#জলনূপুর
#Sharifa_Suhasini
#পর্ব ৪
আমান মুচকি হাসলো। একটা কফির জার ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
-কথাটা আংশিক সত্য। হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরছিলাম। আপনার বাবাকে ফোন দিলে উনি জানান -আপনি এখানে। তাই স্টক করতে চলে এলাম। বিরক্ত হলে চলে যাচ্ছি।
-উহু, যেতে হবে না। আপনাকে অনেকগুলো প্রশ্ন করার আছে।
-করুন।
-আমি যেই আমানকে দেখছি, এটা আপনি নন। তাই না? যা আমার সামনে দেখাচ্ছেন,তা সম্পূর্ণ ভূয়া। আর একটা সত্যি কথা বলুন তো। আপনি আমার সম্পর্কে এত তথ্য কেন আর কিভাবে পেলেন?
আমান নির্বাক হয়ে ওর দিকে তাকালো। সে যেমন মানুষ, ঠিক তেমনটাই নবনীর কাছে প্রকাশ করেছে। কোনো ভনিতা নেই, মিথ্যা নেই, অহেতুক প্রেম নিবেদন নেই। এর বাইরে আবার কেমন রুপ থাকতে পারে?ব্যাপারটা কিছুতেই বুঝে আসেনা ওর। সে এরকম হতভম্ব হয়েই নবনীর দিকে চেয়ে আছে। কিন্তু নবনীর এতে বিন্দুমাত্র মায়া হলোনা। মানুষের উপর থেকে তার সমস্ত মায়া তার অনেক আগেই উঠে গেছে। যা আছে, তা মানুষ হিসেবে সামান্য আবেগ। নবনী মনে করে -পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বোকামো হচ্ছে অন্যকে বিশ্বাস করা। একটা মানুষ যতো বড়ই বিশ্বাস অর্জন করুক না কেন, একদিন না একদিন ঠিকই সে বিশ্বাস ভঙ্গ করবেই করবে।
আমান একবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে পাল্টা প্রশ্ন করে,
-আমার বয়স কত জানেন? ঊনত্রিশ। এই বয়সে এসে আমি বাচ্চা ছেলেদের মতো প্রেমিকা পটানোর নাটক করবো? আপনিই বলুন।
-,করতেই পারেন। প্রেমিকা পটানো নাটক না হলেও ভিতরে ভিতরে কিছু না কিছু তো একটা আছেই। নাহলে আপনি আমাকে বিয়ে করতে চাওয়ার মতো এতবড় সিদ্ধান্ত নিবেন,এটা ভাবলেই আমার শ্বাস আটকে আসছে। আমি একজন ডিভোর্সি,এটা জানার পরেও আপনি আগ্রহ দেখাচ্ছেন। শুধু আপনি নন, আপনার বাবা আরমান খান,বোন ফৌজিয়া পুরো গোষ্ঠী এতো সহজে মেনে নিচ্ছেন। এই একুশ শতকে এসে এটাও আমাকে মেনে নিতে হবে? পৃথিবী এতো তাড়াতাড়ি বদলে গেল কিভাবে? আশ্চর্য লাগে।
আমান যেন একবারেই থমকে গেল। কফি ঠান্ডা হয়ে আসছে। সেদিকে দুজনের একজনেরও মনোযোগ নেই। আমার ইচ্ছে করছে, এখুনি মাটির তলায় নিজে নিজেই পুঁতে যেতে। সে তো স্বচ্ছ মনেই ওকে ভালোবাসে ।
মুহুর্ত খানিক পর আনামের হঠাৎ খেয়াল হলো -নবনীর এত আপত্তির কারণ কি? সে ডিভোর্সী বলে নিজেকে এত ক্ষুদ্র মনে করছে! সে ভাবছে, আমান নিশ্চয় তাকে করুনা করে বিয়ে করতে চায়। ডিভোর্স হবার পর মেয়েটা আশেপাশের পরিবেশ, পরিস্থিতি আর মানুষের কাছ থেকে এতো বেশি কটুক্তির স্বীকার হয়েছে যে, এই দুনিয়ার সবকিছুই তার কাছে বিষাক্ত অনুভব হয়।
আমান একবার নবনীর চোখের দিকে তাকালো। কি সুন্দর চোখ! চোখের পাপড়ি গুলো আলতো করে কাঁপছে। চোখেমুখে যেন সৃষ্টিকর্তার পরম মায়া ঢেলে দেওয়া। এই মেয়েটি শহরের একশো সুন্দরীর সারিতে প্রথম হবে না। এমনকি দ্বিতীয়, তৃতীয় কিংবা একশো হবার সম্ভাবনাও নেই তবুও কি ভীষন আকর্ষণ তার মধ্যে আছে,তা যদি নবনী জানতো-তবে নিজেকে সোনার কৌটায় যত্ন করে তুলে রাখতে চাইতো। আমান তো ওর জন্য সেই সোনার কৌটাটিই হতে চায়। অথচ মেয়েটা অতীতের বিষাক্ত স্মৃতি থেকে বের হতে পারছেনা। ভালোবাসার মানুষকে নিজের অনুভূতি বুঝাতে না পারার মতো যন্ত্রনা একজন প্রেমিকের কাছে আর কিইবা হতে পারে!
