আড়ালে অন্তরালে পর্ব ৬+৭

0
508

#আড়ালে_অন্তরালে
#মাহমুদা_লিজা
পর্বঃ ৬

কাজি ডেকে সবার উপস্থিতিতে তিন কবুল বলে মায়াকে যখন নিজের জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে নিল তখন ফাহিমের চোখে মুখে স্বপ্ন জয়ের আনন্দ।
অচেনা, অজানা একটা মানুষকে কালেমা পড়ে কবুল বলে নিজেকে সোপর্দ করার মুহূর্তে কান্নায় ভেঙে পড়ে মায়া। বাবার সাথে যেই মানসিক দূরত্ব তৈরী হয়েছে তা এক লহমায় যেন সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ের মত দূরে বহুদূরে বয়ে চলে গেছে। বাবাকে জড়িয়ে ধরে বাবার বুকে বিলাপ করার মত কাঁদছে মায়া। না জানি আবার কোন সমস্যার পথে পা বাড়িয়েছে সে।
নিজেকে অর্ধ আড়াল করে নীরবে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে মিরাজ। বোনটাকে আগলে রাখতে না পারার ব্যর্থতায় বোনের নজরে নজর মিলাতে বড্ড অযোগ্য লাগছে নিজেকে।
রাশেদা হতবিহ্বলের মত হিসাব মিলাতে লাগল কিন্তু কোথাও যেন সূত্র না মেনে হিসাবটা মিলছে না।
গুমোট পরিস্থিতিটাকে কিছুক্ষণ মানতে বাধ্য হলেও বেশিক্ষণ তা আর ফাহিমের ভালো লাগছে না। এতক্ষণ দাঁড়িয়ে সব দেখলেও এবার মায়ার বাবার সামনে গিয়ে বীরের মত মাথা উঁচু করে বলল – এবার বিদায় দিন। এই বি ষা ক্ত অক্সিজেনে আমি আমার স্ত্রীকে আর নিশ্বাস নিতে দিতে আগ্রহী নয় মোটেই। সে মুক্ত বাতাসে বুক ভরে অক্সিজেন নিবে।

ফাহিমের কথায় কাঠিন্যের সুর আশরাফকে ভারাক্রান্ত করেছে। তবুও ভঙ্গুর হৃদয়ে অনাদরে বড় হওয়া মেয়েটাকে স্বামীর হাতে তুলে দেওয়ার সময় কাকুতি মিনতি করে বললেন – আমার মেয়েটাকে কখনো শান্তি দিতে পারিনি বাবা। ওকে একটু শান্তি দিও। এক অসহায় মেয়ের বাবার অনুরোধ তোমার নিকট। আর্জিও বলতে পারো।
সবার সামনে মায়াকে বুকে আঁকড়ে ফাহিম বলল – ওকে আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্যে হয়তো রাখতে পারব না কিন্তু সে আমার মনের সিংহাসনের দেবী হয়ে থাকবে। আমার আর তার রাজ্যে সে আমার রাণী হবে। দোয়া করবেন। আমি যাচ্ছি আপনার মেয়ে আর আমার স্ত্রীকে নিয়ে।
বাবার বুকে নিরাপদে এতক্ষণ ছিল মায়া। ফাহিম তাকে আলতো হাতে টেনে নিয়ে বলল – সময় পেলে বাবাকে দেখতে চলে এসো। এখন চলো। এখানে থাকতে আমার বড্ড বিতৃষ্ণা লাগছে।
বাবাকে ছেড়ে আসতে খুব কষ্ট হচ্ছে মায়ার। বুঝতে পারেনি বাবার সুপ্ত আদর, ভালবাসা। ফাহিমের সাথে সেও পা বাড়াল কেঁপে কেঁপে।
আঘাতে আঘাতে দূর্বল মায়া যে নিজের পায়ের তালে পা মিলাতে পারবেনা তা ভালোই বুঝেছে ফাহিম। লম্বা নিশ্বাসটা টেনে এক ঝটকায় মায়াকে কোলে তুলে নিয়ে সে মুখটা মায়ার কানের কাছে এনে বলল – মনে হচ্ছে নবজাতক কোন বাচ্চা কোলে নিয়েছি। পরিণত একজন মানুষের ওজন এত কম হয়!

