#ভালোবাসার_রোজ[পর্ব-০৭]
#আফরোজা_আনজুম
‘ শুক্রবার ‘ দিনটা আমার কাছে ইদের দিনের মতো মনে হয়। এই দিনে বাড়ির পুরুষ মানে বড় চাচা, আব্বু, ছোট চাচা, আরমান ভাইয়া, আরিফ ভাইয়া সকলে উপস্থিত থাকে। মা- চাচীরা পোলাও, বিরিয়ানি সহ নতুন নতুন পদের খাবার রান্না করে। খাবার টেবিলে বাড়ির সব ছেলেরা যখন একত্রে খেতে বসে তখন দৃশ্যটা দেখে মনে শান্তি শান্তি লাগে। দাদা-দাদি জীবিত নেই। তাও বাবা-চাচা, মা- চাচীদের মধ্যে একতার জুড়ি নেই। এমনিতেই ঘুম থেকে দেরিতে উঠা আমার অভ্যেস আর শুক্রবার হলে তো কথাই নেই। বিছানায় শুয়ে থাকতে থাকতে শুনলাম আম্মু উঁচু গলায় বকছে। রুবার ভ্যা ভ্যা কান্নাও শোনা যাচ্ছে। একটু আগে এসে আমার মুখে এক গ্লাস পানি মেরে দিয়েছে। ঘুমের সময় কেউ বিরক্ত করলে প্রচন্ড মেজাজ খারাপ হয়। আর সে তো পানি মেরেছে। তাই উঠেই চড় মেরে দিয়েছি। অন্যান্য দিনে ঘুম থেকে উঠতেই চায় না পড়ার ভয়ে। আর শুক্রবার হলে সবার আগে উঠে ঘুরঘুর করে।
আম্মুর গলার স্বর আরো স্পষ্ট হতেই চট করে উঠে পড়লাম। কাঁথা ভাজ করতে লাগলাম। আম্মু রাগী চোখে একবার তাকিয়ে চলে গেলো। ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে দেখলাম আম্মু সোফায় বসে মোবাইলের দিকে তাকিয়ে কাঁদছে। নিশ্চয়ই আপুর সাথে কথা বলছে! আমি পাশে বসলাম। মনটা একটুও ভালো নেই। কোনো কিছুই ভালো লাগে না। আম্মু মোবাইলটা এগিয়ে দিয়ে বললো, ” তোর আপুর সাথে কথা বল।”
আপু দেখেই বললো, ” তোর চোখ মুখ এমন হয়ে গেছে কেন? খাওয়া দাওয়া করিস না? দেখে মনে হচ্ছে রাজ্যের সব চিন্তা তোর!”
পাশ থেকে আম্মু বললো, ” একদম করছে না খাওয়া দাওয়া। সারাদিন মনমরা হয়ে বসে থাকে। অ্যাই, সকালের নাস্তা করেছিস? এতো বেলা হলো। নাস্তা না করে এখানে বসেছিস কেন? মরবি নাকি না খেয়ে খেয়ে! ”
আমার কান্না চলে আসলো। ঢোক গিলে মনে মনে বললাম, ” মরে যাবো মনে হয় আম্মু। বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করছে না একদম। তোমাদের বললে বলবে এতো ছোট মেয়ের কীসের কষ্ট এতো? আমরা কোনোকিছুর অভাবে রেখেছি তোকে! তোমরা তো জানো না এই ছোট মেয়েটার মনে কতো কষ্ট জমে আছে! ”
.
.
