#বিকেলের_মৃত্যু (পর্ব – ৬)
লেখক: শামীমা জামান
রুকাইয়া লিয়ার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। লিয়া নিজেকে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক রাখতে চাইল। কারণ রুকাইয়া ভয়ানক ধূর্ত মহিলা, সে সব কিছুই সহজে বুঝে যায়। সে আসলে কোন কিছু জানার উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করে না, পুলিশের মত আসামিকে সরাসরি জেরা করে। লিয়া নিজেকে সামলে নিয়ে বলল-
-এটা ঈদ কার্ড, সুমি ঝুমি দিয়েছে।
-দেখি?
লিয়া খাম থেকে কার্ড বের করে তার হাতে দেয়। রুকাইয়া কার্ডটা দেখে লিয়াকে ফিরিয়ে দিয়ে কিছু না বলে তার অফিসের উদ্দেশ্যে বের হয়ে যায়। লিয়া তখন হাফ ছেড়ে বাঁচল যেন।
চিঠি এমন একটা ভালোলাগার জিনিস যে, যতক্ষণ এটা পড়া না হবে ততক্ষণ মনে শান্তি নেই। কী আশ্চর্য রকম তীব্র এক অপেক্ষা কাজ করে এক টুকরো কাগজের ভাজ খুলে কারো মনের কথা জানবার জন্য! লিয়ার এই অপেক্ষা শেষ হয় রাতে সবাই ঘুমিয়ে গেলে। সে আস্তে করে চিঠিটা বের করে পড়তে শুরু করে… ছোট্ট কাগজটার কালো কালো আঁকিবুঁকি আস্তে আস্তে ভাষা হয়ে ওঠে… ভালোবাসা আর অভিমানে জড়ানো অনুভূতির কী সুন্দর বহিঃপ্রকাশ! লিয়ার কষ্ট হয়… “ভালোবাসা” নামক শব্দটার সাথে তার কতকাল কোন সাক্ষাৎ নেই! মা চলে গেছে সাথে করে তার জীবনের পাওনা সকল ভালোবাসাও যেন সাথে করে নিয়ে গেছে! আর তার বাবা? তার ভালো থাকা, মন্দ থাকায় বাবার আদৌ কী কোন ভাবনা হয়? বাবার কাছে তো সে অদৃশ্য এক স্বত্বা! ভালোবাসা বিহীন রুক্ষ জীবনে ছোটবোন এক রুবাই আছে যে তাকে একটু ভালোবাসা দেবার চেষ্টা করে। সুখ দু:খের টুকিটাকি গল্পগুলো কুটুরকুটুর দুই বোনে ভাগাভাগি করে নেয়। যদিও রুবা অনেক ছোট, অনেক কিছুই সে বোঝে না, লিয়াকে সেসব হিসেব করেই চলতে হয়। কিন্তু এই রুবা মেয়েটা তার সারাদিনের একটু ভালো লাগার জায়গা যেখানে সে দুদন্ড মন খুলে বসতে পারে। রুবাও লিয়াকে ছাড়া কিছুই বোঝে না। বোনের ভালোবাসা হয়ত এমনই হয়। রুবা না থাকলে ভালোবাসা শব্দটাকেই হয়ত লিয়া ভুলে যেত! ভালোবাসার কাঙ্গাল লিয়ার দরজায় আজ যে ভালোবাসা এসে উপস্থিত হয়েছে সে ভালোবাসা গ্রহণ করবার সাধ্যও যে তার নেই! তার বুকের ভেতর থেকে চাপা কষ্ট ঠেলে বেরিয়ে আসতে চায়… সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চিঠিটা ভাজ করে খুব যত্ন করে লুকিয়ে রাখে। কেন রেখে দেয় সে জানে না… সে জানে কেবল, তার কিছু পাওয়ার বা চাওয়ার ক্ষমতা নেই।
পরদিন সে পারতপক্ষে ঘর থেকে বের হয় না। সে চায় না কোনভাবে আরিফুলের সামনে পড়তে। সুমি ঝুমি এলে তাদের সাথে ঘরেই সময় কাটায়। সুমি ঝুমি তাকে নিয়ে বেড়াতে যাবার প্ল্যান করে। ঈদের সময় একটু ঘোরাঘুরি না করলে চলে? তারা ঠিক করে পরদিন বিকেলে সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে বেড়াতে যাবে।
বাঙালি মেয়েদের পরিপূর্ণ সৌন্দর্য প্রকাশ পায় শাড়িতে। লিয়া আজ শাড়ি পরেছে। মনের খেয়াল অনুযায়ী সেজেছেও। সুমি ঝুমিও শাড়ি পরে সেজেগুজে তৈরি হয়ে চলে এসেছে।কিশোরী বয়সে দলবেঁধে শাড়ি পরে ঘুরে বেড়াবার মজাটা অন্যরকম। নিজেকে আকাশে উড়তে থাকা রঙিন প্রজাপতি মনেহয়। সবার দৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবে ভাবতেই ভালো লাগে। সুমি ঝুমি আসতেই লিয়া ওদের নিয়ে বের হয়ে যায়। বের হতেই আরিফুলের ছোট ভাইয়ের সাথে দেখা। সে লিয়াকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে গিয়ে মুগ্ধ নয়নে বলে-
-“লিয়া, তোমাকে তো খুব সুন্দর লাগছে!”