এগিয়ে গেল ফাহিম, পিছু ফিরলো না আর। ফাহিমের কোলে থাকা মায়া লজ্জায় সদ্য ফুটন্ত গোলাপের মত রাঙা টুকটুকে হয়ে আছে।
এক পা, দু পা, তিন পা আস্তে আস্তে সকলের দৃষ্টিসীমা অতিক্রম করে চলে গেলো সে। তার মনের করিডোরে কারা যেন শত শত আলো জ্বা লি য়ে অপেক্ষা করছে তার অশান্ত মনটা শান্ত করবে বলে। এ কেমন অনুভূতি তার! নিজেকে প্রবোধ দেয়াই দায়।

______

গতরাত থেকে ইমতিয়াজের সকল চেষ্টা প ন্ড করে দিল তোড়া। এতদিন বাদে এসেছে বলে রাগে গাল ফুলিয়েছে তোড়া। কি মনে করে সে! আঠার দিন কোন খোঁজ খবর নেই। একেবারে লা-পাত্তা সে। আজ এসেছে ঢং দেখাতে। কিছুতেই মান ভাঙবে না তোড়ার। ইমতিয়াজকে উল্টো পাশ করে মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে। ইমতিয়াজও ছোট বাচ্চার মতন নাছোড়বান্দা হয়ে তোড়ার মান ভাঙাতে সবকিছু করছে। ইমতিয়াজ গম্ভীর স্বরে বলল – তোড়া!
তবুও মুখ ঘুরালো না মেয়েটা। ইমতিয়াজ যেই তার হাতটা ধরেছে অমনি তেতে উঠে বলল – একদম ছোঁবে না বললাম।
কপট ভয়ের ভান করে হাতটা সরিয়ে নিয়ে ইমতিয়াজ বলল – এভাবে কেউ ধমক দেয়? আমার কড়া গণিত স্যারও এভাবে ধমক দেয়নি বউ।
মুখটা লুকিয়ে হাসলো তোড়া, সে বুঝতেও পারলোনা ইমতিয়াজের অভিনয়। সে ভাবছে তার বর তার ধমকে ভয় পেয়েছে। ব্যাপারটা ভাবতেই ঠোঁট টিপে যেই হাসলো অমনি তার গালে টুক করে একটা চুমু খেল ইমতিয়াজ। এতক্ষণ অশান্ত, চঞ্চল মেয়েটা যেন ঐ একটা চুমুতেই হা র মেনেছে। শান্ত হয়ে চোখটা বুঁজে চোখের অবাধ্য অশ্রুগুলো ছেড়ে দিল সে। তার শান্ত হয়ে যাওয়া অনুভব করে ইমতিয়াজ কায়দা করে তাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিল। নিজের অর্ধাঙ্গিনীর অশ্রু ফোঁটাগুলো আলতো করে মুছে দিয়ে বলল – এত অভিমান! তোমার চোখের জল যে আমার বুকের পিঞ্জরে আবদ্ধ থাকা পিন্ডটার র ক্ত ক্ষরণ বাড়িয়ে দেয় তা কি তুমি বোঝো?
ইমতিয়াজের বলা প্রতিটা কথায় তোড়ার অভিমানের পাহাড় চুরচুর করে ভেঙে যাচ্ছে তা ভালোই বোঝা যাচ্ছে।
