বিকেলের মৃত্যু পর্ব ৫

0
570

#বিকেলের_মৃত্যু (পর্ব – ৫)
লেখক: শামীমা জামান

সাভারে এসে নতুন জায়গা আর জীবিকায় আবীর তার সংসার জীবন নতুন করে গুছিয়ে নেবে ভেবেছিল কিন্তু কে জানত অদৃষ্টের পরিকল্পনায় ছিল অন্য কিছু! আবীরের একটা কন্যা সন্তান হয়, যাকে ঘিরেই আবীরের যত চাওয়া পাওয়া আর স্বপ্ন। অথচ বিয়ের এত সময় পরেও রীপার কোন পরিবর্তন হয়নি। বরং দিনকে দিন আরও বেশি বেপরোয়া হয়ে গিয়েছে। রীপার যে পরিবর্তন হয়েছে তা কখনো আবীরের কল্পনাতেও আসেনি। রীপা নিজেরই এক রিলেটিভের সাথে পরকীয়ায় জড়িয়ে যায়! আবীর যথা সম্ভব চেষ্টা করেও তাকে ফেরাতে পারেনি। যাকে ভালোবেসে বিয়ে করে এত ঝড়-ঝাপটা সয়ে জীবন সাজাতে চেয়েছে সে এভাবে তাকে আস্তাকুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলবে সেটা সে মানতে পারে না কিছুতেই। উচ্চাভিলাষী রীপা এক সময় আবীরের ঘর ছেড়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলে। পরিকল্পনা অনুযায়ী আবীর অফিস চলে গেলে রীপা টাকা পয়সা আর একমাত্র মেয়েকে নিয়ে চিরতরে পালিয়ে যায় তার প্রেমিক পুরুষের কাছে। পরবর্তীতে মেয়ের জন্য আবীর যোগাযোগ রাখলেও একটা সময় রীপার আচরণে যোগাযোগের সেই শেষ সুতোটাও ছিঁড়ে যায়।

এরপর আবীর তুরষ্ক এ্যাম্বাসিতে চাকরি নেয়। সেখানে টিনা নামের এক মেয়ের সাথে পরিচয় হয়। আবীরের নি:সঙ্গ জীবনে টিনা খুব সহজেই জায়গা নিয়ে ফেলে। সম্পর্কটা এক সময় বন্ধুত্বে রূপ নেয়, তারপর প্রণয়ে। টিনার পরিবারও আবীরকে পছন্দ করে। তাই তাদের প্রণয় পরিণতি পেয়ে যায় সহজেই। টিনাকে বিয়ে করে আবীর এখন খুব ভালো আছে। যে সুখের জীবন সে চেয়েছিল সেটা টিনা তাকে এনে দিয়েছে। জীবন কখনো কাউকে অপূর্ণ রাখে না। মানুষের অদম্য চাওয়া আর পাওনা জীবন চুকিয়েই দেয়।

