বিকেলের মৃত্যু পর্ব ৪

0
669

#বিকেলের_মৃত্যু (পর্ব – ৪)
লেখক: শামীমা জামান

সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে, বাড়িতে আত্মীয়স্বজন আসতে শুরু করেছে একে একে। কখন কার মুখ থেকে লিয়া কী শুনে ফেলবে তখন তাকে সামলানো দায় হয়ে যাবে। তাই আবীর লিয়াকে খাইয়ে দিয়ে তাড়াতাড়ি ঘুম পাড়িয়ে দেয়। আজ বাড়ি ভর্তি সব কাছের মানুষ অথচ সবার মুখেই বিষাদ এবং দু:শ্চিন্তার ছাপ। মিনুর এমন অস্বাভাবিক মৃত্যু কাঁপিয়ে দিয়েছে সকলকে। শুধু টলাতে পারেনি তার জন্মদাত্রী মাকে। শেষবারের মতও একটা বার মেয়েকে দেখার ইচ্ছে হয়নি সরলার!

পরদিন মঙ্গলবার দুপুর দুইটায় আবিদ ঢাকা থেকে আসে। সে যখন রিকশা থেকে নামছিল লিয়া তখন দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে তাকে দেখছিল। লিয়া এখন পর্যন্ত তার মায়ের পরিণতি জানে না। জানে না বাড়ি ভর্তি এত মানুষ কেন? কেন সবার চেহারায় এত উদ্বেগের ছাপ? সে যখন দেখল তার বাবা হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে আসছে তখন সে বুঝে যায় তার মায়ের কিছু একটা হয়েছে। বাবা এসে তাকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদতে লাগল। আর তখনই সে দেখল একটা গাড়ি এসে বাড়ির সদরে থামল। গাড়ি থেকে নামানো হল সাদা কাফনে মুড়িয়ে রাখা তার মায়ের লাশ! জুলাইয়ের সেই তপ্ত দুপুরে লিয়ার জগৎটা থমকে গিয়েছিল এক মুহূর্তে। থমকে গেল তার জীবনের অনেক কিছুই। গতকালের বিকেলটা লিয়ার জীবনের “সুখ অধ্যায়” কেড়ে নিয়ে অস্ত গেছে। অবুঝ লিয়া জানে না আজ থেকে শুরু হয়ে গেল তার দহনের দিন!

বিকেল গড়াতেই কোন রকম জটিলতা ছাড়া মিনুর দাফন হয়ে যায়। আরও একটা বিকেল কেটে গেল ঘটনার ঘনঘটা আর বিষণ্নতা নিয়ে। বিকেল সময়টাই কী আসলে রহস্যময়? বিকেলের আকাশ, মেঘ, আকাশ জুড়ে এত রঙের খেলা সব কিছুই কেমন অন্যরকম… অদ্ভুত আর রহস্যময় লাগে! শেষ বিকেলে মিনুর অধ্যায়টা দাফন হয়ে গেল… এই নশ্বর পৃথিবী হয়ত সেদিন অনুধাবন করতে পেরেছিল মিনুর বুকে কতটা ক্ষত হয়েছিল। যে ক্ষতর যন্ত্রণা আজ এত বছর পর এসেও তার স্বামী সন্তানকে বয়ে বেড়াতে হয়!

মিনু তার আজন্ম মুক্তি খুঁজে নিয়েছে। কিন্তু দিন যেতেই সকলের প্রশ্ন হয়ে উঠল লিয়া আর আবীর। লিয়া অনেক ছোট তার মায়ের যত্নটাই চাই। কিন্তু এই পৃথিবীতে সব কিছুর শূন্যতা পূরণ হলেও মায়ের শূন্যতা কেউ পূরণ করতে পারে না। মা ছাড়া একটা শিশুর জন্য পৃথিবী হয়ে যায় রুক্ষ, কঠিন, দুর্বিষহ, অনিরাপদ। খুব অল্প বয়সে জীবনের অনেক কুৎসিত দিক দেখে ফেলে এরা। বয়স বেড়ে যায় সময়ের চেয়ে বহুগুণ বেশি।

