হৃদয়ে মেঘগলি পর্ব ৫

0
637

#হৃদয়ে_মেঘগলি
|০৫|
লাবিবা ওয়াহিদ

মামা লিভিংরুমে বসে মনোযোগ সহকারে টিভি দেখতে ব্যস্ত। আচমকা হাতে এক কাপ চা নিয়ে লিভিংরুমে প্রবেশ করলো আনোশী। মামা ঘাড় বাঁকিয়ে চাইলো ভাগনির দিকে। আনোশী মামার দিকে চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে আলতো স্বরে বলে,
–“তোমার জন্যে চা মামা।”

মামা নির্বিকার ভঙ্গিতে ভাগনির দিকে চেয়ে চায়ের কাপটা হাতে তুলে নিলো। আনোশীকে হঠাৎ চা বানাতে দেখে মামীও আনোশীর পেছন পেছন এসেছিলো ঘটনা পর্যবেক্ষণ করতে। লিভিংরুমের দরজা পর্যন্ত-ই এসেছে। ভেতরে প্রবেশ করাটা ঠিক মনে করলো না সে।

আনোশী নীরবে সোফায় গিয়ে বসলো। মামা চায়ে চুমুক দিলো। দ্বিতীয় চুমুক শেষ করতেই আনোশী নীরবতা ভেঙে বললো,
–“কিছু কথা ছিলো মামা।”

মামা চোখ তুলে চাইলো ভাগনির দিকে। আনোশীর মুখখানা বেশ স্বাভাবিক। তাই ঠিক ধারণা করতে পারল না ভাগনি তাকে কী বলতে চাইছে? মামা চায়ে তৃতীয় চুমুক দিয়ে বললো,
–“বলো মামণি।”

আনোশী দ্বিধাহীন গলায় আওড়ায়,
–“এই বিয়েটা হলে আমার প্রতি বড়ো অ*ন্যায় হয়ে যাবে মামা। এখন আমি বাচ্চাও নই যে নিজের ভালোটা বুঝবো না। তাই মামা, আমি বলছি। এই বিয়ে করাটা আমার দ্বারা সম্ভব হবে না!”

মামার ফুরফুরে মেজাজ নেতিয়ে পরলো। মুখটা থমথমে ভাব করে বললো,
–“দেখো মামণি, শেহরিমকে তুমি যা ভাবছো…”

মামার কথা আনোশী শেষ করতে দিলো না। কথায় ফোড়ন কেটে বেশ নিবিড় কন্ঠে শুধায়,
–“শেহরিম ভালো নাকি মন্দ সেটায় আমার কোনো যায় আসে না। সবার আগে তিনি আমার বড়ো বোনের প্রাক্তন স্বামী। তাকে আগে বোনের হাসবেন্ডের জায়গায় বসিয়ে অনেক সম্মান করেছি। সেই অবস্থায় যদি তার-ই সাথে আমার বিয়েটা হয় তাহলে বিষয়টা আমার জন্য ভীষণ অস্বাভাবিক লাগবে। যদি রিয়াদ ভাইয়ার ক্ষেত্রেও এরকম কিছু হয়, তাহলে আমি রিয়াদ ভাইয়াকেও মানতে পারবো না। কারণ, তাদের সম্মানটা আমি অন্যভাবে দিয়ে ফেলেছি। প্লিজ, মামা। আমার পয়েন্ট অফ ভিউটা বোঝার চেষ্টা করিও!”

মামা গভীর চিন্তায় পরে গেলো ভাগনির কথাগুলো শুনে। মামী এর মাঝে হনহনিয়ে প্রবেশ করলো লিভিংরুমে। সব শুনে সে ভীষণ রাগাম্বিত। আনোশী মামীকে হালকা ভাবেই নিলো। চেহারায় কোনো পতিক্রিয়া দেখালো না। মামী বেশ কপট সুরে বললো,

–“শেহরিম যথেষ্ট ভালো ছেলে। বিয়ে হয়ে গেলে তোর সব ভ্রান্তি দূর হয়ে যাবে। সব একপাক্ষিক শুনলে, বুঝলে হবে না। ঘটনাকে পর্যবেক্ষণ করতে হয়। জীবনেও মনে হয় বোনের তালাকপ্রাপ্ত স্বামীর সাথে কেউ বিয়ে করেনি? তুই-ই প্রথম?”

আনোশী মামীর দিকে চেয়ে শান্ত ভঙ্গিতে বললো,
–“কেউ বিয়ে করেছে কী করলো না সেসব আমি দেখতে চাই না, জানতেও চাই না। আমি আমার জীবন নিয়ে ভাবছি, যা ভালো মনে হয় তাই করছি। আমি কখনোই আপুর প্রাক্তন স্বামীকে বিয়ে করবো না।”

মামী কিছু বলতে গিয়েও নিজেকে দমিয়ে নিলো। অতঃপর দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
–“আমি নিশ্চিত তাশুতির কানপড়া এখনো তোর মগজে তীরের মতো গেঁথে আছে। এজন্য-ই বিয়ে করতে চাইছিস না তাইতো? তোর বোন শেহরিমের বাড়ী গিয়ে কী করেছে তাঁর সত্যতা যাচাই করবি না? যেহেতু নিজেকে বিচক্ষণ দাবী করিস! তাহলে খোঁজ-খবর নিয়ে সত্যতা যাচাই কর, দেখি তুই আমার কত বিচক্ষণ মেয়ে!”