***
মানুষের জীবন ভাসমান কচুরিপানার মতন। স্রোত তাকে ভাসিয়ে নিয়ে কখন কোথায় গিয়ে স্থায়ী করে বলা যায় না। কেউ শেকড়ের সন্ধানে আর কেউ শেকড় ছড়িয়ে কোথায় নিজেকে থিতু করবে প্রতিনিয়ত সেই প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত। জীবনের দীর্ঘ একটা সোনালী সময় যশোরে কাটিয়ে দেয়া আবিদ সাহেব কী কখনো ভেবেছিল, এই যশোর ছেড়ে সে অন্য কোথাও স্থায়ী হবে? হয়ত না…। কিন্তু জীবন ও জীবিকার তাগিদে আবিদ সাহেব তার যশোরের জমিজমা বিক্রি করে সাভারের এক গ্রাম্য এলাকায় জমি কিনে নিজেকে থিতু করতে চান। তারপর স্বপরিবারে সাভারে চলে আসেন। এখানে মোটামুটি একটা ভালো এলাকায় দোতলার একটা ছিমছাম বাড়িতে ওঠেন। পাঁচিল ঘেরা ছোট্ট উঠানসহ বাড়ি। তারা নিচতলার ফ্ল্যাটে ওঠেন। লিয়াকে এখানে কাছেই ভালো একটা স্কুলে ভর্তি করে দেয়া হয়। তাদের বিল্ডিং এর দোতলায় আমিনুল হক সাহেব তার স্ত্রী, ২পুত্র আর একমাত্র কন্যাকে নিয়ে থাকত। সুন্দর গোছানো এক ধার্মিক পরিবার। এই পরিবারের প্রতিটি মানুষ অমায়িক, ভদ্র এবং ভালো। দুই পরিবারের মধ্যে টুকটাক মেলামেশা হতেই পারত হয়ত কিন্তু রুকাইয়া আর আমিনুল হকের স্ত্রী দুইজন দুই মেরুর বাসিন্দা। আমিনুল হকের স্ত্রী আয়েশা আক্তার ধার্মিক, অমায়িক, পর্দাশীন মহিলা আর রুকাইয়া সম্পূর্ণই বিপরীত বলা চলে। তার পোশাকেও শালীনতার যথেষ্ট ঘাটতি দেখা যেত। সে কারণেই হয়ত একই বিল্ডিং এ থাকলেও প্রতিবেশী হিসেবে দুই পরিবারের মাঝে যে সম্পর্ক গড়ে ওঠার কথা তা হয়ে ওঠেনি। রুকাইয়া কখনোই সামাজিক টাইপ মানুষ নন। তার কারণে আবিদ সাহেবের অন্য সব ভাইবোনের সাথেও পারিবারিক সম্পর্কটা টিকে আছে কেবল যোগাযোগের মাধ্যমে। যে ভাইবোনদের আবিদ নিজের হাতে মানুষ করেছে প্রত্যেককে ডিগ্রী পাস করিয়ে স্বাবলম্বী করে দিয়েছে, বোনকে ভালো পাত্রস্থ করে দিয়েছে তাদের কারো সাথেই আজকাল সেই শৈশব কৈশোরের মত সুন্দর মাখামাখি সম্পর্কটা নেই! তারা কেউ আবিদ সাহেবের বাড়ি আসুক বা তার সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখুক সেটা রুকাইয়া কখনো হতে দেয়নি। রুকাইয়ার আচরণে তারাও বড় ভাইয়ের সাথে দূরত্ব বজায় রেখেই চলেছে। ভাইবোনের সম্পর্কের যে সেতুবন্ধন আছে তা কেবল লিয়ার নামেই টিকে আছে এখনো। এসব নিয়ে আবিদ কষ্ট পায় না এমন নয় কিন্তু রুকাইয়ার আচরণে সে নির্বাক নিরুপায়…

সাভারে আসার কিছুদিনের মধ্যেই আবিদ সাহেব তার ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে বাড়ির কাজ শুরু করেন। ১০শতাংশ জমির অর্ধেক আবিদ সাহেবের নামে আর বাকি অর্ধেক স্ত্রী রুকাইয়ার নামে। রুকাইয়া নিজের অংশে বাড়ির কাজ ধরেন। কারণ তিনি কোন অবস্থাতেই চান না এই বাড়ির ভাগ লিয়া বা আবীর ভোগ করুক। অফিসের কারণে আবিদ সাহেব বাড়ির কাজে তেমন সময় দিতে পারতেন না। তাই সব কিছুই রুকাইয়াকে করতে হত। বাড়ির পেছনে রুকাইয়া যারপরনাই শ্রম দেন। এক প্রকার নিজের হাতেই বাড়ির সমস্ত কাজ তিনি করিয়ে নিয়ে স্বপ্নের বাড়ির কাজ এগিয়ে নিচ্ছিলেন।