আবিদ ঢাকায় একা থাকে সেখানে হুট করে ছেলে-মেয়ে দুটোকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব না। ওদের থাকা নিয়ে তখন সবাই চিন্তিত। আবীর একটু বড় হয়েছে তার থাকা নিয়ে খুব একটা সমস্যা না হলেও লিয়ার কী হবে? অনেক জল্পনা, কল্পনা ও আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে সিদ্ধান্ত হয় আবীর এখানেই তার চাচা আর দাদার সাথে থাকবে। আর লিয়ার মায়ের স্নেহ দরকার তাই সিদ্ধান্ত হল সে ঝিনাইদহে তার ফুপুর কাছে থাকবে। ফুপুর কোন মেয়ে সন্তান না থাকায় তিনি লিয়াকে নিজের মেয়ের মতই আদর, স্নেহ, ভালোবাসা দিতেন। তাই লিয়াকে অন্য কারো কাছে দেয়া হল না। লিয়া ফুপুর সাথে ঝিনাইদহে রওয়ানা হল তার জীবনের নতুন অজানা এক অধ্যায়ের দিকে। কী অদ্ভুত এই জীবন গাড়ি! কখন কোথা থেকে কোথায় নিয়ে যায়, কখন ধাক্কা খেয়ে যায় কেউ বলতে পারে না।

ঝিনাইদহে লিয়া বেশ ভালোই ছিল। মায়ের অভাব কেউ কোনদিন পূরণ করতে পারে না কিন্তু লিয়ার ফুপু চেষ্টা করেছে লিয়া যেন কখনো মায়ের অভাব বোধ না করে। এখানে লিয়ার প্রথম যে সমস্যাটা হয় সেটা হল ভালো স্কুল। কাছাকাছি কোন ভালো স্কুল না থাকায় লিয়াকে অনেকটা দূরে এক স্কুলে ভর্তি করা হয়। তারপর দিন যেতে লাগল আপন গতিতে। ফুপুর আদরে থাকলেও লিয়া ধীরে ধীরে অনেক কিছুই বুঝতে শিখে গেল। এ বাড়িতে তার ফুপুর কোন কর্তৃত্ব নেই, ফুপা যা বলবে তাই হবে। তার ফুপু তাকে মায়ের স্নেহ দিলেও ফুপা সেটা পারলেন না। ফুপা যখন বাড়ি আসে তখন নিজের সন্তানদের জন্য কত কিছু নিয়ে আসতেন কিন্তু সেখানে লিয়ার জন্য কিছু থাকত না! লিয়ার শিশু মনে একটু একটু করে কষ্টের বরফ জমতে থাকে। তার ফুপু এসব দেখে কষ্ট পেলেও তিনি এ ব্যাপারে বিশেষ কিছু করতে পারতেন না। একটা সময় লিয়ার বাবাও বিষয়গুলো আন্দাজ করতে পারলেন। তাই মেয়ে এখানে থাকলেও তার যাবতীয় খরচ তিনি দিয়ে যেতেন। এটাও লিয়ার ফুপা শরীফ সাহেব পছন্দ করতেন না। এসব নিয়ে ফুপুর সাথে তার প্রায়ই কথা কাটাকাটি চলত। এভাবে ৩ মাস চলে গেল।

