অন্তঃপুরে দহন পর্ব ১

0
883

“আমাদের বাসায় যেই আন্টিই আসে সে তোমাদের বেডরুমে কেন ঢুকে আম্মু? তুমি কিচেনে থাকো আর ঐখানে রুমের দরজা বন্ধ করে রাখে। তোমাদের রুমে আব্বুর সাথে অন্য মহিলা কেন ঢুকবে? তুমিতো বলো ঐ রুমে আমরা যেন না যাই কারণ ঐটা তোমাদের রুম তাহলে ঐ আন্টিরা কেন ঢুকে?”

দশ বছরের অন্তরার মুখে এমন কথা শুনে আৎকে উঠে শামীমা। মেয়ের মুখ চেপে ধরে চারদিকে তাকিয়ে দেখে কেউ আছে কি না। তারপর টেনে কিচেনের এককোণে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে বলে, সোনা মা আমার এসব কথা তোর বাবার সামনে কখনো বলবি না কেমন? তোর বাবা অনেক বড় চাকরি করে তো ওরা কাজের জন্যই আসে। তোরা তো যে দুস্টুমি করিস! ওদের ডিস্টার্ব হবে বলে আমিই দরজা লক করে রাখি। আর কে বলেছে আমি থাকিনা রুমে? আমি তো থাকি কিন্তু মেহমানদের চা নাস্তা দিতে হবে না? তাই চলে আসি তুই তখন ভাবিস আমি এখানেই ছিলাম। ব্যাপারটা ওমন না।
অন্তরা তার মায়ের হাত সরিয়ে বললো, একদম মিথ্যা বলবা না আম্মু। আল্লাহ পাপ দেবে! আমি ঐদিন বেলকনীতে বল আনতে গিয়ে দেখেছি ঐ আন্টি আব্বুর পা টিপে দিচ্ছিল। তুমি থাকতে অন্য কেউ কেন আব্বুর পা টিপবে?

তুই তো জানিস আম্মুর হাতে শক্তি নেই। সবসময় তোর আব্বুর হাত পা ব্যথা করে টিপে দিতে হয়। আমি পারিনা তাই ঐদিন ওকে বলেছিলাম,,,

আম্মু তুমি না পারলে আমি করে দিবো। আগে শুক্রবারে আমি আর ভাই আব্বুর পায়ে পাড়িয়ে দেই নি? ঐভাবে রোজ দিবো তবুও অন্য মহিলাকে ধরতে দিবা না।আমার ভালো লাগে না,,,

শামীমা খুব গোপনে চোখের পানি মুছেন। মেয়েটা বড্ড বেশি পাকা হয়েছে। কোনোভাবেই ওকে বোঝানোর সাধ্যি তার নেই। ছেলেটাও আগে এমন প্রশ্ন করেছিল। তখন নয়ছয় করে বুঝানো গেছে আর বাপকে জন্মের ভয় পায় বলেই ঐদিকে ভুলেও যায়না সে। কিন্তু অন্তরাকে কিভাবে বুঝাবে? মেয়েটা তার বাবা বলতে পাগল। তার মতে তার বাবা সুপারম্যান। কিন্তু সুপারম্যানের আসল চেহারা কত কুৎসিত তা কি ওর থেকে লুকানো যাবে?
আজ যে প্রশ্নটা অন্তরা করেছে তা যদি ঘুণাক্ষরেও অনীল টের পায় শামীমার কপালে দুঃখ আছে। শুধুমাত্র এসব কুকীর্তি ঢাকতে বাচ্চাদের অনেক কম বয়স থেকেই আলাদা রুমে রেখেছে। দিনেও ঐ রুমের আশেপাশে যাওয়া ওদের জন্য নিষিদ্ধ। শামীমার দমবন্ধ লাগে। ছেলেমেয়ে দুটোর কথা ভেবেই তো এতো বছর ধরে সব মেনে নিচ্ছে। চোখের সামনে দেখছে নিজের স্বামীর অশ্লীল লীলাখেলা!