আমান সামান্য হাসির চেষ্টা করে বললো
-আপনার বাবা এবং বোন মনে করে আপনি অত্যন্ত চৌকস একজন নারী। অথচ আপনি জানেন , আপনি কতো বোকা?
নবনী ঘাড় ঘুরিয়ে ওর দিকে পাশ ফিরে তাকালো। বার দুয়েক চোখের পলক ফেলে বললো,
-কী অদ্ভুত! এই কথাটা আমিও ভাবি । ওদের কোনোভাবেই বুঝাতে পারিনা_আমি আসলেই একজন বোকা মেয়ে। আমার মাথাটা অন্তঃস্যারশূন্যতায় বদ্ধ। কিন্তু আপনি কিভাবে বুঝলেন আমি বোকা?
-বলতে পারি। তবে এক শর্তে।
-আমাকে শর্ত দিবেন না প্লীজ । শর্ত প্রতিশ্রুতি এসব আমি আমার থেকে শত কিলোমিটার দূরে রাখি। এসব ভন্ড মানুষের অভ্যাসের শব্দ। যাই হোক, কিছু বলার থাকলে,তা সরাসরি বলুন।
-আচ্ছা। আমি আপনাকে বলবো, যদি আপনি আমার সাথে কোথাও বসে ঠান্ডা মাথায় একটু গরম কফি খান।
-আপনার কফিটা প্রায় ঠান্ডা হয়ে গেছে। এই না, না,ওয়েট। খাওয়ার মতো এখনো গরম আছে। এখান থেকে পশ্চিম দিকের গলিটা পেরিয়ে শুনে শুনে ঠিক একশো পা এগোলেই শহীদ চত্ত্বরের ছোট্ট একটি পার্ক আছে । ওখানেই বসি।
আমান মাথা দুলিয়ে সায় দেয়। নবনী তার কথায় সহজ হয়ে আসছে। মেয়েটার সরলতা তাকে ঠিক এই মূহুর্তে একটা জিনিসই উপলব্ধি করালো-মেয়েটির আসলে লাইফ পার্টনার চায় না। আগে চায় তাকে বোঝার মতো একজন বন্ধু। নিজেকে লুকোতে লুকোতে সে মানুষের ভিড় থেকে অনেক দূরে সরিয়ে ফেলেছে। বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে তাকে সেখান থেকে ফিরিয়ে আনতে হবে।
পার্কের একটা বেঞ্চে বসে নবনী ঠান্ডা কফি খাচ্ছে। ঠিক ঠান্ডা বললে ভুল হবে, হালকা গরম কিংবা কুসুম গরমই বলা যায়। কফির এই অবস্থায়ও আলাদা একটা স্বাদ আছে, যা আগে কখনো টের পায়নি। গরম কফি ঠান্ডা হয়ে এলে তখন কফির ফ্লেভারটাই বেশি পাওয়া যায়। হঠাৎ কি মনে হলো, মুখ থেকে কফির জার সরিয়ে সে উচ্চস্বরে হেসে উঠে। আমান ব্যাপারটা ধরতে না পেরে বোকার মতো চেয়ে আছে। নবনী তখন হাসতে হাসতেই বলে,
-আমান সাহেব, আপনি কি ভাবছেন? আমি কেন বোকা – এটা আপনি কিভাবে বুঝেছেন, তা জানার জন্য আমি এখানে এসে বসবো?
