বকুল, পর্ব:১৬

0
1800

#বকুল
#লেখনীতে_আফসানা_মিমি

||১৬||

বর্ষার শেষ সময় । আশেপাশে টিনের চালে টুপ টুপ বৃষ্টি পড়ার আওয়াজ আসছে । মনে হচ্ছে শহরের সেই উঁচু দালান থেকে বহু ক্রুশ দূরে আছি । মাথার অসম্ভব যন্ত্রণায় ভুগছি । অন্ধকারে কোন এক পুরনো কক্ষে অবস্থান করছি যা বুঝতে পারলাম । অন্ধকারে হাতরে হাতরে আলো জ্বালানোর সুইচ খুঁজতে লাগলাম কিন্তু আফসোস পেলাম না । মাথার যন্ত্রণায় আর পেটের ক্ষুধায় ছটফট করছি। সকাল না বিকাল তা দেখারও কোন উপায় নেই। বাসার সবার কথা চিন্তা করছি । আগেই বুঝতে পেরেছিলাম বিপদ সন্নিকটে কিন্তু এমন বিপদ আসবে তা বুঝিনি। আচ্ছা সানিম ভাইয়া কি আমার দেয়া চিঠি পেয়েছে নাকি পাইনি ? চিন্তায় আর ভালো লাগছেনা ।

আরো কিছু সময় অতিবাহিত হবার পর হঠাৎ কেউ দরজা খুলে প্রবেশ করে । সামনে তাকিয়ে দেখি আকীবা মা নাঈমা দিশা আর রাহাত । যা ধারণা করেছিলাম তাই হলো । সেই প্রথম দিন থেকেই এদের উপর আমার নজর ছিল। রাহাতকে তো সেদিনই সন্দেহ হয়েছে যেদিন সে আমাদের বাড়ি পা দিয়েছে । ঘরের এক কোণে বসে আছি ঠিক তখনই আকীবা মা এসে চুলের মুঠি ধরে বলতে শুরু করলেন ,

‘ কী জমিদারের ঝি , কেমন দিলাম ? সারাজীবন আমার খাইয়া পইরা এহন বড়লোকের ঘরে বউ হইয়া আরাম আয়েশ করবি তা তো সইবে না এই আকীবা । তুই জানোস এই বড়লোক বাড়িতে আমার মাইয়াডারে বিয়া দিমু দেইখা কাউরে না জানাইয়া ভোর সকালে চইলা আসছিলাম । এমনকি ঐ মাস্টারনিরে রাজিও করাইছিলাম কিন্তু কি হইলো ! শেষে কি না তুই আইলি এই বাড়ির বউ হয়ে ? ‘

আকীবা মায়ের কথায় চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে । উনি কারাপ তা জানতাম কিন্তু এত খারাপ ভাবিনি কখনও । আমার চুলের মুঠি ছেড়ে নাঈমাকে জড়িয়ে ধরে আবার বলতে শুরু করলেন ,

‘ আমার মাইয়াডা সানিম বাবাজির জন্য পাগল । সানিমের বউ হইবো হেই আশায় অপেক্ষা করছিল। কি না করছি তোরে সানিমের জীবন থেইকা সরাইতে । হৃদয়পুরে মানুষ ভাড়া করছি যেন তুই লোকমুখে কলঙ্কিত হোস সেই জন্য কিন্তু পারলাম না ঐ সানিমের জন্য । সেদিন পার্কে যাওয়া তো শুধুমাত্র বাহানা ছিল আসল উদ্দেশ্য ছিলো তো তোকে সরিয়ে ফেলা । ট্রাক দিয়ে তোকে পিষে মারার জন্য ঠিক করেছি সবকিছু আমার প্ল্যান মোতাবেক হচ্ছিল কিন্তু কোথা থেকে তোর মুখপুড়ি মা এসে সরিয়ে নিয়ে গেল । তারপর কথা হয় আমার রাহাতের সাথে । রাহাত আমাকে দেখে ফেলেছিল ঐ ট্রাকের ড্রাইভারের সাথে কথা বলতে প্রথমে তো ভয় পাইছিলাম ভাবছিলাম স্মৃতিশক্তি হারিয়ে গেছে তাই তোদের সব বলে দিবে কিন্তু পরে দেখি না বেটা তো আমাদের দলে হা হা হা। ‘

এতটুকে বলে আকীবা মা আবার এসে আমাকে এক থাপ্পড় দিলেন । পাশ থেকে দিশা নামক মেয়েটা কাছে এসে বলতে শুরু করল ,

