প্রেম আমার পর্ব ৪

0
1160

#প্রেম_আমার

#তানিয়া

পর্ব:৪

ছাদে উঠার পর বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে তন্নি। পুরো ছাদটা ক্যান্ডেল দিয়ে সাজানো সাথে এত সুন্দর ডেকোরেশন যে তন্নি চোখ সরাতে পারছেনা। টাটকা ফুলের সুবাস সেই সাথে শীতল হাওয়ায় মোমবাতির টিমটিমে আলোতে পরিবেশটা চমৎকার রোমাঞ্চকর সেজেছে। এ বাড়িতে আসার পর তন্নি নিজের রুম ছাড়া খুব একটা বের হয় নি।ছাদে তো প্রশ্নই আসে না।এ প্রথম ছাদে এসে সে মুগ্ধ হলো।মনে মনে আফসোস করছে এত সুন্দর জায়গাটা এতদিন না দেখে ছিল বলে।তখনি পেছনে থেকে প্রিয়ম তাকে জড়িয়ে ধরে আর তাতেই খোলা হাওয়ায় মাঝে তন্নির শরীরে অন্যরকম স্রোত বয়ে যায়। মূলত প্রথমদিন ছাড়া এতদিন একবারের জন্যেও প্রিয়ম তন্নির কাছে আসে নি কিন্তু আজ হঠাৎ তাকে এভাবে জড়িয়ে ধরার কারণ টা সে বুঝে উঠতে পারলো না।তন্নি অস্বস্তি বোধ করছিল তাই নিজেই প্রিয়মের কাছ থেকে সরে আসে।প্রিয়ম কিছু না বলে নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

“আপনি হঠাৎ ছাদে ডাকলেন কেন?”

“তন্নি চারপাশটা দেখার পরও কি তোমার এ প্রশ্নটা করতে হলো,তোমাকে সারপ্রাইজ দিব বলেই তো আজ ছাদটা এভাবে সাজালাম সেই সাথে তোমার সাথে একান্তে কিছু সময় পার করবো বলে!”

তন্নি ভয় পায় প্রিয়মের কথা শুনে।প্রিয়ম কেমন সময় চায় তার কাছে?প্রিয়ম বুঝে তন্নির মনের কথা।সে অট্টহাসি দিয়ে এগিয়ে যায় তন্নির দিকে।তন্নি দুই কদম পেছলো প্রিয়ম তাকে টেনে কাছে আনে।

“এই বোকা মেয়ে তুমি আমাকে ভয় পাও কেনো,আমি ভয়ানক কোনো প্রাণী যে তোমায় খেয়ে ফেলবো?”

তন্নি মোচড়ামুচড়ি করে।তার নড়াচড়াতে প্রিয়ম বিরক্ত হয়।

“উফফ বেব এত নড়াচড়া করো কেনো তোমাকে একটু দেখতে দাও,তুমি জানো কত সুন্দর লাগছে তোমায়!”

প্রিয়ম খুব কাছ থেকে তন্নিকে দেখতে থাকে।মনে হচ্ছে এ না দেখার স্বাদ তার অনেকদিনের।তন্নি এক প্রকার বিরক্ত হয়ে প্রিয়মকে ধাক্কা লাগায়।প্রিয়ম রাগ করতে গিয়েও সংবরণ করে কেননা আজ সে রাগের মুডে নেই। তন্নিকে অনেক কথা বলার আছে। তাই নিজেকে স্বাভাবিক রেখে তন্নিকে চেয়ারে বসতে বলে।তন্নিও চুপ মেরে বসে যায়। প্রিয়ম কিছুক্ষণ টেবিলে থাকা জ্বলজ্বল করা মোমবাতির দিকে চেয়ে থেকে তন্নিকে প্রশ্ন করে,

“আচ্ছা তন্নি বলো তো আজ তোমায় কেনো এখানে এভাবে ডাকলাম?”

“জানি না। হয়তো আবার কোনো নাটকীয়তার সংলাপ শোনাতে।”

প্রিয়ম হাসে।এ মেয়ে কখনো হয়তো তাকে বুঝবে না তবুও তার দিক থেকে সবটা পরিষ্কার করে জানানো উচিত।কে সে কি তার পেশা আর কেনই বা সে তন্নিকে বিয়ে করেছে?