হু হু করে কেঁদে উঠে মেয়েটা বলল – আপনি জানেন না আমি নয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা? তবুও আঠার দিন আমার খবর নিয়েছেন? কেমন লাগে আমার কাছে তা কি কখনো ভেবে দেখেছেন? নাকি আমি প্রেগন্যান্ট দেখে আমার সৌন্দর্য মলিন হয়ে গেছে দেখে আপনি অন্য কারো সৌন্দর্যে মজেছেন? তাহলে একেবারে খু ন করে ফেলব। আমার প্রেগন্যান্সির পিছনে সব দায় আপনার।
স্ত্রীর কথায় হাসি আঁ ট কে রাখতে চেয়েও পারলোনা ইমতিয়াজ। হো হো করে হেসে উঠে পাগলীটাকে বুকে টেনে বলল – প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে তোমার খবর রেখেছি পাগলী। কে বলছে তোমার সৌন্দর্য মলিন হয়েছে, তুমিতো দিন দিন অপ্সরীর মত হয়ে যাচ্ছ। কি স্বর্গীয় সৌন্দর্য তোমার মাঝে তা তুমি জানোও না। কথা দিচ্ছি এভাবে আর নিরুদ্দেশ হবোনা।
হাতের পিঠ দিয়ে বাচ্চাদের মত নাক আর চোখ মুছে তোড়া বলল – রূপার খু নি র কোন হাল করতে পেরেছেন?
স্ত্রীকে বুকে জড়িয়ে ইমতিয়াজ বলল – আমার বোনের খু নি দে র ধ/রা/র জন্য স্পষ্ট প্রমাণ পাইনি কিন্তু মুরাদও তাকে নজরে রেখেছে। খুব শীঘ্রই তাকে ধরতে পারব। লোকটা বড্ড ধূর্ত!
স্বামীর বুকে নিজেকে সোপর্দ করে তোড়া বলল – আপনার ঐ মুরাদ কবে শেষ করবে আমার বান্ধবীর হ ত্যা কা রী র পৌরুষত্ব?
ইমতিয়াজ চাপা নিশ্বাসটা ফেলে বলল – হয়তো খুব বেশি দিন অপেক্ষা করতে হবে না।
মুখটা উঁচিয়ে তোড়া বলল – আমায় একা রেখে আর যাবেন না।
ইমতিয়াজ মুচকি হেসে বলল – শুধু প্রেগন্যান্ট বলে আমার হাত থেকে বেঁ চে গেছ। নয়লে তোমার এই লোভাতুর মুখটা দেখে একটা অ ঘ ট ন ঘ’টি’য়ে ফেলতাম।
ইমতিয়াজের কথার মানেটা বুঝতে পেরে লজ্জায় মুখ লুকালো তোড়া। মিনমিন করে বলল – অ’ঘ’ট’ন ঘটে আছে।
স্ত্রীর কপালে দীর্ঘ একটা চুমু খেয়ে ইমতিয়াজ বলল – কপালে চুমু দেয়া পবিত্র ভালবাসার লক্ষণ।
তোড়া লজ্জামাখা হাসিটা দিতে ভুললো না। তাদের ভালাবাসাময় খুনসুটিতে বাদ সাধলো ইমতিয়াজের ফোনের মেসেজ টিউনটা। স্ত্রীর দিকে একনজর তাকিয়ে মুখে অপরাধবোধের একটা ছাপ নিয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে মেসেজটা ওপেন করতেই লাফ দিয়ে উঠে বসে পড়লো। হঠাৎ হো হো করে হেসে উঠে বলল – আর অল্প কিছুদিন অপেক্ষা করো বউ।
রূপার খু নি কে ধ:রা আর নামেমাত্র অপেক্ষার প্রহর।