ধীরে ধীরে আবিদ বুঝতে পারছেন লিয়ার ফুপুর বাড়ি থাকাটা আর ঠিক হচ্ছে না। ওদিকে রুকাইয়াও তাকে ক্রমাগত প্রেশার দিয়ে যাচ্ছে বিয়ের জন্য। আবিদ তখন সব দিক বিবেচনা করে তার বোনকে বিয়ের কথা জানায়। আবিদের ২য় বিয়ের ব্যাপারে কারো কোন দ্বিমত হল না। বরং এটা যেন দরকারই ছিল বলে মনে করল সবাই। আবিদ তখন জানায়, তার দেখা একটা মেয়ে আছে যাকে সে বিয়ে করতে আগ্রহী। সবাই চাইলে আবিদ তাকে একদিন এখানে নিয়ে আসবে। আবিদের কথায় সবার বুঝতে বাকি থাকে না যে, মেয়ে আসলে ঠিক করাই হয়ে গেছে এখন শুধু বিয়েটা করে নেয়া। তাই তার প্রস্তাবে কিছু বলার প্রয়োজন করল না কেউ। এর এক সপ্তাহ পরেই আবিদ রুকাইয়াকে নিয়ে ঝিনাইদহে তার বোনের বাসায় উপস্থিত হয়। রুকাইয়া এবাড়ির সবার জন্যই উপহার নিয়ে এসেছে। বিশেষ করে লিয়ার জন্য। লিয়ার প্রতি তার ভালোবাসাটা যেন আলাদা করে মনোযোগ কাড়ল সবার। রুকাইয়া সুযোগ পেলেই লিয়ার কাছ থেকে “মা” ডাক শুনতে চায়। লিয়া ছোট হলেও তার মনে প্রশ্ন আনাগোনা করে ‘এই অপরিচিত মাহিলাকে কেন তার ” মা” ডাকতে হবে?’ রুকাইয়া এখানে এক সপ্তাহের জন্য এসেছিল পুরো সময়টাই সে লিয়াকে দেবার চেষ্টা করেছে।

রুকাইয়া ঝিনাইদহ থেকে ঘুরে যাবার কিছুদিন পর লিয়ার ফুপা শরীফ সাহেব তার কোন একটা জরুরি কাজে ঢাকায় আসেন। ঢাকায় তেমন কোন আত্মীয় না থাকায় তিনি আবিদের ফ্ল্যাটে ওঠেন। রুকাইয়া তাকে যথেষ্ট আপ্যায়ন করেন। তাকে আপ্যায়নের অন্তরালে রুকাইয়ার এক দুরভিসন্ধি ছিল। আবিদ বিয়ের জন্য দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে চাচ্ছিল না তাই শরীফ সাহেব ঢাকায় আসায় সুযোগ পেয়ে সেই রাতেই রুকাইয়া তাকে প্রেশার দেয় আজই যেন আবিদের সাথে তার বিয়ে না হলেও কাবিনটা অন্তত করিয়ে দিয়ে যায়। শরীফ সাহেব ভীষণ বিরক্ত হলেন রুকাইয়ার এমন আচরণে। কেন এভাবে এত তাড়াহুড়ো? তিনি এক প্রকার বাধ্য হয়েই কাজী ডেকে তাদের কাবিন কবুল করিয়ে দেন সেরাতেই। কিন্তু পুরো ব্যাপারটা শরীফ সাহেব ইচ্ছের বিরুদ্ধে এবং অপছন্দের সাথে করেন।

অক্টোবরে লিয়ার জন্মদিন। রুকাইয়া ঝিনাইদহে গিয়ে খুব ঘটা করেই লিয়ার জন্মদিন পালন করেন। আপাতদৃষ্টিতে লিয়া এবং তার পরিবার সকলেই বুঝতে পারল রুকাইয়া লিয়ার “মা” হবার চেষ্টা করছে এবং সেটা মন থেকেই। তিনি যে চেষ্টাটা করে যাচ্ছেন তা অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। রুকাইয়া হয়ত সত্যিই একদিন লিয়ার মা হয়ে উঠবেন।

