#হৃদয়ে_মেঘগলি
|০৬|
লাবিবা ওয়াহিদ
বেশ কিছুদিন পেরিয়ে গেলো। আনোশী যতটা সম্ভব পারছে শেহরিমের থেকে ততটা দূরে থাকছে। স্কুলে দেখলেও সে অফিসরুমে চলে যায় অথবা শেহরিমের দৃষ্টির বাইরে। শেহরিমকে কিছু না বলে বেশ ধৈর্যের পরীক্ষা দিচ্ছে আনোশী।
আজ বাসায় আসতেই মামী চোখে-মুখে চিকচিক ভাব ফুটিয়ে বললো,
–“তৈরি হয়ে নে আনোশী। শেহরিম তোকে ঘুরতে নিয়ে যাবে।”
–“আমার হাত-পা আছে এবং পকেটে টাকাও আছে। আমাকে কারো ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার দরকার নেই।”
মামী এবার রেগে গেলো। কাঠ কাঠ গলায় বললো,
–“টাকা কামাস দেখে খুব দেমাগ না তোর?”
–“না, এটা আমার অহংকার। যে আমি আত্মনির্ভরশীল!”
মামী আনোশীর হাত ধরে বললো,
–“কথা বাড়াস না। চুপচাপ তৈরি হয়ে নে। আমার এত অশান্তি আর ভালো লাগছে না!”
আনোশী মামীর চোখে চোখ রেখে শীতল গলায় বললো,
–“নিজে ঘরে অশান্তি বয়ে আনলে এমন হবেই। তোমার মানসিকতা দেখে অবাক হচ্ছি মামী, কী করে পারছো এসব বাজে চিন্তা-ভাবনা করতে? কেউ কী করে তাঁর বোন জামাই কে বিয়ে করতে পারে?”
–“সবাই পারে শুধু তুই ঢং দেখাচ্ছিস!”
আনোশী নজর ঘুরিয়ে বেশ কাঠ কাঠ গলায় বললো,
–“হাত ছাড়ো!”
–“তৈরি না হলে ছাড়বো না।”
মামীর থেকে ছাড়া পেতে আনোশী বললো,
–“ঠিকাছে ছাড়ো!”
মামী খুশি হয়ে আনোশীর হাত ছাড়তেই আনোশী যেই পথে বাসায় এসেছিলো সেই পথেই আবার বেরিয়ে গেলো। মামী চেঁচিয়ে কতবার পিছু ডাক দিলো কিন্তু আনোশী শুনলে তো? কিছু সময়ের মাঝেই আনোশী মামীর ধরা-ছোয়ার বাইরে চলে গেলো।
তিশুতি কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আনোশী এবং মামীর কান্ড দেখে মজা নিচ্ছে। তাশুতি মামীর নজরে এলে তাশুতিকে কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটার মতো লাগলো। কপট রেগে মামী বললো,
–“এই তোর শ্বশুরবাড়ির লোকে তোকে কিছু বলে না? বেহায়ার মতো আমার বাড়িতে পরে আছিস কেন?”
তাশুতি হেসে বলে,
–“এটা তোমার বাড়ি হলো কী করে? এই ফ্ল্যাটের ভাড়া আমার মামা ইনকাম করে দেয়। তুমি দাও নাকি?”
মামীর নিজের মাথার চুল নিজের ছিঁড়তে ইচ্ছা করলো। দুই মেয়ে এত বে*দব এবং অবাধ্য হয়েছে, বড়োদের কথার কোনো গুরুত্ব-ই দেয় না। একেবারে যাচ্ছে-তাই।
—————–
আনোশীর জন্যে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে নিরাশ হয়ে বাড়ী ফিরলো শেহরিম। এশার আযান ততক্ষণে দিয়ে দিয়েছে। বাড়ী ফিরতেই লিভিংরুমে বসা অবস্থায় দেখতে পায় নিজের বাবাকে। শেহরিম ভারী অবাক হলো তাঁর বাবাকে দেখে। শেহরিমের বাবা চিকিৎসার জন্যে ইন্ডিয়ায় গিয়েছিলো। শেহরিম যতটা জানে, তার বাবার আরও সপ্তাহখানেক পর দেশে আসার কথা ছিলো। কিন্তু হুট করে এত তাড়াতাড়ি ফিরলো কেন বুঝতে পারলো না।
শেহরিম আরও কিছুটা এগিয়ে গেলো বাবার দিকে। শেহরিমের বাবা বেশ সিরিয়াস ভঙ্গিতে বসে আছে। মুখ-ভঙ্গি ভীষণ গম্ভীর। শেহরিম শুকনো হাসি দিয়ে বাবার উদ্দেশ্যে সালাম দিলো। শেহরিমের বাবা শেহরিমের দিকে তাকালো ঠিক-ই কিন্তু সালামের উত্তর দিলো না। শেহরিম বাবার সামনে বসতে বসতে বললো,
–“এত তাড়াতাড়ি চলে আসলে যে বাবা?”