নাস্তা করে সোফায় চোখ বন্ধ করে শুয়েছিলাম। চোখেমুখে পানির ছিটা পড়ায় চমকে উঠলাম। নিঠুল ভাই আমার সামনে দাঁড়িয়ে। পরনের সাদা পাঞ্জাবিটা ভিজে গায়ের সাথে লেপ্টে আছে। শরীরের বেশিরভাগ অংশই ভিজে গেছে। চুল ঝেড়ে পানি ফেলেছে আমার মুখে। চোখ মুখ কুঁচকে উঠে বসলাম আমি। ছোট চাচার মেয়ে তিশা ‘ নিতু ভাই এসেছে, নিতু ভাই এসেছে ‘ বলে চিল্লাতে চিল্লাতে পেছন থেকে হঠাৎ ধাক্কা দেয় নিঠুল ভাইকে। নিঠুল ভাই আমার উপর পড়তে পড়তেও সোফার হাতলে ঠেস দিয়ে সামলে নেয় নিজেকে। তিশার দিকে তাকালে সে খিলখিল করে হেসে উঠে। নিঠুল ভাই বললো, ” সবকটা ফাজিল। বাইরে গিয়ে দেখ কাঁদা ছুড়াছুঁড়ি করছে একজন আরেকজনের গায়ে। খেয়াল রাখতে পারিস না বিচ্ছুগুলোকে। বড় বোন হয়েছিস কেন? শুধু ঘুম আর ঘুম না!
ভিজে গেছি দেখছিস না! একটা তোয়ালে আন জলদি। ”
আরমান ভাইয়া দেখে বললো, ” ভিজে কীরকম হয়েছিস! ছাতা ছিলো না?”
” ধূর! বলো না আর। এদিকে একটা কাজে এসেছিলাম। আসার সময় ছাতা গাড়িতে রেখে নেমে পড়েছি। ” পাঞ্জাবিটা খুলে ফেললো সে।
আরিফ ভাইয়া হেসে বললো, ” ভাবি কেমন আছে, ব্রো?”
নিঠুল ভাই আরমান ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বললো, ” বলো ভাইয়া, ভাবি কেমন আছে? ”
আরমান ভাইয়া লাজুক হেসে চলে গেলো। বিয়ের কথা চলছে ভাইয়ার। পাত্রীও পছন্দ হয়ে গেছে। ইদের পর পরই বিয়ের সানাই বাজবে হয়তো।
” ধুর! ঐ ভাবি না। তোমার বউয়ের কথা জিজ্ঞেস করছি।”
” কেন রে? অন্যের বলয় খবর নিতে এতো ভালো লাগে! ঝটপট গিয়ে একসেট কাপড় নিয়ে আয়।”
আরিফ ভাইয়া কীসব বলতে বলতে কাপড় আনতে গেলো। বড় চাচী নিঠুল ভাইকে এই অবস্থায় দেখে হায় হায় করছে। জ্বর আসা ঠেকাতে ঔষধও খাইয়ে দিয়েছে। তাও জ্বর ঠেকানো যাবে বলে মনে হয় না। কারণ উনিশ-বিশ হলেই ভুগতে হয় তাকে। নিঠুল ভাই আমাকে ডেকে বললো এক কাপ কড়া লিকারে চা বানিয়ে দিতে। রান্নাঘরে সবাই ব্যস্ত আছে দেখে আমিই বানালাম। মুখে দেওয়ার সাথে সাথেই ওয়াক করে ফেলে দিলো। চোখ মুখ কুঁচকে বিশ্রী চেহারা বানিয়ে বললো, ” কী এনেছিস এটা!”
