সরোবরে প্রেম
লেখনীতেঃশ্যামকন্যা
পর্ব:০৩
সেলিনা বেগমের হতভম্ব ভাব এখনো কাটেনি। হুট করে মেয়েটা পরে গেল কেন! কোন বিপদের সংকেত দিচ্ছেন রব? তিনি কাব্যকে ডাকেন। কাব্য আর সেলিনা বেগম মিলে প্রিয়তাকে পাঁজাকোলে করে খাটে শোয়ায়। অনেকক্ষণ মাথায় পানি ঢালেন। খানিক সময় পরেই ভেজা চোখ খোলার চেষ্টা করে প্রিয়তা। চোখ খুলে ফোনে শোনা কথাগুলো মনে পড়তেই চোখ দিয়ে গরম নোনাজল গড়াতে থাকে। সেলিনা বেগম জিজ্ঞেস করলো,
“কি হয়েছে, মা? ওভাবে পড়ে গেলি যে! কতটা ভয় পেয়েছিলাম।”
প্রিয়তা আওড়াতে থাকে,
“অর্ণবের এক্সিডেন্ট হয়েছে মা।”
আসমা চৌধুরী একটু আগে অর্ণবের খবর পেয়েছেন। তিনি ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলছেন। আমিন সাহেবকে খবর দেয়া হয়েছে। তিনি একটু আগে নীলক্ষেত বোনের বাসায় গিয়েছেন। সেখান থেকেই হাসপাতালে পৌঁছাবেন।
হাসপাতালের শুভ্র বেডে এলিয়ে আছে অর্ণব। মাথায় ব্যান্ডেজ প্যাচানো। হাতও ভেঙেছে। ঠোঁটের পাশে কেটে ফুলে আছে। প্রিয়তার বুক কেঁপে উঠলো। লোকটার কি দশা হয়েছে তার জন্য! কিভাবে ক্ষমা করবে নিজেকে সে? ভাবতেই দুফোঁটা আক্ষেপ মিশ্রিত অশ্রু বেয়ে অর্ণবের হাতের উপর পরে। অর্ণব জেগেই ছিল। চোখ মেলে প্রিয়তার দিকে তাকায়। বলে,
“খুশি হয়েছো তুমি?”
প্রিয়তা ফুপিয়ে উঠে। জবাব দেয়,
“আমাকে এতো কষ্ট দিচ্ছেন কেন, অর্ণব। তখন ভেবেচিন্তে কথাগুলো বলিনি। প্লিজ, ক্ষমা করে দিন।”
অর্ণব মুখ ফিরিয়ে নেয়। প্রিয়তা আলতোভাবে অর্ণবের চুল স্পর্শ করে। এলোমেলো করে দেয় খানিকটা। অর্ণব রেগে বলে,
“এখন ঢং করতে হবে না। চলে যাও এখান থেকে। ”
চপল পায়ে রুমে প্রবেশ করেন আসমা চৌধুরী। ছেলেকে বুকে জড়িয়ে নিজেকে খানিকটা শান্ত করেন। প্রিয়তাকে দেখতেই ওনার গা গুলিয়ে আসে। এই মেয়েকে তিনি কিভাবে পছন্দ করলেন? তিনি মনে মনে একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নেন।
কেবিন থেকে সবাই বের হয়ে বাইরে দাঁড়ায়। প্রিয়তা কখন থেকেই চোখের পানি ফেলে যাচ্ছে। আসমা চৌধুরীর নিকট এসব ঢং ছাড়া আর কিছুই না। সেলিনা বেগম মেয়েকে শান্তনা দেয়ার সুরে বলেন,
“জামাইয়ের ঠিকমতো খেয়াল রাখবি এখন থেকে।”
আসমা চৌধুরী বিস্ফোরক কন্ঠে বলেন,
“বিয়েটা হচ্ছে না, আপা। যে মেয়ের জন্য আমার ছেলের এই অবস্থা সে মেয়েকে আমি কিছুতেই ঘরে তুলবো না।”
হতভম্ব চোখে তাকায় সবাই। আমিন সাহেবও চুপ করে থাকেন। অর্ণব তাদের একমাত্র ছেলে। যদি সত্যিই ওর কিছু হয়ে যেত!