শেহরিমের বাবা সাথে সাথে শাসনের সুরে বললো,
–“খবরদার বসবে না। দাঁড়িয়ে থাকো!”
শেহরিম সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ায়, বাবার ধমক শুনে। শেহরিমের বাবা এবার বলতে শুরু করলেন,
–“তুমি মনে হচ্ছে আমার মান-সম্মান ডুবানোর আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছো?”
শেহরিম থতমত খেয়ে চাইলো বাবার দিকে। শেহরিমের মা কিছুটা দাঁড়িয়ে সবটা দেখছে। শেহরিম বললো,
–“তোমার কথা ঠিক বুঝতে পারিনি বাবা!”
–“বুঝতে পারছো না নাকি বোঝার চেষ্টা করছো না? আমাকে তো মনে হচ্ছে বাপ মনে করো না। নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে শিখে গেছো। আর কারোই প্রয়োজন নেই তাই না?”
শেহরিম এবার বুঝতে পারলো বাবার কথা। শেহরিম নজর নামিয়ে মৃদু স্বরে বললো,
–“ভেবেছিলাম তুমি আসলে-ই সব জানাবো বাবা। ইন্ডিয়ায় ছিলে চিকিৎসার জন্যে, আলাদা করে চিন্তায় ফেলতে চাইনি!”
–“হ্যাঁ। উদ্ধার করে দিয়েছো একদম।”
থামলো শেহরিমের বাবা। অতঃপর আবার বলতে শুরু করলো,
–“আগের বারের কথা ভুলে গেছো? ঠিক কী হয়েছিলো তোমার সাথে? তাও জেনে-বুঝে কেন নিজের পায়ে কুড়াল মা*তে চাইছো? শেষমেষ প্রাক্তন স্ত্রীর বোন? হাস্যকর!”
শেহরিম কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
–“যখন পছন্দ করেছি তখন জানতাম না আনোশী তিশুতির বোন ছিলো। আর তিশুতির চেয়ে আনোশী ব্যতিক্রম!”
–“লজ্জা হওয়া উচিত তোমার শেহরিম। কোন মুখে তুমি আমার সামনে সেই মেয়ের গুণগাণ গাইছো? তোমার এই উন্নতি দেখে আমি আশ্চর্য হচ্ছি।”
থেমে আবার বলতে লাগলো,
–“আর যাই হোক, আমি বেঁচে থাকতে এই বিয়ে কিছুতেই সম্ভব না। তাই তোমার এই সাময়িক মোহ থেকে বের হও। এতেই তোমার মঙ্গল।”
শেহরিমের মাথার উপর যেন বাজ পরলো। বুকের বা পাশটাও কেমন চিনচিন করে উঠলো তাঁর। কম্পিত কন্ঠে বললো,
–“কিন্তু বাবা…”
–“শুনতে পাওনি আমার কথা? তোমার বিয়ে আমার বন্ধুর মেয়ের সাথে হবে। আমার সিদ্ধান্তে আমি অটল থাকবো। এখন তোমার কাছে যদি তোমার বাবা, মা, পরিবারের মূল্যহীন মনে হয় তাহলে তুমি নির্দ্বিধায় বিয়ে করতে পারো, আমি বা আমার পরিবার তোমাকে বাঁধা দিবো না।”
বলেই শেহরিমের বাবা গায়ের কটিটা ঠিক করতে করতে উঠে দাঁড়ায়। শেহরিম সেই স্থানেই মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকে। শেহরিমের দিকে একপলক চেয়ে স্ত্রীকে ডেকে ভেতরে চলে যান তিনি। শেহরিমের মাও ছেলের দিকে করুণ নজরে চেয়ে স্বামীর পিছু পিছু চলে গেলো। শেহরিমের থেকে কিছুটা দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছে রাইমা এবং শাহেদ। শাহেদ ভাইয়ের কাছে যেতে চাইলো কিন্তু রাইমা বাঁধা দিয়ে মৃদু স্বরে বলল,
–“বলেছিলাম না আল্লাহ্ যা করবে ভালোর জন্য-ই করবে? একা থাকতে দাও ওকে। আমি কাল-ই তাদের কল করে জানিয়ে দিবো যে বিয়ে হবে না।”
শাহেদ কপালে ভাঁজ ফেলে বললো,
–“কিন্তু বাবাকে বিয়ের কথা জানালো কে?”