” খাওয়া যাচ্ছে না? আম্মুরা ব্যস্ত তাই আমি বানিয়েছি।” কাঁচুমাচু হয়ে বললাম আমি।
” বলা লাগবে না। দেখেই বুঝেছি এটা কে বানাতে পারে।” কাপটা টেবিলে রেখে বললো।
” নিঠু, তোকে তো আজকাল দেখাই যায় না। এই ঝড়ের দিনে তোকে দেখতে পাবো ভাবিনি।” আব্বু বললো।
“দেখা যাবে কীভাবে! চুটিয়ে প্রেম করছে। অন্যদিকে মন, ধ্যান দেওয়ার সময় আছে নাকি!” মনে মনে বললাম আমি।
নিঠুল ভাই বললো, ” গ্রামে গিয়েছিলাম চাচু। বড় আব্বু অসুস্থ তাই। ”
দুজনে মেতে উঠলেন গল্পে। সন্ধ্যার দিকে দেখলাম রেবা আন্টি অনেকবার কল দিয়েছে আমার মোবাইলে। রিসিভ করলে জানলাম নিঠুল ভাই ফোন ধরছে না। তারা ছাদে ছিল তাই রুবাকে দিয়ে পাঠালাম মোবাইল। অনেকক্ষণ পর রুবাকে বললাম মোবাইলটা আনতে। সে একদৌড়ে গিয়ে একদৌড়ে এসে বললো নিঠুল ভাই আমাকে যেতে বলেছে। মোবাইল তাকে দিচ্ছে না। ভয় পেয়ে গেলাম আমি। মোবাইলের লক খোলা ছিল। মেসেজ চেক করেছে নাকি! আমি গিয়ে মোবাইলটা যখন চাইলাম সে রাগী চোখে তাকালো। মোবাইলটা দেখিয়ে বললো, ” তোর বন্ধু প্রয়োজন না মনের কথা বলার জন্য! জয়কে বন্ধু বানিয়ে ফেললি! সে তোকে প্রপোজ করেছে তারপরও দিব্যি চ্যাট চালিয়ে যাচ্ছিস। ঘন্টায় ঘন্টায় খবর নেওয়া দেওয়া করছিস। ”
” তো কী হয়েছে? নিজে তো প্রেম করে বেড়াও আর আমি করলেই দোষ! আমি ভেবে রেখেছি কালকেই জয় ভাইয়ার প্রপোজাল এক্সেপ্ট করবো। ”
” ভালোবাসিস একজনকে আর প্রেম করবি অন্যজনের সাথে? ”
কেঁদে উঠলাম আমি। বললাম, ” কে বলেছে তোমায় ভালোবাসি! একদম না। এসব আজগুবি কথা কই পাও? ”
নিঠুল ভাই হেসে বললো, ” আমি তো বলি নি আমাকে ভালোবাসিস। তুই নিজেই বললি মাত্র। ”
” আমি বলি নি। ”
নিঠুল ভাই আমাকে কাছে টেনে নিয়ে ফিসফিস করে বললো, ” আমি জানি আমার সামনে দাঁড়ানো মেয়েটা আমাকে প্রচন্ড ভালোবাসে। ”
আমি হাত ছাড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে বললাম, ” সব জেনেও কষ্ট দাও তুমি। আর সেটা করেই মজা পাও। আমার সামনে আসবে না কোনোদিন। তোমার সুইটির সাথে থাকো।”
” তোকে কে বললো সুইটিকে ভালোবাসি! আমি নিজ মুখে একবারও বলেছি?”
উত্তর দিলাম না। তাকে কাছে পেয়ে কান্না ভেঙে আসছে। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে কতোটা ভালোবাসি তাকে, কতোটা কষ্ট পাচ্ছি তার জন্য।
” সুইটি আমার ফ্রেন্ড হয়। এর বাইরে অন্য কোনো সম্পর্ক নেই।”
নিঠুল ভাই আমাকে তার বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলো। চুলে হাত বুলিয়ে নিচু স্বরে বললো, “একটা কথা জেনে রাখ, আমার বুকে মাথা রেখে কাঁদতে থাকা মেয়েটাই আমার ভালোবাসার মানুষ। সে-ই আমার জীবনের একটা বিরাট অংশ দখল করে আছে। তাকে আমার জীবনে ছাড়া অন্য কারো জীবনে ভাবতে পারি না একটুও। তাকে একনজর দেখার জন্য বারবার ছুটে আসি এখানে। এই যেমন আজকে ঝড়বৃষ্টি উপেক্ষা করে চলে এলাম! তার লেখাপড়ার জন্য তাকে কখনো বলি নি, বুঝতে দিই নি। কিন্তু আড়ালে ভালোবেসেছি ঠিকই। আজকে এই বৃষ্টির সন্ধ্যামুখর মুহূর্তকে সাক্ষী রেখে বলছি ‘ আমার ভালোবাসার রোজ তুই’। ”
নিজের কানকে যেন বিশ্বাস করতে পারছি না। স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি নিঠুল ভাইয়ের হৃৎস্পন্দন। উত্তেজনায় হাত পা কাঁপছে আমার। আবারও কান্না পাচ্ছে। শব্দ করেই কেঁদে দিলাম। নিঠুল ভাই বললো, ” তোর চোখের, নাকের পানিতে আমার বুক ভিজিয়ে দিচ্ছিস।ছিহ্! ছাড়, ছাড়।”
কানে নিলাম না তার কথা। শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। আজকে আমি ভীষণ ভীষণ খুশি। খুশিতে মরে যাওয়ার মতো খুশি।
.
