#চোরাবালি_৬
রেশমা আক্তার
লানার জন্য সত্যিই দুর্বিসহ একটা রাত। একদিকে কটে শুয়ে থাকা মুনের মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে যাওয়া। অন্যদিকে জ্বরতপ্ত শরীরে জোহারের অচেতন আলিঙ্গন। তার ওপর অন্ধকার একটা রাত। নিচে সিঁড়ির ওপর ঝেলানো চার্জারের ম্রিয়মাণ আলোয় একহাতে রোগীর মাথায় জলপট্টি, অপরহাতে মুনের মুখে ফিডার ধরে থাকা। ভাগ্যিস তাও জোহার মুনের ফিডারটা তৈরি করতে ভোলেনি।
মুনকে আবার কটে ফিরিয়ে দিয়ে লানাকে জোহারের পাশে এসে শুতে হয়েছিল। জোহারও টেনে নিয়েছিল লানার হাতটা তার কপালে।
লানা ফিসফিস করে জানতে চেয়েছিল
– খুব ব্যাথা হচ্ছে মাথায়?
– হুম
– ঘরে কোন অষুধ আছে?
জোহার হাত দিয়ে অন্ধকারে কোনদিকে ইঙ্গিত করল বোঝা গেল না। লানা কি খুঁজবে গিয়ে? মানুষটার কষ্ট আর দেখা যাচ্ছে না। এত কাছ থেকে একজন জোয়ান, সমর্থ্য পুরুষ মানুষের রোগাক্রান্ত ক্লেশ দেখার সুযোগ কখনও হয়নি লানার। আর রোগীর সেবা, তার যত্ন, আদর সেসব তো লানা নিজেই পায়নি কখনও। তবু অভিজ্ঞতাহীন জীবনেও কতরকম কাজে পারদর্শিতা দেখাতে হয়, জীবন তা বুঝিয়ে দেয় সময়ের পরতে পরতে।
এই যেমন লানা, বড়লোকের প্রায় বখে যাওয়া একটি মেয়ে। সাধারণ পারিবারিক পরিবেশটাও যার কপালে জোটেনি, সে রাতারাতি এক বাচ্চার মা হয়ে জোহারের স্ত্রীর ভুমিকায় চলে এসেছে। তাও সে আবার লানাও নয়। সোহা নামে অন্য কোন নারীর শারিরীক অবয়বে। শুধু চেতনায় এতটুকু মনে আছেযে, সে লানা। আচ্ছা এই পুরো ব্যাপারটা কি স্বপ্ন? নাকি লানা নামের মেয়েটি, যে কিনা ভার্সিটিতে পড়ে, স্বপ্নীলের বোন, তার নষ্ট হয়ে যাওয়া একটা অতীত, শিল্পপতি বাবা মায়ের মেয়ে, সেইটাই ছিল একটা বিড়াট দুঃস্বপ্ন?
লানা হাতড়ে হাতড়ে কেবিনেটের ভেতর থেকে মেডিসিন বক্স খুঁজে বের করেছিল। নিচে গিয়ে স্বল্প আলোতে খুঁজে এনেছিল পরিচিত দু’একটা অষুধ। বহু কসরতে জোহারের মুখে পানি দিয়ে অষুধটা দিতে পেরেছিল সে। এসব তার পারার কথা ছিল না। তবু কোন এক অবচেতন কর্তব্যবোধে, স্ত্রী ও মায়ের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল।
শেষরাতের দিকে জোহারের জ্বর হয়ত কমেছিল কিছুটা। লানাও সব ভুলে ঢলে পড়েছিল ঘুমে, জোহারের জ্বরতপ্ত শরীরটা ঘেঁষে। লানার এতটুকুও দ্বিধা বা সংকোচ হয়নি। বরং সে একহাতে আঁকড়ে ধরেছিল জোহারকে। বিড়বিড় করে বলেছিল
– আমি তোমার পাশে আছি জোহার, তোমার কোন ভয় নেই। সব ঠিক হয়ে যাবে।
দরজায় কেউ নক করছে থেমে থেমে। এত সকালে কে এলো। অসুস্থ মানুষটা সারারাত ছটফট করে কেবল ঘুমিয়েছে। মুনেরও ওঠার সময় হয়নি। লানা চোখ খুলল পিটপিট করে। ঘরটা এখনও অন্ধকার। তবে ভোর হয়েছে বোঝা যায়। হালকা হলুদাভ আলোর হাতছানি চারিদিকে। দরজায় কারো গলা, লানা পরিপূর্ণ চোখ খুলল।
একটা স্কয়ার, বক্স টাইপের ঘর। খুব ছিমছাম সাজানো। একটা সাদা ধবধবে বিছানায় শুয়েছিল লানা। চট করে উঠে বসে চারিদিকে বিছানা হাতড়াল,
– জোহার…? জোহার কোথায়?
