ভালোবাসার রোজ,পর্ব:৯+১০

0
360

#ভালোবাসার_রোজ[পর্ব -০৯]
#আফরোজা-আনজুম

রাতের খাওয়াদাওয়া শেষ করে আম্মুর রুমে গেলাম। আব্বু ডেকেছিল। আমি যেতেই আব্বু আমাকে বসিয়ে দিল হিসাব-নিকাশের খাতা দিয়ে। চোখের সমস্যার জন্য প্রায় সময় হিসাব আমাকে দেখান। মাঝে আব্বুর ফোন বেজে উঠে। আমাকে নিতে বললে দেখি রেবা আন্টির কল। আব্বুকে দিয়ে আবারও হিসাবে মনযোগ দিলাম। মনযোগ সরে গেলো আব্বুর কথা শুনে। আব্বু বললো, ” আপা, সেদিন তো বললাম মেয়ে বিয়ে দিবো না এখন।”

আন্টির আগের কথা খেয়াল করি নি। তবে এখন শুনতে পেলাম,
” হ্যা। সেটাই তো বলেছি। কিন্তু তারা মানতে নারাজ। সরাসরি আপনাদের বাড়ি গিয়ে প্রস্তাব দেবে বলছে। নিলয়ের আব্বাকে ফোন করে বললো সেও যেন সাথে গিয়ে বলে। আপনি বরং ফোন করে তাদের সরাসরি জানিয়ে দিন যে প্রবাসী ছেলের সাথে মেয়ে বিয়ে দিবেন না। এটাই ভালো হবে। এর আগে অন্য কথা বলায় তারা হালকা ভাবে নিয়েছে।”

” হ্যা সেটাই করবো।”

প্রবাসী বলায় বুঝে গেলাম কার কথা বলছে। হঠাৎ নিঠুল ভাইয়ের আওয়াজ পেলাম। আন্টির পাশেই ছিল বোধহয়। সে বললো,

” আঙ্কেল, তুমি এখন ফোন করে জানিয়ে দাও।”

আব্বু বললো, ” এখন কেন? রাত এগারোটা বাজছে। কাল সকালে বলবো।”

” কাল সকালে না। এখন বলো। তারা জেগে আছে।”

তার গম্ভীর কণ্ঠ শোনা গেলো। আব্বু আচ্ছা বলে কল কেটে দিলো। তারপর মনে পড়লো নিলু আপুর শ্বশুর বা শাশুড়ি কারো নাম্বার নেই। ফোন করবে কীভাবে? আব্বু আমাকে বললে নাম্বারটা নিতে। আন্টির কাছে কল করে নাম্বার দিতে বললাম। নিঠুল ভাই আমাকে শুনিয়ে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো, ” সব দোষ ওর। সেদিন দেখলে না সিয়ামের সাথে কেমন লেগে থেকেছে! তার মধুর মধুর কথা শুনেই তো সে মনে করেছে এও পছন্দ করে হয়তো তাকে। এই বেয়াদবটাই পাগল করেছে সিয়াম ভাইকে। নয়তো প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়ার পর এখন আবার উতলা হচ্ছে কেন? বেয়াদব মেয়ে! কাজই হচ্ছে ছেলেদের পাগল করা।”

আরো কিছু বলতো; আন্টি ধমক দেওয়ায় চুপ হয়ে যায়। এদিকে অপমানে আমার কান্না চলে আসে। আন্টির সামনে কীভাবে বলতে পারলো এটা! সিয়াম ভাইয়ার সাথে সেদিন কথা বললেও এমন কিছু করি নি যাতে মনে হয় আমার তাকে পছন্দ। এখানে আমার দোষটা কী!
.
.
.
পিউ ফোন করে লাইব্রেরিতে যেতে। ক্লাস অফ থাকায় এমনিতেই বসে ছিলাম বিরক্ত হয়ে। পিউ বলার পর আর দেরি করি নি। একটা ছেলেকে দিয়ে নিঠুল ভাই খবর পাঠালো দেখা করতে। সে ভবনের সামনে আছে। ইচ্ছে করেই যাই নি আমি। লাইব্রেরিতে গিয়ে দেখি পিউ কোণার একটা বেঞ্চে বসে মেবাইল টিপছে। খানিকটা ঝুঁকে দেখলাম ছবি দেখছে রুপম ভাইয়ের। আমাকে দেখে মোবাইল রেখে অস্থির গলায় বললো, ” আমি মরে যাবো, রোজ। আমি মরে যাবো। ”

“কত সুন্দর হাসিমুখে রুপম ভাইয়ের ছবি দেখছিলি এইমাত্র। আর এখন আমাকে দেখেই মরে যাচ্ছিস!”