২০০৫ সাল, লিয়া তখন অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী। বাড়ির সমস্ত কাজ একা হাতেই করা শিখে গিয়েছে। রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠে পাকা গৃহিণীর মত ঘর ঝাড়ু দিয়ে, নাশতা বানিয়ে, ছোট বোন রুবাকে ঘুম থেকে তুলে তাকে স্কুলের জন্য রেডি করিয়ে দিত। তারপর দুইজন নাশতা করে রান্নাঘর গুছিয়ে রেখে স্কুলের জন্য বের হয়ে যেত। রুবাকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে লিয়া নিজে কোচিং এ যেত, তারপর স্কুল। এটা ছিল লিয়ার প্রতিদিনের সকালের রুটিন। তার এই ধুসর হয়ে যাওয়া জীবনে একমাত্র রুবাই আছে যে তাকে ভালোসে। বোনের প্রতি বোনের ভালোবাসায় কোন খাঁদ ছিল না। সেই ছোট্ট থেকেই লিয়া রুবাকে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছে বলেই হয়ত রুবা তার ভেতর মা মা গন্ধ পায়, তাকে অসম্ভব ভালোবাসে। লিয়ার কষ্টে সেও কষ্ট পায়।

লিয়া প্রতিদিন সকালে নিজের হাতে নাশতা বানায় অথচ কোনদিন নিজের জন্য স্কুলে টিফিন নিতে পারেনা! সে ক্ষমতাই তো তাকে দেয়া হয়নি। স্কুল শেষ করে তার বাড়ি ফিরতে ফিরতে সাড়ে চারটা বেজে যেত। সে বাড়ি আসত তীব্র ক্ষুধা আর ক্লান্তি নিয়ে কিন্তু কেউ তার জন্য খাবার সাজিয়ে রাখবে সে আশা তো দূরে থাক মাঝে মাঝে তার খাওয়ার জন্য কোন খাবারই থাকত না। নিজের হাতে যে রোজ খাবার তৈরি করে তার প্লেটেই খাবার থাকে না! এমনও দিন গেছে তার শুধুমাত্র আচার দিয়ে ভাত মেখে খেয়ে নিয়েছে। আচার না থাকলে একটা টমেটো কেটে পেঁয়াজ মরিচ দিয়ে মেখে ভাত খেয়ে নিয়েছে। একটা ডিম ভেজে খেয়ে নেবার ক্ষমতা পর্যন্ত তার ছিল না। এই পৃথিবীতে ক্ষুধার যন্ত্রণাই বোধকরি একমাত্র যন্ত্রণা যা সওয়া যায় না। আর এই যন্ত্রণা তাকে প্রায়দিনই স্কুল থেকে ফিরে এসে সহ্য করতে হত… এই পৃথিবীর উপর লিয়ার তখন খুব অভিমান জমত। ঝাপসা চোখে সে তখন তার মায়ের মুখটাই দেখতে পেত… কেন মা তাকে ছেড়ে এভাবে চলে গেল? কেন আজ তাকে এত কষ্ট পেতে হয়? এসব দেখে দেখে লিয়া অল্প বয়সেই মানসিকভাবে পরিণত হয়ে গেল। এই বয়সী মেয়েরা যেখানে স্বভাবে সদ্য ডানা মেলতে শেখা প্রজাপতির মত চঞ্চল, উড়ে উড়ে ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসে, লিয়া সেখানে পরিস্থিতির চাপে মনের সমস্ত রঙ মনে চাপা দিয়ে ধীরস্থির আর শান্ত। অন্য আর ১০টা সমবয়সী মেয়ের মাঝে তাকে সহজেই আলাদা করা যায়, সহজেই সে অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করার ক্ষমতা রাখে।

