রঙিন খামে বিষাদের চিঠি পর্ব ১১

0
200

#রঙিন_খামে_বিষাদের_চিঠি
#পর্বঃ১১
#আর্শিয়া_ইসলাম_উর্মি

২২,
মাঝখানে কেটে গেছে একসপ্তাহ মতোন। নিজেকে একপ্রকার রুমবন্দী করে রেখেছে রিয়ানা। ফাতেহা খানমের বাসায় থাকলে তবু রোজা বা উনার সাথে আড্ডা দেওয়া হতো! বাবা আসার পর একদমই রুম থেকে বেরোয় না সে। হানিফ সাহেবের চোখের সামনে পরতেও তার মন সায় দেয়না। মনে পাহাড় জমে আছে অভিমানের। আচ্ছা এটা অভিমান তো! নাকি সম্পর্কের প্রতি মায়া উঠে যাওয়া! দোষ না করেও দোষী হওয়া! বড় বোনকে বাবার আদরে, মাথায় স্নেহের পরশে বড় হতে দেখা! অথচ সে কষ্ট পেলে, হোঁচট খেলে হাত ধরে উঠিয়ে দেওয়ার জন্য বাবাকে পায়নি। থাক, এসব নিয়ে আফসোস করে লাভ নেই। পায়নি বলে যে জীবন থেমে আছে এমন নয়! চলছে তো জীবন! কখনও ধীরে তো কখনও ঝড়ের গতিতে। বারান্দায় দাড়িয়ে আনমনে নিজেকে নিয়ে ভাবতে ব্যস্ত ছিলো সে। ভাবনা চিন্তা বাদ দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। হাতের ফোন-টা ওন করলো। ডাটা এক্টিভ করে ফেসবুকে ঢুকলো। সার্চলিস্টের টপে থাকা আইডিটায় ক্লিক করে স্ক্রল করে নিচে নামলো। আইডি-টা ভাগ্যিস পাবলিক করা। নয়তো রোজ রোজ এই একবার হলেও স্টক করার অভ্যাস-টা বাদ পরে যেতো তার। পরে আরও একটা দীর্ঘশ্বাস যুক্ত হতো তার দীর্ঘশ্বাস ফেলার তালিকায়। নতুন একটা পোস্ট এসেছে। ঘুরতে গিয়েছে সাজেকে। ক্যাপশনে তা জ্বলজ্বল করছে। রিয়ানা মৃদু হাসলো। একটা ছবিতে টাচ করে জুম করলো। আঙুল দিয়ে পুরো ছবি খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে আনমনে বিরবির করে বললো,

“এমনই এক শরৎ এ আমার শহরে পা রেখেছিলেন। আজ অন্য কারোর সাথে অন্য শহরে রয়েছেন। আমার ভীষণ আফসোস হচ্ছে জানেন তো। আপনাকে ফিরিয়ে না দিলে! নিজেকে একটু পরিবর্তন করলে! এই নারীর স্থানে হয়তো আমি থাকতাম। কিন্তু আফসোস না আমি নিজেকে বদলাতে পেরেছিলাম! না আপনাকে গ্রহণ করতে পেরেছিলাম। যতদিনে মনে হলো আপনাকে ভালোবাসি! ততদিনে গিয়ে দেখলাম আপনি অন্য কারোর হচ্ছেন। বাঁধা হলাম না। হলে হয়তো আজ এই যে আপনি ভালো আছেন? হয়তো থাকতেন না। আমার যে কাউকে ভালো রাখার মতো ক্ষমতা নেই। আপনার আর তার মাঝে ৩য় আরও একজন আসা প্রয়োজন। পরিবার-টা শূণ্য শূণ্য মনে হয়। কবে যে আপনি, আলহামদুলিল্লাহ বাবা হবার গুড নিউজ লিখে আপলোড করবেন! আমি সেই অপেক্ষার প্রহর গুনছি। আপনি ঠিক বলেছিলেন, আমি পাথর। নয়তো দেখুন না! আপনাকে ভালোবেসে যত্ন করে মনের ভেতর লালন করে আপনার সন্তান দেখার আশা কি করে করি? অথচ করে ফেলছি। আপনার ভালো থাকা-টা আমার জন্য বড্ড জরুরী।”

রিয়ানা আকাশের দিকে শূণ্য দৃষ্টি মেললো। চোখ দিয়ে টপটপিয়ে পানি ফেললো। গত কয়েকদিন হলো বড্ড বেশিই অতীতের স্মৃতির পাতা তার চোখে ভাসছে। আজও মনে পরছে কিছু কথা। এড়িয়ে যেতে পারলোনা রিয়ানা। মুচকি হেসে সেই সুন্দর স্মৃতিকে আরও একবার মনে করলো।

