#রঙিন_খামে_বিষাদের_চিঠি
#পর্বঃ১০
#আর্শিয়া_ইসলাম_উর্মি
২০,
জুবায়েরের বাসায় এসে লাগাতার দরজার কলিং বেল বাজিয়ে যাচ্ছে রায়াদ। তার কাছে মুল গেইটের চাবি থাকায় তালা খুলে সোজা উপর তলায় চলে এসেছে রায়াদ। দুতলার একটা বাসা। উপর তলায় থাকে জুবায়ের। নিচতলা এবং উপর তলায় পাশের ফ্লাট ভাড়া দিয়ে রেখেছে জুবায়ের। বাসা ভাড়ার টাকাগুলো দিয়েই তার দিব্যি চলে যায়। তবুও শখের চোটে কেনো যে, পার্ট টাইম জব বা টিউশনি তার করতেই হবে! জব করবে তো বাসা কেনো যে বাসা ভাড়া দিয়ে রেখেছে! বুঝে আসেনা রায়াদের। কেউ যদি মেরে গুম করে রেখে দেয়! টেরও পাওয়া যাবে না। এখন আবার ফোন ওফ, দরজা খুলছে না। চিন্তায় নিজের চুল টেনে ধরে রায়াদ৷ জুবায়েরের খোজ না পেয়ে পাশের ফ্লাটের ভাড়াটিয়াদের নক করার জন্য উদ্দ্যত হতেই খট করে দরজা খুলে দেয় জুবায়ের। রায়াদ সেদিকে খেয়াল করতেই থমকে যায়। জুবায়েরের চোখ দু’টো অসম্ভব রকমের লাল হয়ে আছে। মাথার পরিমাপের তুলনায় একটু বড় চুলগুলো কপালে আচরে পরে আছে। পরনে টাউজার আর টিশার্ট দেখে মনে হচ্ছে কেউ দুমড়ে মুচড়ে ফেলে রেখেছিলো! আর সেটাই জুবায়ের গায়ে দিয়ে আছে। রায়াদ জুবায়েরের সামনে এসে কপালে হাত দেয়। জ্বরের তাপে শরীর বোধ হয় পুড়ে যাচ্ছে এমন অবস্থা। জুবায়েরের এই অবস্থা দেখে রায়াদ হকচকিত হয়ে জিগাসা করে,
“তোর এই অবস্থা! অথচ আমায় একবারও জানানোর প্রয়োজন মনে করিসনি?”
“আমার এনার্জি নেই দাড়িয়ে থাকার। তুই একটু ভেতরে আসবি?”
জুবায়ের ক্লান্ত স্বরে কথাটুকু বলেই রুমের দিকে পা বাড়ায়। বিছানায় কম্বল গায়ে টেনে শুয়ে পরে। রায়াদ দরজা আঁটকে জুবায়েরের পিছু এসে ওর রুমে দাড়ায়। বুকে হাত বেঁধে প্রশ্ন করে,
“ডাক্তার দেখিয়েছিস? এই অবস্থা কি করে করলি?”
জুবায়েরের চোখ দু’টো অসম্ভব জ্বালাপোড়া করছে। জ্বরে শরীরে ব্যথার শেষ নেই। মাথা ব্যথায় দুনিয়ার সবকিছুই ভারী ভারী লাগছে জুবায়েরের কাছে। এজন্য উত্তর দেওয়ার মতো শক্তি টুকুও যেনো তার কাছে অবশিষ্ট নেই। রায়াদ উত্তর না পেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বাইকের চাবী, ফোন জুবায়েরের বেড সাইড টেবিলে রেখে পা বাড়ালো ওয়াশরুমের দিকে। বালতি ভর্তি পানি এনে জুবায়েরের বেডের পাশ ঘেষে রাখলো। নিজেই জুবায়েরকে ধরে মাথায় পানি ঢালার মতো করে শুইয়ে দিয়ে তোয়ালে এনে ওর ঘাড়ের নিচে রাখলো। দরজার পলিথিন কাগজ। এটা এখন কোথায় পায়! জুবায়েরের মাথার চুল আলতো হাতে টেনে দিতে দিতে ওর শিয়রে বসে রায়াদ প্রশ্ন করে,
“জুবায়ের, কোনো পলিথিন কাগজ আছে তোর বাসায়। বড় সাইজের?”