বিংশ শতাব্দীর শুরুর সময়টাও নব্বই দশকের মত চমৎকার ছিল। নব্বই দশকের ছায়া তখনও পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেনি। তখনও শিশু কিশোরেরা দিগন্ত জোড়া খোলা মাঠে দাপিয়ে বেড়াতে পারত, পাড়ার সবকটা মাঠের গাছগাছালির ফলে ছিল তাদের একচ্ছত্র অধিকার, দুই টাকায় ফেরি করে বিক্রি করা আইসক্রিম কিনে খেত, দলবেঁধে কতদূরের পথ হাঁটতে হাঁটতে স্কুলে যেত… যাবার পথে আমগাছে, পেয়ারা গাছে ঢিল ছুঁড়ে ফল পেড়ে খাওয়া… কখনো কখনো ধরা পড়ে তাড়া খাওয়া… উফফফ সে কী আনন্দ…, সন্ধ্যাবেলায় কারেন্ট চলে গেলে আশেপাশের যত বন্ধুরা আছে সবাই মিলে উঠোনে খেলতে বসা, সবাই মিলে একসাথে ঈদের চাঁদ দেখতে মাঠে নাহয় ছাদে ছুটে যাওয়া… কী চমৎকার ছিল সেই সময়ের শিশু-কিশোর বেলা! সেই সময়ে কিশোর বয়সী প্রেমগুলোও ছিল ভীষণ অন্যরকম। জগতের সিংহভাগ প্রেমের শুরুই হয়ত স্কুল লাইফ থেকেই শুরু হয়। প্রতিটা কিশোর কিশোরীই হয়ত এই অনুভূতি স্কুল জীবনেই অনুভব করে। লিয়াও এর ব্যতিক্রম হল না, তার জীবনেও এই অনুভূতি অনুভব করার ক্ষণ এলো। যদিও কঠিন বাস্তবতার শৃঙ্খলে বাঁধা লিয়া কখনো ভাবেনি তার জীবনে কখনো “ভালোবাসা” নামক প্রজাপতিটার উপস্থিতি হবে… নীরবে এসে তাকে ছুঁয়ে যাবে প্রতি মুহূর্ত আলতো আবেশে। নাড়িয়ে দেবে তার সমস্ত সত্তাকে! কিন্তু সৃষ্টিকর্তা কার জন্য কখন, কোথায় কী রেখে দিয়েছেন তা কেবল তিনিই জানেন। লিয়ার শুষ্ক হয়ে আসা রংহীন জীবনে ভালোবাসার আস্ত টলটলে দীঘি নিয়ে হাজির হল আরিফুল হক জুয়েল! সদ্য মেডিকেলে ভর্তি হওয়া আরিফুল স্বভাবে শান্ত, গোছানো, মার্জিত, সুদর্শন যুবক। এই শান্ত ছেলেটার মন অতি সন্তর্পণে মনের অজান্তেই অশান্ত করে ফেলেছে লিয়া। মনের পুরোটা এমনভাবে দখলদারি নিয়ে বসেছে যে আরিফুলের দিনরাত্রি লিয়ার মুখ কল্পনা করেই কেটে যায়! সে প্রস্তুতি নেয় মনের লুকোচুরি পর্বের ইতি ঘটিয়ে লিয়ার মুখোমুখি হতে। এটা যে মোটেও সহজ নয় সেটা জেনে বুঝেই সে সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেলে।

লিয়া বাসায় সার্বক্ষণিক কাজে ব্যস্ত থাকে। ঘরে উঠানে সে সব সময় কিছু না কিছু করতে থাকে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে ইদানীং খেয়াল করেছে সে যখনই উঠানে থাকে দোতলার বারান্দা থেকে একজোড়া অনুসন্ধানী চোখ তাকে নজরবন্দী করে রাখে এবং প্রতিবারই সেটা ওবাড়ির বড় ছেলে আরিফুল! ওপরে তাকালে আরিফুলের সাথে বেশ কয়েকবার তার চোখাচোখি হয়েছে। আরিফুল কী তবে তাকে দেখতেই দাঁড়িয়ে থাকে ওভাবে ওখানে? সেটাই বা কেন হবে? পাতলা গড়নের লম্বা, চশমা পরা, শান্ত মেজাজের ভদ্র ছেলে আরিফুল মেডিকেলে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে। তার সাথে কী লিয়ার কোন দিক থেকে যায়? লিয়ার কৌতুহলী চোখে আরিফুল বার বার পাকড়াও হচ্ছিল নির্দ্বিধায়। তবু লিয়ার প্রতি মুগ্ধতায় সে আটকে থাকে, চোখ ফেরাতে পারে না। লিয়া এসব দেখেও না দেখার ভান করে। তার তো ওসবে প্রশ্রয় দেয়া চলবে না।