রাইমা দ্বিধাহীন গলায় বললো,
–“আমি জানিয়েছি বাবাকে। মন বলছিলো এই সমস্যার সমাধান একমাত্র বাবাই দিতে পারবে।”
শাহেদ রাইমার দিকে চাইলো। রাইমা আশ্বাস দিয়ে বললো,
–“এত ভেবো না। যা হয় ভালোর জন্য-ই হয়।”
———————–
আনোশী রাতে মামার রুমে প্রবেশ করলো। মামী আনোশীর নামে অভিযোগ করতে করতে মামার কান ভারী করে ছেড়েছে। মামা মাথায় হাত দিয়ে নীরবে শুনছে সব। মামা আনোশীকে দেখে বললো,
–“দাঁড়িয়ে কেন? বসো!”
আনোশী মামীর দিকে আড় চোখে চেয়ে বললো,
–“না মামা। তুমি বলো। আমার খাতা দেখতে হবে।”
মামা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
–“তুমি নাকি তোমার মামীর অবাধ্য হয়েছো?”
আনোশী মামীর দিকে চেয়ে বললো,
–“আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে সিদ্ধান্ত হলে তার জন্যে অবাধ্য তো হতেই হয় মামা। যদি মামী কষ্ট পেয়ে থাকে তাহলে স্যরি মামী। স্যরিতেও কাজ না হলে আগামী মাসে শাড়ী উপহার দিবো নে মামীকে!”
আনোশীর কথায় মামা চাপা হাসি দিলো। “শাড়ী”-র কথা শুনে মামী গলে গেলেও প্রকাশ করলো না। বরং আগের মতোই মুখ ভার করে বলল,
–“জু* মে* গরু দান করা হচ্ছে?”
আনোশী আর কিছু বললো না। মামা বললো,
–“ঠিকাছে তাই হোক। তবে শেহরিমের সাথে যাওয়াটা দরকার ছিলো। ছেলেটা রাত অবধি অপেক্ষা করছিলো তোমার!”
আনোশী মৃদু স্বরে আওড়ায়,
–“আমি বলিনি অপেক্ষা করতে। যেখানে বিয়েটাই হবে না, সেখানে তার সাথে ঘুরতে যাবো কোন দুঃখে? আসছি মামা।”
আনোশী পিছে ঘুরে চলে যেতে নিলে মামা পিছুডাক দিয়ে বলে,
–“আরেকবার ভেবে দেখ।”
আনোশী থেমে গিয়ে বেশ শক্ত গলায় বললো,
–“মামা, যদি এভাবেই আমাকে জোর করো তাহলে এখান থেকে চলে যেতে বাধ্য হবো। বিয়ে ছেলে-খেলা নয় যে জোর করলেই মেনে নিবো। একটা বিয়ের মাঝে অনেক ব্যাপার আছে যা জোর-জবরদস্তির মধ্যে বিলীন হোক, তা আমি চাই না!”