এরই মধ্যে শরীফ সাহেব তার অফিস সংক্রান্ত ঝামেলার কারণে পুরো পরিবার নিয়ে শহর ছেড়ে ঝিনাইদহের একেবারে গ্রামে গিয়ে উঠলেন। সেখানে ভালো কোন স্কুল ছিল না। লিয়ার পড়াশোনা হবে কী করে? আবিদ সাহেব চিন্তায় পড়লেন। তিনি চাইলেন না লিয়া আর এখানে থাকুক। তিনি তাকে ঢাকায় তার কাছে নিয়ে যেতে চাইলেন। লিয়াকে ঢাকায় নিয়ে যেতে চাওয়াটা শরীফ সাহেব পছন্দ করলেন না। তিনি এটা নিয়ে আবিদের সাথে এক প্রকার ঝগড়াই করলেন। লিয়ার ফুপুও ব্যাপারটা মেনে নিতে পারলেন না। লিয়াকে তিনি বরাবরই নিজের মেয়ের মত দেখেছেন। তার উপর এতদিন লিয়া তার কাছেই ছিল, লিয়া এখন তার অভ্যেস হয়ে গেছে। এই মেয়েকে ছেড়ে কী করে থাকবেন তিনি? লিয়ার ফুপুর নিজের সৎ মা ছিল। সৎ মায়ের আচরণ আর ভালোবাসা কেমন হয় সেটা তিনি হাড়ে হাড়ে জানতেন। তাই লিয়াকে নিয়ে যাবার কথা তুলতেই তার বুকের ভেতর অজানা আতঙ্ক এসে ভীড় করে। কিন্তু লিয়ার বাবা যদি মেয়েকে নিয়ে যেতে চায় তাকে আটকাবার কোন শক্তি তো তার নেই! তিনি খুব কাঁদলেন… মাঝে মাঝে কিছু অক্ষমতা জীবনকে তুচ্ছ করে তোলে।

ডিসেম্বরেই আবিদ সাহেব লিয়াকে ঢাকায় তার নিজের বাসায় নিয়ে এলেন। রুকাইয়া লিয়াকে সাদরে গ্রহণ করলেন। তিনি লিয়াকে আদর ভালোবাসায় আগলে নিলেন। কিছুদিন পর আবিদ আবীরকেও নিয়ে আসেন এখানে। লিয়াকে খিলগাঁও স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন সাথে আবীরকেও।

আবিদ সকাল সকাল অফিস চলে যেত। বাবা অফিস যাবার পর আবীর লিয়া স্কুলে চলে যেত, তার বেশ কিছুক্ষণ পর রুকাইয়া অফিস যেত। এভাবেই চলছিল প্রতিদিনের রুটিন। লিয়া ছোট ছিল, অনেক কিছুই বুঝত না। কিন্তু আবীর অবুঝ ছিল না। এমন অনেক কিছুই ছিল যা সে এড়িয়ে যেতে পারত না। তাই মাস পেরতেই দেখা দিল বড়সড় ঝামেলা! ওরা সবাই স্কুল আর অফিস চলে যেতেই দুপুরে ফাঁকা বাসায় অনেক কিছুই করার সুযোগ হত যা রুকাইয়া কাজে লাগাত। রুকাইয়া বীমা অফিসে চাকরি করায় অনেক লোককেই তার বাসায় আসতে হত। সাথে উঠতি বয়সী অনেক মেয়েও আসত। ঘরের ভেতর দরজা বন্ধ করে তারা কী এমন কাজ করত তা কিছু বুঝতে না পারার মত বয়স আবীরের ছিল না। মাঝে মাঝেই অনাকাঙ্খিত কিছু ঘটনা তার চোখে পড়ে যেত। সেসব বাবাকে জানাতেই লেগে গেল ধুন্ধুমার। মা সম্পর্কে এমন নোংরা কথা তোলায় আবিদ ছেলেকেই দোষারোপ করলেন। রুকাইয়া তাতে আগুনে ঘি ঢালার সুযোগটা হাতছাড়া করলেন না। পিতা-পুত্রের দন্দ চরমে চলে গেল। আবিদ কোন রকম চিন্তাভাবনা না করেই ছেলেকে পিটিয়ে বাসা থেকে বের করে দিলেন রাতের অন্ধকারে! আবীর দুহাতে চোখের পানি মুছতে মুছতে এক আকাশ সমান রাগ, অভিমান আর ঘৃণা নিয়ে বের হয়ে গেল বাড়ি ছেড়ে। যাবার আগে লিয়াকে জিজ্ঞেস করল-