‘ তোমার সাথে আমায কোন শত্রুতা নেই এমনকি সানিমের সাথেও না । কিন্তু তোমার শ্বাশুড়ির উপর ক্ষুব্ধ অমি । সানিমকে কলেজ লাইফ থেকে পছন্দ করতাম কিন্তু সানিমের দেমাগ বেশি ছিল তার কথা ছিল মা বাবা পছন্দেই তার পছন্দ তাই সরাসরি সানিমের মার কাছে চলে গিয়েছিলাম পার্মানেন্ট সানিম যেন আমার হয় তা বলতে কিন্তু কি করল বা** মহিলা ! থ্রেট দিয়ে আমাকে বের করে দিল । এরপর থেকে তোমাকে বিয়ে করল সানিম। চোখের সামনে তোমার প্রতি তাদের আদিক্ষ্যেতা দেখে সহ্য হচ্ছিল না তাই রাহাতের সাথে হাত মিলালাম আর সানিমের বাড়িতে প্রবেশ করলাম নাটকীয়ভাবে ।’

‘ উফ জানেমান এবার থামোতো ? আমাকে কিছু বলার সুযোগ দাও । আসল কাজ তো করেছি আমি হা হা হা । ‘

রাহাত আমার কাছে এসে দুই গাল চেপে বলতে শুরু করলেন ,

‘ কি সুন্দরী, আজ কি হবে তোমার । কে আসবে আজ তোমাকে বাঁচাতে ? তুমি জানে তোমার জন্য একমাত্র তোমার জন্য আজ আমার এই অবস্থা । জেলখানার এক একটা দিন যে কেমন কেটেছে তা আমিই জানি । স্মৃতি শক্তি হারিয়ে ফেলার নাটক করতে হয়েছে আমার তবুও ছাড়া পাইনি তোমার ঐ বরের জন্য । তারপর আসে আমার জানেমান আমাকে বাঁচাতে । জেলখানা থেকে ফিরে চেয়েছিলাম সানিমকে একেবারে মেরে ফেলতে কিন্তু পরক্ষণে ভাবলাম একেবারে মেরে ফেলার চেয়ে আস্তে আস্তে মারা আনন্দের । তাইতো সেদিন জন্মদিনের পার্টিতে ড্রিংকের সাথে হাই ডোজের ড্রাক্স দিয়েছিলাম কিন্তু শালার কিছুই হলোনা । তারপর সানিমের বাড়িতে ঢোকার পরিকল্পনা করলাম আর তার সাহায্য করল আমার জানেমান দিশা । অনেক চিন্তা ভাবনা করলাম কিভাবে ক্ষতি করা যায় তাপরনে হলো সানিমের সবচেয়ে আপনজন মানুষের ক্ষতি করলে তিলে তিলে ও শেষ হয়ে যাবে । সানিমের আপনজন কে তা দেখার কয়েকদিনে যা বুঝলাম সানিম তোমাকে সেই আগে থেকেই ভালোবাসে কিন্তু তুমি জানোনা । তাই সঠিক সময়ের অপেক্ষায় ছিলাম । দেখো , আমি সফল হয়েছি সানিম এখন তিলে তিলে শেষ হবে হা হা হা । ‘
বলে অট্টহাসিতে হাসতে শুরু করলেন । রাহাত কিছুটা ঝুঁকে পড়ে আমার কানে আবার বলতে শুরু করল ,

‘ আমি কিন্তু সেনিনের অপূর্ণ কাজ আজ পূর্ণ করবো । তুমি আজ চিল্লিয়েও কাউকে পাবেনা সাহায্য করার জন্য ।’

এদের একেকজনের মারাত্নক পরিকল্পনা দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি । এত নোংরা মস্তিষ্ক নিয়ে এরা চলে ছিহ্ । একটা বিষয় খুব ভালো লাগছে যে আমার বরটা আমাকেই ভালোবাসে তাও অনেক আগে থেকেই । মনে মনে আল্লাহ্ কে স্বরণ করছি তখনই নাঈমা বলে উঠে ,

