#অন্তঃপুরে_দহন (পর্ব-2)
#আরশিয়া_জান্নাত
একদিন ভোরে তেষ্টায় ঘুম ভেঙে যায় ওমরের। ডাইনিং এ পানি খেতে এসে হঠাৎ অদ্ভুত গোঙানির শব্দ পায় সে। শব্দটা কোত্থেকে আসছে দেখার জন্য এগোতেই বুঝতে পারে এটা তার বাবার রুম থেকে আসছে। তার মনের ক্ষীণ ভয় মাকে বুঝি ফের মারছে তার বাবা! সেই উদ্দেশ্যেই এগোতে থাকে সে। কিন্তু দরজার সামনে দাঁড়াতেই দেখতে পায় তার মা বাইরের ঘরের সোফায় ঘুমাচ্ছে। তবে রুম থেকে নারী কন্ঠ আসছে কিভাবে! ওমর কান খাঁড়া করে বোঝার চেষ্টা করছিল কন্ঠটা চেনা কি না। কিন্তু আদিমখেলায় মেতে ওঠা নরনারীর গলা চেনা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না বটে। সেদিন ওমর আর কিছু না বুঝলেও এইটুকু বুঝেছিল ঐ রুমে নিষিদ্ধ কিছুই ঘটে। এছাড়া আরেকটা বিষয় ও জানতে পারে তার মা ঐ রুমে থাকে না! কিন্তু মা-বাবা এক রুমে থাকবে সেটাইতো স্বাভাবিক। তবে তাদের বাসায় এমন অস্বাভাবিক ঘটনা কেন ঘটছে? হঠাৎ ওমরের মনে পড়ে গতরাতে একটা আন্টি এসেছিল ওদের বাসায়। অন্তরার সাথেই ঘুমিয়েছিল নিশ্চয়ই। কি ভেবে ওমর অন্তরার ঘরে যায়। গিয়ে দেখে অন্তরা বেঘোরে ঘুমোচ্ছে কিন্তু পাশে কেউ নেই। তবে কি ঐ ঘরে…..মাথা চেপে ধরে ওমর। তার মানে মা জেনেশুনেই অন্য মহিলাকে জায়গা দিয়েছে তাদের ঘরে? ওমরের পুরনো অনেক স্মৃতি মানসপটে ভেসে ওঠে। ছোটবেলায় যা অস্পষ্ট ছিল এখন সব পানির মতো স্পষ্ট হতে থাকে। অনাকাঙিক্ষতভাবেই চোখ ভরে আসে অশ্রুতে। দ্রুত নিজের রুমে গিয়ে শুয়ে থাকে। কিছুক্ষণ পরই তার মা তাকে ডাকতে আসবে তাই ঘুমের ভান ধরে পড়ে থাকে সে।
একটা সময় ছিল ওমর ভাবতো তার বাবা-মা একজন অপরজনকে অনেক ভালোবাসে। বাবা রাগী এতে সন্দেহ নেই। পুরুষমানুষের একটু আধটু রাগ থাকেই এমনটাই বলতেন ওর দাদী। যতদিন দাদী বেঁচে ছিল সব ঠিক ছিল। তখন এমন কথায় কথায় মায়ের গায়ে হাত তুলতোনা তার বাবা। দাদীর মায়াভরা মুখটা মনে পড়তেই হারিয়ে ফেলার যন্ত্রণায় শব্দ করে কেঁদে ফেললো সে। সাথে সাথে মুখে বালিশ চাপা দিলো। কিন্তু শামীমা ঠিকই টের পেয়ে গেল তার ছেলে কাঁদছে। সবেই সে দরজায় এসেছিল ওমরকে ঘুম থেকে ডেকে তুলতে। একটু পরেই তার প্রাইভেটে যেতে হবে। ব্যতিব্যস্ত হয়ে ছেলের মাথায় হাত দিয়ে বললো, ওমর কি হয়েছে বাবা কাঁদছিস কেন? খারাপ স্বপ্ন দেখেছিস?
ওমর চোখ মুছে বললো, দাদীর কথা মনে পড়ছে মা। আল্লাহ কেন দাদীকে এতো তাড়াতাড়ি নিয়ে গেল?