—————————–

প্রিয়ম বাবা মার একমাত্র ছেলে।বাবা মা দু’জনেই ব্যবসায়ী। মূলত প্রিয়মের বাবা মা দুজনে বিজনেস পার্টনার ছিলেন। সেখান থেকে ভালো সম্পর্ক তারপর বিয়ে।প্রিয়মের দাদা তখনো বেঁচে ছিলেন।প্রিয়ম যখন হয় তখন প্রিয়মের দাদা সবচেয়ে বেশি খুশি ছিলেন কারণ বিপত্নীক হওয়ার পর ছেলের সাথে সময় পার করা বা ছেলে ছেলের বউ নিয়ে আলাপ করার সৌভাগ্য তার হয় নি।দুজনে নিজেদের কর্ম জীবন নিয়ে এতটা বিজি থাকতো যে রাতের বেলা তাদের দেখা মিলতো।তাও মাঝে মধ্যে। বয়স আর প্রেশারের রোগী হওয়ায় রাত জাগা তর বারণ ছিল।তাই যখন প্রিয়মের জন্ম হয় তখনি খুশিতে তিনি পুরো এলাকায় মিষ্টি বিতরণ করেন।খুব সুন্দর করে তিনি প্রিয়মকে মানুষ করার দায়িত্ব কাঁধে নেন।প্রিয়মও মা বাবার চেয়ে দাদার ভক্ত হয়ে উঠে। প্রিয়মের দাদা প্রিয়মকে নিজের সন্তানের মতো যত্ন করে লালন করে।প্রিয়মকে তিনি সেই ছোট বেলার সন্তানের মতো মানুষ করার দায়িত্ব নেয়।প্রিয়মের বাবা মা বেশিরভাগ সময় দেশের বাইরে অবস্থান করতেন তবুও প্রিয়ম সেটা নিয়ে একাকিত্ব বোধ করতো না কারণ ছোট থেকে সে নিজের কাছে দাদুকে পেয়েছে যে কিনা তাকে সবটা আদর দিয়ে মানুষ করেছে।কিন্তু সব সুখ সবার কপালে সয় না সেটা ঘটেছে প্রিয়মের জীবনে।যখন প্রিয়ম পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে তখনি তার দাদু মারা যায়। এরপর দূর্বিষহ হয়ে পড়ে প্রিয়মের জীবন।তার জীবনের মোড় ঘুরে যায়। যে প্রিয়ম লেখাপড়াতে ছিল দুর্দান্ত সেই প্রিয়ম হয়ে যায় দূর্বল।বাইরের পরিবেশ থেকে সে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। স্কুলেও যে তার ভালো বন্ধু ছিল তা না বরাবরের মতো সে ইন্ট্রোভার্ট ছিল তাই ক্লাসের কারো সাথে তার ভালো সখ্যতা গড়ে উঠে নি।এভাবে সে এক বছর পার করে।এরমধ্যে প্রিয়ম সম্পূর্ণ একা হয়ে যায়। প্রিয়মের বাবা মা তাদের মতো ব্যস্ত জীবন পার করছে।বাসায় কয়েকজন কাজের মেয়ে রাখলো যাদের কাজ হলো প্রিয়মের দেখাশুনা করা কিন্তু আফসোস কেউ প্রিয়মের মন মতো হতে পারলো না।

স্কুলের টিফিন টাইমে একা একা গাছের নিচে বসে টিফিন করছিল।মূলত টিফিনটা হাতে নিয়ে বসে ছিল।ঠিক তখনি তার হাতে একটা বল পড়ে আর সেই বলে হাতে থাকা খাবারটা নিচে পড়ে যায় বলটা নিয়ে এদিক ওদিক তাকাতে দেখে ছোট্ট একটা পাঁচ ছয় বছরের বাচ্চা মেয়ে তার দিকে দৌড়ে আসছে।এত্ত কিউট মেয়ে প্রিয়ম খুব দেখে নি।সবচেয়ে কিউট লাগছিল তার লম্বা চুলের বিনুনি গুলো।মেয়েটার দৌড়ের সাথে বিনুনি গুলো খুব সুন্দর করে দুলছিল।এত ছোট মেয়ের এত লম্বা চুল আর কিউট বিনুনি দেখে প্রিয়ম হেসে দেয়।মেয়েটা গুটি গুটি পায়ে তার সামনে এসে দাঁড়ায়। মুখে আঙুল পুরে বলে,

“এই শোনো আমার বলটা দেখেছো?”