‘ তুই এখনই সানিমকে ডিভোর্স দিবি । তোর সাথে ডিভোর্স হলে সানিমকে আমি বিয়ে করবো ।’
‘ তোর কি মনে হয় আমার কিছু হলে সানিম তোকে বিয়ে করবে ? কখনোই না । সানিম শুধু আমাকেই ভালোবাসে । আমার জন্য যদি এই রাহাতের এই অবস্থা করতে পারে তাহলে বুঝে নে তোর সাথে কি করবে । ‘
আমার কথা শুনে নাঈমা এসে সজোরে আরেকটা থাপ্পড় মেরে দিলো । ঠোঁটের চারপাশে তরল কিছু অনুভব হওয়ায় হাত দিয়ে দেখি ঠোঁট কেটে রক্ত বের হচ্ছে । অসহায় হয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে আছি । মার কথা খুব মনে পড়ছে । এতদিন পর মা আমাকে পেয়ে তার সব কষ্ট ভুলে গিয়েছিল কিন্তু এখন হয়তো মরেই যাচ্ছে আমাকে না পেয়ে । আকীবা মায়ের কথা শুনে টনক নড়ে আমার ,

‘ কিরে মা** ঝি ডিভোর্স পেপারে সই কর ।’

তাকিয়ে দেখি চোখের সামনে একটা কাগজ ধরে রেখেছেন । আমি কোনক্রমে সই করবোনা এই ভেবে হাত গুটিয়ে নিলাম । সবাই মিলে জোরাজুরি করতে আসলেই দরজা খোলার আওয়াজে চমকে উঠে ।

সানিম ভাইয়া দাঁড়িয়ে আছেন । আর তার সাথে উদয় রাফি ভাইয়া । শয়তানগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখি ভয়ে একেকজনের রুপ একেক আকার ধারন করছে । ভীতু কন্ঠস্বরে রাহাত বলে উঠলো ,

‘ সানিম , তুই এখানে ?’

মুহূর্তেই সানিম ভাইয়া গর্জে উঠলো ,

‘ তোর সাহস তো কম না রাহাত , আমার বউয়ের দিকে চোখ তুলে তাকাস । একবার মাইর খেয়ে শিক্ষা হয়নি তাই না ! আমার তো তোকে সেদিনই মেরে ফেলা উচিত ছিলো । দাঁড়া আজ তোকে আমি মেরেই ফেলবো । ‘ বলেই একনাগাড়ে মারতে শুরু করেন তাঁরা তিনজন মিলে । এদিকে আকীবা মা , নাঈমা আর দিশা পালাতে চেষ্টা করলেই পুলিশ এসে এদের ধরে নেয় । পুলিশের সাথে আমার পরিবারের সকলে হাজির হলেন । পালিত বাবা আকীবা মা ও নাঈমাকে পর পর কয়েকটা থাপ্পড় মেরে বলে উঠলেন ,

‘ আকীবা, মানুষ খারাপ হয় কিন্তু তোমার মত খারাপ আমি এই প্রথম দেখলাম । কিভাবে পারলে ফুলের মত একটা মেয়েকে এভাবে আঘাত করতে? তারপর কিডন্যাপ করতে । একটুও কি বিবেকে বাধেনি ? আরে , মানুষতো কুকুরের উপরও রেহেম করে যেখানে এই মেয়েটি সারাজীবন কাজ করে গেছে আর তোমার করা অত্যাচার মুখ বুজে সহ্য করে নিয়েছে । তোমাকে কখনও ক্ষমা করবোনা । আর তুই (নাঈমাকে উদ্দেশ্য করে ) কেমন বোন রে যে কিনা বোনের বরকে বিয়ে করতে বোনের ক্ষতি করতেও বুক কাঁপলো না ? আজ থেকে তুই আমার কেউ না । আমার একটা মাত্র মেয়ে আর সে হলো বকুল । অফিসার এদের নিয়ে যান আর দেখবেন কোন ক্রমেই যেন এরা বের হতে না পারে ।’

এদিকে সানিম , রাফি , উদয় ভাইয়ারা রাহাতকে মারতে মারতে রক্তাক্ত করে ফেলছে তবুও থামার নাম নেই অবশেষে দুজন পুলিশ এসে তিনজনকে ছাড়িয়ে রাহাতকে নিয়ে চলে যায় । পুলিশ রাহাতকে নিয়ে যাওয়ার পর সানিম ভাইয়া দৌড়ে এসে আমাকে শক্ত করে জরিয়ে ধরেন আর অনবরত কান্না করতেকরতে বলতে শুরু করলেন ,
‘ বকুলফুল , কষ্ট হচ্ছে তোমার ? দেখো আমি চলে এসেছি তোমার স্বামী আর কোন কষ্ট পেতে দেবোনা আর কখনও একা ছাড়বোনা ।আমার একটি করা ভুলের জন্য তোমার এত কষ্ট হচ্ছে । আ’ম সরি বকুলফুল । ক্ষমা করে দাও আমায় । ‘

আর কিছু শুনতে পারলাম না মাথায় জোরে আঘাত করায় আর এতক্ষণের প্রেশারে জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম ।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here