেকের সাথে সম্পর্ক অবনতির দিকে চলে গেছে। কাছের মানুষ গুলো তো বলা শুরু করেই দিছে যে টাকাওয়ালা জামাই পেয়ে কাউকে না জানিয়ে বিয়ে করে নিয়েছে, আবার কারো ভাষ্যমতে টাকার গরম দেখাতে গার্ড নিয়ে ঘুরে।এসব কথায় অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে তন্নি। বাপের বাড়িতে যাওয়া ও বন্ধ করে দিয়েছে তন্নি।সেই ঘটনার পর একবার কি দুবার গিয়েছে কিন্তু তখনও গার্ডগুলো তার সঙ্গে যাওয়াতে সে রেগে যায়।যে বাড়িতে সে এত বছর ছিল, যাদের সাথে এত সময় পার করেছে তাদের কাছে আসতেও যদি তাকে গার্ড নিতে হয় তাহলে আসার চেয়ে না আসাই ভালো।সুমন বোনের এ কষ্ট দেখে সইতে পারে না সে অনেক চেষ্টা করছে প্রিয়মের থেকে তন্নিকে সরাতে কিন্তু এ সাইকোটা এমনভাবে সবকিছু নিজের হাতে রেখেছে যে চাইলেও তার থেকে তন্নিকে এখন নিতে পারবে না।এরমধ্যে নিজের বোনের দূর্দশা দেখে নিজেই ভেঙে পড়েছে।

অনেকদিন হলো তন্নি নিজেকে সংযত রাখার। আজ নাস্তার টেবিলে প্রশ্নটা করেই ফেললো সে প্রিয়মকে।

“আপনার সাথে আমার কথা আছে!”

“বলো আমি শুনছি।”

“শুনলে তো হবে না আপনাকে উত্তর দিতে হবে।কে আপনি,আপনার পরিচয় কি,আর কেনই বা আমাকে বিয়ে করলেন?এতদিন থাকার পর আমার কাছে অনেক রহস্য জমা হয়েছে, আপনার কাজ আর ব্যবহারে আমার মনেই হচ্ছে না আপনি শুধু মাত্র সেই দিনের থাপ্পড়ের শোধ নিতে আমাকে বিয়ে করেছেন, আমাকে বিয়ে করার পেছনে অন্য রহস্য আছে, কারণ কি আমি জানতে চাই? ”

প্রিয়ম মুখের খাবারটা শেষ করে তারপর গ্লাসের পানিটা পান করে তন্নির দিকে তাকায়।

“আমি জানি আমাকে নিয়ে তোমার অনেক প্রশ্ন আর এটাও সত্যি যে আমি তোমাকে শুধু থাপ্পড়ের রিজনে বিয়ে করিনি অন্য রিজনে করেছি।”

প্রিয়মের কথা শুনে তন্নি হা হয়ে যায়। তাহলে কি থাপ্পড়টা শুধু একটা ইস্যু ছিল, তাহলে তাকে বিয়ে করার রিজন কি?তন্নি মুখ খুলতে গেলে প্রিয়ম তাকে থামিয়ে দেয়,

“আমি জানি তুমি আমাকে নিয়ে অনেক প্রশ্নের মুখে আছো।তবে এখন আমার পক্ষে সবটা জানানো সম্ভব না।আর হ্যাঁ তুমি আমার ওয়াইফ,আমার সম্পর্কে তোমার সব জানার হক আছে। আমি তোমাকে সব জানাবো।তবে এটা জেনে রেখো তোমাকে নিয়ে আমি কখনো খারাপ কিছু চিন্তা করিনি বা তোমার প্রতি আমার এতটুকু রাগ নেই। আমি জানি তুমি আমাকে ভালোবাসো না কিন্তু আমি তোমাকে আকাশ সমান ভালোবাসি।তোমার বর এতটা খারাপ না বা এতটা জঘন্য না যতটা তুমি ভাবো?হয়তো ভুল জায়গায় আমি ভুলভাবে তোমার সামনে নিজেকে উপস্থাপন করেছি তাই তোমার মনে আমাকে নিয়ে খারাপ ধারণা জন্মেছে
তবে খুব তাড়াতাড়ি আমি সেটা দূর করবো।”

প্রিয়মের কথায় তন্নি নিস্তব্ধ হয়ে যায়। এতদিন একসাথে আছে কিন্তু কখনো প্রিয়ম তাকে এত সুন্দর করে কথা বলে নি যদিও তাদের মধ্যে আহামরি কথা হয় নি একবারও। প্রিয়ম চাইলেও তন্নি বারবার ইগনোর করেছে আর প্রিয়মও হয়তো সেটা বুঝেছে তাই সেও তন্নিকে নিজের মতো করে ছেড়ে দিয়েছে। তার মানে এই নয় যে তন্নির প্রতি অত্যাচার বা তন্নির ইচ্ছের বিরুদ্ধে কিছু করেছে?তন্নিও নিজের মতো থাকে প্রিয়মও থাকে আপন মনে।তবে প্রিয়ম একবার বলেছে একা খেতে হয় বলে সে অনেকদিন সময় মতো খায় না তন্নি যদি খাওয়ার সময় তাকে সঙ্গ দেয় মানে কথা না বললেও যদি একসাথে খায় তবে সে বাসায় খাওয়াদাওয়া করবে।প্রথম প্রথম তন্নি খেতে আসতো না তখন প্রিয়ম টেবিলে বসে থেকে কিছুক্ষণ পর চলে যেত।এভাবে কিছুদিন যাওয়ার পর একদিন তন্নি খেতে আসে।আর এভাবে কথা না হলেও দুজন একসাথে খাওয়াদাওয়া সম্পন্ন করে।তন্নির প্রতি প্রিয়মের ছোট ছোট কেয়ার কাজ করে।বাসায় আসার সময় প্রায়ইশ সে তন্নির জন্য বিভিন্ন খাবার আনে যেগুলো একসময় বাবার হাত থেকে এবং বাবার পর ভাইয়ের হাত থেকে পেয়েছে।প্রিয়মের এসব কেয়ার তন্নির ভালো লাগলেও তার মনে প্রশ্ন জাগে, প্রিয়মের আসল পরিচয় জানতে আর তার বিয়ের রহস্য কি তা জানতে?

সন্ধ্যার পর কল করে প্রিয়ম তন্নিকে তৈরি হয়ে থাকতে বলে।কেনো তৈরি হবে সেটা নিয়ে কোনো কথা বলে নি শুধু এটা জানায় যে আলমারির তৃতীয় তাকে একটা শাড়ি সাথে প্রয়োজনীয় সবটা আছে সেগুলো পড়ে যেন সে তৈরি হয়ে থাকে।ব্যস এতটা বলেই ফোনটা রেখে দেয়।
,
,
,
চলবে……..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here