#রঙিন_খামে_বিষাদের_চিঠি
#পর্বঃ১২
#আর্শিয়া_ইসলাম_উর্মি
২৫,
আচমকা-ই চোখের চশমা-টার গ্লাস ভেঙে যাওয়ায় রায়াদের সাথে বের হতে হয়েছে রিয়ানা-কে। আপাতত এমন কেউ নেই যে, তার সাথে বেরুবে। আয়াতও তো তপমন কিছু চিনে না বিধায় রায়াদ-কেই সাথে পাঠালেন ফাতেহা খানম। জুবায়েরের উপর বড্ড রাগ হচ্ছে রিয়ানার। ঐ লোক-টার জন্যই এখন এই ঘাড়ত্যাড়া লোকের সাথে বেরুতে হলো তাকে। সিড়ি দিয়ে হাঁটার সময় চোখ কোথায় রাখে! কে জানে? রিয়ানা নিচে নামছিলো দোকানে আইসক্রিম কিনবে বলে। তখনই রায়াদ এবং জুবায়ের উপরে উঠছিলো। ব্যস ওরা দুজন কথা বলায় ব্যস্ত থাকায় রিয়ানা-কে কেউ খেয়াল করেনি। রিয়ানা পাশ কাটিয়ে চলে যেতে ধরেও দুজন বলিষ্ঠ মানুষ-কে পাশ কাটানো যায়! ব্যালেন্স হারিয়ে রিয়ানা-ই পরে যায়। চোখের চশমা-টা তার নিচে পরে গ্লাসগুলো ভেঙে চুরচুর হয়ে যায়৷ এমনিতেও দেশে আসার পর সে সচরাচর চশমা পরতো না। কিন্তু চোখের সমস্যা বেড়ে যাওয়ায় চশমা পরলো! আর সেদিন-ই ভাঙতে হলো চশমা-টাকে! রিয়ানা তপ্তশ্বাস ছাড়লো। রায়াদের বাইকের পিছনে বসেছে সে। এক হাত রায়াদের কাঁধে দিয়ে রেখেছে সেইফ-টির জন্য। রাস্তায় একটু গ্যাপ আসায় সে খাঁমচে ধরলো রায়াদের শার্ট। আঙুল শার্টের উপর দিয়েই কাঁধে ডেবে গেলো যেনো। রায়াদ দাঁতে দাঁত পিষে ব্যথা সহ্য করে নিলো। কিছু বললোনা। মুখ খুললেই ঝগড়া হবে এই ঘাড়ের রগ ত্যাড়া কন্যার সাথে৷ যা এই মুহুর্তে রায়াদ মোটেও চাইছে না৷ এজন্য নিজেকে দমিয়ে রাখলো রায়াদ। নেহাৎ-ই মায়ের আদেশ। নতুবা রিয়ানাকে নিয়ে রাস্তায় একা বেরুনোর কোনো প্রশ্ন-ই উঠে না৷ ব্যবহারের যে ছিড়ি এই মেয়ের! কাঙ্ক্ষিত দোকানের সামনে এসে বাইক সাইড করলো রায়াদ। পার্কিং করে বাইক লক করে রিয়ানার দিকে তাকিয়ে সামনের দিকে হাঁটা ধরে। রিয়ানা বাইক থেকে নেমে কোনোমতে পরনের ওরনা-টাকে সামলে সামনের দিকে আগায়৷ এই লোক-টার সাথে আসার দরুণ জিন্সের সাথে লং কামিজ পরেছে রিয়ানা। মাথায় সুন্দর করে ওরনা দিয়ে শরীর ঢেকে সেপ্টিপিন লাগিয়ে দিয়েছে রোজা। তবেই রায়াদ নিয়ে আসতে রাজী হয়েছে। এরথেকে তো ভালো জুবায়ের লোক-টা। বিরক্তিকর হোক, তবু রায়াদের মতো বদ-মেজাজী নয়। দুই বদ-মেজাজী একত্রে! কখন যে কোন ইস্যু নিয়ে তর্কাতর্কি লেগে যায়! ঠিক নেই। রিয়ানা রায়াদের পিছুপিছু হেঁটে মার্কেটে ঢুকলো। চোখ-টা দিয়ে দূরের জিনিস ঝাপসা না দেখলে আর পানি না আসলে! রিয়ানা চশমা কিনতে এত তাড়াহুড়ো করতো না। ভার মে যাক চশমা, তবুও রায়াদের সাথে কোথাও নড়তো না। এই লোক তার পারসোনালিটি-কে নড়িয়ে নড়বড়ে করে দিয়েছে। শর্ট জিন্স টপস ছাড়িয়ে লং ড্রেস পড়তে হচ্ছে। যদিয়ো শরীর কাপড়ে আবৃত