শামীমা তাকিয়ে দেখে তার ছেলেটার চোখমুখ কেমন ফুলে গেছে। কেঁদেকেটে লাল হওয়া মুখটা দেখে শামীমা নিজেও কেঁদে ফেলল। আসলেই তো কেন নিয়ে গেল তার শাশুড়িকে। যতদিন তিনি ছিলেন অনীলের উচ্ছৃঙ্খলতা বাইরেই সীমাবদ্ধ ছিল। ঘরের চৌকাঠ মারানোর সাহস ছিল না।
সেই রাতে যখন প্রথম শামীমা দেখেছিল তারা যে বাসায় সাবলেট হিসেবে থাকতো সেই ভাবীর সঙ্গে অনীলের অবৈধ সম্পর্ক আছে। কিশোরী শামীমার মত কত ক্ষতবিক্ষতই না হয়েছিল। অনীলকে কিছু বুঝতে না দিয়ে কৌশলে শাশুড়িসহ আলাদা বাসা নিয়েছিল। তখন অবশ্য অনীলকে খারাপ মনে হয় নি। ও তখন ভাবতো দোষটা ঐ মহিলার ই। সে ওমন খোলামেলা চলে বলেই অনীলের চোখে পড়েছে। সব নষ্টের মূল মেয়েরা নিজেই!
সে ভেবেছে এখান থেকে বের হতে পারলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। শাশুড়িকে পেয়ে সেইসব স্মৃতি ভুলতে দেরী হয়নি। তার পর কোল আলো করে ওমর এলো অন্তরা এলো। বেশ গুছিয়েই সংসার চলছিল তার। অনীল ও তখন আদর্শ সন্তান, আদর্শ স্বামী আর আদর্শ বাবার চরিত্রে অভিনয় করছিল! আচ্ছা সেসব কি সত্যিই অভিনয় ছিল? এতো নিখুঁত অভিনয় যে মিথ্যাই মনে হয়নি কখনো। কে জানতো ঐ ভালোমানুষের মুখোশ পড়া লোকটা এত হিংস্র?
।
।
অনীল বেশ ফুরফুরে মুডে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে রেডি হচ্ছে। আজকে একটা একটা জরুরি মিটিং আছে। তার বিশ্বাস এবার টেন্ডারটা ওরাই পাবে। এই টেন্ডার পাস হলেই ওর কোম্পানির ভাগ্যের চাকাই বদলে যাবে!
অন্তরা আর ওমরকে ডাইনিং এ দেখে হাসিমুখেই চেয়ার টেনে বসলো অনীল। ব্রেডে জ্যাম লাগিয়ে অন্তরাকে দিয়ে ছড়া কেটে বললো,
“আমার ময়নাপাখি অন্তরা
হাসে খেলে সারাবেলা”
অন্তরা খিলখিল করে হাসতে লাগলো। অনীল মেয়ের দিকে স্নেহভরা দৃষ্টিতে তাকালো।
ওমর তোমার পরীক্ষা কবে?
আগামী মাসের দশ তারিখ থেকে শুরু হবে।
সিলেবাস কমপ্লিট হয়েছে?
হুম।
রেজাল্ট কিন্তু ভালো হওয়া চাই। রোল এক থেকে পাঁচের মধ্যে হতে হবে। কি বলেছি মনে থাকবে?
হুম।
শামু চা টা দাও তাড়াতাড়ি।
শামীমা তাড়াতাড়ি চা নিয়ে আসলো। অনীল চা খেয়েই বেরিয়ে পড়লো।
অন্তরা আর ওমর ও স্কুলের জন্য বেরিয়ে গেল।
ঘরদোর ঝেড়ে পরিষ্কার করে দুপুরের রান্না বসানো, সব মিলিয়ে এই সময়টা বেশ ব্যস্ততায় কাটে শামীমার। পড়ন্ত দুপুরে গা এলিয়ে টিভি দেখে কখনো বা রহিমা খালার সাথে সুখ দুঃখের গল্প করে। রহিমা কয়েক বিল্ডিং পরের একটা কলোনিতে থাকে। শাশুড়ির সঙ্গে এসে পান খেত গল্প করতো সেই থেকেই ঘনিষ্ঠতা। কিন্তু অনীল থাকাকালীন তিনি তেমন একটা আসেন না। শামীমার উপর কড়া নিষেধাজ্ঞা পাশের বাসার কারো সঙ্গেই যেন গলায় গলায় ভাব না করে, কেউ যেন বাসায় না আসে ইত্যাদি! এমন করতে প্রথম প্রথম খুব
