#মন_বিনিময়
#পর্বঃ৩২
#লেখনীতে- তাসফিয়া হাসান তুরফা
বিয়ের অনুষ্ঠান শেষে ক্লান্ত শরীরে যে যার রুমে প্রস্থান করেছে সকলে। রুমে ঢুকেই গা এলানোর উদ্দেশ্যে বিছানায় শুতেই স্বপ্নিলের চোখে পড়লো ওয়াশরুম থেকে বের হওয়া রাহিতাকে। বিষয়টাতে কিঞ্চিৎ মনোক্ষুণ্ণ হলো ওর। আজ সারাদিনের ব্যস্ততায় মেয়েটাকে ভালোমতো লক্ষ্য করাও হলোনা, ভেবেছিলো রুমে এসে চুপিসারে ভালোমতোন দেখবে ওকে। কিন্তু তার পরিকল্পনায় এক বালতি জল ঢেলে দিয়ে ইতোমধ্যে গোসল সেড়ে বেরিয়েছে রাহিতা। সেদিক চেয়ে এক দীর্ঘশ্বাস ফেললো স্বপ্নিল। তবে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে একধ্যানে চুল মুছতে থাকা রাহিতার দিক তাকিয়ে ওর মন ভালো হতে বেশিক্ষণ লাগলোনা বৈকি। সদ্য স্নানকৃত ভেজা চুলের রাহিতাকে অত্যন্ত স্নিগ্ধ দেখালো, চোখ ও অন্তর উভয়ই শীতল হলো স্বপ্নিলের। কপালের উপর বাম হাত রেখে রাহিতার অগোচরে সরাসরিই আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করে মুগ্ধ হচ্ছিলো সে।
খানিকবাদে চুল ঝাড়া শেষ করে বিছানার দিক তাকাতেই স্বপ্নিলকে এভাবে শুয়ে থাকতে দেখে কপাল কুঞ্চিত হয় রাহিতার। এতক্ষণ হলো রুমে এসেছে অথচ কাপড় অব্দি খুলেনি৷ সে কি ফ্রেশ হবেনা? নাকি এভাবেই ঘুমিয়ে গেছে? ভাবতে ভাবতেই বিছানার দিক এগোয় রাহিতা। ওকে এগিয়ে আসতে দেখে চোখ বন্ধ করে ঘুমোনোর ভান করে পড়ে থাকে স্বপ্নিল। ওর নড়চড় না দেখে আস্তে করে কপালের উপর থেকে স্বপ্নিলের হাত সরিয়ে দেয় রাহিতা। চোখজোড়া বন্ধ দেখে ভাবে সে ঘুমিয়ে গেছে। তাই আস্তে করে ডাকতে থাকে ওকে। স্বপ্নিলের মাথায় অদ্ভুত দুস্টুমি চাপে, রাহিতার ডাক শুনেও সে চোখ খুলেনা, কোনোরুপ সাড়া দেয়না। এবার ডাকা ছেড়ে স্বপ্নিলের গালে হাত দিয়ে ডাকতে আরম্ভ করে রাহিতা, একটু ভালোভাবে লক্ষ্য করলে সে দেখতে পারতো স্বপ্নিলের ঠোঁটের কোণে সূক্ষ্ম হাসির রেখা। সামান্যক্ষণ অতিক্রম হয়, আচমকা রাহিতার হাতে টান পড়ে। কোনোকিছু বুঝে উঠার আগেই সে পড়ে যায় স্বপ্নিলের প্রশস্ত বুকের উপর। বুকের মাঝে প্রবল বেগে চলা ঢিপঢিপ অনুভূতিতে শরীর অসাড় হয় রাহিতা। স্তব্ধ সে নিজেকে সামলে স্বপ্নিলের বুকে দু’হাত রেখে মাথা তুলতেই ওর চোখে পড়ে স্বপ্নিলের চোখ খোলা। সেই খোলা চোখে স্পষ্ট দুস্টুমির আভাস! যা দেখে এতক্ষণের সবকিছু বুঝতে বিলম্ব হয়না রাহিতার! মুখ ফুলিয়ে উঠে পড়ে স্বপ্নিলের উপর থেকে, শ্বাস নিয়ে তড়িঘড়ি করে সরে দাঁড়ায় মুহুর্তে। ওকে এভাবে সরতে দেখে জোরেই হেসে ফেলে স্বপ্নিল। হাসির মাঝেই ভ্রু নাচিয়ে বলে,
—তুমি তো দেখছি বেশ ভিতু! এত সহজেই ভয় পেয়ে গেলে?
—এগুলো কি ধরনের ফাজলামি, স্বপ্নিল? আপনি কি কখনো ভালো হবেন না?