পাশের বাড়ি লিয়ার দুই বান্ধুবী সুমি ঝুমি থাকে। জমজ বোন এরা। লিয়াদের বাড়িতেই তাদের দিনের অনেকটা সময় কেটে যায়। আরিফুলের ব্যাপারটা সুমি ঝুমিরও নজর এড়াতে পারল না। এরা চট করেই ধরে ফেলল আরিফুলের মনে কী চলছে! কিশোরী বয়স… এরা সব কিছুকেই রঙিন দেখে, সব কিছুতেই আনন্দ খুঁজে পায়। ছোট্ট বিষয় নিয়েও হেসে গড়িয়ে পড়তে ভালোবাসে। এরা দুই বোন আরিফুলকে জড়িয়ে লিয়ার সাথে সারাক্ষণ দুষ্টুমিতে মেতে থাকত। আরিফুলের একটা নামও দিয়ে ফেলল তারা, “চাশমুদ্দিন”।

তখন রমজান মাস, দেখতে দেখতে রোজা প্রায় শেষ। দিনটা ছিল শুক্রবার, দুপুরের দিকে লিয়া তাদের ডাইনিংরুমে বসে ভাত রান্নার চাল বেছে নিচ্ছিল। সদর দরজা ছিল খোলা। এমন সময় আরিফুল উপর থেকে নেমে এসে লিয়াকে ভেতরে একা দেখেই একটা দুমরানো কাগজ ওর দিকে ছুড়ে দিয়ে দ্রুত চলে যায় নামাজে। ঘটনার আকস্মিকতায় লিয়া হকচকিয়ে যায়। পর মুহূর্তেই সে কাগজখানা হাতে নিয়ে দেখে ওটা একটা চিঠি!!! এটা কী প্রেমপত্র? এই প্রথম কেউ তাকে প্রেমপত্র দিল! মনের ভেতর মুহূর্তেই একঝাক প্রজাপতি এসে ডানা মেলতে চাইল… পরক্ষণেই মায়ের কথা ভেবে মুহুর্তেই লিয়ার বুক ধুকপুক করে উঠল। এটা যদি তার মা দেখতে বা জানতে পায় তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। কী করবে সে চিঠিটা? ফেলে দেবে? কিন্তু চিঠিটা পড়ার জন্য তার মনে অদম্য ইচ্ছে মাথাচাড়া দিয়ে জেগে বসে আছে যে! উপায় না পেয়ে চিঠি নিয়ে সোজা ওয়াশরুমে চলে যায়। পুরো চিঠিটা রূদ্ধশ্বাসে পড়ে ফেলে সে। কী সুন্দর গোছানো কিছু কথা…

” চিঠিটা লিখছি রাত ১২টার পর। আমি আসলে চিঠি লিখতে জানি না। আগে কখনো কাউকে লিখিনি তাই কী করে লিখতে হয় তাও জানি না। কী লিখব, কীভাবে লিখব সেটাও ভেবে পাচ্ছি না। একগাদা কাগজ ইতিমধ্যেই নষ্ট করে ফেলেছি। কীভাবে লিখলে আমার অব্যক্ত অনুভূতির সহজ উপস্থাপন হবে জানি না… আমি শুধু জানি তোমাকে আমার ভালো লাগে। কেন লাগে তার উত্তর নেই… তবে আমি ভীষণভাবে তোমাতে আটকে গেছি সেটা বুঝতে পারি। যেদিন থেকে জেনেছি তোমার মা নেই সেদিন থেকে ভালোলাগাটা অনেক বেশি বেড়ে গিয়েছে। এটাকে করুণা ভাবার কোন কারণ নেই। তুমি নিজেও হয়ত খেয়াল করেছ তোমাকে দূর থেকে দেখতে আমার ভালো লাগে। এ কারণেই বারান্দায়, তোমার স্কুলে যাবার পথে দাঁড়িয়ে থাকি। জীবনের এতগুলো বছর পার করে এসেছি অথচ আগে কখনো কাউকে দেখে এমন দুর্বলতা বা অনুভূতি কাজ করেনি, যেটা তোমাকে দেখে হচ্ছে!

