বকুল, পর্ব:৪

0
2916

#বকুল
#লেখনীতে:আফসানা মিমি

||৪||

আল্লাহ্ তায়ালার সৃষ্টি কতোই না চমৎকার। প্রতিটা ঋতুতে আলাদা আলাদা রুপ নেয় প্রকৃতি এ যেন এক আলাদা সৃষ্টি । যেমন এখন বর্ষাকাল । সারারাতের অঝোর ধারায় বৃষ্টিপাতের পর সকালের পরিবেশ অন্যরকম হয়। গ্রামাঞ্চলের পরিবেশ আরো বেশি সুন্দর হয়।

আজ একটু সকাল সকাল বাসা থেকে বের হয়েছি । ইচ্ছে প্রকৃতি বিলাস করব। এজন্য ভোর চারটা থেকে কাজ শুরু করে দিয়েছি । এখন ছয়টা বাজে । রিসোর্টে যাব আটটায় তাই এই দুই ঘন্টা সময় আমার । আমাদের রুপনগর গ্রামের দক্ষিণে উঁচু টিলা আছে যা দেখতে পাহাড়ের মতো । আর আমাদের মতো গ্রামের মানুষেরা এই টিলাকে অনেককিছু মনে করে । টিলার উপর ঘাস , বিভিন্ন প্রজাতির ফুল-ফল গাছ , লতা-পাতা জন্মিয়েছে বিধায় এই টিলাকে অনেকে স্বপ্নের পাহাড় বলে । মূলত সেখানেই যাব । আমাদের বাড়ি থেকে স্বপ্নের পাহাড় যাওয়ার দূরত্ব তিন কিলোমিটার পাকা রাস্তা দিয়ে দুই কিলোমিটার যেতে হবে আর বাকি এক কিলোমিটার পায়ে হেঁটে ।
কাল রাতে বাজার করা শেষে তিনশত পঞ্চাশ টাকা রয়ে গিয়েছিল হাতে । তিনশত টাকা মায়ের হাতে দিয়ে পঞ্চাশ টাকা নিজের কাছে রেখে দিয়েছি আটো ভাড়ার জন্য । সেখান থেকেই বিশ টাকা দিয়ে আসা যাওয়া করব আজ । একটা অটো ডেকে চড়ে বসলাম মাথা সম্পূর্ণ ঢেকে । গাড়িতে এলোমেলো চুলে সমস্যা হয় বেশি । স্বপ্নের পাহাড় যাওয়ার আগে এক মোড় পরে। এলাকাবাসীরা এই মোড়ের নাম দিয়েছে ‘ স্বপ্নের মোড় ধাপ_১ ‘ । নামটা হাস্যকর হলেও এই নামের পেছনে অনেক কারন আছে । গ্রামের এই দক্ষিণ পাশটায় অধিকাংশই চাকমাদের বসবাস । সেই বাপ দাদার কাল থেকেই নাকি এরা এখানে বসবাস করছে। তারা এই মোড়ের চারপাশে বিভিন্ন দোকানপাট বসিয়েছে। এখানে বিভিন্ন সামগ্রী বিক্রি করেই তাদের সংসার চলে যার কারনে এই মোড়ের নাম ‘ স্বপ্নের মোড় ধাপ_১’ রেখেছে আরেকটা ধাপ আছে পাহাড়ের চূড়ায় ।

হেঁটে চলেছি একা একা। চারপাশে পাখির কিচিরমিচির আওয়াজ শুনে চোখ বন্ধ করে রইলাম। ইশ কি মধুর আওয়াজ । বর্ষার কাল। যখন তখন বৃষ্টি। রিমঝিম রিমঝিম শব্দ খুব কানে আসছে। একই সময়ের আরেকটি শব্দ অতিপরিচিত। গ্রামে ব্যাপক শোনা যায়। শহরে ডাকটা ঠিক কানে আসে না। কান পাতলে শোনা যায়। হ্যাঁ, ব্যাঙের ডাক। ব্যাঙ ডাকে ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ। ভরা বর্ষায় ডাকটা যথারীতি শোনা যাচ্ছে। সারাবছরই থাকে ব্যাঙ। তবে এখন যৌবনা। বর্ষার জলে নতুন প্রাণ পেয়েছে। চলছে উৎসব। ব্যতিক্রমী উৎসবে নানা নামের হরেক জাত-পাতের ব্যাঙ যোগ দিয়েছে। এদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে বর্ষা। পাশেই সারি সারি কচুগাছের উপর পানি জমে আছে ইচ্ছে করছে ছোটবেলায় হারিয়ে যেতে । এগিয়ে গেলাম সেখানে আলতো হাতের টোকায় কচু গাছের উপর থাকা পানিগুলো ফেলে দিলাম বেশ আনন্দ লাগছে ।