____

ঘরময় অস্হির পায়চারি করছেন জামশেদ রহমান। মায়ার বিয়েটা হয়ে গেল অথচ তিনি আ’ ট ‘কা’তে পারেননি। কি জবাব দিবেন তিনি। কপালে জমেছে চিন্তার সূক্ষ্ম রেখা। আর কয়েকটা দিন পরে কায়দা করে মায়াকে হাতের মুঠোয় নিতে পারতেন তিনি। অনবরত রাশেদাকে উ’স্কে’ছে’ন মায়ার বিরুদ্ধে। বারবার চেয়েছেন যেই রাশেদা বিরক্ত হয়ে মায়ার বিয়ের কথা তুলবেন অমনি নিজের মা তা ল ছেলের জন্য বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাবেন রাশেদার কাছে। কিন্তু কোথা থেকে ছেলেটা এসে সব পরিকল্পনা ডু বি য়ে দিলো। মা তা ল ছেলের কাছে নামেমাত্র বউ হয়ে থাকলেও মায়াকে যে নিজের অর্থ উপার্জনের সিঁড়ি করতে চেয়েছিলেন তাও ভেস্তে যাওয়ায় নিজেকে স্হির করতে পারছেন না। কি জবাব দিবেন তিনি যাকে কথা দিয়েছিলেন মায়াকে তার হাতে তু লে দিবেন। চিন্তার সাগরে যখন প্রায় নি ম জ্জিত তিনি তখন ঘোর কা ট লো স্ত্রীর কথায় – কি গো, কি চিন্তা করছ অমন আহামরি?
নিজেকে স্বাভাবিক রাখার ভঙ্গিমায় জামশেদ বলল – তুমি যে কি বলোনা, তামান্না। আমি কি ভাবব! জাফর কি করছে?
স্বামীর শেষোক্ত বাক্যটা শুনেই দাঁত খিঁচিয়ে বললেন
– কি আর করবে! বসে গিলতেইতো পারে।
স্ত্রীর কথায় জামশেদ উদাস হয়ে বললেন – ছেলেটাকে কিভাবে ফিরাবে তামান্না! এই পথ থেকে কিভাবে ফিরাবে!

চলবে…….

#আড়ালে_অন্তরালে
#মাহমুদা_লিজা

পর্বঃ৭

রিকশা থেকে নেমে রিকশাওয়ালার হাতে ভাড়াটা দিয়ে মায়াকে দুহাতে আগলে ধরে নামতে সাহায্য করলো ফাহিম। চারপাশে তাকিয়ে মায়া বোঝার চেষ্টা করল কোথায় আসলো সে। ততক্ষণে ফাহিমের একটা হাত আষ্টেপৃষ্টে মায়াকে ধরে আছে যাতে মেয়েটা হাঁটতে পারে। মায়ার কাঁপতে থাকা শরীরটা স্পষ্ট ধরা দিচ্ছে ফাহিমের নিউরনে। মেয়েটা হাঁটতে পারছে না ঠিকঠাক। শরীরটায় এতটা আঘাত করা হয়েছে তার। মূল ফটক পেরিয়ে ফাহিম যখন মায়াকে নিয়ে প্রথম ফ্লোরে উঠলো তখনই বাজপাখির মত সামনে আসলো বাড়ির মালিক রহিম হালদার। তীক্ষ্ণ কন্ঠে শুধালেন – এই মা ই য়া ক্যাডা? তোমারেতো ব্যাচেলর ভাড়া দিছি ছাদের রুমে।
ফাহিম যা মনে মনে ভয় পাচ্ছে তাই হলো। এই লোকের চোখে পড়লে শত শত প্রশ্ন তী রে র মত ছুঁড়বে। ফাহিম বিরক্তির সুরে বলল – ব্যাচেলর ভাড়া দিয়েছেন তাই বলে কি জীবনে বিয়ে করতে পারব না এই কথা বলেছি কখনো? নাকি আমার বিয়ে করা বারণ, আজীবন ব্যাচেলর হয়ে কা টা তে হবে?

