জলনূপুর পর্ব ১

0
1750

পাত্রী দেখতে এসে পাত্রীর ডিভোর্সি বড়বোনকেই পছন্দ হয়ে গেল। পাত্রীর ঠিক পাশেই তার ডিভোর্সি বোন নবনী দাঁড়িয়ে আছে। আমি বিয়ের পাত্রীকে না দেখে নবনীর দিকে চেয়ে আছি-এই ব্যাপারটা দুইপক্ষের সবাই টের পাচ্ছে। শুধু নবনীই এখনও খেয়াল করছে না। ইশশ! মেয়েটা আমার দিকে কখন তাকাবে?

পাত্রীর ঠিক সামনের সোফায় বসে একমনে ভাবছে আমান ফাহমি। গত বছর ইন্টার্নি শেষ করতে না করতেই মাত্র এক বছরের মধ্যেই প্রফেশনাল ডাক্তার তকমা পেয়ে গেছে। বিয়ের পাত্রী রিতুও মেডিকেল স্টুডেন্ট। এ বছর থার্ড ইয়ারে উঠেছে মেয়েটা। ডাক্তারে ডাক্তারে দারুণ মিলবে ভেবেই পরিবারের কথায় রিতুকে দেখতে আসা। কিন্তু এখন কি-না তার পাত্রীর বড়বোনকেই পছন্দ হয়ে গেছে।

রিতুর বাবা ফরিদ হোসেন বেশ বিব্রত হয়ে বলে উঠলেন,
-আমার মেয়ে কিন্তু মেডিকেল কলেজে ওর ব্যাচের মধ্যে সেকেন্ড। ফার্স্ট পজিশনে আছে একটি ছেলে। তবে আশা করা যায়, রিতু তাকেও টপকে যাবে। আচ্ছা, আমরা বড়োরা তো কথা বলছিই। তোমরা বরং একটা কাজ করো বাবা। তুমি আর রিতু আলাদাভাবে কথা বলো। এই রিতু, আমানকে তোর ঘরে নিয়ে যা।

-তার আর দরকার নেই আংকেল। আমি রিতুকে নয়, রিতুর বড় বোনকে বিয়ে করতে চাই। উনাকে আমার ভীষণ পছন্দ হয়েছে।

আমানের মুখে এ কথা শুনে এবার বাড়িসুদ্ধ সবাই চমকে উঠলো। পাত্রীর সামনে এ কী দুঃসাহসিক কথাবার্তা! এতক্ষণে নবনী আমানের দিকে তাকালো। মেয়েটার শান্ত দৃষ্টি, নরম পাতলা দুটি ঠোঁট। বুকের ভেতর সমুদ্রের জোয়ার তুলতে ওই দৃষ্টিই যথেষ্ট। আমানেরও তাই হলো। কিন্তু সেই অনুভূতি বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। আমানের বড় আপা ফৌজিয়া রহমান ধমক দিয়ে বলে উঠলেন,
-পাগল হয়েছিস নাকি? নবনী বিবাহিত। আর তাছাড়া গত দুইমাস আগে ওর ডিভোর্সও হয়ে গেছে। আমরা দেখতে এসেছি রিতুকে। আর তুই কি-না এখন নবনীকে পছন্দ করছিস?

ফরিদ হোসেন কী করবেন, ভেবে পাচ্ছেন না। তার কাছে তার দুটি মেয়েই কলিজার টুকরা। তাই বলে একটি মেয়ের জন্য আরেকটি মেয়ের জীবন তো তিনি নষ্ট করতে পারেন না। অত্যন্ত লজ্জিত হয়ে তিনি রিতুর মুখের দিকে তাকালেন। মেয়েটা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে ঘরভর্তি মানুষগুলোর যুক্তিতর্ক শুনছে, যেন এখানে কোনো সার্কাসের আয়োজন হয়েছে আজ। ফৌজিয়া রিতুর হাত ধরে বললেন,
-রিতু, তুমি কিছু মনে করো না। আমরা আসলে তোমাকেই দেখতে এসেছি। আমান হয়তো বুঝতে পারছে না।

রিতু তার ঠোঁটের কোণে স্মিত হাসির রেখা টেনে বললো,
-আমি আমানের সাথে একাকী কথা বলতে চাই। আপনার কি কোনো সমস্যা আছে আমান সাহেব?

আমান মাথা দুলালো। রিতু নিজেই উঠে দাঁড়িয়ে নিজের ঘরের দিকে এগিয়ে গেলে আমান একপলক নবনীর দিকে চেয়ে চুপচাপ রিতুর পিছু পিছু ঘরে ঢোকে।
জানালার পাশে ছোট একটি চেয়ার পাতা। সেখানে বসে বাইরের দিকে চেয়ে আছে রিতু। মাথার উপর ফ্যান ঘোরার গড়গড় আওয়াজ ছাড়া যেন কারো নিঃশ্বাসের শব্দও শোনা যাচ্ছে না। ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে সে রিতুর বিছানার উপর বসলো।

-আপনাকে কী বলেছিলাম, আর আপনি কী করছেন?
বেশ রুঢ় স্বরে প্রশ্ন করলো রিতু। আমান ওর দিকে তাকিয়ে দেখে, রেগেমেগে মেয়েটার নাক মুখ ফুলে গেছে। আমান কিছুটা বিব্রত হয়ে বললো,
-তোমাকে আমার পছন্দ নয়, এটা তো বললামই।

-না, আপনি শুধু এইটুকু বলেননি। আপনি নবনী আপুকে বিয়ে করতে চেয়েছেন। এটা কি আমাদের কথা ছিল?