থাকায় ভদ্র, সুন্দর লাগছে। কিন্তু রিয়ানা তো চায় না এমন লাগুক তাকে। সবাই ঘৃণা করুক এটাই তো চায়। সারা দুনিয়া যেখানে ঘৃণা করে, সেখানে একজন তাকে ভালোবেসেছিলো। সেই বাসুক। তার পরিবর্তনে নতুন করে আর ভালো না-ই বা বাসলো। রিয়ানা মার্কেটের এক দোকানের দেয়ালে আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখে আনমনে এটাই ভাবলো। রায়াদ চশমার দোকানের সামনে দাড়িয়ে রিয়ানাকে পাশে না পেয়ে আশপাশ টায় চোখ বুলালো। অদূরে দাড়িয়ে থাকা মেয়ে-টির কাজ দেখে সে হতভম্ব। জনসম্মুখে কে আয়না পেলে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিজেকে দেখে? আর কেউ কি করে রায়াদের জানা নেই! কিন্তু এই রিয়ানা হোসাইন তো একপিস! তার দ্বারা সব সম্ভব। সে বাজখাই গলায় হাঁক ছাড়লো, বললো,
“বাসায় ফিরতে হবে আমাদের। সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। রঙঢঙ শেষ হলে সব ডিটেইলস বলে নিজের পছন্দের ফ্রেমের চশমা-টা নিয়ে নিলে ভালো হতো৷ যত্তোসব উটকো ঝামেলা।”
২৬,
রিয়ানার কানে কথাগুলো পৌছাতেই মুখ গোমড়া করে ফেললো রিয়ানা। নতুন একটা ফ্যাশনের সাথে পরিচিত হয়েছে। একটু দেখছে। তাতেও এই লোকের সমস্যা। রিয়ানা মেজাজ হারিয়ে খটখট শব্দে ফ্লোর কাঁপিয়ে হেঁটে যেনো রায়াদের পাশে পৌছালো। রিয়ানা যেতেই রিয়াদ ইশারা করে চশমা চয়েজ করতে বললো। সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। নয়তো রোজা-কে সাথে পাঠিয়ে দিতো রায়াদ। এমনি জুবায়েরের সাথে তার অনেক কথা জমে আছে। ওর কথার পুরো মানে বুঝেনি রায়াদ। রাস্তায় কথা বলতে বলতে বাইক রাইড করা অনুচিত বলে জুবায়ের চুপ করিয়ে দিয়েছিলো তাকে। বাসায় গিয়েও আড্ডা দেওয়ার সুযোগ হলো না। এই দূরন্ত মানুষটিকে নিয়ে আসতে হলো এখানে। রায়াদ হাফ নিঃশ্বাস ছাড়লো। রিয়ানা সব চয়েজ করে রায়াদকে বিষয়-টা বোঝাতেই রায়াদ দাম জিগাসা করে। দামাদামি করে চশমা কেনা শেষ হলে রিয়ানা চশমা-টা আর প্যাকেট করায় না। সোজা চোখে পরে নেয়। সেই অবস্থায় রায়াদ এক পলক রিয়ানাকে দেখলো। আনমনে ভাবলো, ‘সভ্য ড্রেস বাংলাদেশের সাথে মানানসই, চোখে চশমা। কিউট একটা মেয়ে। কেনো যে সবটা সময় জল্লাদের বংশধরের মতো নিজের রুপ প্রকাশ করে! কে জানে! রায়াদ বিল মিটিয়ে আবারও ইশারায় রিয়ানাকে বেরুতে বলে মার্কেট থেকে। দুজনেই সমান তালে হেঁটে এসে প্রথমে রায়াদ, এরপর রিয়ানা এসে উঠে বসলো। রিয়ানা বসতেই রায়াদ বাইক স্টার্ট দেয়। একটু বেশি স্পিডে বাইক চালাতেই রিয়ানা দুহাতে রায়াদের শার্ট খামচে ধরে। রায়াদ ফের বিরক্ত হয়। কিন্তু এবার চুপ থাকলো না। বললো,
“আপনি কি আপনার নখ আমার শরীরে ডাবিয়ে আমায় ক্ষত-বিক্ষত করার প্ল্যানে আছেন?”
