#জলনূপুর
Sharifa__Shuhasini
পর্ব,,,,,,,৫
নকীব ভাইয়া আপুকে উনাকে ডিভোর্স দেয়নি। আপু উনাকে ডিভোর্স দিয়েছেন। নিজের কাবিনের সমস্ত দায়ী থেকে মুক্ত করে দিয়েছেন । আমার ধারণা,নবনী আপা নকিব ভাইকে ভালোবাসেন। তবে তার চেয়েও বেশি করে ঘৃণা ।।
-মানে! এত ভালোবেসেও ডিভোর্স দিলেন? তাও আবার স্বেচ্ছায়? আমার তো মাথা আউলিয়া যাচ্ছে। লবনী আপুর মতো এমন বুদ্ধিমতী মেয়ে যখন এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তখন এর পেছনে নিশ্চয়ই কোন কারণ আছে।
সেই মুহূর্তে রিতু কোন জবাব না দিলেও ক্লাস শেষে রাতুলকে ক্যান্টিনে ডেকে তার নবনী আপার বিচ্ছেদের গল্পটি শেয়ার করেন।।।
“নকীবের সাথে নবনীর বিয়েটা মোটামুটি পারিবারিকভাবেই হয়েছিল। বাবা ফরিদ হোসেন নিজে দেখেশুনে বিয়ে দিয়েছিলেন।
পাত্র হিসেবে নকীব খারাপ নয় । অন্তত এই যুগে ১০-৫ টা যোগ্য ছেলের সারিতে প্রথম হবার সম্ভাবনাই বেশি। ফরিদ হোসেন বড় মেয়ের যোগ্য পাত্র পেয়ে মহানন্দে বেশ ধুমধাম করেই বিয়ে দিলেন। লবনীর যথাযথ মত আছে কি-না, সে বিষয়ে বাড়ির লোকের খুব একটা ধারণা নেই। তবে সে বলেছিল- রাজি।
বিবাহিত জীবন নিয়ে দুই পরিবারই মহা খুশি। কথাই বলে- সৃষ্টিকর্তা কিছু যুগল নাকি নিজে হাতে বানান।
নকীব-নবনীকে লোকজন দেখে সর্বদা সেই বুলিই আওড়েছে। দীর্ঘ দুই বছরের নির্ঝঞ্ঝাট সংসার বেশ ভালই ছিল। তবে হঠাৎ একদিন বিপত্তি বাঁধলো- নকীবের আনা একটা ছবি থেকে। সেই ছবিতে নবনী একটি ছেলের সাথে রেস্টুরেন্টে বসে আছে। দুজন মানুষের সামনে একটি মাত্র কফি। তাও নবনীর পছন্দের কফি। লবনী ছেলেটির হাত ধরে আছে।
রাতে ঘুমানোর আগে নবনী যখন বিছানা গোজগাজ করতে ব্যস্ত, নকীব এসে ওর চোখ হয়ে আটকে ধরে বলে ওঠে,
-তোমার জন্য আমার পক্ষ থেকে একটা বড় সারপ্রাইজ আছে। দেখবে?
লাবন্য নিজের চোখের উপর থেকে হাত সরিয়ে মৃদু হেসে জিজ্ঞাসা করে,
– হটাৎ সারপ্রাইজ?
-হ্যাঁ,এই দেখো ।
সে লাবণ্যের চোখের সামনে ফটোগ্রাফটা এগিয়ে ধরে ছবির মানুষ দুটিকে দেখে তার উত্তর দেয়ার ভাষা থাকে না। সে কেবলই শিকারি বাঘের থাবার নিচে আটকে পড়া হরিণ ছানার মত ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো। নকীব প্রচন্ড শান্ত মেজাজেই তাকে জানাই,
-আমার সাথে তোমার এমন সুন্দর ছবি নেই । তাই না বলো?
লবনী কম্পিত সরে জবাব দেয়,
-না, নেই । কিন্তু এ ছবি আমাকে দেখবার কারণ কি, নকীব? আর এমন বিচ্ছিরি অর্থপূর্ণ ছবি কে তুলেছে ? আর কেইবা পাঠিয়েছে!
