#রঙিন_খামে_বিষাদের_চিঠি
#পর্বঃ০৯
#আর্শিয়া_ইসলাম_উর্মি
১৮,
সকালবেলায়, নিজের স্বভাব সুলভ ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে কফির জন্য রুম থেকে বের হলো রিয়ানা। পরনে লেডিস ট্রাউজার, হাফ স্লিভ টপস। কত্তগুলো দিন পর গলায় ওরনা ঝুলাতে হলো না। অনেকদিন পর শান্তি শান্তি লাগছে রিয়ানার। গতকাল রাতেই তার বাবা-বোন এসে পরায় আলাদা ফ্লাটে যে তাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে! সেখানে এসে পরে ডিনার করে। এই ফ্লাটে তো আর রায়াদ নামক মানুষের অসুবিধা হওয়ার মতো কিছু ঘটবেনা। তাই রিয়ানা নিজের সস্তি অনুযায়ী ড্রেস পরে বের হলো রুম থেকে। আয়াত কিচেনে হয়তো ব্রেকফাস্ট বানাতে ব্যস্ত। তা আন্দাজ করে রিয়ানা কিচেনের দিকে পা বাড়ালো। ইয়াসিন আংকেলের সাহায্যে তার বাবা যে এখানে থাকার জন্য যা যা জরুরী, সব করে ফেলেছেন। তা জানে রিয়ানা। তার বাবা আসার সময়ই সব নিয়ে এসেছে। রাতে রায়াদ, ইয়াসিন সাহেব এবং তার বাবা মিলে সবটা সেট করে ফেলেছে। তাই আন্দাজ মতো কিচেনে আসলো সে। কিন্তু কিচেনে এসে অবাক হলো রিয়ানা। পুরো কিচেন ফাঁকা। তার বোনকে কোথাও নজরে পরলো না। হয়তো ফাতেহা আন্টির কাছে গেছে। এই ভেবে রিয়ানা কিচেন জুড়ে কফি মেকার খুজতে লাগলো কফি বানানোর জন্য। কিন্তু কোথাও সেটি খুজে পেলো না। রিয়ানা কিচেন থেকে বেরিয়ে একটু চেঁচিয়েই ডাকলো,
“আপু, এই আপু।”
কিন্তু তার কণ্ঠই প্রতিধ্বনি হয়ে তার কানে আসলো। কোনো সাড়াশব্দ নেই। স্ট্রেঞ্জ! সবাই গেলো কোথায়। রিয়ানা বাবার সামনে যাবেনা ভেবেও তার বাবা যে রুমে থাকবেন বলে ঠিক করেছেন! সেদিকে পা বাড়ালো। কিন্তু সেখানে গিয়েও রিয়ানা হতাশ হলো। তার বাবাও রুমে নেই। আচ্ছা ইয়াসিন আংকেলের বাসায় যায়নি তো! এই চিন্তা মাথায় আসতেই সে তাড়াহুড়ো করে বাসার মেইন ডোর খুলে বেরিয়ে সিড়ির সামনে এসে সিড়ি বেয়ে নিচে নামার জন্য পা তুলতেই রিয়ানার নিজের ড্রেসের দিকে নজর গেলো। এভাবে গেলে আবার কোনো বকা দিবে তার বাবা? মোটামুটি ড্রেস তো ঠিক-ই আছে। এত ড্রেস পাল্টানো যায় নাকি রিয়ানা সেদিকে নজর দিলো না। হনহনিয়ে হেঁটে নিচতলায় এসে রায়াদদের বাসার সামনে দাড়িয়ে দরজায় কলিং বেল বাজালো৷ বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। দরজা খুলতেই রায়াদের ক্ষিপ্ত গলার স্বরে ভেসে আসে কিছু কথা,
“তোকে আসতে বললাম রাতে! তুই সকালে কি করতে আসছিস? কিল খাইতে?”