-লিয়া তৎক্ষণাৎ উপরে তাকিয়ে দেখে বারান্দায় আরিফুল দাঁড়িয়ে আছে, আর সে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। সে তখন তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ইন্টারে পড়ুয়া আসিফের দিকে তাকিয়ে মুচকি একটা হাসি দিয়ে “thank you” বলে চলে আসে। লিয়া মনে মনে মুচকি হাসে এটা ভেবে যে, “তবে কী এরা দুই ভাই-ই তার প্রেমে পড়ে গেল!”
সাধারণ লিয়াকে দেখেই যেখানে আরিফুলের জগৎ থেমে যায় সেখানে আজ তাকে এই বেশে দেখে তার হার্টবিট কয়েকটা মিস গেল। বুকের বা’পাশটায় সুখের চিনচিনে ব্যথা করে উঠল। মেয়েটা তো তাকে বেশামাল করে দিচ্ছে! বাঁচতে দিবে না নাকি? নাহ্, লিয়ার সাথে তার কথা বলতে হবে এবং আজই। আজ তাকে “হ্যাঁ” বলতেই হবে। সে লিয়ার পিছু রওয়ানা হয়ে গেল।
সুমি ঝুমিকে নিয়ে লিয়া স্মৃতিসৌধে পৌঁছে দেখে আরিফুলও সেখানে হাজির! তাকে দেখে সবাই খুব অবাক। সুমি ঝুমি প্রায় চিৎকার করে বলে-
-আরে চাশমুদ্দিন এখানে কী করে?
লিয়া চাপা গলায় বলে- “আস্তে বল, আমি কী জানি এখানে কী করে? মনেহয় তোদের দেখতে ছুটে এসেছে।” বলেই সে ফিক করে হেসে দেয়।
সুমি ঝুমি তখন হাসতে হাসতে বলে আহারে তাই যদি হত…। কিন্তু মি. চাশমুদ্দিন হক দিওয়ানা সাহেব যে কার জন্য ছুটে এসেছে তা কী আর আমরা জানি না?
ওদিকে আরিফুল তখন কোন কিছুর তোয়াক্কা না করে সোজা তাদের সামনে এসে সুমি ঝুমিকে উদ্দেশ্য করে বলে-
-তোমরা একটু আগে হাঁটো তো, লিয়ার সাথে আমার কথা আছে।
-লিয়া বিব্রত হয়। বলে, “আপনার সাথে আমার কোন কথা নেই, আপনি এখানে কেন এসেছেন? কেউ দেখলে আজেবাজে কথা হবে। চলে যান।”
কিন্তু আরিফুল সেসবে পাত্তা না দিয়ে সুমি ঝুমিকে বলে, “তোমাদের বললাম না আগে হাঁটো? খাম্বার মত দাঁড়িয়ে থাকলে কেন, যাও?”
সুমি ঝুমি ধমক খেয়ে কথা না বাড়িয়ে হাঁটতে থাকে। আরিফুল তখন লিয়ার সাথে পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করে- “কই, আমার চিঠির কোন উত্তর দিলে না যে?”
-আপনি বুঝতে পারেন না উত্তর কী হবে?
-না, বুঝি না। তোমার কাছ থেকে সরাসরি শুনতে চাই।
-আমি তো “না” বলেছি আর কী বলব?
আরিফুল তখন অধৈর্য হয়ে বলে- টেপ রেকোর্ডারের মত বার বার একই গান বাজাবে না।
-আর আপনিও টিভির এ্যাডের মতন যখন তখন যেখানে সেখানে আমার আশেপাশে হাজির হয়ে যাবেন না।
-তোমার জানা থাকা উচিত যে, ভালো জিনিসেরই বিজ্ঞাপন হয়। দেখো, আমি এখানে “না” গান শুনতে আসিনি। তোমাকে তো “হ্যাঁ” বলতেই হবে। এখন সেটা এখনই বলবে নাকি আরও ৫মিনিট ঘ্যানঘ্যান প্যানপ্যানানি করতে হবে?
-দেখুন, আপনি খুব ভালো করেই আমার সম্পর্কে জানেন… আপনি যা ভাবছেন তা কোনভাবেই সম্ভব না। আমার আম্মুকে তো জানেন, তিনি কখনোই এটা হতে দিবেন না। সব কিছু জেনেও কেন এসব বলেন?