জুবায়েরের হুঁশ হারিয়ে যাচ্ছে যেনো। রায়াদের কোনো কথা ওর কানে যাচ্ছে না। গতকাল থেকে জ্বর নিয়ে পরে আছে। খাওয়া নেই, ঘুম নেই মাথা ব্যথার জন্য। ওষুধও খাওয়া হয়নি। মাথায় পানিও পরেনি। রায়াদ জুবায়েরের অবস্থা দেখে দিশেহারা হয়ে পরছে যেনো। বসা থেকে উঠে দ্রুতপদে কিচেনে আসে৷ আশা যদি কোনো বড় পলিথিন কাগজ পাওয়া যায়! সেই আশায় সব হাতরাতে থাকে। অবশেষে বড় একটা পলিথিন পেয়েও যায়। সেটা চাকুর সাহায্যে কেটে বড় করলো রায়াদ। জুবায়েরের কাছে ফিরে এসে ওর মাথার নিচে দিয়ে মগ দিয়ে পানি ঢালতে শুরু করলো। পানি পাল্টে এনে বেশ লম্বা সময় নিয়ে পানি ঢাললো। কপাল একটু ঠান্ডা হয়ে আসতেই পানি ঢালা বন্ধ করে তোয়ালে ভিজিয়ে জুবায়েরের টিশার্ট খুলে দিয়ে শরীর মুছিয়ে দিয়ে কিচেনে গেলো রায়াদ। কিচেনে এসে নুডলসের প্যাকেট চোখে পরায় ফ্রিজে ডিম খুজে পাওয়ায় নুডলস বানিয়ে নেয়। জুবায়েরের কাছে এসে তুলে ধরে আধশোয়া করে বসিয়ে দিয়ে জোড় করে খাওয়ায় অল্প করে। মাথায় পানি দেওয়ার পর জুবায়েরের মাথা-টা অল্প একটু হালকা হালকা মনে হচ্ছে। যদিয়ো সামান্য পানি ঢালায় কিছুই ঠিক হয়না। তবুও এই ঢাকা শহরের বুকে কে-ই বা রায়াদের মতো তার যত্ন নিবে! ভাবতেই চোখের কার্ণিশে হালকা জল জমা হলে জুবায়েরের৷ রায়াদ অল্প একটু খাইয়ে পানি খাইয়ে দিলে জুবায়েরকে। অরুচির কারণে ঠিকমতো খেতেও পারলোনা জুবায়ের৷ রায়াদ নুডলসের বাটি কিচেনে রাখতে গেলে জুবায়ের অস্ফুটস্বরে ভাঙা গলায় বলে,
“মা, তোমার ছেলে তোমার অভাবে অসুস্থ হয়ে পরে আছে। তুমি উপর থেকে দেখছো তো! তুমিহীনা আমার জীবন-টা কেমন এলেমেলো। ভাগ্যিস জুবায়ের চৌধুরী রায়াদের কপালে রায়াদের মতো বন্ধু জুটেছিলো! নয়তো আমায় একাই এই ফ্লাটে গুমড়ে পরে থাকতে থাকতে হয়তো মৃত্যুও হয়ে যেতো। কেউ টেরও পেতো না। ভাগ্যিস দুজনের নাম টা মিলেছিলো! নয়তো রায়াদ শাহনেওয়াজ জীবনেও ফ্রেন্ডশিপ করতো না। ভাগ্যিস তুমি নাম-টা দিয়েছিলে মা। তুমি না থেকেও তোমার আমার জন্য করে যাওয়া প্রতিটা কাজ, প্রতি পদক্ষেপে বাঁচিয়ে দিচ্ছে। হয়তো এজন্যই তুমি মা। আই মিস ইউ মা।”
২১,
নতুন বাসায় নিজের রুমে ফোনে চোখ ডুবিয়ে শুয়ে আছে রিয়ানা। একপ্রকার নতুন বাসা-ই বলা চলে। যেহেতু আড়াই মাসের মতো এখানে থাকতে হবে। সেহেতু এটা ওদের নতুন বাসা-ই। কিন্তু রিয়ানার মন টিকছেনা৷ ফোনে যত-ই নেট ঘাটাঘাটি করুক। মন চাচ্ছে একটা লং ড্রাইভে যেতে। বাট এখানে না আছে পারসোনাল গাড়ি, আর না আছে রাস্তাঘাট সম্পর্কে জানাশোনা। এরমাঝে মস্তিষ্কে ঘুরপাক খাচ্ছে আয়াতের তখন-কার করা প্রশ্ন-টা। তখন ফাতেহা খানম কিচেনে এসে পরায় রিয়ানা প্রশ্ন-টা স্কিপ করে চলে এসেছিল। কিন্তু আয়াত হঠাৎ ওরকম প্রশ্ন কেনো করলো? সে কি তাদের নিয়ে কোনো ভু্ল বুঝে বসেছে? মাথার মাঝে প্রশ্নগুলো কিলবিল করছে। অথচ ইচ্ছে করছেনা রিয়ানার যে, আয়াতকে গিয়ে প্রশ্ন গুলো করুক। তার তো কোনো পুরুষের প্রতি আগ্রহ-ই জন্মায় না। আবার কারোর প্রতি ভালো লাগা, মন্দ লাগার বিষয় তো দূরের কথা। রিয়ানা ব্যঙ্গাত্মক হাসলো। রিয়ানা হোসাইনের আবার ভালোমন্দ অনুভূতি! এটা আবার আছে নাকি? কারোর বলা কিছু কথা না চাইতেও মনে এসে পরে রিয়ানার। চোখ বন্ধ করে লম্বা শ্বাস নেয় কয়েক বার। তবুও যেনো তাকে মস্তিষ্ক, মন থেকে এই মুহুর্তে। রিয়ানার মনে পরে যায় সেইদিনের কথা।