আজ থেকে চৌদ্দ বছর আগে পারিবারিকভাবে বিয়ে হয়েছিল অনীল আর শামীমার। শামীমা সৎ মায়ের সংসারে গলার কাঁটা হয়ে গেছিল বলেই পনেরো বছর বয়সেই তার বাবা তাকে বিয়ে দিয়ে দায়সারা হয়েছেন। শামীমা ভেবেছিল বাপের সংসারের জাহান্নাম থেকে মুক্তি হলো, এইবার বুঝি সুখের মুখ দেখবে! কিন্তু হায় এ তো আরেক জাহান্নাম! বিয়ের একমাস পরই নতুন বৌকে নিয়ে ঢাকায় ফেরে অনীল। এখানে সে একটা ফ্যামিলির সাথে সাবলেট হিসেবে থাকতো। নতুন বৌ নিয়ে আসায় প্রথম প্রথম খাতিরযত্নের অভাব ছিল না।
তার উপর শামীমা ধনী পরিবারের মেয়ে বলে কথা! বিয়েতে অনেককিছুই পেয়েছিল, তাই শ্বশুরবাড়ির সবাই তাকে বেশ সাদরেই গ্রহণ করেছিল। সব ঠিকঠাকই চলছিল। কিন্তু এক রাতে,,,,,

আম্মু আম্মু! কোথায় হারালে তুমি?

মেয়ের ডাকে হুঁশ ফিরতেই শামীমা চটজলদি উঠে যায়, চুলায় ডালের ফেনা পড়ে শব্দ করে জ্বলে উঠছে আগুনের আঁচ। অনু যা পড়তে বস? তোর ভাই কই? সন্ধ্যায় টিচার আসা ছাড়া তোদের পড়তে মন চায় না? যা গিয়ে হোমওয়ার্ক কর।

অন্তরা ওর মাকে জড়িয়ে বলে, আম্মু তুমি এতো সুন্দর কেন? নানু বুঝি তোমার মতোই সুন্দর ছিল? আমি যদি তোমার মতো ফর্সা হতাম কত ভালো হতো!

বাপ গড়িয়া ঝি লক্ষি। তুই তোর বাপের মতো হয়েছিস। আর কে বলেছে আমার মেয়ে সুন্দর না? আমার মেয়ে রাজকুমারীর মতো সুন্দর। রং দিয়ে মানুষকে যাচাই করে না মা! মানুষের আসল সৌন্দর্য মনে। আমি জানি আমার মেয়েটার মন ঝকঝকে আয়নার মতো।

অন্তরা টোল পড়া গালে হাসি দিলো। ওর মুখের হাসিটা এতো মায়াবী যে শামীমা যতোবার মেয়ের হাসি দেখে অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে বলে, আল্লাহুম্মা বারিকলাহু। আল্লাহ আমার বদনজরও যেন না লাগে!


ভাত খেতে বসে অনীল ভ্রু কুঁচকে বলে, মাছ ভাজো নি? কাঁচা রান্না করেছ?

না তো ভেজেই তো রান্না করেছি।

তো কি আমি মিথ্যা বলছা? টাটকা কাঁচা মাছের আঁশটে গন্ধ!

শামীমা চামচ দিয়ে চাখতে যেতেই অনীল খুব জোরে একটা থাপ্পড় দিলো তার গালে। দাঁতে দাঁত চেপে বললো, মা*গী আমার কথা তোর বিশ্বাস হয় না? নিজে চেক করে দেখবি এতো হেডাম তোর? ধর খা এখন খেয়ে বল মাছে গন্ধ আছে কি না,

বলেই তরকারিটা মেঝেতে ফেলে দেয়। শামীমা হতবিহ্বল চোখে তাকিয়ে থাকে। কিছু একটা বুঝে উঠতেই দৌড়ে অনীলের পা ধরে বলে, আমারে মাফ করে দেন। আমার ভুল হয়ে গেছে। আপনার কথার উপর কথা বলার পাপ মাফ করেন এমন ভুল আর হবেনা।

অনীল তার পা ঝাড়া দিয়ে বলে, সবকিছুর মাফ হলেও ভুলের মাফ নাই। যা এখন চেটে চেটে খা! তোর তরকারি আমি তোর ****** ঢুকাবো মা*গী।

শামীমা দরজার দিকে তাকিয়ে দেখে তার ছেলে ওমর পর্দার আড়ালে বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে আছে, পাশেই অন্তরা ভাইকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে।