আমান মৃদু হাসলো। কিছুদিন আগে রিতুকে দেখার জন্য বাড়ি থেকে রীতিমতো মাথাব্যথা ধরিয়ে দিয়েছিল। গতকাল চেম্বারে বসে রোগীর সিরিয়াল জানার জন্য কম্পাউন্ডারকে কল দিতে সে মোবাইল ফোন বের করে দেখে, নয়টা মিসড কল। অপরিচিত নাম্বার। জরুরি ভেবে সে কলব্যাক করে। ওপাশ থেকে একটা মিষ্টি নারীকন্ঠ বলে ওঠে,
-ডাক্তার আমান, আমি আপনার বিয়ের পাত্রী রিতু। এই মুহুর্তে আপনার চেম্বারের বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। একটু জরুরি কথা ছিল। বাইরে আসবেন প্লিজ?

-রিতু! কিন্তু আমি তো একটু পরেই পেশেন্ট দেখবো। এই অবস্থায়… আচ্ছা, একটা কাজ করো। তুমি আমার চেম্বার রুমে চলে আসো। মানিককে বলে দিচ্ছি, ও তোমাকে নিয়ে আসবে।

তিন মিনিটের মধ্যেই মানিক নিজ দায়িত্বে রিতুকে ভিতরে নিয়ে আসে। আমান চেয়ে দেখে-পাতলা ছিপছিপে শরীর, লেয়ার কাটিং করা চুল এবং ভিতরে ভিতরে যেন মানসিকভাবে বিধ্বস্ত এক তরুণী। ধপ করে চেয়ারে বসেই সে প্রশ্ন করলো,
-আপনি কি রেগে আছেন? নাকি শান্ত? যদি শান্ত থাকেন, তবেই কথাটা বলবো।

-তুমি বলো। সমস্যা নেই।

-আমি একটি ছেলেকে ভালোবাসি। আমার মেডিকেল কলেজের ফার্স্ট বয়৷ কিন্তু এরমধ্যে বাবা আপনার সাথে আমার বিয়ে দিতে উঠেপড়ে লেগেছেন। আমি যদি আমার প্রেমিকের কথা উনাকে বলি, উনি কোনোভাবেই আমার কথা শুনবেন না। কারণ একটাই, আপনার বাবাকে কথা দিয়ে ফেলেছেন।

-তুমি জরুরি কথার বিষয়ে যখন বলেছ, তখনই বুঝতে পেরেছি। বলো এখন কীভাবে সাহায্য করতে পারি? বিয়ে ক্যান্সেল করে দেবো?

-লাভ নেই। আপনার বাবার সাথে আমার বাবার বিশাল সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছে। আমার কথা তো শুনবেই না। আপনিও পারবেন না।

-তাহলে বিয়ে করে ডিভোর্স দেওয়া ছাড়া কীভাবে কী করবো?

-আগামীকাল আমাকে আপনার পরিবার থেকে দেখতে আসার কথা। আপনিও আসবেন, জানি আমি। আর সেজন্যই অনেক কষ্টে আপনার ফোন নাম্বার যোগাড় করেছি। কাল আমাকে দেখতে এসে শেষ পর্যায়ে সবার সামনে বলবেন- “পাত্রী আপনার পছন্দ নয়। আপনার সাথে ম্যাচ করছে না৷ ” ব্যস, দুই পক্ষের সবাই বিশাল বিড়ম্বনায় পড়ে যাবে। বাবাও এই অপমান কিছুতেই মানবে না। আর বাকিটা আমি দেখে নেবো।

গতকাল রিতুর কথামতো আমান তাকে আশ্বস্ত করলেও আজ নবনীকে নিয়ে আরেক ঝামেলা বাধিয়ে ফেলেছে। নিজেদের চুক্তির কথা মনে করিয়ে দিয়ে রিতু আবার প্রশ্ন করে,
-আমার আপুকে কেন এরমধ্যে জড়িয়ে ফেলছেন বলুন তো?

-কারণ তোমার আপুকে আমার সত্যিই পছন্দ হয়েছে। আমি প্রথম দেখায় উনার শুভ্রতার প্রেমে পড়েছি। উনার চোখের গভীর দৃষ্টির প্রেমে পড়েছি। আর বিয়ে করলে উনাকেই করবো। এটাই সত্যি, এটাই আমার শেষকথা।

রিতু হতবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো। এদিকে বাইরে ঘরের এককোণে লজ্জায় গুটিসুটি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে নবনী। ভদ্রলোক এতগুলো মানুষের সামনে এটা কী বললেন! তাছাড়া এরপরই বা কী করবে সে!

গল্প:- #জলনূপুর (পর্ব:-০১)
লেখা- Sharifa Suhasini

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here