” রুপমের ছবি দেখলে শত দুঃখের মাঝেও হাসি ফোটে। কী করবো বল! ”

” রু..প..ম! ভাইয়াটা কেটে দিলি! তো মরে যাবি বলেছিস। কারণ কী? ”

পিউ এমন প্রশ্নে আহত হলো মনে হচ্ছে। বললো, ” আমি মরে যাবো শোনার পরও তুই এতো স্বাভাবিক হয়ে জিজ্ঞেস করছিস কারণ কী! তোর একটুও টেনশন হচ্ছে না?”

দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বললো পিউ। আমি বললাম, ” নিজের দুঃখ প্রকাশ করতে বলেছিস। সত্যিই যে মরে যাবি না সেটা জানি আমি। এখন বল তো কী নিয়ে দুঃখ! ”

” রুপমকে নিয়ে। সারাক্ষণ তার পিছু ঘুরি, তাকে নিয়ে ভাবি কিন্তু সে একদম দুধের বাচ্চার মতো থাকে। যেন কিছুই বুঝে না। আর আমাকে ডাকে বোন। আমি নাকি তার ছোট বোন। এইতো একটু আগেও বোন ডেকে গেলো।”

আমি হাসলাম। বললাম, ” তার হয়তো ছোট বোন নেই। তাই তোকে ছোট বোন হিসেবে দেখে।”

পিউ রেগে উঠে বললো, ” ভার্সিটিতে মেয়ের অভাব আছে নাকি! আমাকে কেন বোন ডাকে! আজকেই বুঝিয়ে দিবো আমি তার বোন নাকি অন্য কিছু। ”

সে চলে যাচ্ছে। আমিও তার পিছু নিলাম। সিড়ি দিয়ে নামতে নিঠুল ভাই, রুপম ভাইকে দেখলাম। রুপম ভাই জিজ্ঞেস করলো পিউ এমন করে কোথায় গেলো৷ আমি না লুকিয়ে সরাসরি বললাম, ” ভাইয়া, পিউ আপনাকে ভালোবাসে। আপনি তাকে বোন বলে ডাকেন তাই সে রেগে আছে। এখন সে নাকি মরে যাবে।”

রুপম ভাইয়া নিঠুল ভাইয়ের দিকে তাকালো। তাকে চুপ থাকতে দেখে আমি পাশ কাটিয়ে নেমে গেলাম। ক্লাস জলদি শেষ হওয়ায় গাড়িতে বসে অপেক্ষা করছিলাম। সবাই আসলে গাড়ি ছাড়বে। বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিলাম বলে নিঠুল ভাই, রুপম ভাইয়াকে দেখতে পেলাম। সেও দেখলো। মুহূর্তেই আবার আড়াল হয়ে গেলো। হঠাৎ পাশে কেউ গা ঘেঁষে বসায় চমকে উঠলাম আমি। নিঠুল ভাই আমার ব্যাগ টেনে নিয়ে জিজ্ঞেস করলো পানি আছে কি না! বলার সাথে সাথে ব্যাগের চেইন খুলে নিয়েও ফেললো বোতল। ঢকঢক করে পানি খেয়ে বোতলটা বাইরে ছুড়ে মারলো। আমি রেগে গেলাম তা দেখে। বললাম, ” বোতলটা ফেলেছো কেন?”

সে আমার ওড়নার কোণা টেনে হাত মুছে বললো, ” বোতলে পানি খাওয়া সেইফ না। একটা ওয়াটার পট কিনতে পারিস না! নাকি তোর কন্জুস বাপ এখানেও বলে যে বোতল থাকতে ওয়াটার পট কেন কিনতে হবে টাকা খরচ করে! শুধু শুধু খরচ! ”

” আমার আব্বুর কাছে টাকার পাহাড় নেই আমাদের। বলাটাই স্বাভাবিক। ”

” নেই! তোর বাপের কতো টাকা আছে সব জানা আমার। এতো টাকা কেন জমাচ্ছে রে না খেয়েদেয়ে! তোর বাপের যা বুদ্ধি… ”