দরজার ওপাশে খুব চেনা কারও গলা
– লানা… ডারলিং, উঠে পড়। সবাই রেডি, সানরাইজ দেখতে যাবে না? তাড়াতাড়ি নেমে এসে, সবাই অপেক্ষা করছে…
– ইমাদ?
লানা হাঁটু মুড়ে বসে থাকল কয়েক মিনিট। তার মানে, সে চলে এসেছে বাস্তবে। এটা কোথায়? কোন হোটেলের কেবিন? ওইতো পড়ে আছে লানার লাগেজ। যত্রতত্র কাপড়চোপড় ছড়িয়ে ছিটিয়ে। অগোছানো, এলোমেলো। বাথরুমে পানি পড়ার শব্দ। লানা লাফ দিয়ে উঠে গিয়ে উঁকি দিল বাথরুমে। কেউ নেই। কারও থাকার কথাও নয়। লানা গিয়ে মুখেচোখে কয়েকবার পানির ঝাপটা দিল। বালতিতে ভেজা কাপড়, নোংরা বাথরুম। এখানে সে ছিল? ছি ছি..
লানা ফ্রেশ হয়ে ঘরটা কোনরকম একটু গুছিয়ে বেরিয়ে এলো। বাইরে কেউ নেই। লবি, চারিদিকে কেবিন, মাঝখানে কাঠের সিড়ি নেমে গেছে। কেউ সমস্বরে ডাকছে লানাকে। শব্দের দিক নির্দেশনায় নেমে এলো লানা। বাইরে জিপের মত একটা গাড়িতে অপেক্ষা করছিল সবাই। লানাকে দেখে হইহই করে উঠল ওরা। লানা স্মিত হাসল। তারপর ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল গাড়ির দিকে। ইমাদ হাত বাড়িয়ে দিল। উঠতে হলে হাতটা ধরতেই হত। লানা ইমাদের হাত ধরে তার পাশের ফাঁকা আসনেই বসে পড়ল। অবাক হয়ে লক্ষ্য করল, ইমাদ তার হাতটা মুঠোর মধ্যে ধরেই আছে, ছাড়ছে না।
বাবুন বলল
– কি খবর লানা, সব ঠিক আছেতো? কাল রাতে তুইতো নিষেধই শুনলি না। পুরো বোতল সাবাড় করলি একাই। আমিতো ভেবেছিলাম সেদিনকার মত না কোন সিনক্রিয়েট হয়ে যায়।
হাসছে মিতা আর নওফা। মিতা বলল
– লানা, তুই কিন্তু প্রমিস করেছিলি, ট্যুরে এসে ওসব ছুঁবি না। আমিও ভয়ে ছিলাম…
নওফা বলল
– আরে, লানা হল ওসবের বস। ও ছুঁয়ে না দিলে তোরা টেনে মজা পেতিস না। তবে হ্যা আমি আবার মাত্রাজ্ঞান রাখি।
ইমাদ বলল
– আরে না, আমি আছি না সাথে? সব ম্যানেজ করে ফেলতাম।
চুপচাপ ছিল শাহের, লানাও।
তার মানে এখানে এসে সে বাউন্ডুলে জীবন কাটাচ্ছে। মদ, নেশা, অগোছানো ঘর, নোংরা বাথরুম, সব কেমন যেন হিসেব উল্টে দিচ্ছে তার।
ইমাদ এখনও হাত চেঁপে ধরে বসে আছে। লানা নিজের হাতটা টানতেই বাঁধা পেল। ইমাদ কাতর চোখে তাকিয়ে বাঁধা দিল। আশ্চর্য, ইমাদ এতটা সাহস পায় কি করে? তার মানে কি, গত দুদিন সেই ইমাদকে প্রশ্রয় দিয়েছে? লানা চোখ, মুখ শক্ত করে বসে থাকল। নিজেকে গুছিয়ে নিল ভেতরে।
পাহাড়ের ওপরে বানানো একটা বাঁধানো চত্বর। অনেক লোকজন জড় হয়েছে সূর্যোদয় দেখার জন্য। সবাই বেশ উৎসুক, ক্যামেরার ক্লিক, মোবাইলে সেল্ফি নিয়ে সবাই বেশ আমোদিত। লানা কেন যেন কোন উৎসাহবোধ করল না। তার কেমন অস্থির লাগছে। ভালোলাগছে না কিছু।
সূর্য উঠছে, সবাই নানান ভঙ্গিমায় উদীয়মান সূর্যের সাথে ছবি তুলছে। ইমাদটা খুব জালাচ্ছে। সে লানাকে শুধু লানা না ডেকে লানা ডার্লিং ডাকছে। লানা রাগ করবে নাকি স্বাভাবিক থাকবে বুঝতে পারছে না কিছু। অবশেষে সূর্য উঠল। সবাই জটলা করে করে এখন গ্রুপ ছবি তুলছে। লানাকেও ডাকা হল। লানা কেন জানি হাসতে পারছে না। তার চোখে মুখে কেমন যেন একটা দুশ্চিন্তার ছায়া। বাবুনই খেয়াল করল প্রথম। জিজ্ঞেস করল
– তোর কি হয়েছে বলতো লানা? কেমন নিস্তেজ হয়ে গেছিস?
