#একটা_সাধারণ_গল্প
#পর্ব_এক
#সঞ্চারী_চ্যাটার্জী
সময় তখন ছয়টা বেজে কুড়ি মিনিট।
গায়ে মোটা সোয়েটার,মাথা -কান মাফলারে ঢেকেও কাঁপতে কাঁপতে সাইকেল চালাতে চালাতে মহিমের সাইকেল এসে থামলো একটা হলুদ রঙের রঙচটা একতলা বাড়ির সামনে। নেমপ্লেটে লেখা ঘোষভবন।
ডানহাতে যেন সার নেই।তবুও আবারো বেল বাজালো ও।
সাথে সাথে হেলেদুলে বেরিয়ে এল শুভদ।
পরনে একটা পাতলা সোয়েটার।মাথায় কোন আবরণ নেই।
-কিরে এত ডিসটার্ব করিস কেন?
-ডিসটার্ব?আমি?
-হুম,দেখছিস না আমার টমি কাঁচা ঘুমে উঠে গেল।
-ন্যাকরাবাজি ছাড়,কি খাস যে তোর ঠান্ডা লাগে না..
-ঠান্ডা তোর মতন বুড়োর লাগে আমার না।
সিস দিতে দিতে সাইকেলে উঠলো শুভদ ঘোষ।
ওর সাথে সঙ্গ নিল মহিমও।
-কি ঠান্ডা!
-স্যারের বাড়ি যেতে আর কতবার বলবি?
-শীতকালে কেমন মুখ থেকে ধোঁয়া ওঠে।যেন বিড়ি খেয়েছিস।
-বিড়ি কেন,খেলে সিগারেট খাব।
-থাক শুভ তুমি আর বোলো না।পুজোতে একটান দিয়ে কেমন কেশেছিলে মনে নেই।
-সে তো প্রথমবার ছিল। পরেরবার দিব্যি ম্যানেজ হয়ে যাবে।
-এই শুভ স্যারের বাড়ির সামনে চারচাকা থামলো কেন রে?
বকতে বকতে দুই সখা তখন রথীন স্যারের কোচিং -এর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।
চারচাকা থেকে একটা লাল রঙের লং কোটে আবৃত একটা ওদেরই সমবয়সী মেয়ে ঢুকলো ওদের স্যারের ঘরে।
-বাব্বা!মালটা বেশ বড়লোক রে..
-ওরে আমার গা গরম হয়ে গেল যে!চল চল ঐ সুন্দরীর সাথে পরিচয় করি..
কে তুমি নন্দিনী আগে তো দেখিনি।
রথীন স্যারের বাড়ি থেকে প্রায় দশ হাত দূরে ছিল ওরা।
ওখানেই সাইকেল থেকে নেমে পড়লো শুভদ।
সাইকেলটাকে হাঁটিয়ে নিয়ে গিয়ে দেওয়াল ঘেষে রাখলো ও।
পূর্বের অবস্থানে দাঁড়িয়ে শুভকে হাঁ করে দেখছিল মহিম।
মহিমকে লক্ষ্য না করে দ্রুততার সাথে ঘরে ঢুকছিল শুভ।
-এইই!
চিৎকার করে ডাকলো মহিম।
-কি হল এত চেঁচাছিস কেন?
দাঁত কিরমির করলো মহিম। স্থান-কাল বিবেচনা করে চার অক্ষরের গালাগালিটা সশব্দে উচ্চারণ করতে পারলো না ও।
-ভেতরে ঢুকতে তো যাচ্ছিস সাইকেলের চাবি দিয়েছিস কি?
-তুই আছিস কি করতে!
দুহাত দিয়ে চুল ঠিক করে ঢুকে গেল শুভ।
শুভ জানতো কাটায় কাটায় সাড়ে ছয়টায় কখনো রুমে ঢোকে না রথীন স্যার। আজ যে স্বমহিমায় সেখানে উপস্থিত হবে সেই ধারণা কি ছিল!
স্যারকে দেখে আবার ঘর থেকে বেরলো শুভ।
-স্যার আসবো?
-চলেই তো এসেছিলিস হতভাগা আবার গেলি কেন?
রথীন স্যারের কথায় ভিতরে হাসির রোল উঠলো।
ততক্ষণে মহিমও ওর পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে,শুধু দাঁড়ায়নি সাথে দাঁত ও ক্যালাচ্ছে।
ভষ্ম করার দৃষ্টিতে মহিমের দিকে তাকিয়ে আবার মাথা নিচু করে ঘরে ঢুকলো শুভদ।
বারো ফুট বাই ষোলো ফুট ঘরের মেঝে জুড়ে চটের বস্তা পাতা।
নিজের নির্ধারিত জায়গায় বসলো শুভ। পাশেই মহিম। এট্রিটা এতটা খারাপ হবে ভাবেনি ও।
– মাধ্যমিকে কত উঠেছিল ভূগোলে?
-93 স্যার।
-বাহ! ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি আছে?