আমান কি জবাব দেবে, ভেবে পায় না। নবনীর সাথে সাথে সেও হেসে ফেলে। নবনী আবার বললো,
-আমি মোটেও এসব জানার জন্য এখানে আসিনি।
-তাহলে?
-তখন আপনার সাথে হয়তো কড়াভাবে কথা বলে ফেলেছি। কথাগুলো আপনার কাছে খারাপ লেগেছে হয়তো। তাই এজ এ হিউম্যান বিং, আপনাকে একটু সঙ্গ দিচ্ছি।
-আপনাকে তখন বোকা বলাটা আমার ভুল হয়েছে। কড়জোরে আমি মাফ চাই। এবার বলুন, চাকরিটা কি হয়েছে? আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, হয়েছে।
-হয়েছে। কিন্তু এই মনে হবার কারন?
-সব ব্যাপারে এতো কারন খোঁজেন কেন? কারণ ছাড়া কি দুনিয়ার কিছু হয় না?
-না, হয়না। এই দুনিয়ার সবকিছুতেই কারন থাকে। এই যে,ওরা আমাকে চাকরি দিলো, এখানে কারন আছে। আজ যে মানুষগুলো যাচ্ছে,তারও কারন আছে। আর এইযে আপনি নিজের চেম্বার থেকে ছুটি নিয়ে আমার জন্য কফি নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন, তার পেছনেও কারন আছে।
-তাহলে আপনার প্রাক্তন স্বামীর সাথে ডিভোর্স হবার কারন কি?
নবনী চুপ হয়ে গেল। কিছুক্ষণ শুধু ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল মাটির দিকে। আমান আবার বলে,
-সেদিন কিন্তু এই ব্যাপারে কথা বলতে চেয়েছিলেন।
-সেকারনেই কি আজ ক্ষতটাকে খোঁচাতে চাচ্ছেন?
-না, আমার নিজের জন্য আমি জানার প্রয়োজনও মনে করি না। কিন্তু আপনি শুধুমাত্র এই একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে জীবনটাকে একটা বৃত্তের মধ্যে আটকে ফেলেছেন। আমি সেই বৃত্তের গোলকধাঁধা আপনাকে মুক্ত দেখতে চাই। আপনার স্বার্থেই আজ আমি জানতে চাই।।
নবনী অকস্মাৎ উঠে দাঁড়ালো। ডানে-বামে কোথাও না তাকিয়ে দ্রুত পায়ে সে পার্ক থেকে বের হয়ে যায়। আমান বেঞ্চে বসেই পিছন থেকে লজ্জিত স্বরে বলছে,
-নবনী আই এম সরি। আমি এভাবে বলতে চাইনি…
কিন্তু নবনী কোনো কথাই শুনলো না। তার মন আর মস্তিষ্কে সে কি নিয়ে আরাধনা করে, তা কেবল মাত্র সেই জানে।
ক্লাসের ঠিক সামনেই দেয়াল হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রাতুল। আর তার সামনে রিতু। রাতুল কিছুটা কৌতুহলি হয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করছে,
-তোমাদের বাড়ি থেকে সেদিন আসার পর আমার মাথায় শুধু একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে।
-প্রশ্ন? কি? আমার আপনাকে নিয়ে?
-হ্যা। উনার মতো একটা মানুষের ডিভোর্স কিভাবে হতে পারে? উনার প্রাক্তন স্বামী বোকা নাহলে উনাকে ডিভোর্স দেয়?
রিতু জবাব দেয়,
-নকীব ভাইয়া আপুকে ডিভোর্স দেয়নি । আপুই উনাকে ডিভোর্স দিয়েছেন। নিজেদের কাবিনের সমস্ত দায় থেকে মুক্ত করে দিয়েছেন। আমার ধারণা, নবনী আপা আজও নকীব ভাইয়াকে ভালোবাসেন। তবে তার চেয়েও বেশি করে ঘৃনা।
-মানে! এতো ভালোবেসেও ডিভোর্স দিলেন? তাও আবার স্বেচ্ছায়? আমার তো মাথা আউলিয়ে যাচ্ছে!
চলবে…..