মিতা বলল
– এ দু’দিন যে লাফালাফিটা করেছে। আমি তো জানতাম ওর শরীর খারাপ হয়ে যাবে।
লানা কৌতূহলে তাকালো মিতার দিকে।
এ দু’দিন লানা খুব লাফালাফি করেছে? মিতার কাছ থেকে আরও কিছু জানা যেত। কিন্তু নিজের সম্বন্ধে প্রশ্ন করা কি ঠিক হবে?
ইমাদ এসে লানার একটা হাত ধরল, বলল
– লানা ডার্লিং, তুমি ঠিক আছতো? তোমার মুখটা সত্যিই বড্ড শুকনা লাগছে।
লানা ম্লান হাসল। বলল
– হুম, বড্ড তেষ্টা পেয়েছে।
আর্তনাদ করে উঠল যেন ইমাদ। বলল
– তেষ্টা পেয়েছে? ও মাই গড, এক মিনিট দাঁড়াও। আমি পানির ব্যবস্থা করছি..
লানা থামিয়ে দিল, বলল
– শোন, তার দরকার নেই। আসলে পানি না, আমার ভীষণ ডাব খেতে ইচ্ছে করছে…
– ডাব? নো প্রবলেম। তুমি এখানে থাকো, আমি দেখি ডাবের ব্যবস্থা করা যায় কিনা
ইমাদ চলে গেল ডাবের ব্যবস্থা করতে। লানা হাঁফ ছাড়ল। সে আসলে ইমাদকে একটু দূরে সরাতে চেয়েছিল। যাক অন্তত কিছু সময়ের জন্য একা থাকা যাবে। মিতা আর নওফা অনেকটা দূরে, বাবুনকে দেখা যাচ্ছে না কোথাও।
লানা হেঁটে গিয়ে ঢালের কাছে একটা বাঁধানো বেদীর ওপর বসল। নিচে পাহাড়ের অতলান্ত খাদ। লানা তাকিয়ে আছে সেদিকে। তার চোখের পাতায় ভেসে উঠছে জোহারের মুখ। কটে ঘুমিয়ে থাকা মুনের চেহারা।
আচ্ছা, জোহারের কি ঘুম ভাঙবে? শরীর খারাপ নিয়ে সে কি নিচে গিয়ে ব্রেকফাস্ট তৈরি করবে? আর মুন? যদি জ্বরে জোহার অচেতন হয়ে থাকে, তাহলে মুনকে খাওয়াবে কে? মুন কি করবে একা একা? খুব কাঁদবে? ওর নিশ্চই খুব ক্ষিধে পাবে, তাইনা?
এসব কি ভাবছে লানা? কোথায় জোহার আর মুন? বাস্তবে যাদের কোন অস্তিত্বই নেই। জোহার আর মুন সম্পূর্ণ লানার মস্তিস্ক প্রসূত দুটি চরিত্র।সুতরাং তাদের কি হল তা নিয়ে দুশ্চিন্তার কোন কারণ নেই।
– কি খবর লানা?
লানা চমকে উঠল। তাকিয়ে দেখল দাঁড়িয়ে আছে শাহের। শাহেরের চোখে মুখে কেমন একটা চাহনি। জিজ্ঞেস করল
– কি চলছে তোর মনে?