রায়াদের কথা শুনে রিয়ানা হতভম্ব। সে ভ্রুকুটি করে তাকায় রায়াদের দিকে। কোনো জবাব দেয়না বা প্রশ্নও করেনা। রায়াদকে পাশ কাটিয়ে বাসায় ঢুকে পরে। রায়াদ নিজেও এই ঘটনায় কিছু টা অপ্রস্তুত হয়ে পরে। সে তো ভেবেছিলো জুবায়ের। গতকাল রাতে আসতে বলায় তো আসেনি। সেজন্য ভেবেছে হয়তো সে-ই এসেছে। কিন্তু রিয়ানা আসবে এটা ভাবেনি সে। তাছাড়া এই মেয়ের সকাল ৮টায় ঘুম ভেঙেছে! এটা একটু আশ্চর্যজনক-ই মনে হলো রায়াদের। সে দরজা লাগিয়ে দিয়ে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ায়। সবাই নাস্তার টেবিলে সকালের নাস্তা করতে বসেছে। রায়াদের খাওয়া আগেই শেষ হওয়ায় সে উঠে দরজা খুলে দিতে যায়। আর এই কাণ্ড ঘটে বসে। রায়াদ ডাইনিং টেবিলের দিকে এক পলক তাকিয়ে নিজের রুমে চলে যায়। কি জাতের মেয়ে-রে বাবা। একটা টু শব্দ করলো না। রায়াদ হাফ ছাড়ে। যে ছেলের কপালে এ মেয়ে আছে, তার জীবন নিশ্চিত শেষ। রিয়ানার কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে রায়াদ। ফোন হাতে নিয়ে কল লাগায় জুবায়েরের কাছে। কিন্তু সুইচ ওফ পায় জুবায়েরের নাম্বার। ফোনে জুবায়েরের নাম্বারের দিকে তাকিয়ে অবাক হয় রায়াদ। ওর ফোন তো কখনও ওফ থাকে না। তবে এখন ওফ দেখাচ্ছে! আসতে বলেছে, অথচ আসেওনি। এমন টা আগে কখনও হয়নি যে, জুবায়েরকে রায়াদ ডেকেছে আর জুবায়ের আসেনি৷ ছেলে-টার কিছু হলো না তো! এই চিন্তায় রায়াদ বাইকর চাবি নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে পরে বাসা থেকে। যাওয়ার সময় ফাতেহা খানম ছেলেকে লক্ষ্য করে চেঁচালেও গায়ে মাখলোনা রায়াদ। গুরুত্ব পূর্ণ কাজ আছে বলে বেরিয়ে যায়।
১৯,
রিয়ানা এসে বসে পরেছে আয়াতের পাশে। বাবা আর আয়াতকে খুজতে এসে এই বাসাতেই পেলো। ইয়াসিন সাহেব নিজের প্রাণপ্রিয় বন্ধুকে আজকের দিনের দাওয়াত দিয়ে এসেছিলেন গতকাল রাতেই। নিজের রুমে ঘুমিয়ে থাকায় রিয়ানা এই বিষয় টা জানতোনা, আর আয়াতও তাকে কিছু বলার সুযোগ পায়নি। সমস্যা এক জায়গাতেই। রিয়ানাকে ঘুম থেকে উঠালে ওর মাথা ব্যথা করে। নিজ ইচ্ছেয় যতক্ষণ না উঠবে, রিয়ানাকে ঘুমাতে দিতে হয়। এজন্য জানানো সম্ভব হয়নি। আয়াত, রিয়ানা, রোজা একপাশে বসেছে। ইয়াসিন সাহেব এবং হানিফ সাহেব একপাশে। ফাতপহা খানম সবাইকে সব টা সার্ভ করে দিয়ে দাড়িয়ে আছেন। হানিফ সাহেব উনাকে বসতে বলার পরও বসাতে পারলেন না। খাওয়া প্রায় শেষ পর্যায়ে সবারই। রিয়ানা শুধু কোনো রকমে ডিম ভাজি দিয়ে একটা পরোটা খেলো। তেলযুক্ত খাবার সে খেতে পারেনা। কিন্তু আজ ব্রেকফাস্ট টেবিলে সব-ই বাঙালি খাবার। কোনো জুস, স্যান্ডুইচ, ব্রেড পেলোনা রিয়ানা। এজন্য পেটে ক্ষুধা নিয়েই উঠে পরলো। ফাতেহা খানম বিষয়-টা খেয়াল করলেন। রিয়ানা উঠতেই ফাতেহা খানম তার হাত ধরে কিচেনের দিকে নিয়ে গেলো। সবাই বিষয় টা খেয়াল করলেও কিছু বললো না। নিজ মনে খাবার শেষ করতে ব্যস্ত হয়ে পরলো সবাই। এদিকে ফাতেহা খানম কিচেনে এসে রিয়ানার হাত ছাড়লো। হাত ছাড়তেই রিয়ানা প্রশ্ন করলো উনাকে, বললো,
“এভাবে টেনে আনলে কেনো আন্টি?”