আমার কথা তো জানালাম। এবার তোমার মতামত জানিও। খুব বেশি অপেক্ষা করাবে না। ভালো থাকো।”

চিঠিটা লিয়ার মনে অদ্ভুত এক অনুভূতির সঞ্চার করল। মুহূর্তেই অনুভূতিটা চাপা দিয়ে কাঁপা হাতে চিঠিটা কুচিকুচি করে ছিঁড়ে টয়লেটে ফ্ল্যাশ করে দিয়ে বের হয়ে এসে কাজ করতে শুরু করে কিন্তু কিছুতেই কাজে মন বসাতে পারে না। অজানা এক ভালোলাগা আস্তে করে এসে বুকের ভেতর ভীড়তে চাইছে, নোঙর ফেলতে চাইছে। কিন্ত… “সবার জন্য সব কিছু নয়” সেটা মনে হতেই ভালোলাগাটুকু নিকষকালো অন্ধকারে ছেয়ে যায়। “স্মৃতি কথা” হিসেবে রেখে দেবার মত জিনিসটা সে নির্দয়ভাবে ছিঁড়ে টয়লেটে ফ্ল্যাশ করে দিয়ে এসেছে! তার ভেতর প্রথম প্রেমপত্র পাবার ভালোলাগার অনুভূতিটা ভালোলাগা না হয়ে আতঙ্ক হয়ে ধরা দিচ্ছে! জীবন এমন জটিল না হলে কী হয় একটু?

বাকি দিনটা লিয়ার চাপা উত্তেজনার অনুভূতি নিয়েই কেটে গেল। পরদিন সুমি ঝুমি আসলে উঠানে বসে কাজের ফাঁকে গল্প করতে করতে যখন ওরা সিদ্ধান্ত নিচ্ছিল ইফতারের পর ছাদে যাবে চাঁদ দেখতে তখন বারান্দায় দাঁড়িয়ে আরিফুলও সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে এখন পর্যন্ত না পাওয়া তার চিঠির জবাব কীভাবে আদায় করবে সে? জবাব তো তাকে পেতেই হবে এবং সেটা অবশ্যই “হ্যাঁ” হতে হবে।

সন্ধ্যায় লিয়া দুই বান্ধুবীকে নিয়ে ছাদে যেতেই দেখে সেখানে আরিফুল আগে থেকেই দাঁড়িয়ে আছে! আরিফুলকে দেখে এখানে থাকাটা ঠিক হবে কিনা সেই ভাবনায় দ্বিধান্বিত লিয়া শেষমেশ চাঁদ দেখার জন্যই এগিয়ে যায়। তারা যখন চাঁদ খোঁজায় ব্যাস্ত আরিফুল তখন লিয়াকেই আড়চোখে দেখছিল আর লিয়ার প্রতি ভালোলাগার মুগ্ধতা তার চোখে, মুখে, ঠোঁটে খেলে যাচ্ছিল… সে তখন লিয়াকে শুনিয়ে বলতে থাকে-

– “চাঁদ দেখতে এসে এ কোন চাঁদের দেখা পেয়ে গেলাম আমি!”