লানা যেন ধরা পড়ে যাওয়ার হাত থেকেই বাঁচাতে চাইছে নিজেকে
– কই, কিছু না.. একদম কিছু না…
শাহের অনুসন্ধানী চোখে তাকিয়ে বলল
– কিছু না বললেইতো চলবে না। আমি খুব ভালো করে লক্ষ্য করছি, তোর মনের মধ্য কিছু একটা মতলব চলছে।
গম্ভীর হল লানা। জানতে চাইল
– মানে?
– দেখ লানা, ইমাদের সাথে তোর কেমিস্ট্রিটা আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। আসার দিন সারাক্ষণ ইমাদকে এড়িয়ে চললি, ইগনোর করলি, সেটা আমরা সবাই লক্ষ্য করেছি। কিন্তু এখানে আসার পর সম্পূর্ণ পাল্টি খেলি। এক মুহূর্তেই একদম ইমাদের সাথে লেপ্টে গেলি। এমন ঢং শুরু করলি যে গ্রুপের সবাই হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারছে না।
চিকন চোখে তাকাল লানা। শাহেরের গলার স্বরটা তার ভালো লাগছিল না। একারণেই প্রতিবাদী স্বর বেরিয়ে এলো। বলল
– হতেই পারে। ইমাদকে প্রথমে আমি বুঝতে ভুল করেছিলাম হয়তো। এখন দেখলাম, ছেলেটা খারাপ নয়, ওকে বন্ধু ভাবা যায়।
শাহেরের ঠোঁটে বিদ্রুপ হাসি।
– বন্ধু….!
– হুম, অফকোর্স বন্ধু..! কিন্তু তাতে তুই এমন রিএ্যাক্ট করছিস কেন বলতো? জেলাস…? তুই আবার আমাকে ভালোটালো বাসিস নাকি?
হাসল শাহের
– ওয়েট, নো ওয়ে.. ইউ নো…। আমার একজন ভালোবাসার মানুষ আছে আর সে কে তুই জানিস।
– তাহলে কে কার সাথে লেপ্টে আছে নাকি দূরে আছে ওসব নিয়ে মাথা ঘামাসনা। ট্যুরে এসেছিস, ফুর্তি কর
শাহেরের চোখ আরও তীক্ষ্ণ হল
– এত সহজে আমাকে বিভ্রান্ত করা যাবে না লানা.. সত্যি করে বল, কি চলছে তোর মনে?
লানা এবার সত্যিই বিরক্ত হল। বলল
– শাহের, যথেষ্ট হয়েছে। তুই ঠিক কি বলতে চাইছিস ঝেড়ে বল। আমি আর নিতে পারছি না
– গতকাল বিকেলে আমরা পাশের ওই পাহাড়ের রুফটপ দেখতে গিয়েছিলাম। অনেক সরু, বিপজ্জনক আর উঁচু পথ পারি দিতে হয়েছিল আমাদের
– হুম.. তো?
– এখনও মনে পড়ছে না তোর?
– কিসের কথা বলছিস তাইতো বুঝতে পারছি না
– ওখানে উঠতে উঠতে দিনের আলো ফুরিয়ে এসেছিল। আমরা সবাই সানসেট দেখা নিয়ে মেতে ছিলাম। আরও অনেক টুরিস্ট ছিল ওখানে। হঠাৎ আমি লক্ষ্য করলাম তুই আর ইমাদ কোথাও নেই। অল্প একটু জায়গা, হঠাৎ তোরা উধাও। আমরা চিন্তিত হয়ে পড়েছিলাম। সবাই খুঁজতে শুরু করলাম। অন্ধকার নেমে এলে পাহাড় থেকে নেমে আসা কঠিণ হয়ে পড়বে। আস্তে আস্তে লোকজন নেমে যাচ্ছিল। আমরা যে যার মত খোঁজাখুঁজি করতে শুরু করলাম তোদের।
– তারপর…?
অবাক চোখে তাকিয়ে আছে শাহের। বলল
– তারপর কি, তুই ভুলে গেছিস?
– লানা ঘোর লাগা গলায় বলল
– তারপর কি, সত্যিই আমি ভুলে গেছি শাহের। প্লিজ টেল মি…
শাহেরের গলায় এবার চাপা রাগ।
– তোদেরকে খুঁজে পেলাম আমিই। একটা বিপজ্জনক ঢালে দাঁড়িয়ে ইমাদ সানসেটের ছবি তুলছিল, আর তুই…
– আমি কি…?