সেলিনা বেগম বলেন,
“এতে প্রিয়তার দোষটা কোথায়?”
আসমা চৌধুরী বলেন,
“দোষ আমি ব্যাখ্যা করতে পারবো না। আমি এই বিয়ে হতে দেব না। ”
গুমোট হয়ে উঠে হাসপাতালের পরিবেশ। প্রিয়তা অসহায়ের ন্যায় তাকিয়ে থাকে। তার এখন মনে হচ্ছে সে অর্ণবের যোগ্য নয়। বিয়ে না হওয়াটাই বোধহয় অর্ণবের জন্য ভালো। প্রিয়তার মতো অভিশপ্ত মেয়েকে নিজের জীবনের সাথে না জড়ানোটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। প্রিয়তা তপ্ত নিশ্বাস ফেলে।
ইতোমধ্যে অতিবাহিত হয়েছে পনেরোদিন। অর্ণব এখন সুস্থ। বিয়ে ভাঙার ঘটনা শুনে সে হাতে থাকা গ্লাস ভেঙে ফেলে। আসমা চৌধুরী তবুও সিদ্ধান্তে অটল রইলেন। প্রিয়তা দোষ করেছে ঠিকই তবে বিয়ে ভাঙার কথা চিন্তাও করতে পারে না অর্ণব। সে কড়া গলায় বলে,
“বিয়ে আমি একমাত্র প্রিয়তাকেই করব, মা।”
আসমা চৌধুরী উত্তর দেন,
“ঐ মেয়ে এ বাড়িতে আসতে হলে আমার লাশ পড়বে।”
অর্ণব এরপর আর কথা বাড়ায়নি। প্রিয়তাদের বাসায়ও যায়নি। প্রিয়তার সাথে যোগাযোগের কোনো চেষ্টাও করেনি। তবু মন পড়ে আছে প্রিয়তার কাছে।
প্রিয়তা অনেকদিন ধরে ভার্সিটি যাচ্ছে না। সেলিনা বেগম সব জানার পর প্রিয়তার সাথে কথা বলছেন না। প্রফেসর হাউসে নীরবতা বিদ্যমান। খাবার টেবিলে কাব্য বললো,
“আপু, আমায় একটু নীলক্ষেত নিয়ে যাবি? কয়েকটা বই কিনবো।”
প্রিয়তা রাজি হয়ে যায়। সেলিনা বেগম মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকেন।
চৈত্রের প্রথম দিন। আকাশ ঝকঝকে। রোদের তেজ খানিকটা কমে এসেছে। বই কিনে ফেরার পথে অর্ণবের দিকে চোখ আঁটকে যায় প্রিয়তার। কাছাকাছি দাঁড়িয়ে বলে,
“আমায় বুঝি এখনো ক্ষমা করেননি, ডাক্তার। ”
অর্ণব ফোঁস করে নিশ্বাস ছাড়ে। কাব্যকে বলে,
“আয় আমার সাথে।”
খানিক থেমে বলে,
“এখানেই দাঁড়াবে, প্রিয়তা।”
কাব্যকে রিকশায় তুলে বাইকটা সামনে নিয়ে আসে অর্ণব। কোনো কথা ছাড়াই প্রিয়তাকে বাইকে উঠতে বলে। প্রিয়তাও বিনা বাক্যে অর্ণবের কথায় সায় দেয়।
তীব্র পুরুষালি পরিচিত ঘ্রাণ প্রিয়তার ভেতরটা এলোমেলো করে দিচ্ছে। ইচ্ছে করছে জড়িয়ে ধরতে। তবে দুজনের মাঝে এখন হাজার মাইলের দূরত্ব। প্রিয়তা অর্ণবকে অবিশ্বাস করার ফল হারে হারে টের পাচ্ছে।
বাইকটা একটা খোলা মতো জায়গায় এসে থামে। অর্ণব ঘাসের উপর বসে প্রিয়তাকে বসার ইঙ্গিত দেয়। প্রিয়তাও বসে পড়ে নিরাপদ দূরত্ব রেখে। অর্ণব বলে,
“আঠারোদিন আমাদের কথা হয়না, প্রিয়তা। তোমার কিছু আসে যায় না?”