.
রুমে অস্থির হয়ে পায়চারী করছি। সন্ধ্যায় ঐ সময়ের পর পরই চলে গিয়েছিল নিঠুল ভাই। রাতে বড় চাচীর কাছ থেকে জানলাম জ্বর এসেছে নাকি তার। ফোন করবো কিনা ভাবছি। লজ্জা লাগছে ভীষণ। আর না ভেবে কল দিয়ে দিলাম। কয়েকবার দেওয়ার পরও রিসিভ হলো না। টেনশন হচ্ছে। অবস্থা খারাপ নয় তো! মিনিট পাঁচেক পর কল এলো। সাথে সাথেই রিসিভ করলাম। নিঠুল ভাই জিজ্ঞেস করলো, ” না ঘুমিয়ে কী করছিস এতো রাত পর্যন্ত?”
তার গলার স্বর কাঁপছে। আমি বললাম, ” ঘুম আসছে না। তোমার জ্বর তো বেশি মনে হয়। সাথে কেউ নেই? ”
” আম্মু ছিলো এতক্ষণ। কিচেনে গেল মাত্র। ”
” ওহ্ “, বলে আর কিছু বললাম না আমি। নিঠুল ভাই বললো,” আমার অনেক আফসোস হচ্ছে জানিস?”
” কেন?”
” তখন চুমু খায় নি বলে। সর্দি মাখানো মুখ হলেও একটা চুমু খাওয়া উচিত ছিলো।”
এপাশ থেকে আমি লজ্জা পেলাম, সাথে রাগও হলে। তখন সে আমার মুখ তুলেছিল চুমু খাবে বলে। পরে চুমু না খেয়ে বললো চোখের পানি, নাকের পানিতে আমার মুখ ভিজে একাকার। চুমু খাওয়ার অবস্থায় নেই। যদিও মজা করে বলেছিল তাও আমি রেগে তাকে ছাড়িয়ে দৌড়ে চলে গিয়েছিলাম।
আবারও শুনতে পেলাম তার কণ্ঠ, ” এ মুহূর্তে তুই কাছে থাকলে ভালো হতো।তুই একটা চুমু দিলেই আমার জ্বর সারিয়ে যেতো।”
” জ্বরের ঘোরে ভুলভাল বলছো তুমি। রাখো।” বলে ধমকে উঠলাম। ওপাশ থেকে হাসির শব্দ শুনতে পেলাম। মজা করলো নাকি জ্বরে মাথা খারাপ হলো সে-ই ভালো জানে।
#চলবে…
#ভালোবাসার_রোজ[পর্ব-০৮]
#আফরোজা_আনজুম
সকাল আটটায় ঘুম থেকে উঠে তাড়াহুড়ো করে তৈরি হয়ে নিলাম। সাড়ে আটটায় ভার্সিটির গাড়ি আসে। বেশিরভাগ সময়ই ঘুমের কারণে মিস করে ফেলি। তখন অন্য গাড়িতে যেতে হয়। একা একা চলাফেরা করলে আব্বু আম্মু ভয়ে তটস্থ থাকে। তাই তাঁরা বলে ভার্সিটির গাড়িতেই যেন যায়। তৈরি হয়ে খাবার টেবিলে গিয়ে দেখি রুবা আর তিশা খেতে বসেছে। দুজনে মুখ ফুলিয়ে রেখেছে। হাতে পাউরুটি আর কলা। দেখেই আমার বমি পেলো। সবচেয়ে অপছন্দের খাবার। রুবা আমাকে দেখে প্লেট এগিয়ে দিলো। দাঁত দেখিয়ে হেসে বললো, ” আপু, এগুলো তোমার ভাগের। খাও।”
চোখ পাকিয়ে তাকালাম তার দিকে। চেয়ারে টেনে বসে উঁচু গলায় বললাম অন্যকিছু থাকলে আনতে, দেরি হয়ে যাচ্ছে। রান্নাঘর থেকে আম্মুর চিরাচরিত ডায়লগ শুনতে পেলাম ‘ ভাত খা ‘। রান্নাঘরে গিয়ে সমুচা নিলাম। নিঠুল ভাইয়ের পছন্দের খুব। গ্যাস্ট্রিকের সমস্যার জন্য বাইরের ভাজাপোড়া খায় না সে। তবে ঘরে বানানো সমুচা খেতে পছন্দ করে। ভাবলাম তার জন্য নিয়ে যায়।
” চাচী আম্মু, কয়েকটা সমুচা একটা বক্সে করে দাও না!” ছোট চাচীকে বললাম আমি।
আম্মু বাঁকা চোখে তাকিয়ে বললো, ” স্কুলে থাকতে তো জোর করেও কোনোদিন টিফিন নেওয়াতে পারলাম না। তোর পছন্দের কিছু রান্না করলেও নিতি না। আর আজকে তুই টিফিন দিতে বলছিস?”