মামীর কথায় আনোশী বেশ অবাক হলো। বিস্ময়ে মামার সাথে এই টপিকে আর কথা বলতে পারলো না। চুপ করে উঠে চলে গেলো। আনোশী যেতেই মামা জোরে ধমক দিলো মামীকে।
–“বোনেদের মধ্যে বিবাদ লাগানো শুরু করেছ? এসব বলার কী প্রয়োজন ছিলো?”

–“আমি ওকে সত্যতা যাচাই করতে বলেছি। এতেই দোষ হয়ে গেলো? মিথ্যের ছায়ায় আর কতদিন নিজের আস্তানা গড়বে? যেই বোনকে নিয়ে এত গীত গায় সেই বোন ওর আপন নাকি? যত্তসব ন্যাকামী!”

মামা অবশিষ্ট চা না খেয়েই উঠে গেলেন। হনহন করে তিনিও বেরিয়ে গেলেন। মামীও তাশুতিকে গাল-মন্দ করতে করতে রান্নাঘরে চলে গেলো। এদিকে লিভিংরুমের ফ্যান আর টিভির দিকে কারো হুঁশ-ই রইলো না। দুটোই চালানো রইলো।

—————
পরেরদিন আনোশী হেঁটে হেঁটেই স্কুলে যাচ্ছে। মাথায় তাঁর নানান চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। ধ্যানে কিছুটা ছেদ ঘটলে বুঝতে পারে তাঁর পাশাপাশি একটি বাইক চলছে। আনোশী ঘাড় বাঁকিয়ে পাশ ফিরে চাইলো। শেহরিম তাঁর হাঁটার গতির সাথে বাইক চালাচ্ছে। নজর আনোশীর দিকেই। চোখ জোড়া কেমন ফোলা ফোলা। মুখ জুড়েও ক্লান্তি ভাব বিচরণ করছে। গায়েও এপ্রোনটা রয়েছে। যেন খোলার সুযোগ হয়ে ওঠেনি শেহরিমের।

আনোশী সঙ্গে সঙ্গেই আবার নজর ঘুরিয়ে নিলো। ভাব করলো এমন, শেহরিমকে সে চিনে না। আনোশীর ভাব-ভঙ্গি দেখে শেহরিম হাসলো। আলতো স্বরে বললো,
–“আজকাল আমার থেকে লুকিয়ে চলছো কেন? আমার প্রণয়ে লিপ্ত হবার ভয়ে বুঝি?”

আনোশী সোজা নজর ফেলে সোজা-সাপটা উত্তর দিয়ে বললো,
–“আমি কারো থেকে লুকাই না। এটা আপনার ভ্রম!”

–“তাহলে এড়িয়ে যাও কেন? জানো সারা রাত ডিউটি করেছি। বাসায় ফেরার পথে তোমায় রাস্তায় দেখে বাইক ঘুরিয়ে আবার তোমার পিছে পিছে চলছি। আমার এই কষ্টের কিছুটা মূল্য পাওয়া উচিত!”

–“আপনাকে অনুরোধ করিনি আমার পিছে পিছে আসতে। তাই মূল্য চাওয়াটা বেমানান।”

শেহরিম হাসলো আনোশীর চটপটে উত্তর শুনে। হেসে বলে,
–“তোমার চটপটে উত্তরগুলো তে বিরক্তির চেয়ে অদ্ভুত ভালো লাগে বেশি। তা কী জানো তুমি আনোশী?”

–“জানানোর জন্য ধন্যবাদ। আপনি আসতে পারেন!”

বলেই আনোশী আরও লম্বা লম্বা পা ফেলে হাঁটতে লাগলো। শেহরিমও বাইকের গতি সামান্য বাড়িয়ে বললো,
–“স্কুল পর্যন্ত গিয়ে চলে আসবো। প্রমিস!”

আনোশী এবার বিরক্তি অনুভব করলো। তাইতো স্কুলের দিকে না গিয়ে পাশের মার্কেটের মধ্যে ঢুকে গেলো। আনোশীর কর্ম-কান্ড দেখে শেহরিম নিঃশব্দে হেসে ফেললো। হাসি বজায় রেখে বাইক ঘুরিয়ে বাড়ীর পথে চলে গেলো।

মিনিট দশেক পর আনোশী মার্কেট থেকে বেরিয়ে আসলো। হাতে তাঁর একটা শপিং ব্যাগ। আশেপাশে সতর্ক নজর ফেলে রিকশায় চড়ে স্কুলের দিকে রওনা হলো। চেয়েছিলো স্কুল ছুটি হওয়ার পরপর গিফটটা কিনে নিবে, কিন্তু শেহরিমের জন্যে বাধ্য হয়ে এখনই কিনে ফেলেছে। আজকের মতো শেহরিমকে যথেষ্ট সহ্য করেছে সে।