আমি উঠে চলে আসতে চাইলাম। সে আমাকে বসিয়ে দিয়ে ধমকে উঠলো। বললো, ” আমি প্রচুর রেগে আছি তোর উপর। মাথা ঠান্ডা রাখতে চাইছি। তুই আবার আমাকে রাগ দেখাচ্ছিস! সকালে আধঘন্টা মতো দাঁড়িয়ে ছিলাম ভবনের সামনে। কয়বার ডেকে পাঠিয়েছি? আসিস নি কেন? ”

” কেন! বেয়াদব, খারাপ মেয়েটাকে কেন প্রয়োজন তোমার যে ছেলেদের পাগল করে দেয়! ”

” কারণ মেয়েটা আমাকেও পাগল করে দিয়েছে। তাকে অন্য কেউ চাইলে আমার ইচ্ছে করে তাকে খুন করতে। আমার তাকে অন্য কেউ কেন চাইবে! কেন ভাববে তাকে নিয়ে! এতো বছর ধরে তাকে ভালোবেসে আসছি, আগলে রেখেছি। হুট করে অন্য কেউ কেন তার জীবনে আসতে চাইবে! সে শুধু আমার। একান্ত আমার। তাকে নিয়ে ভাববোও আমি।”

কেঁপে উঠলাম আমি। পাশাপাশি সিটে বসায় খুব কাছে দুজনে। আমার চোখে চোখ রেখে কথাগুলো বলেছে নিঠুল ভাই। তার কণ্ঠে কী যেন ছিলো! চোখ নামিয়ে নিলাম আমি লজ্জায়। নিঠুল ভাই একহাতে আমার মুখ তুললো। তার মুখটা কাছাকাছি আনছে। সে কী চুমু খাবে এখন! আমি কাঁপছি, বুকে ধুকপুক আওয়াজ হচ্ছে। চোখ বন্ধ করে ফেললাম। আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো,
” যেটা ভেবে আন্ডা চোখগুলো বন্ধ করে ফেলেছিস সেটা একদমই করবো না এখন। তার জন্য স্পেশাল প্লেস, স্পেশাল মোমেন্ট চাই।”

তার উষ্ণ নিঃশ্বাস আমার কানের কাছে অনুভব করছি। চোখ খুললেই লজ্জায় পড়তে হবে তাই চোখ বন্ধই রাখলাম। অন্যদের আওয়াজ শুনে চোখ খুলে ঠিক হয়ে বসলাম। নিঠুল ভাই পাশের সারির সোজাসুজি সিটে বসে আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। আমি এপাশ ফিরে হাসলাম আমিও।

#চলবে…

#ভালোবাসার_রোজ[পর্ব-১০]
#আফরোজা_আনজুম

রমজান মাস চলছে। এইবার খুব তাড়াতাড়িই দিনগুলো পেরিয়ে যাচ্ছে মনে হচ্ছে। আসলে পরিবেশ ঠান্ডা হওয়ায় রোযায় খুব একটা কষ্ট হচ্ছে না। এইবার রুবাও খুশিমনে রোযা রাখছে। আছরের নামায পড়ে ছাদে গেলাম। সেখানে আরিফ ভাইয়ার সাথে সাকিবকে দেখে অবাক হলাম। সে কখন এলো! সাকিব আমার সমবয়সী। খালাতো ভাই হয়। পড়ালেখার পাঠ চুকিয়ে হাতে গলায় চেইন, সুতা পেঁচিয়ে গুন্ডা সেজে নেতাদের পেছন পেছন ঘুরে বেড়ায়। তাদের এলাকার কোনো এক নেতার আমাকে পছন্দ হয়েছে বলে সাকিব কম চেষ্টা করে নি আমাকে ঐ বখাটে নেতার সাথে জুড়িয়ে দিতে। এতে নাকি ঐ দলে তার পাওয়ার বাড়বে নেতার শালা হিসেবে। নিঠুল ভাইয়ের কাছে ধরা খেয়ে হেনস্তা হয়ে থেমেছিল। এ কারণে নিঠুল ভাই একদম পছন্দ করে না তাকে।

আমি চুপিচুপি হেঁটে গিয়ে পেছন থেকে ভাউ শব্দ করে ভয় দেখানোর চেষ্টা করলাম। সফলও হলাম। ভয়ে চমকে ওঠায় তার হাত থেকে মোবাইলটা পড়ে যায়। ও একবার বিস্ফোরিত চোখে ফ্লোরে তাকায়, একবার আমার দিকে তাকায়। আমি মোবাইলটা তুলে তার হাতে দিলাম। কোনো ক্ষতি হয় নি। আরিফ ভাইয়া বললো, ” কী করেছিস রে তুই! ওর তো হার্ট অ্যাটাক হয়ে যাবে।”

আমি বললাম, ” ঠিক বলেছো। ওর কলিজা কেমন দেখেছো! একটু শব্দে ভয় পেয়ে কেমন করলো!”