-আমার ভীষণ ঘনিষ্ঠ বন্ধু। কিন্তু ছবি কেন পাঠিয়েছে, এখনো বুঝতে পারছ না? আমার আফসোস, নবনী। আমি ছাড়াও তোমার জন্য কারো হাত ধরার দরকার পড়ে।
– নকীব! আমি তোমার বিবাহিত স্ত্রী। বুঝেশুনে কথা বলো। এই ছবির অর্থ ভিন্ন। লবনীকে বিয়ের আগে তাকে না চিনেই বিয়ে করে ফেললে নাকি? তুমি কিন্তু আমার আত্মসম্মানে আঘাত দিচ্ছো।।
-আমি তোমাকে এতদিনও কিছু বলেছি? তুমি ওই ছেলেটির হাত ধরে বসে আছো । এর আবার ভিন্ন অর্থও হতে পারে !
নকীবের এমন কথাবার্তায় নবনী আর টু শব্দটিও করতে পারে না । যে সে ছেলেটির বিষয়ে তাকে বুঝাবে, কিন্তু কি বুঝাবে? কাকে বুঝাবে? যে তার ব্যাখ্যাটুকু শুনতে চাই না। অথচ ছবির ছেলেটার নাম অব্দিও নবনী জানে না । একদিন শপিংমল থেকে বের হবার সময় এক ভদ্রমহিলা নবনীর হাতে পায়ে ধরে কান্না করতে শুরু করে। ভদ্রমহিলাটির স্বামী দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন, জরুরী ভাবে বি পজেটিভ রক্ত প্রয়োজন। অথচ ছিন্নমূল মানুষ দেখে এই জগতের একটি কাকপক্ষীও এগিয়ে আসছে না। সব শুনে নবনিও মহিলাটির সাথে রক্তদাতা খুঁজতে হন্যে হয়ে গেল। সমাজের উঁচু শ্রেণীর মানুষের সম্পৃক্ত থাকার সুবিধা সেদিন নবনী বুঝতে পারে। অনেকেই রক্ত দিতে এগিয়েও আসে। শেষমেষ ভার্সিটি পড়ুয়া একটি ছেলেকে পাওয়া যায় । কিন্তু বিপত্তি বাধে রক্ত দেওয়ার পর ছেলেটি বাইরে এলে বেশ দুর্বল অনুভব করে । নবনীই তখন তাকে ধরে পাশে একটি কফিশপে বসায়। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতে দিয়ে নিজে থেকে টুকটাক ফলমূল আর জুস কিনে দেয় । ছেলেটির হাত সে ধরেছিল, একথা সত্য। তবে তার কারণ ছিল- শুধুমাত্র তার শরীরের অবস্থা দেখার জন্য। একজন ডাক্তার না হলেও একজন স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে যতটা একটা মানুষের করা উচিত, ততটাই। ঘটনা এ পর্যন্তই।
নকীব অবশ্য খুব বেশি কথা শোনালো না । প্রয়োজনও নেই। নবনী প্রচন্ড আত্ম সম্মানী একটা মেয়ে। সে নিজে যেমন স্বচ্ছ কাছের মত পৃথিবীটাকে দেখতে ভালোবাসে, তেমনি মনে করেন আশেপাশের মানুষগুলোকেও। নিজের আত্মসম্মানে আঘাত লাগে- এমন কর্মের চিন্তা সে কল্পনাও করতে পারে না। কিন্তু ওই যে, আত্মসম্মানী মেয়েদের এই এক সমস্যা। তাদের অভ্যাস, আচরণ কিংবা চরিত্র নিয়ে কেউ সিকিভাগও প্রশ্ন তুললে, তা মেনে নিতে পারে না। নমনীও পারলো না। কাঠের পুতুলের মত ঠাঁই দাঁড়িয়ে থেকে নকীবের অনুযোগ শুনে গেল।
সেদিন সে নকীবের ভুল ভাঙানোর বিন্দুমাত্র চেষ্টা করল না। ভুল করার যেখানে তার কোন অপশনই ছিল না, তাহলে কেন ভাঙ্গাবে?”