কোমড়ে হাত দিয়ে চোখ পাকিয়ে তী’ক্ষ্ণ কণ্ঠে উত্তর দেয় রাহিতা। ওর প্রশ্নে আরেকটু হাসে স্বপ্নিল। বিছানা থেকে উঠে এসে দাঁড়িয়ে যায় রাহিতার পাশে। খানিকটা ঝুকে এসে মাথা দুদিকে নাড়িয়ে স্বাগতিক কণ্ঠে বলে,
—না
ওর সহজ স্বীকারোক্তিতে বিরক্ত হয় রাহিতা। দাতে দাত চেপে “চ” উচ্চারণ করে সরে দাঁড়ায় ওর কাছে থেকে। সেদিক চেয়ে ফিচেল হাসে স্বপ্নিল। এমন সময় রাহিতা তাড়া দিয়ে বলে,
—এভাবে শুয়ে ছিলেন কেন এতক্ষণ? আর কতক্ষণ এ কাপড়ে থাকবেন? তাড়াতাড়ি চেঞ্জ করে ফ্রেশ হোন!
—আচ্ছা
ওর কথা শুনে স্বস্তির শ্বাস ফেলে বিছানার দিক এগোয় রাহিতা। হঠাৎ কি মনে করে পেছন ফিরতেই স্বপ্নিলকে দেখে চমকে যায় সে৷ ফরমাল পরিহিত স্বপ্নিল একধ্যানে বোতাম খুলছে রাহিতার দিক তাকিয়ে। রাহিতা জানে স্বপ্নিল এখনো নির্ঘাত ফাজলামির মুডে আছে, কিন্তু তবুও আজ এ স্বপ্নিলকে দেখে এক অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে ওর মনের ভেতর। রাহিতার মন বলছে স্বপ্নিল ওকে মন থেকে স্ত্রী হিসেবে মেনে নিয়েছে। অন্তত স্বপ্নিলের চোখ আজকাল সে কথাই বলে! তবু রাহিতার ভয় হয়, পুনরায় স্বপ্নিলের কাছে প্রত্যাখ্যান হওয়ার ভয়ে মনের প্রশ্ন মনেই চেপে রাখে। স্বপ্নিলকে এখনো নিজের দিক তাকিয়ে থাকতে দেখে ওর গলা শুকিয়ে যায়। শুকনো ঢোক গিলে জিব দিয়ে শুষ্ক ঠোঁট ভিজিয়ে সে ইতস্তত কণ্ঠে বলে,
—কি সমস্যা? এখানে কাপড় খু’ল’ছেন কেন? বাথরুমে যান!
ইতোমধ্যে স্বপ্নিলের শার্ট খোলা শেষ। রাহিতার চোখ সরিয়ে নেওয়া, লাজুক আবরণে রেঙে যাওয়া গাল খুব মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করে সে। অতঃপর রাহিতার হাত থেকে তোয়ালে কেড়ে নিয়ে গলায় ঝুলায় সে। পেছন ফিরে বাথরুমের দিক যেতে যেতে বলে,
—নিজেই চেঞ্জ করতে বললে আবার নিজেই জিজ্ঞেস করছো কেন করছি? শার্টই তো খুললাম শুধু। আর তুমি এমন ভাব করছো যেন জীবনেও আমায় খালি গায়ে দেখোনি!
স্বপ্নিলের কথায় রাহিতা অবাক হতেও ভুলে গেলো এক মুহুর্তের জন্য। চোখমুখ কুচকে বিড়বিড়িয়ে বললো “অসহ্য লোক!”
____________________
পরেরদিন সকালে সবাই মিলে আড্ডা দেওয়া হচ্ছিলো। এসবে নেই শুধু সীমা বেগম ও আমিরা৷ পরদিন সকাল হতেই তিনি স্বপ্নিলের নানিকে জানিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে চলে গেছেন। হুট করে এভাবে চলে যাওয়ায় সবাই প্রশ্ন করলেও রাহিতা বিশেষ অবাক হলোনা, সে বুঝেছে উনি কেন এভাবে চলে গিয়েছেন। হয়তো এর পেছনে রয়েছে তার অপরাধবোধ নয়তো পশ্চাত্তাপ! কারণ যেটাই হোক, এতক্ষণ পর্যন্ত সব ঠিক ছিলো কিন্তু রাহিতা সবচেয়ে অবাক তখন হলো যখন শাশুড়ি তাকে সকালে ডেকে একটা খাম হাতে ধরিয়ে দিলেন।
—এটা কি, মা?
—তোর জন্য উপহার। সীমা দিয়েছে।
—সত্যি?
রাহিতার কণ্ঠে বিস্ময়। তা দেখে দিলারা বেগম পুনরায় বলেন,
—অবাক হয়েছিস না? আমিও হয়েছিলাম যখন সকালে চলে যাওয়ার আগে হুট করে সীমা আমার কাছে এলো। এসে তোকে এটা দিতে বললো। তোদের বিয়েতে আসেনি, কিছু দেয়নি তাই এটা তোকে দিতে বললো আজ! আমি চমকে যাই! হঠাৎ ওর সুমতি কিভাবে হলো আল্লাহই জানে!