সাকিব তেড়ে আসলো আমার দিকে। সরে গিয়ে হেসে উঠলাম আমি। জিজ্ঞেস করলাম, ” কখন এসেছিস? ”

সে মোবাইল ঠিক আছে কি না দেখছে। দেখতে দেখতে বললো, ” দু-ঘন্টার বেশি হচ্ছে। তোর এসব দেখার সময় আছে না কি! সারাদিন ঘুম আর ঘুম। এতো ঘুম কই থেকে আসে!”

” চোখ থেকে। কোনো কাজকাম নেই, চিন্তা নেই । তাই ঘুমাই।”

” এজন্যই তো বলি প্রেম কর। প্রেম করলে সারাক্ষণ সে তোর খবর নিবে, তুই তার খবর নিবি, সে তোর কেয়ার করবে, শাসন করবে, তুইও সারাক্ষণ তাকে নিয়ে ভাববি, দুজনে ঘুরবি ফিরবি। এটাতেই তো আনন্দ! হাসিখুশি থাকবি, অনেকদিন বাঁচতে ইচ্ছে করবে। করবি প্রেম? তৌফিক ভাই এখনো তোর কথা বলে। সেইবার নিঠুল ভাই না জানলে এতদিনে তোদের প্রেম জমে ক্ষীর হয়ে যেতো। নিঠুল ভাই একটা আতঙ্ক। আব্বুকে বলে দিবে বলে সেইবার কী ভয়টা দেখাইছিল জানিস! হাতে পায়ে ধরে বাঁইচা গেছি।” শেষের কথাগুলো দুঃখজনক শোনালো।

আরিফ ভাইয়া হেসে বললো, ” এইবার হাতে পায়ে ধরেও বাঁচতে পারবি না। ”

” আমাদের মাঝেই তো থাকবে কথাটা। জানতে পারবে না। এই রোজা, নম্বর দিবো তৌফিক ভাইয়ের! আচ্ছা তৌফিক ভাইকে বলবো। সে কল দিবে তোকে। তুই কথা বলিস।”

হঠাৎ পেছন থেকে কেউ তার ঘাড় চেপে ধরায় ভয়ে আঁতকে উঠে সে। আমিও চমকে পেছনে ফিরতেই নিঠুল ভাইকে দেখলাম। সাকিব হাসার চেষ্টা করে বললো, ” ভাই, তুমি কখন আসছো?”

তার দিকে অগ্নি দৃষ্টি ছুড়ে নিঠুল ভাই বললো, ” তৌফিক্কার চামচা তুই কখন আসছোস? প্রেম নিয়ে তো অনেক কিছু শুনাইলি। এসব কী তৌফিক্কা শিখাইছে! খালাতো বোনের পিছু নিছোস কেন? আগের বারের কথা ভুলে গেছিস?”

” আমি তো মজা করছিলাম ভাই। কিচ্ছু ভুলি নি। ওর মনে কিছু আছে কিনা সেটাই দেখছিলাম হি..হি।”

বোকা বনে গেলাম আমি। কীভাবে কথা ঘুরিয়ে নিল। যত ইচ্ছে ঘুরা। নিঠুল ভাইকে বোকা বানানো এতো সহজ নয়।

নিঠুল ভাই তাকে ছেড়ে দিয়ে চট করে মোবাইলটা নিয়ে নিল। নিজের পকেটে ঢুকিয়ে বললো,” আর পাবি না এটা।”

” কেন? আমি তো বলেছি রোজাকে পরীক্ষা করার জন্য এসব বলা। তুমি কোত্থেকে এসে অর্ধেক কথা শুনে ভুল বুঝো। আরিফ ভাই তুমি বোঝাও নিঠুল ভাইকে। ”

আরিফ ভাইয়া নিঠুল ভাইকে উদ্দেশ্য করে বললো, ” হ্যা। আমি এখানে উপস্থিত। ও তো ভালোই বলেছে। ভাই হিসেবে বোনকে খুশি রাখা ওর দায়িত্ব না! বেশিদিন বাঁচার আশা রাখতে, হাসিখুশি থাকতেই তো রোজাকে প্রেম করতে বলছে। এটা তো ভালোই করছে। ”

সাকিব কটমট চোখে তাকায় আরিফ ভাইয়ার দিকে। ভেবেছিলো সে বাঁচাবে। এভাবে বাঁশ দিবে তা কী সে জানতো! ফোন বেজে উঠলো এর মধ্যে। সাকিব তড়িঘড়ি করে বললো, ” আমার ফোন। আমার ফোন বাজছে।”

নিঠুল ভাই পকেট থেকে ফোন বের করে দেখলো। মুখে আওড়ালো, ” শিমুল ভাই!”