রহিম হালদার সন্দেহের দৃষ্টিতে মায়ার দিকে একবার তাকিয়ে দেখলেন। চোখের দৃষ্টি মুহূর্তেই ফাহিমের দিকে ঘুরিয়ে আরো জোরালো স্বরে বললেন – তা তো কই নাই পোলা। বিয়াই যদি করছো তাইলে মা ই য়া সোজামতো খাড়াইতে পারতেছে না ক্যান? বিয়ার শাড়ি কই? নাকি অন্য ঘটনা?
ফাহিম ধরতে পারলো অন্য ঘটনার মানে বলতে রহিম হালদার কি বুঝিয়েছেন। ফাহিমের মেজাজ মুহূর্তেই আরো জ্ব লে উঠলো। সে চেঁচিয়ে বলল – একদম উল্টাপাল্টা বলবেন না আপনি। অন্য ঘটনা মানে কি?
রহিম হালদার দমে থাকার মানুষ নয়। তিনিও বললেন – একদম চেঁচাইবা না। তুমি এত ছোড পোলাও না যে আমি অন্য ঘটনা বলতে কি বুঝাইছি তা বুঝবা না।
অবস্থা বেগতিক দেখে ফাহিম মায়াকে আরো শক্ত করে আঁকড়ে ধরে স্বরটা নিচু করে বলল – চাচা, অনেক কাহিনী, বিয়েটা হুট করে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে হয়ে গেছে। আমরা কেউ প্রস্তুত ছিলাম না। আমি ওকে বাসায় রেখে সব বলছি। ও দাঁড়াতে পারছেনা।
রহিম কি একটা ভেবে বললেন – লও আমিও তোমার লগে উপরে উঠমু। সব আগে কইবা। তারপর আমি যামু।
ফাহিম আর কথা বাড়ালো না। মায়ার আরক্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে তাকে সাবধানে আগলে ধরে পাঁচতলায় থাকা চিলেকোঠার রুমের সামনে এনে দাঁড় করিয়ে বলল – দাঁড়াও, তালাটা খুলি।
তালাটা খুলতে যতটুকু সময় ব্যয় হলো মায়া ততক্ষণে বসে পড়লো দরজার সামনে। পিছনে থাকা রহিম হালদার ব্যাপারটা খেয়াল করে ফাহিমকে আবারও প্রশ্ন করলেন – এই পোলা, এই মা ই য়া তো সোজা হইয়া খাঁড়াইতে পারতাছে না। কি করছো মা ই য়া ডা রে?
ফাহিম তালা খুলে তালাটা দরজার ছিটকিনি থেকে আলাদা করে দরজাটা খুলতে খুলতে বলল – আসেন চাচা, ভিতরে আসেন। সব বলতেছি।
মায়াকে উঠিয়ে রুমের ভেতরে খাটে বসিয়ে ফাহিম বলল – একটু বস, ঐ আপদটাকে দূর করে আসছি। কষ্ট হলে একটু শুতে পারো। বিছানা একদম ফ্রেশ।
এত কাছাকাছি ফাহিমের মুখটা মায়াকে অপ্রস্তুত করে তুলল। সে মাথা নিচু করে বলল – হুম।
ফাহিম কিছু না বলে ফিরে এলো সামনের রুমটায়। দু রুমের ঘরটায় ছোট্ট একটা রান্নাঘর আছে আর ওয়াশরুমও একটাই আছে। আসবাব বলতে শুধু একটা খাট, ছোট্ট একটা ওয়্যারড্রোব আর ছোট্ট একটা ফ্রিজ। সামনের রুমটায় দুটো চেয়ার। ব্যস, এটাই ছিল ফাহিমের সংসার। আজ যুক্ত হলো মায়া।
পাঞ্জাবির হাতাগুলো টেনে খানিকটা উপরে তুলে ফাহিম এসে বসল রহিম হালদারের পাশে। একটু জিরিয়ে বলতে থাকলো মায়ার সাথে ঘটে যাওয়া সব ঘটনার সারমর্ম। সব শুনে রহিম হালদারের চোখ জ্বলে উঠলো। ফাহিমের মাথায় হাত রেখে বললেন – তুমিও কি ভাবতাছো মা ই য়া ডা রে কষ্ট দিবা? তাইলে ভুইলা যাও। আমি তা হইতে দিমুনা।
ফাহিম ভূত দেখার মত চমকে গেল। এত রাগী লোকটা কি বলল এসব। ফাহিম চমকে থাকায় সে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছে। রহিম আবারও বললেন – তুমি মাইয়াডার খেয়াল রাহো। আমি তোমার চাচীরে কইতাছি খানা পাঠাইতে।
ফাহিম স্বপ্ন দেখছে ভেবে রহিম হালদারের গায়ে কষে এক চিমটি কাটলো। বেচারা ওমাগো বলে চিৎকার করে উঠে বলল – পা গ ল হইছো পোলা!
ফাহিম হেসে বলল – না চাচা, স্বপ্ন কিনা তাই ভাবতেছি।