আনোশী হনহনিয়ে রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেলো।
রাতে তিশুতি তাঁর মেয়েকে নিয়ে আনোশীর রুমে শুলো। তিশুতি নানান কথা বললেও আনোশী তিশুতির কোনো কথা শুনলো না। সে কানে হেডফোন লাগিয়ে নীলের সাথে কথা বললো কিছুক্ষণ। যা তিশুতি টের পেলেও কিছু বললো না। বরং খুশি হলো এই ভেবে আনোশী কাউকে পছন্দ করে। শেহরিমকে এই কথা জানিয়ে ভীষণ পৈশাচিক আনন্দ পাবে সে।
হঠাৎ আনোশী শোয়া থেকে উঠে বসতেই তিশুতি বললো,
–“উঠলি কেন?”
–“ঘুমাও তুমি। আমি বারান্দায় যাচ্ছি!”
–“বাহ্। কী এমন প্রাইভেট কথোপকথন যা আমার সামনে বলা যাবে না? সম্পর্কে জড়িয়েছিস বললি না তো আমায়!”
–“তুমি যা ভাবছো তাঁর কিছুই না। আমি কোনো সম্পর্কে জড়াইনি!”
–“সেটা তোর লাজুক মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। কিছু লুকানোর নেই। আমরা আমরা-ই তো!”
আনোশী কিছুটা হতভম্ভ হলো তিশুতির কথা শুনে। সে লজ্জা পেলো কই? যা সত্যি তাই তো বললো। গালে, কপালে হাত দিতে দিতে বারান্দায় চলে গেলো আনোশী। লাজুক চেহারা আবার কী রকম সেটাই বুঝলো না সে। তাশুতি এই ফাঁকে শেহরিমকে কল করলো। শেহরিম রিসিভ করতেই তাশুতি পৈশাচিক হাসি দিয়ে বলে,
–“ঘুমোচ্ছিলে বুঝি? এদিকের খবর জানো? আমার বোন প্রেম করছে। সে তোমাকে ফেলে অন্য ছেলেকে পছন্দ করেছে। এর মানে এটাই দাঁড়ায় তুমি ওর যোগ্য নও।”
শেহরিম তিশুতির আবোল-তাবোল কথাবার্তায় গুরুত্ব না দিয়ে বললো,
–“তোমার বোন পছন্দ না করলেও এককালে তুমি আমি বলতেই পাগল ছিলে। তাই এসব কথাবার্তা ছেড়ে নিজে ঘুমাও, আমাকেও ঘুমাতে দাও।”
–“আগে বোকা ছিলাম, এজন্যেই অসুখে ভুগিয়েছিলে। আমি এখন শান্তি পাচ্ছি এই ভেবে যে তুমি নামক অসুখে আমার বোন ভুগছে না!”
শেহরিম এবার অনেক বিরক্ত হলো। অধৈর্য কন্ঠে বললো,
–“কল রাখো তো তুমি। বিবাহিত মহিলা হয়ে আমাকে রাত-বিরেতে কল দিচ্ছ! শরম-লজ্জার দিকে খেয়াল করো। বাই!”
বলেই খট করে কল কেটে দিলো শেহরিম। বিরক্তিরও সীমা পার করে ফেলেছে এই তাশুতি। তাশুতি এদিকে ফোনের দিকে তাকিয়ে একা একাই হাসছে।
আনোশী বারান্দায় আসলে ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে নীল বলে ওঠে,
–“কী বলছিলো তোমার আপু?”
আনোশী ভ্রু কুচকে বললো,
–“আমি নাকি সম্পর্কে জড়িয়েছি। লজ্জাও পাচ্ছি। আজব কথাবার্তা!”
নীল হাসতে হাসতে বললো,
–“সত্যি লজ্জা পাচ্ছো?”
–“লজ্জার কী আছে বুঝলাম না? আপনি আমার বন্ধুর মতো। কথা বলাই যায়!”
–“রাত-বিরেতে এত কথা কী আদৌ বন্ধুর সাথে হয় আনোশী? তোমার কখনো অস্বাভাবিক লাগেনি?”
আনোশী কিছু বললো না। নীল উত্তর না পেয়ে নিরাশ হলো না। বরং অন্য প্রসঙ্গে কথা বলতে শুরু করলো।
~[ক্রমশ]
বিঃদ্রঃ ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। গঠনমূলক মন্তব্যের প্রত্যাশায় রইলাম।