স্কুলে পৌঁছাতেই নীলকে অফিস রুমে দেখলো। নিজের চেয়ারে নিউজ পেপার পড়ছে সে। আনোশী চাপা হাসি দিয়ে নিজের সিটে গিয়ে বসলো। নীল কীভাবে যেন দেখে ফেললো আনোশীকে। আনোশীও তাকালো। আনোশী তাকাতেই সকলের আড়ালে চমৎকার হাসি দিলো নীল। যা দেখে আনোশীর হৃদয় জুড়ে শীতলতা ছেঁয়ে গেলো। অফিসরুম টিচার দিয়ে ভর্তি, তাই কেউ কোনো কথা বললো না। প্রথম পিরিয়ডে তাদের কারো ক্লাস নেই। ২য় পিরিয়ড থেকে ৪র্থ পিরিয়ড অবধি ক্লাস থাকে।

প্রথম পিরিয়ডের সময়টুকু যে যার যার মতো কাটিয়ে দিলেও ঘন্টা পরলে দুজন-ই উঠে যায় অফিসরুম থেকে বের হওয়ার উদ্দেশ্যে। সিঁড়ি দিয়ে এক সাথেই উঠলো। নীল চাপা স্বরে আনোশীর উদ্দেশ্যে বললো,

–“গতকাল তো বললেন আজ তাড়াতাড়ি আসবে। তাহলে দেরী করলে কেন?”

আনোশী সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে বললো,
–“আপনি কল করে বড্ড জ্বালান, এজন্য ঘুম থেকে উঠতে দেরী হয়ে যায়।”

নীল হেসে বলে,
–“আমি জ্বালালেও আপনি বিরক্ত হন না, সেটা আমি ছাড়া কে ভালো বুঝবে শুনি?”

আনোশী কোনো উত্তর না দিয়ে অধর প্রসারিত করলো। হঠাৎ তাদের সম্মুখে কোনো টিচার চলে আসলে দুজনেই দূরত্ব বজায় রেখে নিশ্চুপ রয়। দু’জনই তাদের নিজেদের ক্লাসে চলে যায়।

সব ক্লাস শেষে নীল যখন চেয়ার টেনে আনোশীর সামনে এসে বসলো তখন আনোশী হুট করে বললো,
–“আজ আপনার যাওয়ার তাড়া নেই?”

নীল ভ্রু কুচকে চাইলো আনোশীর দিকে। কিছু আনোশীর কথার হিসাব মেলাতে না পেরে বললো,
–“যাওয়ার তাড়া থাকবে কেন?”

–“ওমা। গতকাল রাতে আপনি না কলে আপনার বোনের জম্মদিন আজ।”

নীল এবার বুঝতে পারলো আনোশীর কথা। আলতো হেসে বললো,
–“হ্যাঁ বলেছিলাম। তবে আমার বোনকে সময় দেওয়ার মানুষ আছে। আর তোমাকে সময় দেওয়ার মানুষ হিসেবে আমি থাকি নাহয়!”

নীলের শেষ কথাকে অগ্রাহ্য করে আনোশী আলতো স্বরে প্রশ্ন ছুঁড়লো,
–“বয়ফ্রেন্ডের সাথে বোনকে একা ছেড়ে দিচ্ছেন?”

নীল ভারী অবাক হলো আনোশীর কথা শুনে। অবাক স্বরে বলে,
–“বয়ফ্রেন্ড কেন হবে? আমার বোন ম্যারিড! আই মিন, কাবিন হয়েছে আর কী!”

আনোশী বেশ অবাক হলো নীলের কথা শুনে। কবে যেন নীল বলেছিলো নীলের বোন এবার ইন্টার পরীক্ষা দিয়েছে। এজন্য কিছুটা অপ্রস্তুত হয় খবরটি শুনে। নীল আবার বললো,
–“অবাক হলে? ভাবছো বড়ো ভাইয়ের আগে বোন কী করে বিয়ে করে ফেলে? আরে আমারও তো সেই কথা, কেন বড়ো ভাইয়ের হবু বউটা মানছে না? সে মানলেই তো বড়ো ভাইটাও বিবাহিত ট্যাগ পেত।”

আনোশী নজর ঘুরিয়ে ফেললো নীলের কথা শুনে। কথা ঘুরাতে নীলের বোনের জন্যে কেনা গিফটের প্যাকেটটা নীলের হাতে ধরিয়ে দিয়ে ছোট করে বললো,
–“আপনার বোনের জন্যে!”

নীল গিফটের প্যাকেটটা উলটে পালটে বললো,
–“ওহ। আমি তো ভেবেছিলাম আমার জন্যে উপহার। আমার জম্মদিন আসছে কিন্তু। উপহার পাবো তো?”

আনোশী উত্তরে কিছু বললো না। আলতো হাসলো।

~[ক্রমশ]
বিঃদ্রঃ গঠনমূলক মন্তব্যের প্রত্যাশায় রইলাম। ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here