রহিম চলে যেতেই দরজাটা ভেতর থেকে আঁটকে দিল ফাহিম। দুরুদুরু বুকে অস্হির কাঁপুনি তাকে বড্ড জ্বা লা চ্ছে। কপাল বেয়ে ফোঁটা ফোঁটা ঘামের কণাগুলো পকেট থেকে টিস্যু পেপার বের করে মুছে নিল ফাহিম। মায়ার সামনে দাঁড়াতে তার এত অস্হিরতা কেন? সে তো কাউকে ভয় পায় না। তাহলে মায়ার বেলায় উল্টো কেন।
এসব ভাবতে ভাবতে দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো ফাহিম। দেখলো মায়া ঠাঁয় বসে আছে। আস্তে আস্তে রুমে এসে মায়ার পাশে বসলো সে। মায়া ভয়ে আর লজ্জায় তটস্থ হয়ে আছে। চোখের কোণে টইটম্বুর জল। নিজেকে ধাতস্থ করে ফাহিম বলল – ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় হোক, এখন থেকে তুমিই আমার অর্ধাঙ্গিনী। আমাকে ভয় বা লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। যে কোন সমস্যা মন খুলে বলতে পারো আমায়। কথা দিচ্ছি নিজের সবটা দিয়ে আগলে রাখব। কখনো কষ্ট পেতে দিবো না।
ফাহিমের কথাগুলো শুনে মায়া এক নজর তার দিকে তাকালো। দেখতে পেল একজোড়া মায়াবী চোখ। সেই চোখে কোন ছলনা থাকতে পারে না।
এদিকে মায়ার চেখের কোণে জমাট বাঁধা জলের উপস্থিতি দেখে ফাহিম তার দুহাত দিয়ে মায়ার দু বাহু ধরে বলল – কাঁদছ কেন?
মায়া ককিয়ে উঠে বলল – ছাড়েন, আমার হাতে লাগছে।
ফাহিম সঙ্গে সঙ্গে হাত ছেড়ে ব্যস্ত হয়ে বলল – কোথায় লেগেছে?
ব্যাথায় মায়ার চোখের জল আর বাঁধা মানছে না। গাল বেয়ে টুপ করে তারা তার কোলে এসে গলিয়ে পড়ছে। সৎমায়ের করা লাঠির আঘাতগুলো যে তার দু বাহুকে র ক্তা ক্ত করেছে তা বুঝতে ফাহিমের সময় লাগলেও তার ব্যাথা তাকে কাবু করেছে।
ফাহিমের খুব করে ইচ্ছে হচ্ছে মায়ার মাথাটা বুকে ধরে বলতে – কেঁদো না।
ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে মায়া। ব্যাথা তাকে বেশ কাবু করেছে। পিঠ, হাত, আর পেটের ডানপাশের আঘাত থেকে বের হওয়া র ক্ত ফোঁটাগুলো শুকিয়ে জায়গায় জায়গায় শরীরের সাথে জামা আঁটকে গেছে।

কিছুক্ষণ মায়ার কান্না দেখে ফাহিম আঁচ করলো মায়ার ব্যাথা বাড়ছে হয়তো। ঘরে থাকা কেক আর পানি বাড়িয়ে দিয়ে ফাহিম বলল – খেয়ে নাও। পেইন কি লা র খেলে ব্যাথা ধরে আসবে।
ওড়না দিয়ে ঘোমটা দেয়া মায়া মুখ তুলে দেখলো ফাহিমের পানে। সে বলতেও পারছে না খেতে পারবেনা, গলায় বড্ড ব্যাথা।