-কেন বলি সেটা তো না বোঝার কিছু নেই। আর আমাকে এসব অজুহাত দেখিয়ে কোন লাভ হবে না।
-আপনি শুধু শুধু জেদ করছেন। যার কোন পরিণতি নেই সেটাতে কেন জড়াবেন? চলে যান আপনি।
-চলে যাবার জন্য বা “না” শুনবার জন্য আমি আসিনি।
লিয়া কাতর গলায় বলে- কেন বুঝতে চাচ্ছেন না যে,আপনি যা শুনতে চান তা বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়?
-তুমি এত ভয় পাচ্ছ কেন? তুমি চাইলে কিছুই অসম্ভব না।
লিয়া তখন কী করবে বুঝতে পারছিল না… তখন সে আরিফুলের কাছে সময় চাইল। আরিফুল এতে খুশিই হল। কারণ সে জানে সময় সব কিছুই ঠিক করে দেয়। লিয়ার হৃদয়ে ঝড় তুলে দিয়ে সে সবাইকে আইসক্রিম খাওয়াতে নিয়ে যায়। আইসক্রিমওয়ালার কাছে গিয়ে বলে-
-মামা দুইটা আইসক্রিম দিন। তারপর সুমি ঝুমির দিকে তাকিয়ে বলে তোমাদের জন্য কোন আইসক্রিম নেই। আমি আসবার পর তোমরা আমাকে কী বলে ডাকছিলে সেটা শুনিনি ভেবেছ? এখন চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে আমাদের খাওয়া দেখবে। এটাই তোমাদের শাস্তি।
সুমি ঝুমি তখন মুখটা করুণ করে লিয়ার দিকে তাকায়। লিয়া অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আরিফুলের দিকে। এটা কী হল?
-কী হল আবার? পানিশমেন্ট হল।
-লিয়ার মুখ থমথমে হয়ে গেল। সে ব্যাপারটা কিছুতেই মেনে নিতে পারল না।
আরিফুল তখন হাসতে হাসতে বলল- আরে একেকটার চেহারা দেখো… আমি তো জাস্ট ফান করছিলাম। অবশ্যই তোমরাও আইসক্রিম খাবে। সবাই তখন রিল্যাক্স হয়ে যায়।
সবাই পছন্দমতো আইসক্রিম ওর্ডার করতেই আরিফুল বলে- আচ্ছা ভালো কথা, তোমরা আমার নামে কী বলছিলে তখন বলো তো? আমি বলতেই এমন ভয় পেয়ে গেলে যে?
ওরা ৩জন তখন একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে লাগল… কিছু না পেয়ে কথা ঘুরাবার জন্য ঝুমি বলল- ভাইয়া লিয়াকে আজ খুব সুন্দর লাগছে না?
-আরিফুল আড়চোখে একবার লিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল- তাই নাকি? কই দেখিনি তো!
লিয়া তখন নাক ফুলিয়ে বলল- আমি আমার জীবনে এত বাজে আইসক্রিম কোনদিন খাইনি। ধুর… মুখটাই নষ্ট!
বাকি ৩জন তখন হা হা হা করে হাসতে লাগল। তারপর আরিফুল ওদের বেড়াবার জন্য ছেড়ে দিয়ে চলে আসে। বাকিরা ঘুরেফিরে তারপর বাসায় আসে। কিন্তু লিয়া ভেতরে ভেতরে পড়ে যায় ভাবনায়…
স্কুলের পাশাপাশি লিয়া সপ্তাহে ৩দিন করে তার স্কুলের ইংরেজি আর গণিত শিক্ষকের কাছে ব্যাচে পড়তে যেত। সকালে পড়ে তারপর স্কুলে চলে যেত। সেদিন স্মৃতিসৌধ থেকে ঘুরে আসার পর পড়তে যাবার পথে সে প্রতিদিনই আরিফুলকে পথে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখত। মাঝে মাঝে দুই/চারটা কথাও হত এর বেশি কিছু না। কিন্তু এই সামান্য ব্যাপারটাই একদিন ইংরেজি শিক্ষকের নজরে পড়ে যায়! লিয়া ভয় পেয়ে যায় কারণ এই স্যারের সাথে লিয়ার বাবার খুব ভালো একটা সম্পর্ক আছে। পারিবারিক ভাবেই সম্পর্ক ভালো। লিয়া তখন আরিফুলের সাথে কথা বলাটা বন্ধ করে দেয়। সে অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেয় আরিফুলের সাথে এসব আসলে তার পক্ষে সম্ভব না। সে আরিফুলকে স্পষ্টভাবে সেটা জানিয়ে দেয়। আরিফুল তাকে অনেক বোঝাবার চেষ্টা করে কিন্তু তার কোন কথাই সেদিন আর লিয়া কানে তোলে না।