“খাবার তো ঠিকমতো খেলি না। পেটে ক্ষুধা নিয়ে উঠে যাচ্ছিলি তো! এজন্য টেনে আনলাম।”
ফাতেহা খানম রিয়ানার গালে হাত রেখে আদুরে স্বরে বললেন কথাটা। রিয়ানা মৃদু হাসলো। বললো,
“না আন্টি, আমার পেট ভরে গিয়েছে।”
ফাতেহা খানম কিচেনে থাকা একটা টুল এগিয়ে দিয়ে বললেন,
“চুপ। মায়ের কাছে আসছে কষ্ট লুকাতে। চুপচাপ টুলটায় বোস। আমি তোর পছন্দ মতো খাবার বানিয়ে রেখেছি। খেয়ে নে। আমি কফি বানিয়ে ফেলি এরমাঝে। তোর তো কফি ছাড়া চলে না।”
এরপর ফাতেহা খানম কিচেনে থাকা র্যাক থেকে রিয়ানার জন্য স্যান্ডুইচ বের করে দিলেন। ফ্রিজ থেকে ওর জন্য বানিয়ে রাখা জুস গ্লাসে ঢেলে এগিয়ে দিলেন। এরপর কফি বানাতে ব্যস্ত হয়ে পরলেন। রিয়ানা জুস টুকু আগে খেয়ে স্যান্ডুইচে কামড় বসিয়ে উঠে দাড়ালো। প্লেট-টা চুলার একপাশে রেখে ফাতেহা খানমকে জড়িয়ে ধরে বললো,
“তুমি বড্ড ভালো আন্টি। তুমি আমার মা হলে না কেনো বলো তো? আমার মা দেখেছো কতটা নিষ্ঠুর মানবী। আমায় একা করে দিয়ে নিজে ঘুমিয়ে পরেছে। যার দায়ভার আমি বয়ে বেড়াচ্ছি। আমার মা-কে বড্ড মিস করি আন্টি। তোমায় পেয়ে আমার আফসোস কিছু টা কমে এসেছে জানো। অথচ দেখো! আমার ছুটি শেষ হলেই ব্যাক করতে হবে। অথচ হয়তো এর আগেই। এদেশে আমার আর মন টিকছেনা।”
রিয়ানা কথাগুলো বলার ফাঁকে কেদেও ফেলেছে। মায়ের কথা মনে পরায় মন-টা বড্ড পুড়ছে তার। ফাতেহা খানমের কাঁধে গিয়ে ঠেকলো রিয়ানার চোখের জল। ফাতেহা খানম দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। রিয়ানার গালে হাত রেখে আফসোসের সুরে বললেন,
“তোকে আমার কাছে রেখে দিতে পারলে বড্ড শান্তি পেতাম রে মা। এক মেয়ে বড় হচ্ছে। বিয়ে দিলেই ফুরিয়ে যাবে। তোকে কাছে রেখে দিতে পারলে! কি যে শান্তি হতো আমার। তোকে বলে বোঝাতে পারবোনা।”
রিয়ানা কান্নার মাঝেই মুচকি হাসলো। বললো,
“আমি সারাজীবনই তোমার মেয়ে হয়ে রয়ে যাবো। শরীরে হয়তো তোমার কাছে উপস্থিত থাকতে পারবো না। কিন্তু মনে সবসময় তোমার কাছেই থাকবো।”