-“লিয়া, তুই যাবি না আমার সাথে?

-না।

-এত কিছুর পরেও এখনো থাকবি এখানে? আমার সাথে চলে আয়?”

ছোট হলেও লিয়া এতটুকু বুঝতে শিখেছে যে, যেখানে তার ভাইয়ের নিজের কোন নির্দিষ্ট গন্তব্য নেই সেখানে তার সাথে সে কী করে যাবে? তাই সে তার ভাইকে অনিচ্ছার সাথে বলল- “না, ভাইয়া, যাব না।”

-যাবি না তো? এখানে থেকে পঁচে মরবি?

-জানি না…

-আমি চললাম। থাক তুই তাহলে। আমি আর আসব না। বাবা আমাকে বুঝল না। কেমন নির্দয় হয়ে গেল! এই বাবা কী আমাদের বাবা? আম্মু কেমন করে মার খাওয়াল আর বাবা তার কথায় মারল! চলে যাচ্ছি আমি, আর আসব না। ভালো থাকিস তুই। এক নাগারে কথাগুলো বলে আবীর হাঁটতে শুরু করল। কোথায় যাবে এখনো সে জানে না!!!

লিয়া অসহায়ভাবে তার ভাইয়ের এভাবে চলে যাওয়ার স্বাক্ষী হল। কী হবে তার ভাইয়ার?

আবীর সে রাতে শেষমেশ যশোরে চলে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়। সেখানে চাচার সাথে কিছুদিন থেকে ঝিনাদহে তার ফুপুর বাড়িতে চলে যায়। শুরু হয় স্রোতের টানে বয়ে যাওয়া ছন্নছাড়া জীবন। সেখানে সে স্কুলে ভর্তি হয় পাশাপাশি ড্রাইভিং শিখে নেয়। ফুপুর বাসা থেকেই সে এসএসসি পাশ করে। এসএসসি পাশ করার পর সে ঝিনাইদহ ছেড়ে নড়াইলে চলে যায় তার এক মামার বাসায়। সেখানে সে দুই বছর থাকে। তার বাবা তার জন্য খরচ পাঠালেও পড়াশোনার পাশাপাশি একটা দোকানে সে সেলসম্যানের কাজ করত। খুব অল্প সময়ে আবীরকে অনেক কিছুই দেখতে হচ্ছে। নতুন করে শিখে নিতে হচ্ছে জীবনের যত গোলিঘুঁজি। তার নিজের পরিবার থাকা স্বত্তেও সে কোথায় থাকছে, কার বাসায় থাকছে, কার কাছে থাকছে!! তার অসহায় ভাসমান জীবন মনের অজান্তেই একটা স্থায়ী আশ্রয় চাচ্ছিল… যেখানে সে দিন শেষে নিজের ঘর ভেবে ফিরতে পারে, যে ঘরে নিজের মানুষের কাছে নিজেকে খুলে জমা রাখতে পারে। সে ধীরে ধীরে খেয়াল করল তারই ক্লাসের মেয়ে রীপা আলাদা করে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। যার সাথে কথা বলতে তার ভালো লাগে। ইচ্ছে করে চেপে রাখা যত ব্যথা তার কাছে আলগা করে দেয়। এই ভালোলাগাটা কী অন্য কিছু?