আচমকা লিয়ার এমন সিদ্ধান্ত আরিফুলকে ভেঙে ফেলে ভেতর থেকে। সে এক আকাশ সমান অভিমান নিয়ে নীরবে প্রস্থান করে। লিয়ার সাথে আরিফুলের বয়সের যে ব্যবধান সেখান থেকে লিয়া আসলে বুঝতেই পারছে না আরিফুলের ভালোবাসাটা কোন ছেলেখেলা নয়। কোন মোহ থেকে আরিফুল তার প্রেমে পড়েনি। সে সত্যিকার অর্থেই তাকে মন দিয়ে বসেছে। আরিফুলের মত ছেলেরা এক নারীতেই আসক্ত হয়। তারা চাইলেই কাউকে দিয়ে দেয়া মন তুলে নিতে পারে না। একই মনে কয়েকজনকে জায়গা দিতে পারে না।
সেদিনের পর থেকে পুরো দুই বছর চলে গেছে আরিফুলের সাথে লিয়ার কোন রকম কথা বা যোগাযোগ হয়নি। লিয়া মাঝে মাঝে স্কুলে যাবার পথে দেখত ব্যাগ কাঁধে নিয়ে ভার্সিটি যাবার জন্য দাঁড়িয়ে আছে আরিফুল। তাকে দেখা মাত্রই বাসে উঠে চলে যেত। লিয়া বেশ বুঝত অপেক্ষাটা বাস নয় তার জন্যই ছিল। আরিফুলের এই নীরব চাহনি, নীরব প্রস্থান লিয়ার মনে গভীর আঁচড় কেটে যেত।
দুই বছর দীর্ঘ একটা সময়। এই দীর্ঘ সময় দূরে থেকেও লিয়ার প্রতি আরিফুলের অনুভূতির কোন পরিবর্তন হয়নি! সে সিদ্ধান্ত নেয় লিয়ার সাথে আবার কথা বলবে।
২০০৭ সাল, লিয়ার তখন সামনে টেস্ট পরীক্ষা। কিছুদিন পরেই এসএসসি দেবে। সে নিয়মিত কোচিং এ যায়। কোচিং এ যাবার পথেই একদিন আরিফুল এসে হাজির হয় তার সামনে। দৃঢ় কন্ঠে বলে- “লিয়ার সাথে তার কথা আছে এবং সেটা তাকে শুনতেই হবে। লিয়ার কোন বাহানা শুনতে সে নারাজ। আজ তাকে সময় দিতেই হবে।”
আরিফুলের কথায় জেদ এবং অনুনয় দেখে এক প্রকার বাধ্য হয়েই লিয়া তার কথা শুনতে রাজি হয়। কোচিং ফাঁকি দিয়ে সে আরিফুলের সাথে রিকশা নিয়ে সোজা জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে চলে যায়। সেখানে পৌঁছে আরিফুল লিয়াকে কিছু উপহার দেয়। উপহার পেয়ে লিয়া বলে-
-এসব কেন দিচ্ছেন? আপনি জানেন না আমি এসব নিতে পারব না?
-জানি… তবু ইচ্ছে করে তোমার জন্য কিছু করতে… তোমাকে নিয়ে আমার কতটা ইচ্ছে জাগে, ভালো লাগে সেটা যদি তোমাকে বোঝাতে পারতাম…?
আরিফুলের এভাবে বলায় লিয়ার কেমন মায়া হল… সে জিজ্ঞেস করল-
– কী আছে এতে?
-খুলে দেখ?
লিয়া ব্যাগ হাতে নিয়ে খুলে প্রথমেই খুব সুন্দর একটা শো-পিস বের করল। কাঁচের বলের ভেতর একটা কাপল ডান্স করছে। এরপর একে একে একটা আংটি, গহনার সেট আর একটা ব্রেসলেট বের করল। সবগুলো জিনিসই লিয়ার খুব পছন্দ হল। লিয়াকে কেউতো কখনো এভাবে ভালোলাগার অনুভূতি দিতে চায়নি! আজ যখন কেউ নিজে থেকে দিতে চাইছে তখন সে অপারগ। লিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেকে শক্ত করে বলল-
-এবার বলুন কী বলতে এভাবে ধরে এনেছেন আমাকে?
-কী বলতে চাই সেটা তোমার অজানা নয়। তোমার কথামত আমি দুটো বছর তোমার থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছি। অথচ একদিনের জন্য, একটা মুহূর্তের জন্যও তোমাকে ভুলে থাকতে পারিনি আমি। আমি আগের মতই রোজ তোমাকে লুকিয়ে দেখে গেছি। আমি না ঘুমাতে পারি, না জেগে ভালো থাকি। প্রতি মুহূর্তই তুমি চলে আসো গুটিগুটি পায়ে… তোমার অদৃশ্য উপস্থিতি আমাকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকে সারাটাক্ষন। আমি কী করব বলো তো?