– তুই ঠিক পেছন থেকে ইমাদকে ধাক্কা মারার জন্য দুহাত বাড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলি। প্রথমে আমি ভাবলাম, মজা করছিস। কিন্তু ঠিক শেষ মুহূর্তে চিৎকার করে তোকে থামিয়ে না দিলে কি যে হত…উফ্….
– তারপর…?
– তুই আমার দিকে যেভাবে ক্রুদ্ধচোখে তাকিয়েছিলি, আমার সত্যিই গলা শুকিয়ে গিয়েছিল। এক মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল, তুই আসলে ঠিক তুই নস, অন্য কেউ….
লানা বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে তাকল কিয়ৎক্ষণ, তারপর হো হো করে হেসে উঠল। সে হাসি কিছুতেই থামে না। থমথমে মুখে তাকিয়ে আছে শাহের। লানা বলল
– আরে, আমিতো মজা করছিলাম। তোর কি মনে হয়, আমি ইমাদকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিতাম? পাগল হয়েছিস? হি ইজ মাই ফিয়ন্সে। তুই পাগল হয়েছিস শাহের…?
শাহের এখনও তীক্ষ্ণচোখে দেখছে লানাকে। বিভ্রান্তিকর হাসি দিয়ে শাহেরকে বিভ্রান্ত করা যায়নি।
– সেটা হলেই ভালো। তবে বি কেয়ারফুল। আমার তোকে ঠিক লাগেনি। আমরা একটা ট্যুরে এসেছি। নিরাপদে সবাই ফিরতে পারলেই খুশি
– অবশ্যই…
শাহের তার গলায় ঝোলানো ক্যামেরা নিয়ে ব্যস্ততা দেখিয়ে চলে গেল অন্যদিকে
মাথা চেপে ধরে বসে থাকল লানা অনেক্ষণ। কিছুই বুঝতে পারছে না সে। তবে শাহেরের গলায় এমন কিছু ছিল যেটা হেসে উড়িয়ে দেয়া যায় না। সে এখানে আসার পর ইমাদের সাথে ভাব জমিয়েছে? আবার ইমাদকে পাহাড় থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিতে চেয়েছে? কোন হিসেবই তো মিলছে না।
ডাব হাতে হাসতে হাসতে ইমাদ চলে এলো একটু পরেই। বলল
– লানা এই নাও তোমার ডাব
ডাব হাতে নিতে নিতে লানা বলল
– তোমাকে অনেক কষ্ট দিলাম ইমাদ, তাই না?
– আরে কি যে বল লানা, তুমি চাইলে এই পাহাড় থেকে আমি শুধু ডাব কেন, আতা, আম, আনারস সব খুঁজে বের করতাম।
বিগলিত হাসল লানা। ইমাদ এসে ঘনিষ্ট হয়ে বসল তার পাশে। ডাবের স্ট্র তে টান দিতে দিতে সে ভাবল, ইমাদের সাথে এত বিগলিত হওয়ার কারণ কি? অপরাধবোধ? ইমাদকে পাহাড় থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিতে চাওয়ার অপরাধবোধ?
লানা হোটেলে ফিরল ক্লান্ত হয়ে। কিছুতেই মন বসছে না তার। জোহার আর মুন সংক্রান্ত দুশ্চিন্তাটা উঁকি দিচ্ছিল থেকে থেকে। যদিও অবান্তর। স্বপ্ন থেকে জেগে ওঠার পর স্বপ্ন ওখানেই থেমে যায়। তবু নিজের স্বামী সন্তানবোধে থেকে থেকে মনটা কেমন উদাস হয়ে যাচ্ছিল লানার। হাসিও পাচ্ছে মনে মনে।
তবু কোথাও যেন খানিকটা খটকা। খানিকটা কিন্তু উঁকি মারছে। সেটা কোথায় বুঝতে পারছে না লানা। দুপুরে লাঞ্চের পর তারা যার যার রুমে ঢুকে বিশ্রাম নেবে কিছুক্ষণ। তারপর বিকেলে আবার বের হবে। এমনই কথা হয়ে আছে। লাঞ্চ করে ফেরার পথে ইমাদ গা ঘেঁষে হাঁটতে হাঁটতে ফিসফিস করে বলল
– আমি আসব নাকি তুমি আসবে?
– মানে?