” ভালো হয়ে গেছি আম্মু। তখন নিতাম না বলে খুব কষ্ট পেতে না! এখন থেকে নিবো। তবে যেদিন পছন্দের খাবার বানাবে সেদিন। তোমার ভালো মেয়ে না আমি! ”
আম্মু বললো, ” আমার ভালো মেয়ে হলে ভাত খেয়ে যা।”
মুখ কুঁচকলাম আমি। আম্মুর এই কথা শুনতে শুনতে কান গেলো আমার। আম্মুদের একমাত্র লক্ষ্যই বোধ হয় আমাকে ভাত খাইয়ে খাইয়ে মোটা করা। রুবা দেখেই নাকিকান্না করে বললো, ” রোজা আপু যেটা খেতে চায় সবসময়েই সেটা খাওয়ায় তাকে। তার সব কথা শুনে। আমি আর তিশা ছোট বলে পঁচা খাবারগুলো দেয়। তিশাও শুরু করলো একই কথা। বললাম ছোট বেলায় আমার উপরও খাবার নিয়ে এমন অত্যাচার চলতো। তাহলে তোদের উপর কেন নয়! এগুলো খেতে খেতে বড় হয়েছি আমি। তোরাও খা! খা!
তাদের উস্কে দিয়ে চলে আসলাম।
ভার্সিটিতে যাওয়ার ঘন্টা দুয়েক পরও নিঠুল ভাইয়ের দেখা পেলাম না। তার জ্বর কী সারে নি! ভাবলাম বাসায় যাই। নিঠুল ভাই আমাকে দেখে অবাক হলো। দরজার হাতল ধরে আমার দিকে ঝুঁকে জিজ্ঞেস করলো, ” আমাকে দেখতে এসেছিস?”
হাসছেও সে। আমি সোজা গলায় ‘না’ বললাম। সে ভ্রু কুচকে বললো, ” তাহলে কেন এসেছিস?”
আমার কিছু বলতে হলো না। আন্টিকে দেখলাম। আন্টি নিঠুল ভাইকে সরিয়ে দিয়ে রাগী গলায় বললো, ” কেন এসেছে মানে? এটা কী ধরনের কথা! তুই কেন যাস ওদের বাড়িতে প্রতি সপ্তাহে?!”
” শ্বশুরবাড়ির প্রতি আমার একটা দায়িত্ব আছে না! খবরাখবর নিতে যাই। ” আমার দিকে তাকিয়ে কথাটা বলে সোফায় গিয়ে বসলো সে।
আন্টি অবাক হয়ে বললো, ” শ্বশুরবাড়ি মানে!”