ওমরের বয়স তেরো বছর। ছেলেরা অল্পতে বুঝের না হলেও মায়ের প্রতি অন্যদের আচারব্যবহার তারা ঠিকই মনে গেঁথে রাখে। কে কবে মাকে ভালোবেসে কূলের ভর্তা খাইয়েছিল কিংবা খোঁচা মেরে কথা বলেছে। এসব তাদের মনে অনেক বড় আকাঙ্ক্ষা তৈরি করে। প্রতিটা ছেলেই সেই ছোট বয়সেই ঠিক করে ফেলে মায়ের কি কি সাধ আহ্লাদ বড় হয়ে মেটাবে সে! ওমর এদিকে একটু বেশিই সচেতন। এই যে সেদিন ফেরিওয়ালা দেখে মা যখন বলেছিল কত দিন লাল ফিতা দিয়ে কলাবেণী করি না! ওমর সাথে সাথে পকেট হাতড়ে দেখলো পাঁচ টাকার দুটো কয়েন ছাড়া কিছুই নেই। তিনদিন টিফিন খরচ বাঁচিয়ে লাল ফিতা কিনে এনেছিল মায়ের জন্য। মা তখন হেসে বলেছিল আমার সোনা ছেলের কান্ড দেখেছ! তোর মায়ের কি আর লাল ফিতে দিয়ে চুল বাঁধার মতো বয়স আছে?

ওমর অবাক কন্ঠে বলেছিল, কেন নেই? চুল বাঁধতে বয়স লাগে নাকি? দেখি বাঁধো না মা কলাবেণী?

তার জেদে বাধ্য হয়েই বেণী করেছিল শামীমা। কি খুশিই না হয়েছিল ওমর। ঐ ফিতা খুব যত্নে বাক্সে তুলে রেখেছিল শামীমা। সেই গল্প কতজনকে যে বলেছে, ওমর লজ্জায় তখন আড়ালে পালিয়ে বাঁচে।
ছেলেটা মায়ের আঁচলে থাকতেই বড্ড ভালোবাসে। ছোট থেকেই মায়ের সাথে সাথেই ঘুরতো। এখন যদিও একটু আধটু মাঠে যায় খেলাধুলা করে। কিন্তু সুযোগ পেলেই মায়ের কাছ ঘেষে বসতে ভুলে না। বাবাকে যমের মতো ভয় পায় বলেই মায়ের কাছেই তার সকল আবদার। যতো বড় হচ্ছে বাবার সাথে দূরত্বও বাড়ছে। আগে যেটা ভয় ছিল দিনদিন সেটা ঘৃণায় পরিণত হচ্ছে সেটা খুব জোরালোভাবেই টের পায় শামীমা। তাই তো চায় না এসব অনাকাঙিক্ষত ঘটনার সম্মুখীন হতে। কিন্তু কিভাবে যে ভুল হয়েই যায়!

একদিন ভোরে তেষ্টায় ঘুম ভেঙে যায় ওমরের। ডাইনিং এ পানি খেতে এসে হঠাৎ অদ্ভুত গোঙানির শব্দ পায় সে। শব্দটা কোত্থেকে আসছে দেখার জন্য এগোতেই বুঝতে পারে এটা তার বাবার রুম থেকে আসছে। তার মনের ক্ষীণ ভয় মাকে বুঝি ফের মারছে তার বাবা! সেই উদ্দেশ্যেই এগোতে থাকে সে। কিন্তু দরজার সামনে দাঁড়াতেই,,,,,,

চলবে,,,,

#অন্তঃপুরে_দহন

#আরশিয়া_জান্নাত

(আস্সালামু আলাইকুম। অনেকদিন পর লিখতে বসেছি। গল্পে অনাকাঙিক্ষত শব্দ ব্যবহারের জন্য ক্ষমাপ্রার্থী। আশা করছি আপনারা লাইক কমেন্ট করে পাশে থাকবেন। আর গল্পটা ধারাবাহিকভাবে নিয়মিত লেখার চেষ্টা করবো। সূচনা কেমন হয়েছে জানাতে ভুলবেন না। ভুলত্রুটি ক্ষমাপ্রার্থনা।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here