প্রিয়ম প্রথমে হ্যাঁ বলতে গিয়ে আবার থেমে যায়। সে মাথা নেড়ে না জানায়।মেয়েটা এপাশ ওপাশ খুঁজতে থাকে। বেশ কিছু সময় ওর সে জিজ্ঞেস করে,

“একটু খুঁজে দাও না বলটা,আমাদের খেলার সময় চলে যাচ্ছে তো?”

প্রিয়ম হেসে তার হাত থেকে বলটা দেয় আর সেটা দেখেই গাল ফুলিয়ে ফেলে মেয়েটি।

“তুমি মিথ্যা বললে কেনো?”

“কোথায় মিথ্যা বললাম?”

“এই যে তুমি বলটা দেখো নি?”

“আসলে তোমার সাথে মজা করছিলাম তাই এমন করেছি। এই নাও তোমার বল।তবে বল নেওয়ার আগে তোমার নাম বলতে হবে,কি বলবে?”

ছোট মেয়েটা মুখে বুড়ো আঙুল দিয়ে কিছু সময় ভাবে তারপর সে তার নাম জানায়।তখনি প্রশ্ন করে তন্নি,

“কি নাম ছিল মেয়েটার?”

প্রিয়ম তন্নির দিকে তাকিয়ে বলে,

“তন্নি! ”

তন্নি নামটা শুনেই চমকে যায় তন্নি। স্তব্ধ হয়ে চেয়ে থাকে। প্রিয়ম হাসে, সে আবারও বলতে থাকে।

“এভাবে মেয়েটার সাথে প্রথম কথা হয়।প্রতিদিন আমি অপেক্ষা করতাম কখন টিফিন সময় আসবে আর মেয়েটা আমার সাথে গল্প করবে।আগেই বলেছি আমার ভালো কোনো বন্ধু ছিল না তাই একা থাকতাম।ছোট মেয়েটার কথা গুলো এতটা আদুরে ছিল যে ওর সাথে কথা বলে আমি বেশ মজা পেতাম।বেশি ভালো লাগতো তার বিনুনি গুলো। সে যখন মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে কথা বলতো তখনি আমি তার বিনুনি গুলো টেনে দিতাম।এতে সে বিরক্ত হতো ঠিকই কিন্তু তবুও রাগ করতো না।মাঝে মধ্যে আমাকে ধমকাত।প্রথমে আমাকে সে ভাইয়া ডাকতো কিন্তু আমি ওকে সেটা নিষেধ করি।বলেছি আমার নাম ধরে ডাকতে।স্কুল যাওয়ার সময় ওর জন্য চকলেট চিপস বিভিন্ন খাবার নিয়ে যেতাম।আস্তে আস্তে আমাদের সম্পর্কটা খুব গাঢ় হয়।মনেই হতো না যে আমি একটা বাচ্চা মেয়ের সাথে বন্ধুত্ব করেছি।কীভাবে জানি ও আমার সব সমস্যা বুঝে নিতো।বাচ্চা হলেও প্রচুর পাকা পাকা কথা বলতো তাই সম্পর্কটা তাড়াতাড়ি গড়ে উঠেছিল।একদিন হঠাৎ আমার বাবা মা সিদ্ধান্ত নেন তারা আমাকে নিয়ে বিদেশ যাবেন।এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণ হচ্ছে দেশের ব্যবসায় তারা সন্তুষ্ট নয় তাই এখানের সবকিছু বিক্রি করে তারা বিদেশে সেটেলে হবে।আর দেশে যেহেতু আর কেউ নেই তাই তারা আমাকেও সঙ্গে নিয়ে যাবে।আমি বেঁকে বসলাম কারণ আমি সবসময় একা ছিলাম।যেই দাদু আমার বন্ধু ছিলো সেও মারা গেছে। এতদিন পর আমি একটা বন্ধু পেলাম তাকেও ছাড়তে হবে ভেবে কান্নায় আমি বুক ভাসালাম কিন্তু বাচ্চা ছিলাম তাই বাধ্য হয়ে বাবা মা আমাকে তাদের সাথে নিয়ে গেলো।এরপর অনেক গুলো বছর কেটে গেলো।আমি নিজের পড়াশোনা শেষ করে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম বিজনেস কাজে।তারপর শুরু হলো আমার জীবনের আরেক অধ্যায়। ”