” ভাইয়ার শ্বশুরবাড়ি। সেটাই বললাম। ”
আন্টি ভেতরে নিয়ে গেলো আমাকে। তাঁর কাছ থেকে জানলাম আজ নিলু আপু আসবে।
” এখানে আয়।” আদেশের সুরে ডাকলো।
গেলাম না আমি। একটু আগে আসার কারণ জানতে চায়লো। কেন আমি আসতে পারি না এমনি! গত সন্ধ্যার মুহূর্তগুলো সে ভুলে গেছে! কোথায় একটু প্রেমিকাকে মতো আচরণ করবে, প্রেমময় চোখে তাকাবে তা না ; সারাক্ষণ কাট কাট গলায় কথা বলবে। রান্নাঘরে গিয়ে দেখলাম রিনি আপু খুবই ব্যস্ত। সাথে নিলয় ভাইও আছে। অনেকদিন পর দেখলাম। চাকরির জন্য শহরের বাইরে থাকতে হয় তাকে। আমাকে দেখে হেসে ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করলো। আন্টি এসে নিলয় ভাইকে জোর করে পাঠিয়ে দিলো।বললো, ” তুই যা। তোর বউয়ের সাথে আমি আছি তো! কথা শুনছিস না কেন? রোজার সাথে কথা বল, যা।”
নিঠুল ভাই সোফায় আধশোয়া হয়ে বসে রিমোট হাতে নিয়ে টিভি দেখছে। নিলয় ভাইকে দেখে নাটকীয় ভঙ্গিতে বললো, ” চারপাশের মানুষজনের প্রেম পিরিতি দেখতে দেখতে গা জ্বলে গেলো আমার। ঘরে এসে দেখি রান্নাঘরেও প্রেম চলছে। কোথায় যাই আমি!”
‘ চুপ ফাজিল’ বলে নিলয় ভাইয়া রিমোটটা কেড়ে নিয়ে নিলো। নিলয় ভাই লাজুক, শান্ত প্রকৃতির। নিঠুল ভাই ঠিক তার উল্টো। রিনি আপু আসলে টিফিনবাক্সটা তাকে দিলাম। রিনি আপু বাক্স খুলে দেখে বললো, ” কী এনেছিস এগুলো? ”
আমি হেসে উত্তর দিলাম, ” সমুচা। চাচী আম্মু বানিয়েছিলো সকালে।”
” সমুচা! ছোট চাচীর বানানো সমুচা, না সমুচা না ছোট চাচীর রান্নার হাতটাই ভালো। দাও ভাবী। ” নিঠুল ভাইদের বললো।
রিনি আপু বাক্স নিচু নেমে দেখাতেই মুখ হা হয়ে গেলো আমার। এরাও একে অপরের দিকে তাকালো। তারপর সশব্দে হেসে উঠলো হু হু করে।
” কী এনেছিস রে রোজ? ছেঁড়া পাউরুটি আর অর্ধেক খাওয়া কলা! আম্মা দেখে যাও তোমার রোজ মামনি কী এনেছে? কন্জুস কী আর সাধে ডাকি!” হা হা হা করে হাসতে হাসতে বললো নিঠুল ভাই। ততক্ষণে আমি বুঝে গেলাম এগুলো রুবা, তিশার কাজ যখন রুমে গেলাম তখনই করেছে। খেতে পারে নি বলে আধখাওয়া গুলো এখানে ঢুকিয়ে দিয়ে সমুচা গুলো তাদের পেটে চালান করেছে। সেজন্যই তো আসার সময় রুবা ভদ্র মেয়ের মতো বললো, “আপু, টিফিনবাক্স ব্যাগে ঢুকিয়ে দিয়েছি। তুমি আবার নিতে ভুলে যাবে।”
আন্টিও এসে হাসিতে যোগ দিলো। লজ্জায় আমার কান্না চলে এসেছে। “সমুচা’ই দিয়েছিল। রুবা, তিশা করেছে এগুলো “, বলে ব্যাগ নিয়ে বের হয়ে গেলাম।
নিঠুল ভাই এসে আঁটকালো। বললো, ” কিছু না খেয়ে যাচ্ছিস কই! এতো কিছু এনেছিস। খালি মুখে যাবি?”
ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলে সে আমার হাত ধরে আটকালো। হেসে বললো, ” আরে মজা করছি। কাঁদছিস কেন গাধীর মতো?”