কষ্ট হতো শামীমার। একেতো সে চঞ্চল প্রকৃতির মেয়ে তার ওপর সর্বদাই মানুষের ভীড়ে থেকেছে। হুট করে এমন নিঃসঙ্গ জীবনযাপনে অভ্যস্ত হওয়া চাট্টিখানি কথা না। কিন্তু অনীলকে সে অনেক ভয় পায়। তার একেকটা আঘাতের ক্ষত এখনো শরীরে দাগ হয়ে আছে। গেল বছর পাশের বাসায় নতুন ফ্যামিলি উঠেছে। এসেছিল দেয়াশলাইয়ের জন্য। ভদ্রতার খাতিরে শামীমা মানা করতে পারেনি সামান্য দেয়াশলাই ই তো! তাই দিয়েছিল। সেই সুবাদে টুকটাক কথাও হলো। নুহা মেয়েটা বেশ মিশুক ছিল বলে অল্পতেই অনেক ভাব হয়েছিল। একদিন অনীল বাসায় থাকা অবস্থায় সে এসেছিল লবণ নিতে। অনীল অবাক হলেও তখন কিছু বলেনি। কিন্তু সে যাওয়ার পর শামীমাকে যেভাবে মেরেছিল তা ভাবলে আজও শিউরে উঠে সে। লাজলজ্জার মাথা খেয়ে মুখের ওপরই বাসায় আসতে নিষেধ করে নুহা কে। এমনিতে বিল্ডিং এর সবাই শামীমাকে একঘেয়ে, গম্ভীর, অহঙ্কারী বলে খেতাব দিলেও অনীল সকলের চোখেই ভালো। তার মতো মনখোলা মানুষই হয় না। সকলের চোখে সে রসিক মানুষ। কেউ কেউ আফসোস করে বলে এমন দিলখোলা লোকটার বৌ কি না এতো অসামাজিক? কাউকে কোনোদিন এক কাপ চা খেতেও ডাকে না, হাসিমুখে একটু কথাও বলে না?! এতো ভুল বোঝার মানুষের মাঝে রহিমা খালাই একমাত্র মানুষ যিনি সবটা বোঝেন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, তুই হচ্ছিস ফেরাউনের ঘরে আসিয়া! তোর দুঃখের দিন ঠিকই শেষ হইবো দেখিস! ধৈর্য ধরতাছোস তো ধৈর্যের ফল মিঠাই হইবো!
শামীমা ম্লান হেসে বলে, খালা ছেলেমেয়ে দুইটা বড় হইতাছে। যেসব কীর্তি করে কয়দিন লুকামু? সে কেন ঘরে এনে এসব করে? বাইরে কি জায়গার অভাব আছে?
তোর জামাই হচ্ছে মুখোশধারী শয়তান। নয়তো কেউ নিজের ঘরে এসব আকাম করে না। ওয় ভাবে ওরে শাসন করার কেউ নাই যা মন চায় করতে পারবো। তোর শাশুড়ি যদি জানতো তার পোলা এমন আরো আগেই মইরা যাইত! আল্লাহ মানে মানে তুইল্লা নিছে, নয়তো এইসব লজ্জা ছি ছি!
তোর বাপেও মানুষ না। মাইয়াগো আসল ক্ষমতা হইছে বাপের বাড়ির লোক। বাপের বাড়ির দাপোট ছাড়া স্বামীর বাড়িতে দাম নাই। পুরুষ জাত বড়ই আজব কিছিমের রে মা! তাগোরে যতোই যত্ন করোস না ক্যান বান্ধি রাখা যায় না। ঠিকই ময়লায় মুখ দেয়।
খালা তার তো আয়রুজি ভালোই। আমার দ্বারা সন্তুষ্ট না হলে আরেকটা বিয়া করুক। তাও তো হালাল হইতো। এসব নষ্টামির মানে কি? আমি তো কিছু কইতেও পারিনা। সেদিন ওমর আমারে বলে, জানো মা,
“অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে
তব ঘৃণা তারে যেন তৃণ সমদহে”
ছেলের মুখে এই কথা শুনে আমার আত্মা শুকাই গেছিল। ও কি কিছু টের পাইছে?
রহিমা পাশের দিকে তাকিয়ে বললো, ঐ ঘরটাতে নামায পড়িস না। নষ্ট ঘর ঐটা। ঐ নষ্ট ঘরের প্রভাব তোর ছেলেমেয়ের উপর পড়তে দিস না। আমার যদি সামর্থ্য থাকতো তোরে আমার কাছে নিয়া যাইতাম। কিন্তু কি করমু বল আল্লাহ মন দিছে ধন দেয় নাই। খালি দোআই করতে পারি তোর কষ্টের দিন ফিরুক!
শামীমার চোখের পানিতে ভিজে উঠে গ্রীবা। রহিমা ভাবে, কি নেই মেয়েটার! রুপে গুণে কেউ ফেলতে পারবে? অথচ এমন সুন্দরী মেয়েটার নসীব এতো খারাপ। আসলেই সুন্দরীগো কপাল পোড়া হয়!!
চলবে,,,,