***
বিয়ের এক বছর না যেতেই কন্যা রুবার জন্ম হয়। রুবার জন্ম আবিদ রুকাইয়ার জীবনকে পরিপূর্ণতা দিল। কিন্তু রুবার জন্ম সবার জন্য সুখকর হল না। তার জন্ম লিয়ার জীবনের এক অন্ধকার অধ্যায়ের সূচনা করল। রুবা পেটে আসতেই রুকাইয়া পুরোপুরি বদলে গেলেন। লিয়ার জন্য তার মনে ভালোবাসার পরিবর্তে জমা হতে লাগল ইর্ষা। সে লিয়াকে দিয়ে আস্তে আস্তে ঘরের সমস্ত কাজ শিখিয়ে নিতে লাগলেন। আদরের লিয়াকে ধীরে ধীরে সংসারের সব কাজ শিখে নিতে হল। ঘরের সমস্ত কাজের পর তার নিজের পড়াশোনা করার সময় হত। সকালের নাশতা বানিয়ে স্কুলে যেত, ফিরে এসে দুপুরের রান্না করতে হত। সেই সাথে তার মায়ের যত কাজ আছে সেসব করতে হত। লিয়া স্কুল থেকে এলে রুকাইয়া অফিসে যেত। তখন বাড়ির সব কাজ লিয়াকে করতে হত। রুবার জন্ম হবার পর লিয়ার কাজ আরও কয়েকগুণ বেড়ে যায়। কী করে একটা নবজাতকের কাঁথা ধুতে হয় ছোট্ট লিয়াকে সেটা পর্যন্ত শিখতে হল। লিয়া কাজ করত আর তার মায়ের স্মৃতি মনে করে বোবা কান্নায় ভেঙে পড়ত। প্রতিদিন সে নতুন করে পৃথিবীর আরও একটা নিষ্ঠুরতম দিনের সাথে পরিচিত হত। দিন শেষে একাকী অন্ধকারে বসে তার মনে হাজারো প্রশ্ন ভীড় করে… তার জীবন কেন এমন করে পাল্টে গেল? কেন তার জীবন আর সবার মত হতে পারল না? কেন তার মা তাকে ছেড়ে এভাবে চলে গেল? বছরে ২/১ বার যখন সবাই মিলে চাচা বা ফুপুর বাড়িতে বেড়াতে যায় লিয়া তখন মন খুলে একটু শ্বাস নিতে পারে। কিন্তু সেটাও রুকাইয়ার সহ্য হয় না। রুকাইয়া একবারের জন্য লিয়াকে কাছ ছাড়া করে না। যদি লিয়া তার গোমড় সব ফাঁস করে দেয়? লিয়া কী একদিনের জন্যও স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাবে না? সেদিন রাতে ভাইয়াকে যখন বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হল সেদিন কেন ভাইয়ার ডাকে সে সাড়া দিল না? তাহলে হয়ত এভাবে নিজের বাড়িতে আজ তার কাজের লোকের স্থান হত না। লিয়ার এই কান্না কখনো তার বাবার চোখে পড়েনি! সবই কী রুকাইয়ার মায়াজাল ছিল, না কি আবিদ নিজেও ইচ্ছে করে চোখে ঠুলি পরে থাকে?

প্রায় বছর দুই পর এক দুপুরে হুট করে আবীর এসে হাজির হয়। লিয়া দরজা খুলেই দেখে তার ভাইয়া। এতদিন পর ভাইয়াকে দেখে সে ভীষণ অবাক হয়। আরও বেশি অবাক হয় ভাইয়ার সাথে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটাকে দেখে। লিয়া জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালে আবীর বলে-

-“আমি বিয়ে করে ফেলেছিরে… এটা তোর ভাবি, রীপা।”