তন্নি জিজ্ঞেস করে কি সেই অধ্যায়। প্রিয়ম আবারও বলা শুরু করে।

“প্রায়ইশ আমি একটা স্বপ্ন দেখা শুরু করলাম।প্রথম প্রথম স্বপ্নটা ছোট থাকলেও দিন দিন সেটা দীর্ঘ হয়।আমার পুরো স্বপ্ন জুড়ে ছিল একটাই মেয়ে আর সেই মেয়ের সাথে আমার প্রতিদিন নতুন নতুন কথোপকথন হতো।মজার বিষয় কি জানো মেয়েটা ছিল একদম পিচ্চি আর আমি মানে আমি এই বয়সেই সেই মেয়ের সাথে বন্ধুত্ব করলাম।অবাক লাগতো যখন দেখতাম তার কথায় আমি মজা পাচ্ছি। এত সুন্দর সুন্দর ঘটনা ঘটতো মনে হচ্ছে আমি বাস্তবে ফিল করছি অথচ চোখ খোলার পর বুঝতাম সবই স্বপ্ন। স্বাভাবিক ভাবে নিলাম কিন্তু এটা আমার জন্য সমস্যা হয়ে দাঁড়ালো।এভাবে দিন দিন আমার স্বপ্নটা বাস্তবভাবে কাজ করতে লাগলো।যতক্ষণ ঘুমাতাম মনে হতো আমি বাস্তবে আছি কিন্তু চোখ খুললেই সব ভ্যানিশ।আমার নিজেকে হঠাৎ মানসিক রোগী মনে হলো। এরজন্য আমি একজন সাইক্রিয়াটিস্টের শরণাপন্ন হয়।তিনি আমার কাছ থেকে সব তথ্য জেনে নেন।এরপর জিজ্ঞেস করেন আমার সমস্যা। সবটা শুনে তিনি জানান যে আমার ছোট বেলার গড়ে উঠা একাকিত্বে যার সঙ্গ পেয়ে আমি কিছু সময়ের জন্য সুখি হয়েছিলাম এতবছর পর আবারও তার সখ্যতা পাওয়ার জন্য আমার অবচেতন মন তাকে কল্পনা করছে।শুধু তাই নয় আমার মনের মধ্যে আমার অজান্তে সেই পিচ্চি মেয়েটা একটা জায়গা দখল করে নিয়েছিল যেটা এতবছর পর ভালোবাসায় রূপ নিয়েছে। আর তাই তাকে বারবার স্বপ্নে দেখছি।তারপর বাসায় এসে আমি দেশ থেকে নিয়ে যাওয়া আমার সব জিনিস বের করি।যদি সেখানে কোনো ক্লু থাকে।ঠিক তখনই আমি একটা ছবি পাই যেটা এতবছর আমার বাক্সের আড়ালে লুকিয়ে ছিল। তখনি আমি তাজ্জব বনে যায় কারণ আমার স্বপ্নের মেয়েটাই সেই ছবিতে ছিল।অবিকল সেই হাসি আর সেই বিনুনি।তখন মনে পড়ে আমি দেশ ছাড়ার আগে আমার ক্যামেরা নিয়ে ওর স্মৃতি হিসেবে একটা ছবি তুলেছিলাম যেটা এতকাল আমার বাক্সে পড়েছিল অথচ আমি জানতাম না।আর তাকেই খুজতে আমি দেশে আসি।আমি আমার সেই স্কুলে যায় যেখানে তার সাথে পরিচয়। সেখান থেকে তার ঠিকানা কালেক্ট করি আর সেই ঠিকানায় জানা যায় বর্তমানে সে ভার্সিটি স্টুডেন্ট। ”

“তাকে কি পেয়েছেন? আর আমাকেই বা বিয়ে করার কারণ কি?”

প্রিয়ম চেয়ে থাকে তন্নির দিকে।কি মনে করে হঠাৎ প্রিয়মের চোখ টলমল করে উঠে। সে কিছু না বলে তন্নির কোলে মাথা রাখে।প্রিয়মের এহেন কান্ডে তন্নি সংকুচিত হয়ে যায়।

“তন্নি আমার খুব ক্লান্ত লাগছে আমি তোমার কোলে মাথা রেখে একটু ঘুমায়?”

প্রিয়মের আবদারটা এমনি ছিল যে তন্নি না বলতে পারে নি।হঠাৎ মাতৃ মমতা কাজ করে তার মধ্যে। প্রিয়মের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে নিজেই ভাবতে থাকে, এত সবকিছুর মধ্যে তার সাথে এসব ঘটনার সূত্র কি,আর সেই মেয়ের খোঁজ কি তবে প্রিয়ম পায় নি নাকি সেইদিনের শোধ নিতে শুধু মাত্র আমাকে বিয়ে করলো?
,
,
,
চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here