প্রিয়তা কেঁপে উঠে। কিভাবে বলবে সে! তার নিস্তব্ধ রাতগুলো পার হয় অর্ণবের ‘ মন কেমনের জন্মদিন ‘ শুনে। গ্যালারিতে অর্ণবের ফটোর দিকে তাকিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দেয় সে। ঠিকমতো খেতে পারে না। ঘুম হয় না। চোখের নিচ কালশিটে হয়ে আছে। সে খানিক ভেবে জবাব দেয়,
“এখন তো কিছুই বদলানো যাবে না। আপনাকে পাওয়ার ভাগ্য হয়তো আমার ছিল না। ”
অর্ণব হাসে। বলে,
“ছিল না নাকি তুমি খোয়ালে?”
“আপনি আমার জায়গায় নিজেকে বসিয়ে দেখুন তো। নিজের উডবি র সাথে অন্য কাউকে দেখতে মজা লাগবে আপনার? তার উপর আপনার আমাকে মিথ্যা বলা।”
“সম্পর্কে বিশ্বাস খুব জরুরি, প্রিয়তা। বিশ্বাস সম্পর্ক ধরে রাখে। আর অবিশ্বাস সম্পর্ক ভাঙে।”
“বুঝেছি।”
“এতো দেরীতে বুঝলে, প্রিয়তা।”
প্রিয়তার চোখের কোণায় পানি। আর সহ্য হচ্ছে না তার। কি করবে সে?
চলবে?
সরোবরে প্রেম
লেখনীতেঃশ্যামকন্যা
পর্ব:০৪
কঠোরভাবে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য।
প্রিয়তা কাঁপা চোখে অর্ণবের হাত স্পর্শ করে বলে,
“আমায় একটা সুযোগ দেবেন? কথা দিচ্ছি কখনো আপনাকে অভিযোগ করতে দিব না।”
অর্ণব হাসে। বলে,
“তোমার উপর আমি রাগ করে থাকতে পারিনা, প্রিয়ু। নিজের একটা অংশের উপর কখনো রাগ করে থাকা যায়?”
“তাহলে এতোদিনেও একটাবার আমার খোঁজ নিলেন না!”
“অভিমান হয়েছিল ভীষণ।”
“অভিমান ভাঙাতে কি করতে হবে?”
“আমার বুকে একটু মাথাটা এলিয়ে দাও, প্রিয়ু। একটু শান্তি দাও আমায়।”
প্রিয়তা লজ্জা রাঙা চোখ নিচু করে আনে। আলতো হাতে অর্ণবের চুল নেড়ে এলোমেলো করে দেয়। এরপর সযত্নে মাথাটা রাখে অর্ণবের বুকের বা পাশে। হৃদযন্ত্রটা বোধহয় এবার বেরিয়ে যাবে। লোকটা এতো ভালোবাসে কেন? লোকটার গায়ে এতো সুগন্ধ কেন?