কলেজ শেষে টিউশন সেরে বাসার দিকে পা বাড়িয়েছে রিয়ানা। আজ সাথে করে গাড়ি বা সাইকেল কোনো টাই আনেনি। স্টুডেন্টদের সুবিধার জন্য সাইকেল রাইডিং এর পারমিশন এদেশে দেওয়া হয়। কিন্তু আজ সবকিছুতেই আলসেমি লাগছে ভীষণ। বাসা থেকে কলেজের দূরত্ব বেশ ভালো সময়ের। আস্তেধরে রাস্তার ওয়াক ওয়ে ঘেষে হাঁটছে সে। শরৎ এর রঙে রঙিন শহর-টা পড়ন্ত বিকেলের সূর্যের আলোয় ঝলমল করছে যেনো। আজ বন্ধু-দের সাথেও বাসায় ফিরতে চায়নি রিয়ানা। এজন্য একা-ই হাঁটছে সে। সবাই সাইকেল রাইডিং করে চলে গিয়েছে হয়তো। একা হাঁটতে আজ বেশ লাগছে রিয়ানার। পরণের শর্ট স্কার্টের জন্য হাঁটতে একটু অসুবিধা হচ্ছে যদিয়ো। টপসের উপর শার্ট-টার কলার বারবার কাঁধ থেকে নেমো গিয়ে বেশ বিরক্ত করছে তাকে। কাঁধের ব্যাগ টাকে ভালোমতোন ধরে জোড়ে হাঁটা ধরলো রিয়ানা। বাড়ির কাছাকাছি এসে বাড়িতে ঢুকলোনা সে। বাসার পাশেই একটা পার্ক আছে। সেখানে ঢুকলে মনে হয় ম্যাপল গাছের বাগান। হলুদ রঙের পাতায় আচ্ছাদিত গাছের বাগান দেখতে বেশ লাগে রিয়ানার। এইদেশে এসে যদি কাউকে ভালোবেসেছে মন থেকে! তবে এই ম্যাপল গাছের পাতাকেই। এরা শরৎ এ যেমন ঝড়ে পরে, যেনো মাটিকে ভালোবেসে আকড়ে ধরে। আর রিয়ানার কাছে ম্যাপল পাতা আর মাটির সন্ধি দারুণ লাগে।

২৩,
পার্কের ভেতরে ঢোকার পর রিয়ানা পা বাড়ায় একবারে দক্ষিণ দিকটায়। সেখানে কিছু হাঁটার জন্য স্পেস আছে। যেই স্পেসের দুই পাশে ওকগাছ মাথা তুলে দাড়িয়ে আছে। আর দুইপাশে দাড়ানো ওকগাছের ডালপালা একত্রিত হয়ে এমন একটা পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে! যেনো দেখলে মনে হবে কেউ নিজ হাতে ডালগুলো কেটে একটার উপর আরেকটা দিয়ে ছাউনি তৈরি করেছে। একদম হলুদ পাতার ছাউনি যেনো! রিয়ানা সেই ছাউনির মাঝ বরাবর যেই হাঁটার জন্য স্পেস! তার ধার ঘেষে হাঁটতে লাগলো। হাতের ফোন টা দিয়ে ভিডিও করছে টুকটাক। এরমাঝেই হঠাৎ নিজের পাশে কারোর অস্তিত্ব টের পেলো রিয়ানা। চট করে ঘাড় ঘুরালো ডানপাশে। পরিচিত পারফিউমের স্মেলই জানান দিচ্ছিলো এটা সাজ্জাদ। রিয়ানা সাজ্জাদকে দেখে ঘাবড়ালো না। শানৃত চাহনীতে এক পলক দেখে নিজমনে ব্যস্ত সে। হাঁটতে হাঁটতে ছাউনির মতো জায়গা-টা ছেড়ে পার্কের একটা বেঞ্চিতে বসলো। মাথার উপর ম্যাপল ট্রি। মাঝে মাঝে পাতা ঝরে তার উপর পরছে। সাজ্জাদ দূর হতে রিয়ানাকে লক্ষ্য করলো। এরপর দ্রুত পদে হেঁটে এসে দুম করে রিয়ানার পাশে বসলো। রিয়ানা একবার শান্ত চাহনীতে তাকিয়ে নিজের ফোনে মনোযোগ দিলো। সাজ্জাদ নিজেই মুখ খুললো, বললো,

“আমি আমার জবাব পাইনি রিয়ু।”

“কতবার বলবো! আমায় রিয়ু ডাকবেন না আপনি।”

“হাজার বার ডাকবো। পারলে ঠেকাও।”

“ঠেকালাম না। আমার ঠ্যাকা পারলোনা। এখানে কি করছেন আপনি? আমি যেখানেই যাই! আপনি পৌছে যান। অদ্ভুদ। ফলো করেন আমায়?”