” রুবা, তিশা করেছে এগুলো। জানতাম না আমি। জানলে আনতাম না।”
” তুই জেনে শুনে এনেছিস এমন বলেছি নাকি আমরা! দেখে একটু হাসি আসলো তাই…”।
” একটু হেসেছো! হা হা করে হেসে আমাকে লজ্জায় ফেলেছো।”
” ঘরের মানুষ’ই তো আমরা।” আবারও হাসলো সে।
তার হাসি দেখে রেগে বললাম, ” সরো! আর কোনোদিন আসবো না আমি।”
” তোর আসতে হবে না। বিয়ে করে আমিই নিয়ে আসবো।”
এই কথায় লজ্জা পেলেও দেখালাম না তা। তবে রাগ কমলো। সে আমার হাত টেনে নিয়ে গেলো। দরজার সামনে যেতেই আবার বললো, ” তুই’ই মনে হয় প্রথম যে ছেঁড়া পাউরুটি, অর্ধেক কলা নিয়ে প্রেমিককে দেখতে এসেছে।”
কথা বাড়ালাম না আমি। কিছু বললেই উল্টো আরেকটা বলবে। আন্টিরা দেখে স্বাভাবিকভাবেই অন্য কথা চালিয়ে গেলো। আর নিঠুল ভাই! সে পাউরুটি, কলার বক্স নিয়ে মজা করতে লাগলো।
.
.
.
নিলু আপুুর সাথে সিয়াম ভাইয়া আর দিশা আপুও এসেছে। সিয়াম ভাইয়া আমাকে দেখে অবাক হয়ে হয়ে বললো, ” তোমাকে এখানে পাবো ভাবিনি। এসে ভালোই করেছি দেখছি।”
নিঠুল ভাই শুনে আমার দিকে কটমট চোখে তাকালো। সেদিন একটুখানি শুনতে পেলাম যে সিয়াম ভাইয়ার জন্য নাকি আমার কথা বলেছে হালকা পাতলা। আমি অবাক হলাম মাত্র কয়েকঘন্টা সাথে ছিলাম। এর মাঝেই সে আমাকে নিয়ে ভেবে ফেললো আর আমি বুঝতেই পারি নি! নিঠুল ভাই কয়েকবার বললো আমাকে, ” তোর ক্লাস নেই! ক্লাস মিস করছিস কেন? চল দিয়ে আসি।”
আন্টিরা বাঁধ সাধলো তাই তারও চুপ থাকতে হলো। কিছুক্ষণ পর সে রুমে ডাকলো। আমি যেতেই আমার হাত চেপে ধরে বললো, ” সিয়াম ভাইয়ের আশেপাশে ঘুরঘুর করছিস কেন বেয়াদব মেয়ে! জানিস না সে বিয়ের প্রপোজাল পাঠিয়েছে তোর জন্য!”
” হ্যা জানি। এখন কী তার থেকে পালিয়ে বেড়াবো? আমাকে তুলে নিয়ে বিয়ে করে ফেলবে?” মনে মনে হেসে বললাম আমি।
” আবার বড় বড় কথা! আমার জিনিসের দিকে চোখ দিচ্ছে সে। জানেনা বলেই এতো সাহস হয়েছে তার। বিমান থেকে টুপ করে পড়ে মেয়েদের পিছু লেগেছে। আর তুই… তুই তার সামনে সামনে হাঁটছিস বলেই তো পিছু নিয়েছে! ”
” কী আশ্চর্য! এক ঘরে উপস্থিত থাকলে সামনে পিছু তো হবোই। চলে যাওয়াই উচিত ছিলো আমার।” রাগ দেখিয়ে বললাম। তখন তো অনেক হাসলো, মজা নিলো। এবার জ্বেলাসিতে জ্বলুুক।
তাকে দেখিয়ে দেখিয়েই সিয়াম ভাইয়ার সাথে কথা বললাম, হাসলাম, আপ্যায়ন করলাম। পরে দেখলাম সেও দিশা আপুর সাথে কথা বলছে। তাকে রুমে নিয়ে গেলো আমার সামনেই। বেচারা মনে করেছে আমি জ্বেলাসিতে জ্বলবো। কিন্তু আমি তো জানি দিশা আপুকে একদমই নিতে পারে না সে। কিছুক্ষণ পর আমাকে ডাকলো। দিশা আপু বারান্দায় ফোনে কথা বলছিলো তখন। আমাকে এক টানে তার পাশে বসিয়ে বললো, ” আমি ডিসিশান নিয়েছি দিশাকে একটা চান্স দিবো। বেচারী আমার পেছনে অনেক ঘুরেছে।”