জার্মানি, নিজেদের বাসার ব্যাক ইয়ার্ডে বসে আড্ডা দেওয়ার জন্য রাখা বেঞ্চিতে বসে আছে রিয়ানা। হাতে বিয়ারের বোতল। মাঝে মাঝে চুমুক দিচ্ছে, আবার ফোনের দিকে দৃষ্টি দিয়ে মনোযোগ সহকারে কিছু করছে। উপরতলা নিজের রুম থেকে জানালা দিয়ে রিয়ানাকে লক্ষ্য করছে সাজ্জাদ। মেয়ে-টা কেমন যেনো! অদ্ভুত। আজ দিয়ে একমাস হয়ে আসলো সে জার্মানি এসেছে। অথচ রিয়ানা তার সাথে প্রয়োজন ব্যতিত একটা টু শব্দ অব্দি করেনি। সে আগ বারিয়ে কতবার যে কথা বলার চেষ্টা করেছে। তার ইয়ত্তা নেই সাজ্জাদের। এমন ইগনোর তো তাকে কেউ করেনি। তার মনে মনে ভীষণ একটা ক্ষোভ জন্মালো রিয়ানার উপর। সে কি খুব বাজে মানুষ নাকি! যে তার সাথে একটু কথা বলা যায় না? ২৫বছরের যুবকের মনে ১৮বছরের কিশোরের ন্যায় অভিমান জন্মালো। ভারী অভিমান। অথচ যার উপর অভিমান! সে যেনো হাওয়ায় উড়া ম্যাপল পাতা। যে শরৎ এ রঙিন, শীত আসলেই ঝড়ে যায়। সাজ্জাদ আজ যে করেই হোক রিয়ানার সাথে কথা বলেই ছাড়বে। তার মনে যে ষোড়শী কন্যা এক্কা দোক্কা খেলছে! তার অবহেলা সাজ্জাদকে পোড়াতে শুরু করেছে! এটা কি ষোড়শী কন্যা বোঝেনা? সব প্রশ্নের উত্তর জেনেই ছাড়বে। সে যে ভীষণ ভাবে, বড্ড বাজে ভাবে ষোড়শী কন্যার এলেমেলো স্বভাবে হারিয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছে। সে যখন গুরুত্ব দিবেই না! তবে এই মায়ায় জড়িয়ে নেওয়ার মানে কি? প্রতি-টা দিন রিয়ানার এটিটিউড, ডেইলী রুটিনে রিয়ানার অলক্ষ্যেই তাকে ফলো করা! একপ্রকার ঘুরতে আসা যুবকের মনে রিয়ানা নামক কিশোরীকে জানার আগ্রহ জন্মিয়ে দিয়েছে। সেই আগ্রহ কি করে যে মায়ায় পরিণত হলো! মাথায় ঢুকছেনা সাজ্জাদের। আচ্ছা এটা মায়া! নাকি ভালোবাসা? নিজেকে প্রশ্ন করেও উত্তর পেলোনা সাজ্জাদ। ধীর পদে হেঁটে রিয়ানার পাশে এসে একটু দূরত্ব বজায় রেখে নিশ্চুপে বসলো। রিয়ানা এক পলক সাজ্জাদকে দেখেও সে নিজের কাজে মনোযোগ দিলো। ফ্রেন্ড’সদের সাথে আড্ডা দিতে মহা ব্যস্ত সে। আজ উইকেন্ড, ছুটি। এজন্য বাসায়। বিকেলে বেরুবে ফ্রেন্ড’সদের সাথে। এজন্য গ্রুপচ্যাটে সব আলোচনা চলছে। তার পাশাপাশি জার্মানি এক ছেলের সাথে মেসেজে সমানতালে ফ্লার্ট করে চলেছে রিয়ানা। ফ্লার্টিং এর ছলে মাঝে মাঝে তার ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ফুটে উঠছে। সাজ্জাদের একটু রাগ হলো। সে পাশে বসে আছে। অথচ রিয়ানা তার সাথে কথা-ই বলছে না। সে আগ বারিয়ে নিজেই বললো,
“আচ্ছা আমি কি খুব বিরক্তি কর মানুষ রিয়ু?”