“যাকে ভালোবাসি বলে মন উড়েছে, তাকে একা ছাড়তেও ভয় করে।”

“এটা ভালোবাসা নয়, মোহ। আপনি আমার বড় হয়েও এমন বাচ্চাসুলভ আচরণ কেনো করছেন! আমার জানা নেই।”

“কথা ঘুরাচ্ছো! আমার জবাব চাই।”

“জবাব আমার জানা নেই।”

রিয়ানা নিজেকে শান্ত রেখেই উত্তর দিলো। সাজ্জাদ ক্ষান্ত হলো না। সে আগের থেকে দ্বিগুণ ঝাঁজ সহিত বললো,

“আমি আর এখানে আছি-ই ১মাস ১০দিন। চলে যাবো আমি এখান থেকে। ভিসার মেয়াদ ফুরোবে। ভালোবাসি তোমায়। তোমার অনলে আমার অন্তরে দহন হচ্ছে। বুঝতে পারছোনা?”

“আসলেই বুঝতে পারছিনা। আমি এত কঠিন বাংলা ভাষা শুনে অভ্যস্ত নই।”

“যে ভাষা বোঝেনা, সে মন বুঝবে! আশা করাও বোকামি।”

“আমায় ভালোবাসেন?”

সাজ্জাদ চকিতে তাকালো রিয়ানার দিকে। এতক্ষণ পার্কের ইট গাঁথানো রাস্তায় দৃষ্টি অবনত ছিলো তার। এবার দৃষ্টি তুলে তাকিয়ে কাঁপা গলায় বললো,

“না, আমি তো মজা করছি এতোদিন ধরে তাইনা?”

“ওকে ফাইন। আমায় ভালোবাসেন, বিয়ে করে হাত ধরতে পারবেন? আপনার পরিবার শর্ট ড্রেস পরা, সিগারেট, মদ খাওয়া, নাইট ক্লাবে পার্টি করা, হুটহাট গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পরা, বন্ধুদের সাথে অল নাইট মস্তি করা, ছেলেদের সাথে ফ্লার্ট করা এই আমি-টাকে মানতে পারবে? আমি তো নিজেকে বদলাতে পারবোনা। আপনার জন্য বড়জোড় ছেলেদের সাথে ফ্লার্টিং করা ছাড়তে পারবো। এরবেশি সম্ভব না।”

“ফ্লার্টিং ছাড়তে পারলে বাকিগুলো আমি ছাড়িয়ে দিবো। কোনো বাঙালি মেয়ের মাঝে এসব অভ্যাস দেখলে সব বাঙালি পরিবারই একটু ওভার রিয়েক্ট করবে এটিটিউড কুইন। আমি যদি তোমায় আমার মতো করে পাল্টানোর চেষ্টা করি! সায় দিবে তাতে?”

“আমি আপনার জন্য আমায় বদলাতে পারবোনা।”

“তোমায় বদলাতে হবে না। আমি-ই বদলে নেওয়ার দায়িত্ব নিলাম।”

“ওকে, দ্যান আই উইল গিভ ইউ অ্যা চান্স। জাস্ট ওয়ান চান্স। আপনি হেরে গেলে চুপচাপ চলে যাবেন। কোনো অভিযোগ রাখবেন না।”

“তুমি পুরো-ই আপাদমস্তক একটা পাথর জানো এটা? তবুও একটা সুযোগ দিয়েছো। এটাই এনাফ ফর মি। আই উইল ট্রাই মাই লেভেল বেস্ট।”

“এডভান্স বেস্ট ওফ লাক।”

রিয়ানা উঠে দাড়ালো। দেরি করলোনা। কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে হনহনিয়ে হাঁটা ধরলো বাসার দিকে। সাজ্জাদকে সেখানেই ফেলে সে চলে আসলো বাসায়।

“রিয়ানা! এই রিয়ানা। বিকেলের নাস্তা বানিয়েছি। খাবি আয়।”