আমি হেসে বললাম, ” তো যাও। আমাকে ডেকেছো কেন? ”
নিঠুল ভাই সত্যি সত্যিই গেলো। দিশা আপুর পেছনে দাঁড়িয়ে রেলিঙে হাত রাখলো। তার নাকটা দিশা আপুর চুল ছুঁইছুঁই। খুব কাছে। মুহূর্তেই বুকটা কেমন করলো আমার। এরমধ্যে দিশা আপু পেছনে ফিরে হঠাৎ নিঠুল ভাইকে জড়িয়ে ধরলো। দিশা এমন করবে তা নিঠুল ভাই নিজেও ভাবতে পারে নি হয়তো। সে চমকে উঠে ছাড়িয়ে নিলো জোর করে। আমিও দৌড়ে চলে আসলাম সেখান থেকে। হঠাৎ কান্না পেলো আমার। রিনি আপুর রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলাম। একটু পর দরজায় কড়া নাড়লো। নিঠুল ভাই এসেছে ভেবে খুললাম না। রিনি আপু ওপাশ থেকে বললো দরজা খুলতে। সে’ই কড়া নেড়েছে। অমন দৃশ্য দেখে আমার মনের অবস্থা কী হতে পারে সেটা জেনেও নিঠুল ভাই আসলো না একবারও। তাহলে কী সত্যি সত্যিই..। আর ভাবতে পারলাম না। খেতে বসলে নিঠুল ভাই আমার পাশে বসে ফিসফিস করে বললো, ” সিয়াম ভাইয়ের পাশে বসিস নি কেন? যা, আপ্যায়ন কর।”
খাবার টেবিলেও দিশা আপুকে নিয়ে আদিক্ষেতা দেখালো। তাদের আশেপাশে গেলাম না আর। বিকেলের দিকে তারা চলে গেলে নিঠুল ভাই রিনি আপুকে বলে, ” ঘরে মন টিকছে না ভাবী একদম। তারা চলে যাওয়ার সাথে সাথে আমার মনটাও নিয়ে গেলো।”
রিনি আপু হেসে বললো, ” দিশাই তাহলে সে। এতোদিন লুকিয়ে রেখেছিস। আজ তো সব দেখলাম। ”
আমি বললাম, ” আপু, চলে যাবো আমি। আব্বু মন খারাপ করবে।”
সবাই থাকতে বললো নিঠুল ভাই ছাড়া। রুম থেকে ব্যাগ আনতে গেলে পেছনে নিঠুল ভাই এসে দরজা বন্ধ করে দেয়। আমাকে তার কাছে টেনে মুখ কাছাকাছি এনে বলে, ” যাওয়ার আগে একটা চুমু দিয়ে যা তো! দিশাও দিয়েছে। কোনটার ফ্লেভার কেমন টেস্ট করি!”
আমি দাঁতে দাঁত চেপে তার দিকে তাকালাম। সে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বললো, ” আন্ডা চোখে এভাবে তাকাস কেন? দিশা চোখে এক সমুদ্র প্রেম নিয়ে কী সুন্দর তাকায়! চোখের দিকে তাকিয়েই থাকতে ইচ্ছে করে। ”
আমি এবার ঠোঁট টিপে কেঁদে দিলাম। নিঠুল ভাই হেসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো, ” আমাকে জেলাসিতে জ্বালাতে আসবি তো নিজে দশগুণ জ্বলবি জেলাসিতে।”
” সে তোমাকে জ..জড়িয়ে ধরেছে। ” বললাম আমি।
সে বললো, ” আচ্ছা আমিও ধরবো..”
তার কথা শুনে আমি ছাড়ানোর চেষ্টা করলে সে আরো জোরে চেপে ধরে তার বুকের সাথে। হাসছে সে আর বললো, ” তোকে।”
#চলবে…