ইমাদ লাজুক হাসল। বলল
– আহা, প্রশ্ন করে লজ্জা দাও কেন বলতো? আজ বিকেলে কিন্তু তুমি আমার রুমে আসবে।
কথাটা বলে ইমাদ হনহন করে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল লানা। কান দিয়ে আগুনের হলকা বের হচ্ছিল তার। এসব কি বলছে ইমাদ? কি এমন সম্পর্ক হয়েছে তার ইমাদের সাথে যে এই টাইপের কথা বলার সাহস পায় ও?
মেজাজ ও মন দুটোই বিক্ষপ্ত করে লানা নিজের রুমে এলো। দরজা বন্ধ করে ঝাঁপিয়ে পড়ল বিছানায়। নিজের অজান্তেই দুফোটা চোখের জল গড়িয়ে পড়ল গাল বেয়ে। কেন এসব হচ্ছে তার সাথে? কোনটা স্বপ্ন, কোনটা বাস্তব? কোনটা ভালো, কোনটা মন্দ? কেনটা প্রিয় বা কোনটা অপ্রিয়? প্রশ্নগুলো নিজেই নিজের কাছে উত্তর চাইছে যেন।
লানা কাঁদছে, হু হু করে কাঁদছে।
– মম্… মম্….
ছোট্ট, কচি গলায় তাকে ডাকছে কেউ। লানা প্রথমে বুঝতে পারল না কিছু। এই পাহাড়ী কটেজে কচি গলায় মম্ মম্ করে কে কাকে ডাকছে?
একটা ক্ষীণ সম্ভাবনা মনে এসেও ডুবে গেল। মুন তো অনোক ছোট, এমন স্পষ্ট ডাক এখনও শেখেনি। একটু পরে স্পষ্ট গলায় জোহার ডাকল
– সোহা, আর ইউ ফিলিং বেটার নাউ?
লাফ দিয়ে উঠে বসল লানা। এতো জাহারের গলা।
লানা, সোহার ঘরের বিছানায় কেমন জুবুথুবু হয়ে বসে আছে। লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে দেখল আয়নায় নিজেকে। চুলগুলো উস্কুখুস্কু, চোখের নিচে কালি। কেমন ক্রুর চেহারা। গায়ের পোশাকটাও মলিন।
লানা দ্রুত গিয়ে দরজা খুলল। সামনে দাঁড়িয়ে আছে বছর আড়াই, বয়সের একটা বাড়ন্ত শিশু। দুদিকে দুটি লম্বা চুলের ঝুটি। কপালে ছোট্ট একটা টেপ ব্যান্ডেজ। কিছুটা ভীত চোখমুখ। পুতুলের মত দেখতে, এ তো মুন!
পেছনে জোহার, কিছুটা শুকনো, আগের চাইতে। ম্লান হাসি তার মুখে।
– এখন কেমন বোধ করছ সোহা? অতিথিরা চলে এসেছে। মুন অস্থির হয়ে উঠেছে কেক কাটবে বলে। তুমি কী আসতে পারবে? তাহলে তৈরি হয়ে নেমে আসো জলদি।
– কিসের কেক?
– কেন তোমার মনে নেই? আজ ফার্স্ট ডিসেম্বর, মুনের জন্মদিন?
– আজ ফার্স্ট ডিসেম্বর? কোন ইয়ার?
জোহার দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল, বলল
– দুই হাজার বিশ।
লানার মনে পড়ল, সে প্রথম স্বপ্ন দেখা শুরু করেছিল যেদিন, সেদিনটি ছিল উনিশ সালের কোন একটা দিন। দিন এত দ্রুত সামনে এগোচ্ছে? তার বাস্তব জীবন থেকে কিছুটা পেছনে এসে সে আবার সেই সময়ের দিকে ছুটছে। এটা কি কোন নিয়মানুযায়ী ঘটছে?
মুনকে বেশ বড়সড় লাগছে। এইতো কাল রাতে কটে শুয়েছিল, ফিডারের জন্য চিৎকার করে কাঁদছিল। লানা ফিরে গিয়েও শান্তি পাচ্ছিল না ছোট্ট, ক্ষুধার্ত মুনের মুখটা মনে করে।
লানা এগিয়ে গিয়ে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল মুনের সামনে। দু’হাত প্রসারিত করে আচমটা বুকে জড়িয়ে ধরল মুনকে। আহ কি শান্তি, কি নিশ্চিন্ত লাগছে এখন!
( চলবে)