“আপনি অল্প স্পিডে বাইক চালালেই পারতেন।”
রিয়ানার উত্তরে রায়াদ স্পিড কমিয়ে দেয়। বাসায় যাওয়া জরুরী। জুবায়ের অপেক্ষা করছে। সেখানে এই মেয়ের ভয়ের অভাব নেই। উফফ খোদা। মনে মনে আফসোস জাগে রায়াদের। কোন কু-ক্ষণে যে মায়ের কথা রাখতে গিয়েছিলো! রায়াদ স্পিড কমাতেই রিয়ানা নিজের হাত সরিয়ে নেয়৷ বাসা আর কিছুদূর পরেই। তখনই রিয়ানার নজরে পরলো ফুচকা স্টল৷ সে রায়াদের পিঠে ধুপধাপ থাবা বসিয়ে বসিয়ে বলতে শুরু করে,
“এই আমার জন্য আপনার ট্রিট বাকি আছে না? চকলেট আইস্কিম বলেছিলেন৷ আজ আমি ওসব চাইনা। প্লিজ ফুচকা খাই। প্লিজ এক প্লেট। রোজার কলেজে গিয়ে খেয়েছিলাম। এত্ত মজা এগুলো, একেকটা আস্তে রসগোল্লা। বিদেশে তো এগুলো খুজেই পাওয়া যায় না। আফসোস হয় ভীষণ।”
রায়াদ রিয়ানার বাচ্চাসুলভ আচরণ থেকে বারণ করলোনা। ফুচকা স্টলে বসে রিয়ানাকে ইশারা করলো বসতে। রিয়ানা খুশি মনে বসে পরলো রায়াদের পাশে। রায়াদ এক নজর রিয়ানাকে দেখলো। দেখা হওয়ার পর থেকে এই প্রথম রিয়ানা-কে উৎফুল্ল দেখলো রায়াদ। এজন্য মন সায় না দিলেও রিয়ানার খুশি-টা নষ্ট করলো না। চেয়ারে বসে ২প্লেট ফুচকার অর্ডার দিলো। এক প্লেট দিলে রিয়ানা হয়তো সে খাবেনা দেখে খাওয়ার কথা তুলবে। তার প্লেট থেকে তুলে খাওয়ানোর বদলে নিজের জন্য অর্ডার করা-ই ভালো মনে হলো রায়াদের। দুজনে অপেক্ষা করতে লাগলো ফুচকার জন্য।
বাসার ছাদে মাদুর পেতে বসে আছে জুবায়ের, রোজা, আয়াত। তিনজনই ছাদটাকে একটু ডেকোরেট করতে করতে হাঁপিয়ে বসে পরেছে হাত পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে৷ রিয়ানার জন্য একটা সারপ্রাইজ রেডি করতে চাচ্ছে ওরা৷ এজন্য ইচ্ছে করেই রায়াদের সাথে একা পাঠিয়ে দিয়েছে। যেনো ওরা মনমতো সব সাজাতে পারে। প্ল্যান ছিলো রোজা আর আয়াতের। জুবায়েরকে পেয়ে টেনে এনেছে রোজা। লম্বা মানুষের কাজগুলো জুবায়ের-ই ভালো পারবে করে দিতে, এজন্য টেনে এনেছে। এমনিতেও আয়াত টেনশনে ছিলো রিয়ানাকে আড়াল করে এতসব আয়োজন কি করে করবে! কিন্তু চশমা ভাঙার উছিলায় সব সমস্যার সমাধান ঘটলো। তিনজনেই যখন কাজের শেষ প্রান্তে এসে হাঁপিয়ে গেলো। তখনই ফাতেহা খানম অতিকষ্টে হেঁটে সিড়ি পেরিয়ে ছাঁদে আসলেন৷ রোজা মা-কে দেখেই চট করে বসা থেকে দাড়িয়ে বললো,
“তুমি ছাদে আসলে কেনো মা? তোমার হাঁটুতেও সমস্যা৷ ভুলে গেলে?”
“কাজ কতদূর দেখতে এলাম। মন সুস্থ তো সব সুস্থ। রাখ তোদের অসুস্থতা। কাজ ফেলে বসে আছিস কেনো অলসের দল!”
তিনজনেই খিলখিলিয়ে হেঁসে উঠে ফাতেহা খানমের ধমকের সুর শুনে। জুবায়ের বললো,
“আন্টি তোমার ধমক দেওয়া মোটেও রিয়েলিস্টিক মনে হয় না। অযথা কেন যে ধমক দাও? বুঝিনা।”
“আমিয়ো এতসব বুঝিনা। কাজ শেষ কর৷ কিন্তু আয়াত মা সবই বুঝলাম যে, তোরা রিয়ুকে সারপ্রাইজ দিবি বলে এসব করছিস৷ কিন্তু উপলক্ষ কি? এটাই তো বুঝলাম না। ”
আয়াত মুচকি হেসে বললো,
“রিয়ানা আসুক আন্টি। টের পাবে সবই। আপাতত কাজ শেষ করি। রোজা, জুবায়ের ভাই! কাজ শেষ করি। লেগে পরেন আপনারা।”
ফাতেহা খানম কথা বাড়ালেন না। এক পাশে বসে কাজ করা দেখতে লাগলেন। পুরো ছাদের চেহারা-ই পাল্টে দিচ্ছে এরা৷ সুন্দরই হচ্ছে। শুধু এখন অপেক্ষা যে, এত সাজানোর উপলক্ষ-টা ঠিক কি!
চলবে?