-ভূগোলে অনার্স।
-বলাটা সহজ কিন্তু ভূগোলে অনার্স ব্যাপারটা সহজ নয়। উচ্চমাধ্যমিকে 95 পেতেই হবে।
তোরা মেয়েগুলো ভালো রে ছেলেগুলো তো এক একটা বাঁদর।
রথীন স্যারের ব্যাচে আগে ছেলে-মেয়েরভাগ সমান সমান ছিল।
আজ ঐ নবাগতার কারণে ছেলে-মেয়ের সংখ্যাটা ছয়- সাতে এসে দাঁড়ালো।
মেয়েগুলো শব্দ করে হেসে উঠলো। হাসিতে যোগ দিল ঐ নবাগতাও।
সরাসরি সেই কন্যার দিকে তাকানোর সুযোগ পেল শুভ। সামান্য চোয়াল খুলতেই গজদন্ত বেরিয়ে পড়েছে ওর।
চোখ দুখানি আয়তনে মাঝারি হলেও সরু সরু টানাটানা। নাকটা সামান্য বসা।অত্যাধিক ঠান্ডায় মুখাবয়ব রক্তিম। বিশেষকরে নাকের ডগাটা।
মজাকরে এতক্ষণ সুন্দরী বলছিল। এতো সত্যিই তাই!
ইস! এখনো নামটা জানা হল না।
কোন ইস্কুলে পড়ে কি জানি!
হঠাৎ সেই কন্যার চোখ পড়লো ওর দিকেই।
ওর ক্যাবলা তাকানোতে ওই কন্যার হাসি মিলিয়ে গেল।
বাধ্য হয়েই দৃষ্টি ঘোরালো শুভম।
-মালটা তো হেব্বি দেখতে!
-মাল কিরে সম্মান দিয়ে কথা বলবি,মহিম ও তোর বৌদি হয়।
-উরিব্বাস! এ তো গাছে না উঠতেই এক কাঁদি!
বোকা*দা ও তো অন্য কারুর লাভার হতেই পারে।
-হতে পারে কিন্তু থাকবে না।
আমিই ওকে ভালোবাসি।লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট বলতে পারিস।
-কটা বাজে রে?
-কেন তুই ঘড়ি দেখে কি করবি?
-ছয়টা ঊনচল্লিশ,মানে তোর প্রেমের বয়স হল চোদ্দো মিনিট তোর প্রেমের বয়স হল।
-এগারো মিনিট কেন,এগারো বছর হবে তখনও আমাদের প্রেমের গাড়ি চড়চড়িয়ে চলবে।
-তোর ভাট বকা রাখবি!
কটমটিয়ে তাকালো মহিম।
-আআ!
মহিম তাকিয়ে দেখে কপালে হাত বোলাচ্ছে শুভ।
ওদের সামনেই পড়ে আছে অর্ধেক চক।
সেই সাথে রথীন স্যারের বাক্যবাণ ছুটে আসছে ওদের দিকে।
-আর একটা শব্দ শুনলে ক্লাস থেকে বের করে দেব তোদের।
হতচ্ছাড়া গুলো!নে বই বের কর।
ছেলেদের ঐ নামে সম্মোধন করে খুশি হয় রথীন স্যার।
অন্যদিন হলে শুভ মনেমনেই বারদশেক রথীন স্যারের মুন্ডপাত করত,আজ যেন অন্য মুডে আছে, শত অপমানও ও গায়ে মাখছে না।
-পর্ণা! তোর কাছে এক্সট্রা পেন আছে,আমারটা কালি সরছে না।
-হ্যাঁ আছে।দিচ্ছি..
মাম্পির প্রশ্নে নামটা জানা হল শুভদের।
“পর্ণা! আহা কি মধুর নাম।” মনে মনে আওড়ালো শুভ।
-নামটার মতন মেয়েটা কি মিষ্টি তাই না!
ফিসফিসিয়ে মহিমকে বলল ওর পাশে বসা এক সহপাঠী।
কথাটা কর্ণগ্বহরে প্রবেশ করলো শুভরও।
স্যারের বকুনিকে উপেক্ষা করে মহিমকে টপকে ঐ ছেলেটার কানে কানে বললো,
-ও কিন্তু আমার। তোরা নজর দিস না..
-হ্যাঁ বে নতুন কেউ এলেই তোর হবে।
-এই তোরা আবার গুজুর গুজুর ফুসুর ফুসুর শুরু করেছিস,এত বলেও তোদের লজ্জা নেই।
রথীন স্যারের হুংকারে দুইপক্ষই চুপ করল।
-পর্ণশ্রী তোর কাছে ভাঁজ,চ্যুতির চ্যাপ্টার ক্লিয়ার তো?
ঘাড় হেলালো পর্ণা।
-মহিম,এই নামটাতো নলেন গুড়ের রসোগোল্লার মতন কিউট।
যে উদ্ভিদ বছরের একটা নিদিষ্ট সময়ে পাতা ঝরিয়ে আবার নতুন ভাবে ফুল-ফলের সৃষ্টি করে তাকে পর্ণমোচি উদ্ভিদ বলে।
পর্ণার অভিমুখে তাকিয়ে একদৃষ্টিতে কথাগুলো বললো শুভদ ঘোষ।
-তোকে আমি এটা জিজ্ঞাসা করেছি?
রথীন স্যারের কাছে ব্যাপারটা বোধগম্য না হলেও, ওকে উদ্দেশ্য করেই যে বলেছে সেটা ভালোই বুঝতে পারল পর্ণা।
রাগত দৃষ্টিতে তাকাল শুভর অভিমুখে।
আবারো ক্যাবলা হাসলো শুভদ।
চলবে: