মেহেরাবের মুখ থেকে এমন কঠিন কথাগুলো শুনে যেন প্রিয়া কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল।সে ভাবতেও পারছে না,তার মেহেরাব ভাইয়া তাকে এই কথাগুলো বলছে।যে মানুষটা তার সাথে গলা উঁচু করে কথা পর্যন্ত বলে না সেই মানুষটা আজ।প্রিয়া আর কিছু ভাবতে পারলো না।
কিছুক্ষণ আগে,
মেহেরাব বাইরে থেকে আসলে প্রিয়া তার জন্য কফি বানাতে যায়,সে আজ বেশ রাত করে বাসায় ফিরছে।মেহেরাব সাধারণত রাত ৯টার মধ্যেই বাসায় চলে আসে কিন্তু আজ এতটা দেরিতে ফিরেছে।হয়তো কোনো কাজে আটকে গিয়েছিল।আর প্রিয়া জানে মেহেরাব এ সময় এসে এক কাপ কফি খায়,সে দেখেছে তার খালামণি আর তিশপি আপুকে মেহেরাব ভাইয়ার জন্য কফি বানিয়ে তার ঘরে দিয়ে আসতে।এরপর তারা সবাই মিলে বেশ কিছুক্ষণ গল্পগুজব করে।প্রিয়ার এ বাসায় একবার আসলে আর যেতেই ইচ্ছে করে না।খালামণি,খালু,তিশপি আপু,মেহেরাব সবাই তাকে ভীষণ ভালোবাসে।আজ মেহেরাবের দেরি করে ফেরাতে খালামণিরা ঘুমিয়ে গিয়েছিল,প্রিয়াও ঘুমাতে যাচ্ছিল কিন্তু হুট করে দরজা খোলার শব্দে সে চমকে উঠে।সে বসার ঘরে বসে টিভি দেখছিল,তিশপি আপুও ছিল কিন্তু অনেকক্ষণ আগেই তিশপি আপু চলে গিয়েছে।তবে প্রিয়া যায়নি সে তার প্রিয় সিনেমা,”Kal ho na ho” মুভিটি শেষ করে তারপর যাবে সিনেমাটি যতবার দেখে তার মনের মধ্যে একটা অদ্ভুত ভালোলাগা,কষ্টের সংমিশ্রণ হয়।লাস্টের সিনটুকুতে সে যতবার দেখে ততবার কেঁদে ফেলে।এই নিয়ে তার মেহেরাব ভাইয়া যে তাকে কত খেপিয়েছে আর বলেছে,
-“কি রে চুন্নি,তুই প্রতিবার এই সিনটুকু দেখবি আর এমনভাবে কাঁদবি যেন মনে হয় ছোট বাচ্চাদের থেকে কোনো খেলনা কেড়ে নিলে বাচ্চারা যেমন করে কাঁদে।”
কথাটা বলে মেহেরাব ভাই তার বিখ্যাত হাসিটা হাসতে থাকে আর প্রিয়া কিছু না বলে গাল ফুলিয়ে বসে থাকে।মাঝে মাঝে প্রিয়ার তার কানের কাছে গিয়ে চেঁচিয়ে বলতে ইচ্ছে হয়,
-“তোমার না হয় কোনো ইমোশন নেই,তাই বলে কি আর কোনো মানুষেরও নেই।”
কিন্তু মনের কথাটা মনেই রয়ে যায়।কে জানে যদি আবার ধমক দিয়ে বসে।সে জানে তার মেহেরাব ভাইয়া যেমন হাস্যজ্জ্বল ঠিক তেমনি রাগী।রাগলে আবার তার দিন দুনিয়ার কোনো হুশ থাকে না।
প্রিয়া ঘুমোতে যেতে যাবে এমন সময় সে দেখে মেহেরাব বাসায় এসে কোনোদিকে না তাকিয়ে হন্তদন্ত হয়ে তার ঘরে ঢুকে গেল।মুখটাও কেমন যেন লাল হয়ে ছিল।অন্যদিন হলে আগে এসেই মেহেরাব ভাইয়া তার পিছে লাগবে তারপর বাকি সব।অথচ আজ।প্রিয়া ভাবলো,ভাইয়া হয়তো ভীষণ ক্লান্ত তাই আজ কোনো কথা না বলেই এভাবে ঘরে ঢুকে গেল।প্রিয়া তারপর আর ঘুমাতে না যেয়ে একটু চোখেমুখে পানি দিয়ে মেহেরাবের জন্য কফি বানিয়ে তার ঘরে গেলে দেখে,মেহেরাব চেঞ্জ না করেই কপালের উপর হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে।
প্রিয়া ঘরে ঢুকে মেহেরাবকে এমন অবস্থায় দেখে কফিটা তার বেডের পাশের সাইড টেবিলটাতে রেখে মেহেরাবের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“এ কি,মেহেরাব ভাইয়া তুমি এসে চেঞ্জ না করেই এভাবে শুয়ে পড়েছো,এভাবে কেউ শুয়ে পড়ে নাকি বাইরে থেকে আসছো যাও ফ্রেশ হয়ে আসো।”
মেহেরাবের থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে প্রিয়া আবার বললো,
-“কি হলো মেহেরাব ভাইয়া যাও ফ্রেশ হয়ে এসে এই যে তোমার জন্য কফি আনছি কফিটা খেয়ে নাও দেখবে ভালো লাগবে।এরপর ডিনারটাও তো করতে হবে,খালামণিরা ঘুমিয়ে পড়েছে আমিই তোমার খাবারটা বেড়ে দিচ্ছি।”
এবার মেহেরাব তার তেমন শোয়া অবস্থাতেই প্রিয়ার কথার প্রতিত্তোরে শুধু এটুকু বললো,
-‘তুই যা প্রিয়া,আমাকে একটু একা থাকতে দে’
মেহেরাবের কথা শুনে প্রিয়া ঝটপট করে বললো,
-“না,না আগে তুমি উঠবে ফ্রেশ হবে।কফি হাতে নিবে দেন আমি যাবো।”
মেহেরাবের কোনো ভাবান্তর হলো না।সে তার অবস্থান থেকে এক চুলও নড়লো না।সে ঠিক তেমনভাবেই শুয়ে রইলো।এবার প্রিয়ার বেশ বিরক্ত লাগলো যে মেহেরাব ভাইয়া তার কথা শুনেও শুনছে না।প্রিয়া অনেকটা বিরক্তি নিয়ে মেহেরাবের হাত ধরে টেনে বললো,
-উঠো।উঠো বলছি।
মেহেরাব আচমকা তার থেকে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে তাকে ধমকে উঠলো,
-“তোকে আমি যেতে বলেছি না প্রিয়া,আর এত রাতে আমার ঘরে তোর কি?কোনো ভদ্র মেয়ে তো এতরাতে কোনো পরপুরুষের ঘরে আসতে পারে না।”
বর্তমান..
মেহেরাবের মুখে এমন কথা শুনে প্রিয়া যেন কথা ভুলতেই ভুলে গেল।তার মেহেরবার ভাইয়া কি বললো,তার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুললো।সে তো শুধু কফিটাই দিতে এসেছিল।প্রিয়া কোনো কথা না বলে একদৃষ্টিতে মেহেরাবের দিকে তাকিয়ে আছে।প্রিয়ার এমন নিরবতা দেখে মেহেরাব যেন আরো রেগে গেল।আর চিল্লিয়ে বললো,
-“কি রে এখনো দাঁড়িয়ে আছিস,এতো বেহায়া কেন তুই।এখনি আমার ঘর থেকে বেরিয়ে যা,যা বলছি।আর কখনো যদি এ ঘরে এসেছিস তাহলে আমার থেকে খারাপ আর কেউ হবে না।”
মেহেরাবের চিল্লাচিল্লিতে ততক্ষণে তার খালামণিদের ঘুম ভেঙে গিয়েছে।আর তার খালামণিরা,তিশপি আপু মেহেরাবের রুমের সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল।মিসেস রুহি তার ছেলের করা এমন অন্যায় আচরণ দেখে মেহেরাবের রুমে যেয়ে বলে,
-“আর একবার আমার মেয়েকে কিছু বললে তোকে মেরে পিঠের ছাল ছাড়িয়ে নিবো আমি।এ কেমন ব্যবহার তোর?কি করেছে ও?তুই জানিস না আমরা সবাই তাকে কতটা ভালোবাসি।”
মেহেরাব তার মায়ের কথায় কিছু না বলে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো।আর এবার প্রিয়ার খালু অর্থাৎ রোহান রহমানও ভীষণ রেগে গেল।সে তার ছেলের উদ্দেশ্যে বললেন,
-“তুমি জানো না,একটা মেয়ের সাথে ঠিক কিভাবে ব্যবহার করতে হয়।আর ওকে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে বলছো কেন তুমি?”
মেহেরাব এবারও কিছু বললো না।প্রিয়া এতক্ষণ নির্বাক দর্শকের মতো সবটা দেখে গেল।তার জন্য কতকিছু হয়ে গেল,মেহেরাব ভাইয়াও কত বকা খেল কিন্তু আদৌ কি তার কোনো দোষ ছিল।প্রিয়া কোনো উত্তর পেল না।মিসেস রুহি আবারও তার ছেলের উদ্দেশ্যে কিছু বলতে গেলে প্রিয়া তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে,
-“থাক খালামণি,তাকে আর কিছু বলো না।আমারই ভুল এত রাতে উনার ঘরে আসাটা,উনাকে ডিস্টার্ব করাটা উচিৎ হয়নি।”
এরপর মেহেরাবের দিকে ছলছল দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
-“মাফ করবে মেহেরাব ভাইয়া,এমন ভুল আর কখনো হবে না।”
প্রিয়ার এমন ছলছল দৃষ্টি দেখে মেহেরাবের বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো।কথাটা বলে প্রিয়া ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।রোহান রহমান,তিশপিও বেরিয়ে গেল।তিশপি এতক্ষণ প্রিয়ার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল।মিসেস রুহি বের হতে গেলে দেখে মেহেরাবের বেড সাইডে কফির মগ রাখা।সেটা দেখে সে মেহেরাবের উদ্দেশ্যে বললো,
-“মেয়েটা তো তোকে কফি দিতে আসছিল,আর তুই এমন ব্যবহার করলি।হয়তো তুই কোনো কারণে ডিস্টার্ব আছিস কিন্তু তুই তো ওকে ভালোভাবে বেরিয়ে যেতে বললেই পারতিস।তুই জানিস না ও কতোটা ইমোশনাল,অভিমানী।পারবি তো ওর অভিমান ভাঙাতে?”
কথাগুলো বলে মিসেস রুহি বেরিয়ে যান।মিসেস রুহি জানেন তার ছেলে প্রিয়াকে ঠিক কতটা ভালোবাসে।মেহেরাব তার যাওয়ার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো।এরপর মাথায় হাত দিয়ে ধপ করে বিছানায় বসে পড়লো।ও তো চায় নি,প্রিয়ার সাথে এমন ব্যবহার করতে কিন্তু কি থেকে কি হয়ে গেল সে কিছুতেই নিজের রাগটাকে কন্ট্রোল করতে পারলো না।মেহেরাবের এখন প্রিয়ার সেই ছলছল দৃষ্টির কথা মনে পড়ছে।সে তার প্রিয়াকে কষ্ট দিয়ে ফেলেছে,তার জানকে সে কিভাবে এত কঠিন কথাগুলো বললো।মেহেরাবের এখন তার নিজের প্রতিই ভীষণ রাগ হচ্ছে সে কেন তার নিজের রাগটাকে কন্ট্রোল করতে পারে না।এই রাগটাই যে মানুষকে ধ্বংস করে দেয়।মেহেরাব সেই কফির মগটা হাতে তুলে নেয়,কফিটার দিকে তাকিয়ে বলে,
-“তোকে ভীষণ কষ্ট দিয়ে ফেলেছি তাই না রে প্রাণপ্রিয়া।কি করবো বল,তুই তো জানিস তোর মেহেরাব এরকমই।রাগের মাথায় যে কি বলে ফেলে,কিচ্ছু খেয়াল থাকে না।সব হয়েছে ওই রাদিফটার জন্য,ও যদি আজ তোকে নিয়ে ওই কথাগুলো না বলতো তাহলে কিচ্ছু হতো না।তোকে কেউ কিছু বললে,আমার সহ্য হয় না প্রাণপ্রিয়া।আর আজ যদি ও আমার বেস্টফ্রেন্ড না হতো,তবে ওকে আমি জিন্দা কবর দিয়ে দিতাম।”
আজ মেহেরাব আর তার বন্ধুরা যখন সবাই মিলে আড্ডা দিচ্ছিল তখন হঠাৎ রাদিফ বলে উঠে,
-“কি মামা,তোকে তো দেখি ভালোই প্রিয়াকে নিয়ে ঘুরে বেড়াতে।ভালোই মজা করছিস তাই না।সেদিন দেখলাম রিকশায় ওকে নিয়ে ঘুরতে তা কোমড়ে হাত দিয়েছিলি নিশ্চয় আর আজকালকার মেয়েদের কাছে তো এসব কমন বিষয় প্রিয়াও নিশ্চয় ইনজয় করেছে।”