বোনের ডাকে সুখস্মৃতি মুহুর্তে ধুলিস্মাৎ হলো রিয়ানার। ফোঁস করে কয়েকটা লম্বা দম ফেলে হাঁটা ধরলো ড্রইং রুমের দিকে। নয়তো আয়াত বাসা মাথায় তুলবে। খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে সে আবাট ভীষণ স্ট্রিক্ট।

২৪,
জুবায়ের এখন অনেক-টাই সুস্থ। জুবায়ের এবং রায়াদ দুজনেই এসেছিলো ভার্সিটিতে টার্ম পেপার সংঘটিত বিষয়ের জন্য। নিজপদের কাজ সেরে দুজনই বাইক নিয়ে বেরিয়ে পরেছে। পাশাপাশি ধীর স্পিডে বাইক চালিয়ে ছুটেছে। গন্তব্য রায়াদদের বাসা। ফাতেহা খানম জুবায়েরের অসুস্থতার কথা শুনে বারংবার বাসায় নিতে বললেও জুবায়ের রাজী হয়নি। নিজের সমস্যার জন্য পুরো একটা পরিবারকে দৌড়ের উপর রাখতে চায়নি সে। কিন্তু রায়াদ নিজের বন্ধুত্বের দায়িত্ব থেকে পিছু হটেনি। পুরো একটা সপ্তাহ নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসক্তর কাপড় নিয়ে জুবায়েরের বাসাতেই কাটিয়ে দিয়েছে। দিনরাত এক করে জুবায়েরকে সুস্থ করে আজ ভার্সিটি আসলো। আজ না আসলে চলছিলো না বলেই দুজনের আগমন। যদিয়ো বা জুবায়েরের শরীর বড্ড দুর্বল। খাওয়া দাওয়ার ঠিক ছিলো না। শরীর স্টেবলই বা কি করে হয়! তারমাঝে ফাতেহা খানম বারবার ফোন করে বলে দিয়েছেন, তার দুই ছেলেই যেনো আজ বাসায় ফিরে। এজন্য একসাথে রওনা দিয়েছে বাসার উদ্দেশ্যে। দুজনই রাস্তার কিছু-ট ধার ঘেষেই সাবধানে বাইক রাইড করছিলো। এরমাঝেই রায়াদ থমথমে গলায় জুবায়েরকে প্রশ্ন করলো,

“সুস্থ একটা মানুষ আমার বাসায় থেকে চলে গেলি! কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে এমন ভয়ংকর জ্বর বাঁধালি কি করে? আজও তো গা শিউরে উঠে। জ্বরের তাপ ১০৬° তে গিয়ে ঠেঁকেছিল। এত জ্বর আচমকা তো হয়না জুবায়ের।”

জুবায়েরের দৃষ্টি সামনের দিকে স্থির। সে নিজেও রায়াদের কথা শুনে গম্ভীর স্বরে বললো,

“একটা মানুষকে দেখে ভয় করে। উনাকে দেখে ভয়ের চোটে বাইক এক্সিডেন্ট করতে করতে বেঁচে গেছি। শরীরে কি ব্যথা ছিলো বাপরে। এই ব্যথা জ্বরে ভুগিয়ে ছাড়লো। বাইক-টা আমার গায়ে এসে পরেছিলো।”

“কিন্তু তোর শরীরে চোট তো দেখলাম না!”

“কেন চোঁট দেখলে কি খুশিত হতিস? তাহলে বাসায় চল, প্যান্ট খুলে দেখাই।”

রায়াদ বিরক্ত হলো জুবায়েরের খাপছাড়া কথায়। সে ঝাজালো স্বরে বললো,

“তোর উল্টাপাল্টা কথা রাখ। এটা বল কাকে দেখে এতো ভয় পেলি? মানুষ হয়ে মানুষকে ভয় পায় কেউ! জ্বীন-ভুত হলে কথা ছিলো।”

“যে আকাম করছি ভাই। যার মেয়ের কপাল পুড়ছি! সেই মেয়ের বাপরে দেখলে কে না ভয় পাবে?”

রায়াদ জুবায়েরের কথার মানে বুঝলো না। রাস্তার মাঝেই জোড়ে অবাক স্বরে বললো,

“মানে?”

চলবে?

ভুলত্রুটি মার্জনীয়, রিচেইক দেওয়া হয়নি আজ যা ভুল আছে একটু উল্লেখ করবেন কেউ দয়া করে। আমি এডিট করে ঠিক করে নিবো। আসসালামু আলাইকুম।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here