ফাতেহা খানমও হাসলেন রিয়ানার কথায়। কফির জন্য গরম করা দুধ নামিয়ে নিয়ে কফি রেডি করে রিয়ানার দিকে এগিয়ে দিলেন। রিয়ানা হাসিমুখে কফির মগে চুমুক দেয়। ফাতেহা খানমের ডাক আসায় তিনি কিচেন ছেড়ে বেরিয়ে এলেন রিয়ানাকে রেখেই। কিচেনের দরজায় দাড়িয়ে ফাতেহা খানম এবং রিয়ানার এই সুন্দর মুহুর্ত গুলো দেখছিলো আয়াত। ফাতেহা খানম বেরিয়ে যাওয়ার সময় সে দরজা থেকে সরে দাড়ায় যেনো ফাতেহা খানম তাকে খেয়াল না করে এমন ভাবে। উনি চলে যেতেই আয়াত রিয়ানার কাছে গিয়ে দাড়ায়। রিয়ানা কিচেনের সাইডে মাঝারি সাই জলের জানালা থাকায় জানালার কাছে দাড়িয়ে বাইরের দৃশ্য দেখছিলো আর কফিতে চুমুক দিচ্ছে। আয়াত গিয়ে ওর পাশে দাড়ালো।। রিয়ানা বোনকে লক্ষ্য করে একবার তাকালো। কিন্তু কিছু বললো না। আয়াত দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। দিনকে দিন রিয়ানার শান্ত থেকে আরও শান্ত হয়ে যাওয়ার বিষয়-টা বড্ড পোড়াচ্ছে তাকে। রিয়ানা আগে যেমন তার সাথে খুনশুটি করতো! এখন সেসব করা একদমই কমিয়ে দিয়েছে। আয়াত ওর পাশে দাড়িয়েই রিয়ানার দৃষ্টি লক্ষ্য করে শূ্ণ্যে দৃষ্টি মেলে। জানালার গ্রিলে হাত দিয়ে বলে,
“আন্টির কাছে মা মা বিষয়-টা বেশ ভালো লাগে তোর! তাইনা?”
“হুম।”
রিয়ানার ছোট্ট জবাব। আয়াত ফোঁস করে দম ফেললো। একটা কথা বড্ড জানতে ইচ্ছে করছে তার। কিন্তু বলার সাহস পাচ্ছে না। যদি রিয়ানা রেগে যায়! তবুও ইতস্তত করতে করতে আয়াত সাহস করে বলেই বসে,
“তোকে একটা কথা জিগাসা করি?”
“মুড খারাপ হয়, এমন কথা কিছু বলিস না আপু।”
“মুড খারাপ হবে কি না জানিনা। তবে আমার আগ্রহ দমন করতে পারছিনা।”
রিয়ানা এবার আয়াতের দিকে তাকালো। সে ভ্রু উঁচিয়ে বললো,
“কি কথা বলে ফেল। তোর কথার ধরণ দেখে আমারও এখন জানার আগ্রহ হচ্ছে।”
আয়াত ইতিউতি করে বলেই ফেললো, বললো,
“রায়াদ ভাইকে তোর কেমন লাগে?”
রিয়ানার চোখে মুখে বিস্ময় প্রকাশ পায়। তার বোনের এটা কেমন প্রশ্ন!
চলবে?
ভুলত্রুটি মার্জনীয়। ইনশা আল্লাহ রাতে আরও একটা পর্ব দিবো। আসসালামু আলাইকুম।