রাদিফের মুখে এমন বিছ্রি কথা শুনে ঘৃণায় মেহেরাবের গা গুলিয়ে উঠলো সাথে প্রচন্ড রাগে হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে গেল।সে ভাবতেও পারেনি তার বেস্টফ্রেন্ড এ ধরণের কথা বলতে পারে।মেহেরাব রাগে তার দিকে এগিয়ে যেয়ে রাদিফের কলার ধরে বললো,
-“মুখ সামলে কথা বল রাদিফ।প্রিয়াকে নিয়ে তোর এ ধরণের কথা বলার সাহস কি করে হলো।সেদিন ওকে নিয়ে কোথাও ঘুরতে বের হয়নি ওকে পরীক্ষা দিতে নিয়ে গিয়েছিলাম গাড়িটা মাঝপথে খারাপ হয়ে যাওয়ায় বাধ্য হয়ে রিকশা নিয়েছিলাম।আর কি যেন বললি আজকালকার মেয়েদের কাছে এসব কমন বিষয় ভুল বললি বাজে মেয়েদের কাছে এসব কমন বিষয় আর আমার প্রিয়া পবিত্র।প্রিয়াকে নিয়ে আর একটা বাজে কথা বললে তোর জিভ টেনে ছিঁড়ে ফেলবো আমি।”
মেহেরাবের এমন ব্যবহারে রাদিফও রেগে যায়।সে রেগে গিয়ে মেহেরাবের হাত থেকে নিজের কলার ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,
-“হ্যাঁ,হ্যাঁ যা জানা আছে।ও তোকে নাচাচ্ছে।ও যেমন আজ তোর সাথে ঘুরছ্র কাল তেমনি অন্য একটা ছেলেকে নিয়ে ঘুরবে।মেয়ে জাতটাই খারাপ।”
রাদিফের এমন কথায় মেহেরাব আরো রেগে যায়।পরিস্থিতি অস্বাভাবিক হয়ে উঠছিল।দুই বন্ধুর এই দ্বন্দ্বে যেন বাকি বন্ধুরা দিশেহারা হয়ে উঠছিল ওরা চেয়েও কাউকে আটকাতে পারছিল না।রাদিফ আর মেহেরাবের মধ্যে এক প্রকার মারামারিই বেঁধে গিয়েছিল।অবশ্যত তার বাকি বন্ধুরা মেহেরাবের পক্ষেই ছিল কেননা রাদিফ খুব বাজেভাবে কথাগুলো বলেছে।এরপর অনেক কষ্টে মেহেরাবের হাত থেকে রাদিফকে ছাড়ানো হয়।এরপর থেকে মেহেরাবের মেজাজ প্রচন্ড খারাপ ছিল।
মেহেরাব কফিটা খেয়ে মগটা রেখে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে রাত ১ টা বাজে।এতক্ষণে তার প্রাণপ্রিয়া নিশ্চয় ঘুমিয়ে পড়েছে।মেয়েটা কি কেঁদেছে,হয়তো।কথাটা ভাবতেই মেহেরাবের মনটা খারাপ হয়ে যায়।হঠাৎ কিছু একটা ভেবে মুচকি হেসে বলে,
-“তোর,আমার সম্পর্কটা নতুন নাম পেতে চলেছে শীঘ্রই।তোর অভিমান আমি ঠিক ভাঙাবো প্রাণপ্রিয়া।তোর এই অভিমান আমাদের সম্পর্কটাকে আরো গভীর করে তুলবে।”
সকাল নয়টায় মেহেরাবের ঘুম ভাঙে।আজ অনেকটা দেরিতে ঘুম ভেঙেছে তার।অনেক রাত হলেও তার ঘুম আসছিল না প্রাণপ্রিয়াকে ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছিল।কিন্তু ইচ্ছে থাকলেও উপায় ছিল না।সকালের দিকে একটু চোখটা লেগে গিয়েছিল তাতেই উঠতে এত দেরি হয়ে গিয়েছে।মেহেরাব দ্রুত রেডি হয়ে নেয় অফিসে যাওয়ার জন্য তার বাবার অফিসটার দায়িত্বে বর্তমানে সেই আছে।মেহেরাব রেডি হয়ে নিচে নেমে যা দেখলো তাতে তার চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গেল।সে দেখলো…
#উপসংহারে_ভালোবাসা
#পর্ব_১
#তিয়াশা_জেরিন
[গল্পটিতে আপনাদের রেসপন্স আশা করছি।সাথে থাকলে হয়তো একটা সুন্দর গল্প আপনাদের উপহার দিতে পারবো ইন শা আল্লাহ।]