আরিফুলের এমন অসহায় অনুরক্তিতে লিয়ার কষ্ট হয়। কিন্তু কী করবে লিয়া? সে জানে এর পরিণতি কখনো ভালো হবে না। তার সৎ মা যদি কখনো জানতে পারে তাহলে তার জীবন অতিষ্ঠ করে ফেলবে। শুধু তার জীবনের ব্যাপার হলেও সমস্যা ছিল না সে সয়ে নিতে পারত কিন্তু তিনি তো আরিফুল বা তার পরিবারকেও ছাড়বে না! তারা সম্মানি মানুষ… তাদের সম্মান নিয়ে লিয়া খেলতে পারে না। আর তার নিজের এমন একটা পরিবার দেখে, জেনে কে রাজি হবে তাকে পুত্রবধূ করে নিতে? তার জীবনে যে-ই আসুক না কেন তাকে এটা মেনে নিয়েই আসতে হবে যে, শ্বশুরবাড়িতে জামাই আদর বলে সে কিছুই পাবে না। কোন ছেলে বা তার পরিবার নিশ্চই এমন একটা পরিবারে আত্মীয়তা করতে আগ্রহী হবে না? তাই সে নিজের বাক্যে অনঢ় থেকে আরিফুলকে আবার বোঝাতে চাইল কিন্তু আরিফুল কোন কিছুই শুনল না। আর কী বললে, কীভাবে বললে লিয়া বুঝবে তাকে ছাড়া আরিফুলের চলবে না? নিজেকে এতটা অসহায় লাগছিল যে, একটা পর্যায়ে সে কেঁদে ফেলে! নিজেকে পুরোপুরি ভেঙেচুরে লিয়ার কাছে আত্মসমর্পণ করে।
পুরুষ মানুষের ভেঙে পড়ার মত হৃদয়বিদারক দৃশ্য হয়ত পৃথিবীর আর কিছুতে নেই। তাছাড়া “পৃথিবীর সকল দাবী উপেক্ষা করা গেলেও ভালোবাসার দাবী উপেক্ষা করা যায় না”… তাই বুকে চাপা সংশয় আর শত দ্বিধা নিয়ে লিয়াকে “হ্যাঁ” বলতেই হল। এই সংশয়, দ্বিধা আরিফুলের ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে নয়, এটা এই ভালোবাসার পরিণতিকে কেন্দ্র করে।
লিয়া “হ্যাঁ” বলতেই আরিফুল যেন দেহে প্রাণ ফিরে পেল। তার ইচ্ছে হল লিয়াকে একবার শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে। তার বুকে কান পেতে লিয়া জানুক, এই বুকের ভেতর মস্ত আকাশ আছে, যে আকাশ শুধুই লিয়ার জন্য। সেখানে সে নিজের খেয়ালে মনের খুশিতে ডানা ঝাপটাবে, উড়ে বেড়াবে… কেউ শেকল পরাতে পারবে না।
সেদিনের পর দুজনের সম্পর্কের সুতোটা নতুন করে জোড়া লাগল। ভালোবাসার গভীরতা বাড়তে শুরু করল। কোচিং এ যাবার পথে আসার পথে দেখা হত সাথে অল্প কথাও হত। লিয়ার আম্মু রুকাইয়া যখন বাইরে যেত তখন ঘরে লিয়ার জন্য একটা ফোন রেখে যেত। তাই আম্মু বাইরে যাবার পর এবং রাত ১২টার পর লিয়ার সাথে আরিফুলের কথা বলার সুযোগ হত। আরিফুল লিয়ার মায়ের ব্যাপারে জানত বলেই লিয়া ফোন না দিলে সে কখনো ফোন দিত না। তাছাড়া রুবা লিয়ার সাথে লিয়ার ঘরেই থাকত। তাই রুবা না ঘুমানো পর্যন্তও লিয়াকে অপেক্ষা করতে হত। প্রতিদিন রাতে সবাই ঘুমিয়ে গেলে ১২টার পর কথা বলত ওরা। বলবার জন্য লিয়ার কাছে থাকতই বা কী? সারাদিনের পরিশ্রম আর আম্মুর বকুনি ছাড়া তার জীবনে বলবার জন্য বাড়তি কোন বিষয় ছিল কী? দিন শেষে লিয়ার যত দু:খ কষ্ট যন্ত্রণা ভাগ করে নেবার জন্য আরিফুলই যোগ্য বন্ধু হয়ে উঠল। আরিফুল চেষ্টা করে যেত লিয়াকে যতটা সম্ভব মানসিক সাপোর্ট দিয়ে যাবার। তাদের মাঝে আলাপের পুরোটা জুড়েই থাকত লিয়ার প্রতিদিনের বিষাদের গল্প। লিয়ার কান্নায় রাতের নিস্তব্ধতা চিরে কিছু সময়ের জন্য পুরো পৃথিবী থেমে যেত আরিফুলের কাছে।