লিয়া তার ভাইয়ার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটার দিকে তাকাল, ফর্সা গোলাগাল মুখের সুন্দর মুখখানায় কেমন যেন কাঠিন্যের ছাপ! জার্নি করে আসায় মুখটা একটু শুকনো দেখাচ্ছে। লিয়া ওদের কী বলবে ভেবে পেল না। সে একইসাথে বিস্মিত এবং আতংকিত অনুভব করল। সে জানে রুকাইয়া এসব দেখলে তুলকালাম কান্ড ঘটাবে। সে তার ভাবিকে সালাম দিয়ে তাদের ভেতরে এসে বসতে বলে।

আবীর তখন লিয়াকে বলে- কিরে ভাবিকে দেখে খুশি হোসনি? তোর ভাবি কিন্তু খুব চমৎকার মেয়ে। তোর পছন্দ হবে।

-পছন্দ হবে না কেন? খুব ভালো লেগেছে। কিন্তু বাবা আর আম্মু তোদের এভাবে দেখে কী বলবে তাই ভাবছি…

-ও… কী আর বলবে? কিছু বকা তো দিবেই। বিপদে পড়েছি বলেই তো এসেছি। নয়ত আসতাম নাকি?

-তোরা বস আমি আম্মুকে ডেকে আনি। বলে লিয়া রুকাইয়াকে ডাকতে চলে যায়। রুকাইয়া এসে এই অনাহুত অতিথি দেখে চরম বিরক্ত হল। সে চিৎকার চেঁচামেচি করে তাদের ঘর থেকে বের করে দিলেন। বললেন-

-“তোমাদের বাবা বাসায় এলেই সিদ্ধান্ত হবে তোমরা কোথায় থাকবে।” আবীর নিজেকে অসহায় বোধ করল। এইচএসসি পাশ করে সে হুট করেই রীপাকে বিয়ে করে ফেলে কাউকে না জানিয়ে। বউ নিয়ে মামাবাড়িতে উঠতেই মামা-মামী ব্যাপারটা ভালোভাবে নিতে পারলেন না। তাছাড়া দুজন বাড়তি মানুষ লালনপালন করাও তাদের জন্য কষ্ট সাধ্য। তাই আবীরের মামা তাকে তার বাবার কাছে চলে যেতে বলেন। তিনি একটা কিছু ব্যবস্থা নিশ্চই করবেন। তাই কোন রকম খবর না দিয়ে আবীর সোজা তার বাবার কাছে চলে এসেছে রীপাকে সাথে নিয়ে। কিন্তু রুকাইয়া তাদের সাথে এতটা দুর্ব্যবহার করবে সেটা তার কল্পনাতেও ছিল না। মস্ত এই শহরে যাবার মত তার দ্বিতীয় কোন জায়গাও নেই। তাই বাধ্য হয়েই সে এ বাড়ির সিঁড়িতে বসে থেকে বাবার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। বাবা নিশ্চই তাদের ফেলে দিতে পারবে না। কিন্তু রীপা এই পরিস্থিতিতে ভীষণ অপমানিত বোধ করল। সে আবীরকে কথা শোনাতে ছাড়ল না।

আরও একটা বিকেল তীব্র অস্থিরতা নিয়ে কাটল লিয়ার। বিকেল সময়টাকেই এখন তার ভয় লাগে। তার জীবনের যত অঘটন ওই বিকেলই তো ঘটিয়েছে! এমন বিভীষিকাময় বিকেল আর কত দেখতে হবে তাকে? বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হতেই আবিদ সাহেব বাসায় উপস্থিত হয়। আবিদ সব কিছু শুনে প্রথমে হতভম্ব হয় পরে এই অল্প বয়সে নির্বোধের মত বিয়ে করে ফেলার জন্য ছেলেকে পেটাতে শুরু করে। অনেক রাগারাগি আর কথা খরচের পর আবিদ ওদের ঘরে ঢুকতে দেয়। হাজার হোক নিজের ছেলে… তাকে তো আর ফেলে দেওয়া যায় না।