কারোর হাসির শব্দে পেছনে ফিরে তাকালাম । ওমা ! এদেখি রিসোর্টের ভাইয়া আপুরা । বিনা, মিরা আপু হেসে এগিয়ে আসলেন আমার কাছে । হাত ধরে মিরা আপু হেসে বলে উঠলেন ,

‘ বাহ্ বকুল, তোমাকে না দেখলে আমরা বুঝতামই না যে প্রকৃতি বিলাস কি করে করতে হয় । আমরা কিন্তু তোমাকে সেই অটো থেকে নামার পর পরই অনুসরণ কর… । ‘

মিরা আপুর বাকী কথা বলতে না দিয়েই সানিম নামের সুদর্শন পুরুষটি বলতে শুরু করল ,

‘ চোখ বন্ধ করে প্রকৃতির বিলাস করা এক রমণীকে দেখেছি যার মাথার ঘোমটা থেকে কিছু অবাধ্য চুল বাতাসে উড়ছিল । কচু গাছের উপর জমে থাকা পানিতে টোকা দেয়ার সময় মিষ্টি হাসিতে অনেকটা প্রাণবান লাগছিল ঐ প্রানবান হাসিতে ছিল সর্বনাশ । ইচ্ছে করছিল এভাবেই চেয়ে থেকে নিজের সর্বনাশ ডেকে আনি। ‘

সানিম নামের সুদর্শন পুরুষটির কথা শুনে চোখ বড় হয়ে গেল আমার । সকাল সকাল ভূতে ধরেছে নাকি চিন্তা হচ্ছে । কিসব উল্টা পাল্টা কথা বলছে মানুষটা ।

‘ বন্ধুরা শোন শোন শোন ,এই হচ্ছে আমাদের সানিম।
বিশ্বাস হচ্ছে কারোর ! আমাদের সানিম একজন মেয়ের প্রশংসা করছে তাও এত নিখুঁতভাবে । যে সানিম ভার্সিটির সব মেয়েদের ক্রাস কিন্তু সে কাউকে পাত্তা দেয় না আজ সেই সানিম ইয়াসার কোন মেয়ের প্রশংসা করছে । বিশ্বাস করা যায় ? ‘
রাফি ভাইয়ের কথায় আমারও টনক নড়লো । সামনে তাকিয়ে দেখি সানিম ভাই কপাল ভাঁজ করে আছেন আর এদিক-সেদিক তাকাচ্ছেন । তাকে দেখে মনে হচ্ছে ভুল জায়গায় ভুল কথা বলে ফেলেছেন এমন।আমি চিন্তা করছি এই সুদর্শন পুরুষটি তার কথা দ্বারা কি বোঝাতে চাচ্ছে ? পাশ থেকে উদয় ভাইয়া চিন্তিত স্বরে বলতে শুরু করলেন,

‘ হ্যাঁ তাইতো ! সামিন তুই কি ড্রিংক করেছিস ? সকাল সকাল কিসব বকছিস বল ?’

‘ আরে ইয়ার ,আমি ঠিকাছি । এমনি প্রকৃতির সাথে মিশে প্রাকৃতিক বর্ণনা দিতে মন চাইলো সামনে বকুলফুলকে পেলাম তাই তাকে দিয়েই বর্ণনা দিলাম।’
সানিম ভাইয়ার দ্রুত উওর

স্বস্তিরে নিশ্বাস নিলাম । আমিও মনে মনে কি না কি ভেবেছিলাম । বিনা মিরা আপুর পানে চেয়ে দেখি তারা সরু চোখে সানিম নামের সুদর্শন পুরুষটির দিকে চেয়ে আছে যেন সানিম ভাইয়ার কথাগুলো বিশ্বস করেনি । আর সানিম ভাইয়া , সে তো ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখছে ।
সবার কথার মাঝে এতক্ষনে আমার কৌতূহল জেগেছে এই ভেবে যে তারা এত সকালে এখানে কি করছে তা জানার জন্য তাই সকলের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করলাম এত সকালে এখানে কেন ?