এভাবে তাদের সম্পর্ক বেশ ভালোই এগিয়ে যাচ্ছিল। ফোনে কথা বলার পর লিয়া সব সময় নাম্বারটা ডিলিট করে রাখত। কোন অবস্থাতেই আম্মুর হাতে পড়া যাবে না নাম্বারটা। কিন্তু কথায় আছে না, “১০দিন চোরের আর একদিন গেরস্তের”? লিয়ার ব্যাপারটাও তাই হল, একদিন রাতে কথা বলার পর লিয়া আরিফুলের নাম্বারটা ডিলিট করতে ভুলে যায়। পরদিন রুকাইয়া অফিসে যাবার আগে ফোন হাতে নিলে নাম্বারটা চোখে পড়ে। সে আনমনেই নাম্বারটায় একটা মিসকল দেয়। মিসকল দিতেই আরিফুল ধরে নেয় লিয়ার আম্মু অফিসে চলে গেছে। তাই সে কল ব্যাক করে। রুকাইয়া ফোন রিসিভ করতেই আরিফুল বলে-
-কী ব্যাপার আম্মু বাসায় নেই? আজ এত তাড়াতাড়ি অফিসে চলে গেছে!
রুকাইয়ার কান ঝা ঝা করে ওঠে। কী শুনছে সে এসব? তার মানে সে বাসায় না থাকলে লিয়া কারো সাথে কথা বলে? সে জিজ্ঞেস করে, “কে তুমি?”
প্রশ্ন শুনে আরিফুল মুখের হাসি উবে যায়। ফোনটা কী তাহলে লিয়ার মা ধরেছে? সে ভয় পেয়ে কোন কিছু না বলে দ্রুত লাইন কেটে দেয়।
রুকাইয়া তখন লিয়াকে নিয়ে মুখোমুখি বসে প্রশ্ন করে, কে এই ছেল?
-লিয়ার দম বন্ধ হয়ে আসে… সে বুঝতে পারছে এখন আর চেপে রেখে লাভ নেই। তাছাড়া রুকাইয়ার জেরা মানে পুলিশের চেয়ে তা কোন অংশে কম নয়। তাই লিয়া চুপ না থেকে সবটা তার আম্মুকে বলে দেয়।
রুকাইয়া চুপচাপ শুনে নেয়। তার অফিসে যাবার সময় হয়ে যাচ্ছে তাই সে কোন কিছু মন্তব্য করে না। কিন্তু সে বের হতে যাবে এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে উদভ্রান্তের মত হাজির হয় আরিফুল! আরিফুলকে দেখে লিয়া বুঝে যায় ধরা পড়ে বকা খাবে বলেই আরিফুল চলে এসেছে যাতে একটু হলেও ম্যানেজ করতে পারে সে। রুকাইয়া আরিফুলকে দেখে ভেতরে আসতে বলে। আরিফুল ভয়ে ভয়ে ভেতরে আসে। কিন্তু রুকাইয়া তাকে এ প্রসঙ্গে কিছুই বলে না। তিনি স্বাভাবিক কথাবার্তা বলে অফিসের জন্য বের হয়ে যায়। আরিফুলও তার সাথে বের হয়ে যায়। ওরা চলে যেতেই লিয়া নিজেকে নিয়ে ভাবতে শুরু করে… রুকাইয়া এখন চুপচাপ আছে তার মানে এই নয় যে এটা নিয়ে তিনি কিছুই বলবেন না বা করবেন না। পরিস্থিতিটা ঠিক ঝড় আসার পূর্ব মুহুর্তে যেমন থমথমে হয় তেমন। তিনি এটা নিয়ে ঠিক কতটা ঝড় তুলবেন সেটাই এখন দেখার বিষয়!