অর্ণব প্রিয়তাকে এক হাতে জড়িয়ে নেয় নিজের সাথে। আবার প্রশ্ন করে,
“উইল ইউ বি মাইন ফর এভার, প্রিয়ু।”
প্রিয়তা চুপ করে থাকে। আসমা চৌধুরীর কথা মনে হতেই অন্তরে তিক্ততা ছেয়ে যায়।
অর্ণব বলে,
“তোমার উত্তর ” না” হলে আমি আর কখনোই তোমার সামনে আসবো না। ”
বুক কেঁপে উঠে প্রিয়তার। সে আলগোছে অর্ণবের হাতটা বাড়িয়ে শক্ত করে ধরে। মোলায়েম কন্ঠে বলে,
“মৃত্যুর আগে পর্যন্ত এই প্রিয়তার সবকিছুতে শুধু আপনার একছত্র অধিপত্য থাকবে।”
অর্ণবের বুক জুড়ে শীতলতা বয়ে যায়। সে ঘোর লাগানো দৃষ্টিতে প্রিয়তার দিকে তাকায়। মেয়েটা আজ মেরুন কালারের একটা টপ পড়েছে। চুলগুলো বাতাসে উড়ছে। নাকের ডগায় সামান্য তেল এসে জমা হয়েছে। ইচ্ছে করছে কামড় বসাতে। অর্ণব নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,
“কবে যে বিয়েটা হবে, প্রিয়ু? সারারাত তোমায় বুকে নিয়ে ঘুমাবো।”
প্রিয়তা ঈষৎ লজ্জা পেয়ে চোখ নামায়। অর্ণবের এসব কথায় মোটামুটি অভ্যস্ত সে। আগে রাত জেগে দুজন কথা বলতো। মাঝে মাঝে লজ্জায় প্রিয়তার গাল গরম হয়ে যেত। গলার কাছে কথা আটকে আসতো।
অর্ণব বলে,
“তুমি নীল শাড়ি পরে আমার সামনে আসবে। রুমের অল্প আলোতে আমি তোমার দিকে তাকিয়ে থাকবো।”
প্রিয়তা জিজ্ঞেস করে,
“তারপর?”
“তারপরেরটা শুনতে চাও? পরে আবার আমাকে দোষ দিও না।”
“হুস, বলতে হবে না। ”
“না, বলবই।”
“অসভ্য লোক কোথাকার।”
অর্ণব হাসতে হাসতে বলে,
“তারপর আমি তোমার উপর……
পুরোটা বলার আগেই প্রিয়তা অর্ণবের মুখ চেপে ধরে। অর্ণব চেঁচিয়ে বলে,
” বলতে দাও না, প্রিয়ু।”
প্রিয়তা অনুনয়ের সুরে বলে,
“আমি লজ্জায় মরে যাব, প্লিজ। বিয়ের পর আপনার সব কথা শুনবো।”
অর্ণব বলে,
“বউ রাজি, আমিও রাজি। বিয়েটা দিয়ে দাও না,মা।”
হুট করে প্রিয়তার মুখটা কালো হয়ে যায়। সে বলে,
“আন্টি কি সত্যিই রাজি হবে না, অর্ণব?”
অর্ণব ভরসার সুরে বলে,
“এতো টেনশন করো না, প্রিয়ু। মাকে রাজি করানোর দায়িত্ব আমার। তবে সেটার জন্য ঘুষ দিতে হবে।”
“আপনি আমার থেকে টাকা নেবেন?”
“উহু। একটা চুমু খেতে দিলেই হবে।”
প্রিয়তা ভয়ার্ত চোখে তাকায়। কোনোদিন সে ছেলেদের সংস্পর্শে আসেনি। সত্যিই যদি বিয়েটা না হয়? এসব কিভাবে ভুলে থাকবে সে। অর্ণব প্রিয়তার মুখ দেখে কিছুটা আঁচ করতে পারে। সে বলে,
“মজা করছিলাম বোকা মেয়ে। তোমায় আমি পবিত্রভাবেই স্পর্শ করবো। আদরগুলো নাহয় বিয়ের পরের জন্য তোলা থাক।”
আবারও গরম হয় প্রিয়তার ফর্সা গাল।
চলবে?