রিয়ানা থমকালো সাজ্জাদের প্রশ্নে। নাম-টা সাজ্জাদ। কিন্তু রিয়ানার কাছে বজ্জাতের মতোই লাগে এই লোককে। কি রকম হ্যাংলার মতো তাকে বিরক্ত করে চলে। সে ভ্রুকুটি করে বললো,
“ডোন্ট কল মি রিয়ু। এটা আমার প্রিয়জন-রা বলে। আর আপনি আমার প্রিয় কেউ নন।”
সাজ্জাদ মৃদু হাসলো রিয়ানার কথায়। মাথা চুলকে বোকা চাহনীতে রিয়ানার চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,
“আমি তোমার প্রিয়জন নই। কিন্তু তুমি আমার প্রিয়জন। জানিনা কখন কিভাবে তোমায় আমার ভালো লাগতে শুরু করেছে! আমি কিচ্ছু জানিনা। তোমার এলেমেলো স্বভাব, পারসোনালিটি, এটিটিউড সবকিছুই কেমন একটা আমায় টানতে লাগলো তোমার প্রতি। তুমি চোখের আড়াল হলে আমার হাঁসফাঁস লাগে। আমি কি তোমায় ভালোবেসে ফেললাম এটিটিউড কুইন?”
রিয়ানা হতভম্ব হলো সাজ্জাদের কথায়। এই লোক এতদূর গড়িয়ে গেছে! এটা তো রিয়ানা কল্পনাও করতে পারেনি। সে কাঁপা গলায় উত্তর দিলো,
“এরা ক্ষণিকের মোহ। কেটে যাবে। দূরত্ব বজায় রাখুন আমার থেকে। আমার মতো মেয়েকে কখনও ভালোবাসা যায় না। আপনিই প্রথম হয়তো অনুভূতি সহ ভালোবাসার কথা বললেন। আপনিই প্রথম যে হয়তো আমার এলেমেলো স্বভাব, অস্বাভাবিক জীবনকে কাছ থেকে দেখেও ভালোবাসি বললো। এটা ভালোবাসা নয়, মোহ। চোখের আড়াল হোন কেটে যাবে।”
“কাটবেনা এটিটিউড কুইন। আই থিংক আই রিয়েলি লাভ ইউ। দেখো না, তোমার থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করে জানার আগ্রহে যেনো আরও কাছে এসে পরি।”
রিয়ানা এবার শব্দ করেই হাসলো। সাজ্জাদ মুখ গোমড়া করে বললো,
“হাসছো কেনো?”
“আপনি-ই প্রথম পুরুষ যে আমায় আবেগ নিয়ে ভালোবাসি বললো।”
“আর তুমি-ই প্রথম নারী, যে আমায় ইগনোর করলে এত। অথচ সাজ্জাদ হোসাইনের পেছনে যেখানে শত নারী ঘুরে বেড়ায়। সে এই ষোড়শী কন্যাকে ভালোবাসি বললো।”
সাজ্জাদ মৃদু হেসে কথাটা বললো। রিয়ানার হাসির রেখা প্রশস্ত হলো। খিলখিলিয়ে হেসেই চলেছে সে। সাজ্জাদ গালে হাত দিয়ে বসে রিয়ানার উদ্দেশ্যে বললো,
“আমি-ই প্রথম, আমি-ই যেনো শেষ পুরুষ হই এটিটিউড কুইন। যে তোমায় আবেগ-অনুভূতি জড়িয়ে ভালোবাসি বললো। আর কোনো পুরুষ যেনো না বলে। কখনও না। আমায় কি একটা সুযোগ দেওয়া যায় না?”
রিয়ানার কানে আজও যেনো কথাগুলো বেজে উঠলো। শরীর কাঁপিয়ে অতীতের স্মৃতিতে ভাঁটা ফেললো রিয়ানা। আর কোনো পুরুষ যেনো না বলে! এজন্যই রিয়ানা নিজেকে বদলায়নি। সময়ের স্রোতে নিজেকে আরও নিষ্ঠুর মানবীতে রুপান্তর করছে দিনদিন। আবেগ অনুভূতির গলা টিপে হত্যা করে চলেছে রোজ। এমন মেয়েকে সত্যি ভালোবাসা যায় না৷ রিয়ানা নিজের এলোমেলো চিন্তায় নিজেই হাসলো। তাকে কি সত্যি-ই ভালোবাসা যায় না! নাকি সে কাউকে ভালোবাসতে দেয়না!
চলবে?
ভুলত্রুটি মার্জনীয়।১৫০০+শব্দ, যদি বলেন ছোটো হয়েছে আরও ছোটো করবো আগামীকাল। আসসালামু আলাইকুম