লিয়ার সমস্ত দিন কাটে সন্ধ্যায় বাবা আর আম্মু আসার পর কী হবে সেই ভাবনায়। আরিফুল এর মাঝে একবার ফোন করে খোঁজ নেয় লিয়ার। লিয়ার কথায় চাপা ভয় দেখে “কিছু হবে না, আমি পাশে আছি” বলে তাকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করে। লিয়া জানে আরিফুল পাশে আছে কিন্তু সেই থাকাটা তার আম্মুর সামনে কতটা টিকতে পারবে সেটাই প্রশ্ন। তার আম্মুকে তো সে চেনে।
সন্ধ্যায় লিয়ার বাবা এলে রুকাইয়া তার কাছে সবটা বলে এবং এই নিয়ে তুমুল হৈচৈ করেন। লিয়া তো এসবের জন্য প্রস্তুতই ছিল…
সেদিনের পর থেকে লিয়ার উপর নতুন করে অত্যাচার শুরু হয় রুকাইয়ার। লিয়াকে সারাক্ষণ চোখে চোখে রাখা ছিল তার প্রথম কাজ। প্রতি মুহূর্ত সে সুযোগের অপেক্ষায় থাকত কখন লিয়াকে প্রমাণ সহ ধরবে? এসবের বাইরে সে লিয়াকে আরও বেশি ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করত। রুবাকে পড়ানো, রাতের রান্না সবই লিয়াকে করতে হত। এতসবের পর লিয়ার নিজের পড়ার সময়টাও বের করতে কষ্ট হত কিন্তু তার কোন উপায় ছিল না… রুকাইয়া চাইত না লিয়া ভালো করে পড়ুক, ভালো রেজাল্ট করুক। লিয়াকে শুধু কাজে ব্যস্ত রাখা নয় সুযোগ পেলেই তিনি লিয়াকে বকাঝকা করে ঝগড়া শুরু করে দিতেন।
এতদিনে আবিদ সাহেবের বাড়ির কাজ শেষ হয়ে যায়। তিনি পরিবার নিয়ে তার নিজের বাড়িতে উঠে যান। এখানে আসার কিছুদিনের মধ্যেই লিয়ার টেস্ট পরীক্ষা শুরু হয়ে যায়। তারা এখন যে বাড়িতে আছে সেটা থেকে নিজের বাড়ি খুব বেশি দূরে নয়। প্রায় পাশাপাশি এলাকা। তাই সেখান থেকে আরিফুলের সাথে যোগাযোগ রাখাটা খুব বেশি কঠিন ছিল না লিয়ার জন্য। আরিফুলের বাড়ির সবার সাথে লিয়ার সম্পর্কও ভালো ছিল তাই টুকটাক যাতায়াতও হত।
ওই সময় হুট করেই লিয়ার চিকেন পক্স হয়। পরীক্ষা কী করে দেবে সেটা নিয়ে সে মহা চিন্তায় পড়ে গেল… সে কোন অবস্থাতেই পরীক্ষা মিস করতে চায় না। রুকাইয়া তখন নিজেই লিয়ার স্কুলে গিয়ে প্রধান শিক্ষকের সাথে কথা বলে তার আলাদাভাবে পরীক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা করেন। তবে লিয়ার উপর রুকাইয়া কড়া নজর রাখত। তার পক্ষে সারাক্ষণ সেটা সম্ভব হত না বলে সে দুজন লোক রেখে দিল নজর রাখবার জন্য। এত সবের মধ্যেও লিয়া কোনরকমে যোগাযোগ চালিয়ে গেল আরিফুলের সাথে।
লিয়াকে জব্দ করতে পরীক্ষা শেষ হতেই রুকাইয়া আটঘাট বেঁধে লেগে পড়েন বিয়ে দেবার জন্য। যেকোন ছেলে হলেই এনে লিয়ার সামনে দাঁড় করিয়ে দিত। ছেলে কি করে, কেমন তার চরিত্র, কেমন তার পরিবার এসব কোন কিছুই সে দেখে না। পারলে রিকশাওয়ালাও ধরে নিয়ে আসে বিয়ের জন্য! তবু সে কোনভাবেই চায় না আরিফুলের সাথে লিয়ার কিছু হোক। কারণ আরিফুল ছেলে ভালো, সে ডাক্তার হতে যাচ্ছে খুব শীঘ্রই, তার পরিবারও ভালো। “লিয়ার কপাল এত ভালো হবে” রুকাইয়ার জন্য এটাই ছিল মূল সমস্যা। সে ক্রমাগত বিয়ের জন্য আজেবাজে ছেলে পাত্র হিসেবে ধরে আনতে লাগল। এসব আচরণে লিয়া প্রচন্ড মানসিক অশান্তিতে ভূগতে লাগল। সে আরিফুলকে ফোন করে কান্নাকাটি করত কিন্তু আরিফুল এই মুহূর্তে কী করবে? সে এখনো পড়াশোনা শেষ করতে পারেনি। আরও দুটো বছর অন্তত তার দরকার। পড়া শেষ করে নিজের পায়ে দাঁড়াবার একটা কিছু উপায় হলেই সে লিয়াকে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করবে ততদিন যেভাবেই হোক লিয়াকে দুটো অপেক্ষা করতেই হবে। এই নিয়ে আরিফুলের নিজেরও মানসিক চাপ যাচ্ছিল। সে লিয়াকে বলে, “তুমি যেভাবেই হোক আর দুই বছর অপেক্ষা করো।