মায়ার হা ল দেখে ফাহিম তার পায়ের কাছে বসে পড়লো। কেকের এক পাশ থেকে ছোট এক টুকরো ভেঙে মায়ার মুখের সামনে ধরে ইশারা করলো খেতে। মুখ হা করতেও মায়ার কষ্ট হচ্ছে। কোনমতে হা করে কেকের টুকরোটা মুখে নিতেই তার চোখের কোল বেয়ে জলগুলো দরদরিয়ে নামতে লাগলো। গলায় হাত দিয়ে শব্দ করে কেঁদে উঠে বলল – খাব না, গলা ব্যাথা করছে।
ফাহিম পানিটা এগিয়ে দিয়ে বলল – একটু কষ্ট করে খাও, আমি ওষুধ দিচ্ছি। ওষুধ খেলে কমে যাবে।
ফাহিমের কথামতো কেকের একটা টুকরো খেয়ে আর খেলোনা মায়া। ফাহিম কথা না বাড়িয়ে ঔষধটা খাইয়ে দিয়ে বলল – তোমার জামা কাপড়তো এখনো আনিনি। আপাতত আমারগুলো দিয়ে চালাও। রাতে এনে দিব সব।
ফাহিম কিছু একটা ভেবে মায়ার মাথা থেকে ঘোমটা সরিয়ে কাঁধের দুপাশে রেখে বলছে – মাথায় একটু তেল দিয়ে দেই। ভালো লাগবে।
কথাটা বলে দৃষ্টি মাথা থেকে ঘাড়ে পড়তেই দেখলো র ক্ত ঘাড় বেয়ে জামার ভেতরে যেতেই জামাকে শরীরের সাথে আঁটকে রেখেছে। চোখটা বন্ধ করে লম্বা শ্বাস নিয়ে সে বলল – তোমার আঘাতগুলোতে ইনফেকশন হতে পারে মায়া। ব্লাডগুলো মুছে এন্টিসেপ্টিক লাগিয়ে দিচ্ছি আমি।
কথাটা শুনে মায়া হকচকিয়ে বলল – না, লাগবে না।
আমি গোসল করলে সব ঠিক হয়ে যাবে।
ফাহিম তার সামনে এসে বসলো, নরম হাতজোড়া নিজের হাতের তালুতে রেখে বলল – ব্লাড শুকিয়ে গেছে, জার্মস এ্যা টা ক হতে পারে। এভাবে নিষেধ করোনা।

মায়াকে কিছু বলতে না দিয়ে উঠে গেল ফাহিম। ওয়্যারড্রোবের উপর থেকে এন্টিসেপ্টিক আর তুলা নিয়ে এসে বসলো মায়ার পিছনে। আবার উঠে জানালাগুলো টেনে পর্দা টেনে দিয়ে ঘরে আলো জ্বেলে নিলো সে। নিজের বড় টাওয়েলটা এনে মায়ার সামনে রাখলো। একটা বাটিতে করে এক বাটি পানি আনলো রান্নাঘর থেকে। পিঠের খোলা অংশে থাকা শুকনো জমাট বাঁধা র ক্ত গুলো পরিষ্কার করতে গিয়ে ফাহিম শুনেছে মায়ার আর্তনাদ। হঠাৎ মায়া শুনতে পেলো ফাহিমের গম্ভীর কণ্ঠ – মায়া! প্লিজ, জামাটা খুলে টাওয়েলটা শরীরের উপর দাও। এভাবে পরিষ্কার করতে খুব একটা সুবিধা হচ্ছে না।
মায়া চিৎকার করে বলে উঠলো – নাআআ।
ফাহিম মোলায়েম কন্ঠে বলল – প্লিজ মায়া, শুধু এন্টিসেপ্টিক লাগিয়ে দিব। আঘাতগুলোতে অয়েন্টমেন্ট লাগিয়ে দিব। আমায় বিশ্বাস করতে পারো।
মায়া মাথা নিচু করে বলল – ব্যাথা হচ্ছে হাতে, খুলতে পারব না।
চিন্তায় পড়ে গেল ফাহিম। কি করে সে মায়াকে এন্টিসেপ্টিক লাগিয়ে দিবে, নয়লেতো আঘাতগুলো শুকাবে না।

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here