” শিমুল ভাই! ফোনটা দাও ভাই। শিমুল ভাইয়ের সাথে জরুরি কথা আছে আমার। ফোন না ধরলে সংঘ থেকে বের করে দিবে আমাকে।”

নিঠুল ভাই দিলো না ফোন। রেলিঙে উঠে বসে ফোনের গ্লাসে নিজেকে দেখে চুলে আঙুল চালাচ্ছে। সাকিব এসে সেটা একপ্রকার কেঁড়ে নিয়ে দৌড় লাগালো। তার এমন বাচ্চাদের মতো কাণ্ডে তিনজনই হেসে উঠলাম। আরিফ ভাইয়া নিচে নেমে যাচ্ছে। আমিও তার পিছু নিলে নিঠুল ভাই পেছন থেকে আমার চুল টেনে ধরলো।বললো, ” তুই কোথায় যাচ্ছিস আমাকে না বলে? ”

আমি রেগে বললাম, ” তোমাকে বলতে হবে কেন? আর এভাবে চুল টেনে ধরেছো কেন? এভাবে চুল টেনে কেউ থামায়?”

” তো কী আদর করবো? আমি না আসলে এতক্ষণে তোর খালাতো ভাইয়ের ফাঁদে পা ফেলতি। দেখলাম তো কীভাবে ওর কথাগুলো মনযোগ দিয়ে শুনছিস। ওকে আরো কড়া ডোজ দিতে হবে। নয়তো দেখা যাবে যতক্ষণ পর্যন্ত সে তৌফিক্কার শালা হতে না পারছে ততক্ষণ পর্যন্ত ওর শান্তি হবে না। হাসিখুশি থাকতে, বেশিদিন বাঁচার ইচ্ছা জাগাচ্ছে তোর!”

” সে তো ভালোই করছে আমার। শুনেছি মানুষ নাকি প্রেম করলে হাসিখুশি থাকে সবসময়, হাসিখুশি থাকলে মন ভালো থাকে, সুন্দর হয়ে যায়। প্রেমিক-প্রেমিকারা মিনিটে মিনিটে একে অপরের খবর নেয়, এখানে ওখানে ঘুরতে যায়, সময় কাটায়, কেয়ার করে, দুষ্টু মিষ্টি শাসনও করে। আর তুমি! তোমার সাথে আমার প্রেম ভালোবাসা আছে বলে মনেই হয় না। সামনে থাকলে তো ক্যাটক্যাট করো শুধু, আর ফোন করে কী বলো! এতো রাতে অনলাইনে কী, সারাদিন মোবাইলে কী, কথার উত্তর না দিলে চড়, থাপ্পড় মারবো..এসব। একটু ভালোভাবে কথাই বলো না বাকিসব তো দূর!তুমি আমাকে বুঝোই না কখনো। ”

নিঠুল ভাই একলাফে নেমে গেলে রেলিঙ থেকে। আমার দিকে তেড়ে এসে বললো, ” আমি ক্যাটক্যাট করি! শাসন করি! এইজন্য তুই তৌফিক্কার সাথে প্রেম করবি?”

” সেটা কখন বললাম? ”

” তো কী বলেছিস! সাকিবের কথার সাথে তাল মেলাচ্ছিস। আমি বুঝি না কী বলতে চাস তুই!”

” কচু বুঝো তুমি! বলি এক, বুঝে একশো।” রেগে কথাটা বলে ধুপধাপ পা ফেলে চলে আসলাম। তাকে যে ইনডিরেক্টলি বোঝালাম যে বাকিসব প্রেমিক -প্রেমিকার মতো হোক আমাদের প্রেম সেটা বুঝলো না। বুঝলো আমি অন্য কারো সাথে প্রেম করতেই চাই।
.
.
.
ইফতার তৈরি করে সেসব টেবিলে এনে রাখলো বড়ো চাচী৷ নিঠুল ভাই সোফায় বসা ছিল। বড় চাচীকে দেখে বললো, ” চাচী, ওকে দিয়ে করাতে পারো না কাজ! কী সুন্দর চেয়ারে বসে পা দুলিয়ে অপেক্ষা করছে খাওয়ার। রান্নার ‘র’ ও জানে না। বিয়ে দিলে শ্বশুরবাড়িতে কী করবে!”