বিয়ে নিয়ে লিয়ার সাথে নিত্যদিন যা হচ্ছিল রুকাইয়া তার কোন কিছুই আবিদ সাহেবকে জানাতেন না। আর মায়ের বিরুদ্ধে কিছু বলাটা লিয়ার সাধ্যে ছিল না। তাই ঘরের ভেতর চলতে থাকা এই নিরব স্নায়ুযুদ্ধ আবিদ সাহেবের অজানা ছিল। সুযোগে রুকাইয়া লিয়ার উপর টর্চার চালিয়ে যাচ্ছিলেন। দিন দিন এসবের মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছিল। লিয়া তখন উপায় না পেয়ে বাবার সাথে সরাসরি কথা বলে। বিয়ে নিয়ে তার সাথে যা কিছু হচ্ছে সব কিছু খুলে বলে বাবাকে। সে পরীক্ষাটা অন্তত শেষ করতে চায়। এরমধ্যে এসব তার জন্য পড়াশোনার ক্ষতির কারণ হয়ে যাচ্ছে। আবিদ সাহেব মেয়ের কথায় তাকে আশ্বস্ত করেন রুকাইয়ার সাথে এবিষয়ে কথা বলবেন। মা হারানো মেয়ে তার, অনেক কিছুই হয়ত তিনি মেয়ের জন্য করতে পারেন না কিন্তু মেয়ের ব্যাপারে সম্পূর্ণই উদাসীন হবেন এমনটাও নয়। মিনুকে তিনি ভালোবেসে জয় করে ঘরে তুলে এনেছিলেন। যে ভালোবাসায় কোন খাঁদ ছিল না। কিন্তু তারই অসাবধানতায় তার ভালোবাসার ধন হারিয়ে গেছে! যেটা তিনি মেনে নিতে পারেন না… যে দু:খ আর অপরাধবোধের পাহাড় তিনি আজও বুকে বয়ে বেড়ান অথচ কাউকে বলতে পারেন না, বোঝাতে পারেন না… এই বুক পাজরে মিনুর জন্য কতটা হাহাকার হয় তা যদি কাউকে দেখানো যেত, একটু হালকা হওয়া যেত??? মেয়েটা কেন এত অভিমানী ছিল? কেন এতটাই ভালোবাসত আমায়??? তার বুকের ভেতর হু হু করে ওঠে…
আবিদ সাহেব রুকাইয়ার সাথে কথা বলেন। তাকে বোঝায় এখনই লিয়ার বিয়ের ভাবনা থাকুক, পরে দেখা যাবে। পরীক্ষাটা অন্তত শেষ হোক। আবিদের কথায় রুকাইয়া সাময়িকভাবে পাত্র দেখা বন্ধ করেন। তবে সে মনে মনে ঠিক করে রাখে, পরীক্ষা শেষ হলেই যেকোনো উপায়ে লিয়াকে বিয়ে দিয়ে বিদায় করবেন।
লিয়া যেন ভালোভাবে পরীক্ষা দিতে না পারে সেজন্য যা যা করতে হয় রুকাইয়া তখন সে সবকিছুই করতে লাগলেন। ঘরের যাবতীয় কাজ তো আছেই সেই সাথে লিয়াকে পড়ার খরচ দেয়া বন্ধ করে দিলেন। লিয়া তখন বাধ্য হয়ে এলাকার ছোটখাটো এক স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করে দিল, সাথে দুটো টিউশনি। সব মিলিয়ে মাস শেষে তার হাতে ২৭০০ টাকা আসত। লিয়া এই কাজগুলো যেন ঠিকভাবে করতে না পারে সেজন্য তাকে সব সময় ঘরের কাজের প্রেসারে রাখতে শুরু করলেন রুকাইয়া। সকালে রান্না করে ঘরের সমস্ত কাজ গুছিয়ে তবেই সে স্কুলের জন্য বের হতে পারত। স্কুলের চাকরি, টিউশনি, রুবাকে পড়ানো সেই সাথে তার দেখাশোনা, ঘরের যাবতীয় কাজ করে তারপর নিজের পড়ার জন্য সময় বের করতে হত লিয়াকে। বাড়িতে গ্যাসলাইন না থাকায় লাকড়ির চুলায় রান্না করতে হত, যেটা আরও বেশি কষ্টের ছিল। সে এক হাতে রান্না করত আরেক হাতে বই নিয়ে পড়ত আর চোখের পানিতে গা ভাসাত… এই পৃথিবীটা কবে লিয়ার জন্য একটু সদয় হবে? কবে লিয়া এই নরক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবে? লিয়ার জীবনে আরিফুল ছিল বলেই হয়ত বেঁচে থাকার অদম্য এক ইচ্ছা তার ভেতর তখনও শেকড় ছড়িয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু এভাবে কতদিন?