রিতুর কাছে এসব শুনে নবনী আপাকে ঠিক কোন দাড়িপাল্লায় মাপবে, সেটাই বুঝতে পারেনা রাতুল। কিন্তু মানুষের একমাত্র সম্পদ তাদের আত্মসম্মান। নবনী আপারও তাই। কিন্তু এ কারণে নিজের স্বামীকে ডিভোর্স দিয়ে দিবে? ব্যাপারটা বুঝে আসেনা ওর।
রিতু ওর অবস্থা বুঝতে পেরে আবার বলল,
-আমি জানি, তুমি নবনীর আপার গল্প শুনে কি ভাবছো । কিন্তু ঘটনা এখানে শেষ ছিল না। এর কিছুদিন পর আপা নকীব ভাইকে নিজে থেকেই সেদিনের ব্যাপারে “বিস্তারিত চিঠি” লিখে রেখে আমাদের এখানে আসতে চেয়েছিলেন। লকীব ভাই পড়ে চমকে যেতেন, হয়তো আফসোসও করতেন । অথচ সেটা হলো না। আপা যেদিন চিঠি লিখেছিলেন, সেদিন দুর্ঘটনাক্রমে জানতে পেরেছিল- নকীব ভাইয়া তার প্রাক্তণের সাথে বেশিই যোগাযোগ করেছিলেন। প্রাক্তণের ব্যাপারে আপা জানতেন, কিন্তু গভীরতা তার জানা ছিল না। সম্ভবত উনার প্রান্তন সবকিছু ঠিক করে নিতে চাইছিলেন। যে কারণেই হোক- উনি নিজের দোষ লুকিয়ে বরং আপার আত্মসম্মানেই খোঁচা মে*রেছিলেন।
অবশেষে এসব জানার পর আপা ও বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছেন। এক সপ্তাহের মধ্যে ডিভোর্স লেটারও পাঠানো হলো।
জানো রাতুল? নকীব ভাই কিন্তু এখন নিজের ভুল বুঝতে পেরে আপার কাছে অনেকবার ফিরে আসছে চেয়েছেন। কিন্তু আপা জায়গা দেননি। যে বিশ্বাস তার ভেঙ্গেছে- আবার জোড়াতালি দিয়ে সারাজীবন মনের ভিতর পুনরাবৃতির ভয় নিয়ে বেঁচে থাকা তার পক্ষে সম্ভব নয়। আমার আপা এমনই। তাকে পৃথিবীর কোন দাড়িপাল্লায় মাপা যায় না , হিসাব করা যায় না।
লবনীর জায়গায় হয়তো সে ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। নকীব ভাইকে মনে মনে ভালোবেসে গেলও, সে ভালো থাকতে পারবে। কিন্তু আবার একসাথে থেকে আজীবন মানুষটার কথা কিংবা আজকে ভিতরে ভিতরে সন্দেহ করতে হবে-এমন পরিস্থিতিতে লবনী সুস্থ থাকতে পারবে না। কখনোই না। রাতুল বলল,
-এজন্যই উনি আমান ভাইকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। জগতে আসলে এমন কিছু মানুষ থাকে- যারা সহজে কাউকে নিজের মনে জায়গা দেয় না। আবার যাকে একবার দেয়, তাকে পুরোটা দিয়ে নিজেকে শূন্য করে ফেলে । এমনভাবে যে মানুষের মন একবার ভেঙ্গে যায় সে আর কখনোই কাউকে বিশ্বাস করতে পারে না।
শেষ বিকেলে বাসায় ফিরে রিতু তার বোনের ঘরে ঢুকে দেখে, লবনী ঘরে নেয়। বারান্দার দরজা খোলা দেখে সেদিকেই এগিয়ে গেলে দেখতে পায়, মাঝারি সাইজের ক্যানভাসে একটা ধূমায়িত একটা মস্তিষ্ক আঁকানো। চোখ আর চুলের অবস্থা দেখে বুঝা যায়-এটি কোন মেয়ের ছবি হবে। তবে বিশ্বাস বিশ্বাস মুহূর্তে। খুব খুশি থাকলে আর না হলে খুব মন খারাপ থাকলে। রিতু বোনের দিকে এগিয়ে গেল । নবনীর দুই চোখ লাল হয়ে আছে। কিছুক্ষণ আগেই যে মেয়েটা অঝোরে কান্না করেছিল, তাই স্পষ্ট!
-আপা!
-এই ভদ্রলোকটি আমাকে নিয়ে কেন খেলছে, রিতু? আমি তাকে কেন বিশ্বাস করতে পারছি না! আমার কি করা উচিত একটু বলে দে না,,,,,,,,,
চলবে,,,,,,