বড় চাচী গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে বললো, ” শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার পর শিখে নিবে সব।”

” বিয়ের রাতে যদি বর বলে ‘রঙ চা বানিয়ে আনো তো! বারান্দায় দাঁড়িয়ে তোমার হাতের রঙ চা খেতে খেতে জ্যোৎস্না বিলাস করবো’। ও বলবে আমি জানি না। আমার আম্মু, চাচীরা জানে বানাতে। তখন ব্যাপারটা কেমন হবে বলো তো!”

চাচী হেসে উঠলো শব্দ করে। আমি লজ্জায় মাথা নিচু করে রইলাম। আরিফ ভাইয়া বললো, ” রঙ চা খেতে তুমি পছন্দ করো। তাই বলে ওর বরও রঙ চা খেতে চাইবে নাকি!”

নিঠুল ভাই হেসে বললো, ” চাইবে চাইবে। জিজ্ঞেস করিস ওর কাছ থেকে। ”

সাকিব পাশ থেকে জানতে চায়লো, ” তুমিও রঙ চা বানিয়ে আনতে বলবে নাকি তোমার বউকে! ”

” হ্যা। আমার বউকে রঙ চা বানানো জানতে হবে। আমার পছন্দের সব খাবার বানানো জানতে হবে। বুঝেছিস রোজ?”

” ওকে কেন বলছো সেটা? ”

” ওকে না তো কাকে বলবো?”

আরিফ ভাইয়া আর সাকিব দুজনেই অবাক হয়ে বললো, ” মানে? ”

আমিও চমকে উঠলাম। নিঠুল ভাই সবার সামনে কী বলছে এসব! আব্বু আম্মু জানলে খুবই খারাপ হবে দুজনের জন্য।

” আমার বউকে তো জানাতে হবে না এসব! তাই ওকে বলছি যেন ও বলে দেয় আমার বউকে। ”

দুজনেই ‘ওওহ ‘ বলে শব্দ করলো। সাকিব বললো, ” একটা কাজের মেয়ে বিয়ে কইরো তাহলে।”

নিঠুল ভাই সাকিবের হাত চেপে ধরে বললো, ” তৌফিক্কার চামচা! তোরে তৌফিক্কার ঘরের কাজের লোক হিসেবে নিয়োগ দিতে বলবো। তারপর দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টাই তার চামচামি করতে পারবি।”

রাতে খেয়েদেয়ে চলে গেল নিঠুল ভাই। যাওয়ার আগে আমাকে হুমকির মতো করে বলে গেলো, ” তোর বজ্জাত খালাতো ভাইয়ের কাছ থেকে গুনে গুনে একশো হাত দূরে থাকবি। অন্য প্রেমিক জোগাড় করে তার সাথে প্রেম করে হাসিখুশি থেকে অনেকদিন বাঁচার ইচ্ছা যদি বিন্দুমাত্র থেকে থাকে মনে তাহলে সেটা ঝেড়ে ফেল। আমিই থাকবো তোর মনে, আমাকে ছাড়া অন্য কারো কথা ভাববি না যতোই ক্যাটক্যাট, শাসন করি না কেন! এমন যদি হয় তাহলে মেরে ফেলবো,জানে মেরে ফেলবো একদম।”
তার এমন কথা শুনে ভয় পেয়ে গেলাম, রাগও লাগলো। নিঠুল ভাই একটু গিয়ে আবার ফিরে আসলো তড়িৎ বেগে। আমার কানের কাছে ফিসফিস করে বললো, ” বিয়ের রাতে বউয়ের হাতে বানানো চা খেতে খেতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে জ্যোৎস্না বিলাস করবো। এটা আমার অনেকদিনের ইচ্ছে। রঙ চা বানানো শিখে নিবি।”

উষ্ণ নিঃশ্বাসের সাথে তার ফিসফিস কথাগুলো আমার কানে যেতেই শরীর শিরশির করে উঠলো। এর আগের ভয়, রাগ মিলিয়ে লজ্জায় কান লাল হয়ে গেলো আমার। সে আমাকে আরেকটু লজ্জা, আরেকটু বিস্মিত করতে চুমু খেলো কানের কাছে। তারপর যেভাবে আসলো আমার সামনে সেভাবে ফিরে গেলো সামনে থেকে।

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here