প্রত্যুত্তরে উদয় ভাইয়া বললো সকাল সেই পাঁচটায় সানিম ভাইয়া সবাইকে ডেকে তুলে এখানে নিয়ে এসেছে প্রকৃতি দেখাতে ।
কথাটা শুনে খুব ভালো লাগল । সানিম নামের সুদর্শন পুরুষটি আমার মতো প্রকৃতি প্রেমি ।
সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললাম ,

‘ ভাইয়ারা আপুরা তো চলুন আমাদের স্বপ্নের পাহাড় আপনাদের ঘুড়িয়ে নিয়ে আসি ।’

সকলে আমার কথায় সম্মতি দিল। চলা শুরু করলাম এঁকেবেঁকে রাস্তায় ।

পাহাড়ে উঠার জন্য আদিবাসীরা মাটি কেঁটে কেঁটে রাস্তা তৈরি করেছে । আমার এ পাহাড়ে চড়া অভ্যাস তাই অনায়েসেই উঠতে পারছি । পেছনে বিনা মিরা আপুকে উদয় আর রাফি ভাইয়া ধরে ধরে উঠাচ্ছেন।রাফি ভাইয়া একটু পরপর মিরা আপুকে ছেড়ে দিতেই মিরা আপু চিল্লিয়ে উঠছে ব্যপারটা দেখে খুব হাসি পাচ্ছে । বিনা মিরা রাফি উদয় ভাইয়া সামনে আর আমি তাদের পেছনে আর আমর ঠিক পেছনে সানিম ভাইয়া । পাহাড়ের ঢালু পথে আদিবাসীরা বিভিন্ন প্রজাতির গাছ লাগিয়ে রেখেছে । এর মধ্যে বেশিরভাগই আমগাছ । পাহাড়ের জায়গায় জায়গায় বিভিন্ন ফুলের গাছ দেখা যাচ্ছে কোনটার রং বেগুনি তো কোনটার রং হলুদ । বেগুনি রংয়ের ফুলটা দেখে খুব ভালো লাগছিল তাই একটা ফুল ছিড়ে কানে গুঁজে দিলাম । পেছনের মানুষটি মনে হচ্ছে গভীরভাবে আমাকে পর্যবেক্ষণ করছে তাই দেখার জন্য সানিম ভাইয়ার দিকে ফিরে দেখি সে আশেপাশের প্রকৃতির ছবি তোলায় ব্যস্ত ।
এতকিছু না ভেবে সামনে অগ্রসর হলাম ।

অবশেষে সকলে পাহাড়ের চূড়ায় উঠতে সক্ষম হলাম। বিনা মিরা আপু সামনে এগিয়ে অসাধারণ বলে দুহাত আকাশের দিকে মেলে ধরলেন । রাফি উদয় ভাইয়া এক গাছের গোড়ায় বসে পড়লেন । আর সানিম ভাইয়া সে তার মতো ব্যস্ত ফোনে । কি আছে যে ঐ ফোনে আল্লাহ্ জানে। সর্বক্ষণ তার হাতে ফোন থাকে । আমি চেয়ে আছি অদূরে লজ্জাবতী গাছটার দিকে কেমন যেন তাকিয়ে আছে । মনে হচ্ছে তার কাছে যাওয়ার জন্য আহ্বান জানাচ্ছে । মনের ইচ্ছেকে দমিয়ে না রেখে লজ্জাবতী গাছের কাছে চলে গেলাম ।
লজ্জাবতীকে ছুঁবো কি ছুঁবো না তা নিয়ে দ্বিধায় আছি ।হঠাৎ পেছন থেকে সানিম ভাইয়া বলে উঠলো ,

ছুঁয়ে দাও তোমার কোমল হাতে , নুয়ে যাবে লজ্জাবতী দিন শেষে । হেসে যাবে তুমি , তৃপ্ত হব আমি ।
– আফসানা মিমি

খিলখিলিয়ে হেসে উঠলাম সামিন ভাইয়ার কবিতা শুনে । আর সামিন ভাই , অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে আছে আমার পানে । সামিন ভাইয়া নিজের কোঁকড়ানো চুলে হাত বুলিয়ে বলল,

‘এভাবে হেসো না বকুলফুল ! কোথায় যেন লাগে ।’

চুপ হয়ে গেলাম উনার কথায় । মাঝে মাঝে এই সুদর্শন পুরুষটির আবল তাবল কথাতে নিজেই বোকা বনে যাই ।
বড় বড় পাতিলের আওয়াজ পেয়ে পেছনে তাকাই । ইয়া আল্লাহ্! একি কান্ড ? কি দেখছি এসব ?
অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি সানিম ভাইয়ার পেছনে ।

চলবে ……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here