আবীর তার বউ নিয়ে বাবার বাসায় উঠে তো পড়ল কিন্তু আদৌ কী এখানে তারা স্থায়ী হতে পারবে? লিয়া রুকাইয়াকে এতদিনে হাড়ে হাড়ে চিনে ফেলেছে। তাই তার ভেতরে ভাইয়াকে নিয়ে নতুন করে আতঙ্ক শুরু হল। তার বয়স মনেহয় আরও একধাপ বেড়ে গেল। সে চেষ্টা করত সব দিক সামাল দিতে। আবীর কোন কাজ করে না আর রীপা প্রচন্ড অলস এবং অহংকারী। রীপা সংসারের কোন কাজ তো করতই না বরং গোসল করে নিজের কাপড়টা অব্দি আবীর লিয়ার জন্য রেখে আসত। বেলা করে ঘুম থেকে উঠে তার জন্য ডাইনিং টেবিলে খাবার রেডি চাইত। লিয়া খাবার রেডি রাখলে খেত, না রাখলে গিয়ে আবার শুয়ে পড়ত। আবীর তখন বেকার ছেলে তাই সঙ্গত কারণেই রীপার প্রয়োজনীয় জিনিসের অভাব পূরণ করতে অপারগ ছিল। আবীরের এই অক্ষমতা নিয়ে রীপার সাথে প্রায় প্রতিদিনই কথা কাটাকাটি ও তুমুল ঝগড়া হতে লাগল। আবীর বাধ্য হয়ে এক সময় একটা গার্মেন্টসে চাকরি নিয়ে নেয়। এইচএসসি পাস করা একটা ছেলে এরচেয়ে ভালো কী চাকরিই করতে পারে?

রুকাইয়া যেখানে এমনিতেই এত লোকের উপস্থিতি মেনে নিতে পারছে না সেখানে রীপার এসব আহ্লাদী আচরণ আর অবান্তর বায়না তাকে আরও বেশি ক্ষেপিয়ে তুলল। সে অনবরত আবিদের কান ভাড়ী করতে লাগল। সারাদিন অফিস করে এসে রোজ রোজ এত সব ঝামেলা আবিদ মেনে নিতে পারছিল না। সে সিদ্ধান্ত নিল আবীরকে আলাদা বাসায় তুলে দেবে। সে ওদের দুজনের থাকার জন্য আলাদা একটা বাসা ঠিক করে দিয়ে সংসারের যাবতীয় জিনিস কিনে দিলেন। কিন্তু অহংকারী রীপার কোন কিছুই পছন্দ হল না। ঢাকা শহরে অল্প আয়ে বা কারো সাহায্য নিয়ে বিলাসী জীবন চাওয়াটা যে রীতিমত অন্যায় আবদার সেই বোধটুকুও রীপার মাঝে নেই! প্রতিনিয়ত রীপার এই অসহনীয় আবদার মেটাতে হিমশিম খাচ্ছিল আবীর। তাই সে এক সময় সিদ্ধান্ত নেয় এই রঙিন ঢাকা শহরে আর নয়। সে ঢাকার অদূর সাভারে এসে থাকার বন্দোবস্ত করে ফেলে।

সাভার জায়গাটা একেবারে গ্রামও নয় আবার আধুনিক শহরও নয়। এখানে দুটোর ইমেজই পাওয়া যায়। তাই থাকার জন্য ভালোই লাগে। ফ্রেস পানি আর বাতাস এখনো এখানে বিদ্যমান। আবীর সাভারে চলে আসার পর তার বাবাও সকলকে নিয়ে সাভারে চলে আসেন। এখানে ভাড়া বাসায় উঠে কিছুদিনের মধ্যে একটা জমিও কিনে ফেলেন। চেষ্টা করেন এখানে স্থায়ী হবার। আর এরপর থেকেই শুরু হয় নতুন আরেক অধ্যায়ের…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here