কথাটা শুনতেই সুমি ঝুমি হেসে গড়িয়ে গেল, লিয়া চুপ… আরিফুল তখন এগিয়ে এসে লিয়াকে বলে,

-“ঈদ মোবারক লিয়া” তারপর তার পেছনে রাখা ডান হাতটা সামনে এনে লিয়ার সামনে বাড়িয়ে ধরে।

লিয়া অবাক হয়ে বলে-

-কী এসব?

-ঈদ কার্ড আর একটা চিঠি আছে তোমার জন্য।

-এগুলো কেন এনেছেন? আমি এসব নিতে পারব না। আর কখনো এসব দেবেন না আমাকে।

-কেন দিব না? ঈদ, তাই ঈদ কার্ড দিচ্ছি, নেবে না কেন? ধরো এটা?

লিয়া তখন উপায় না পেয়ে বলে, “ঈদ কার্ড নিয়ে কী করব? লাগবে না আমার” তারপর সুমি ঝুমিকে নিয়ে তড়িঘড়ি নিচে চলে যেতে চাইল। অনিচ্ছা স্বত্বেও সুমি ঝুমিকে নিচে চলে যেতে হচ্ছে। যাবার জন্য সবাই পা বাড়াতেই আরিফুল লিয়াকে ডেকে থামতে বলে কিন্তু লিয়া থামতে নারাজ। আরিফুল তখন কিছুটা কর্তৃত্বের সুরে বলে-

-“কী হলো দাঁড়াতে বলেছি না? দাঁড়াচ্ছ না কেন?” লিয়ার হাতে এক প্রকার জোর করেই ধরিয়ে দেয় খাম। লিয়া ভয়ে সেগুলো সেখানেই ফেলে রেখে দৌড়ে নিচে চলে যায়। লিয়ার কান্ড দেখে আরিফুল হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। “মেয়েটা এমন কেন? কিছু দিলে নিতে কী সমস্যা হয়?”

পরদিন ঈদ, আরিফুল সেদিনও নানানভাবে চেষ্টা চালিয়ে গেল ঈদ কার্ড আর চিঠিটা দিয়ে যেতে। কিন্তু কোনভাবেই পারল না। পরদিন দুপুরে সুমি ঝুমিকে সাথে নিয়ে লিয়া আচার রোদে দিতে ছাদে যায়। আরিফুল সেটা দেখে সোজা ছাদে চলে যায়। লিয়ার সামনে দাঁড়িয়ে কিছুটা কঠিন সুরে বলে-

-“কেউ কিছু দিতে চাইলে সেটা নিতে হয়। এটা নুন্যতম ভদ্রতা।”

আরিফুলের রাগ দেখে লিয়া ভয় পাওয়া শান্ত গলায় বলে- আমি তো বলেছি, আমি এসব নিতে পারব না। নিলে মা বকবে, ঝামেলা হবে।

সুমি ঝুমিও লিয়ার সাথে তাল মিলিয়ে একই কথা বলতে চাইল কিন্তু আরিফুল তাদের কোন কথা বলারই সুযোগ দিল না। বলল- “তোমরা কোন কথা বলবে না। যা শোনার আমি ওর কাছেই শুনতে চাই।” সুমি ঝুমি তখন চুপ হয়ে যায়। আরিফুল তখন লিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল-

-ঈদ কার্ড যে কেউ দিতে পারে এটা নিয়ে এত সমস্যার তো কিছু দেখি না? তুমি এটা নেবে কিনা?

আরিফুলের নাছোড়বান্দা আচরণে লিয়া কোন উপায় না পেয়ে শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে সেগুলো নিয়ে নেয়।

ঈদ কার্ড নিয়ে নিচে এসে ঘরে ঢুকতেই লিয়া রুকাইয়ার সামনে পড়ে যায়! রুকাইয়া দেখে ফেলেন লিয়ার হাতে বড় একটা খাম। তিনি কুঞ্চিত কপালে জিজ্ঞেস করেন-

-কী এসব? কে দিয়েছে?

লিয়ার দমবন্ধ হয়ে আসে… আতঙ্কে জমে যায় সে। কী বলবে এখন?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here