শাশুড়ির কথায় হেসে ফেললো রাহিতা। খাম নিয়ে রুমে এসে তা খুলতেই চোখে পড়লো হাজার পাঁচেক টাকা। পরিপক্ক হাতের একটি চিঠি। তাতে এলোমেলো ভাবেই লেখা,
“রাহিতা, তুমি যখন এ চিঠি দেখবে তখন আমি হয়তো তোমার সামনে থাকবোনা। আসলে তোমার সাথে যেমন আচরণ করেছি, এরপর তোমায় কিছু বলার ভাষা আমার নেই। শুধু বলবো আমার মেয়ের কৃতকর্মের জন্য আমি লজ্জিত, স্বপ্নিলের প্রতি এতদিনের খারাপ মনোভাব রাখার জন্য আরও বেশি লজ্জিত৷ ওকে ধন্যবাদ দিও আমার মৃত মেয়ের সম্মান রক্ষা করার জন্য, ওর রেখে যাওয়া অতীতের কথা কাউকে না বলার জন্য৷ তোমাদের বিয়েতে তো রাগের বশে যাইনি, তাই এ খামে সামান্য উপহার দিলাম দুজনের জন্য। পারলে কোথাও থেকে ঘুরে এসো। দুজন এভাবেই এএকে-অপরের পাশে থেকো, সুখে থেকো!”
সীমা বেগমের চিঠি পড়ে নিমিষেই মন ভালো হয়ে যায় রাহিতার৷ মনে মনে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে আল্লাহর নিকট তাকে সঠিক বুঝ দেওয়ার জন্য৷ সে ঠিক করে এরপর ঢাকা গেলে একদিন তার সাথে দেখা করবে, মন খুলে কথা বলবে। এরই মাঝে স্বপ্নিল রুমে এলে তাকে চিঠি দেখায় রাহিতা৷ ওর হাতে চিঠি দেখে স্বপ্নিল ভ্রু কুচকে বলে,
—কিসের চিঠি এটা?
এক মুহুর্ত স্বপ্নিলের চেহারার দিক তাকিয়ে রাহিতা ওর মতোই ফাজলামির স্বরে বলে,
—লাভ লেটার পেয়েছি তো। সেটাই দেখছিলাম আর কি!
রাহিতার বলতে দেরি, স্বপ্নিলের চিঠি ছি’নিয়ে নিতে দেরি হলোনা৷ চোখমুখ শক্ত করে চিঠি হাতে নিতে নিতে সে বলে,
—তো আমিও একটু দেখি আমার বউকে চিঠি দেওয়ার সাহস কার হয়েছে!
আনমনেই বলা স্বপ্নিলের কথায় বুকজুড়ে তোলপাড় হয় রাহিতার। বারবার কানে বাজে ওর বেখেয়ালি কথাগুলো! তবে ওর ভাবনা দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার আগেই স্বপ্নিল চিঠি পড়ে অবাক সুরে বলে,
—আরে? সীমা খালামনি লিখেছে নাকি এটা?
—হুম
—বাপরে! তার এত উন্নতি? কিভাবে হলো এসব, রাহি? তুমি কিছু জানো? আমার তো মাথায় ঢুকছেনা!
মাথা নাড়িয়ে এক শ্বাস ফেলে স্বপ্নিলকে সব বলতে আরম্ভ করলো রাহিতা। সবকিছু শুনে অবাক হলো সে। মাথা নাড়িয়ে বললো,
—আমার পিছে এতকিছু হয়ে গেলো আর আমিই জানলাম না! তুমিও আমায় এত পরে জানালে, রাহি? আগে জানালেনা কেন?
—সরি। আপনাকে কালকেই বলতে চেয়েছিলাম কিন্তু পরে টায়ার্ড হয়ে ভুলে গেছি।
—হ্যাঁ, তা তো ভুলেই যাবে। বলো যে আমায় শার্টলেস দেখে মাথা হ্যাং হয়ে গিয়েছিলো তোমার। আমি কি বুঝিনা নাকি?
স্বপ্নিলের কথা শুনে ধাতস্থ হতে কিছুক্ষণ সময় নেয় রাহিতা। বুঝে উঠে ঝগড়া করার জন্য কিছু বলার আগেই হাসতে হাসতে রুম থেকে চলে যায় সে। পেছনে ফেলে যায় এক লাজুক রাহিতাকে!
____________
স্বপ্নিলের কাজিনরা সব বেড়াতে যাওয়ার প্ল্যান করছে। এসবে উচ্ছাসিত রাহিতা সবার সাথে ব্যস্ত কোথায় কোথায় যাবে সেসব নিয়ে আলোচনা করতে। এরই মাঝে হুট করে স্বপ্নিল আসে সেখানে। গম্ভীরমুখে জানায় ওদেরও আজকেই যেতে হবে, তার অফিসে একটা কাজ পড়ে গেছে। সে মা-কেও জানিয়ে এসেছে, এখন রাহিতাকে জানাতে এলো। কাজিনমহল এসব শুনে বেশ জোরাজোরি করে ওকে তবুও কাজের ক্ষেত্রে স্বপ্নিল সিরিয়াস বলা চলে। তাই সে কারও কথার তোয়াক্কা না করে রাহিতাকে স্পষ্ট জানিয়ে দেয়,
—আমরা আজ বিকেলেই রওনা হবো। দুপুরের খাবার খেয়ে রেডি থেকো। আমি জানি তোমার হয়তো মন খারাপ হবে কিন্তু কিছু করার নেই। ইটস আরজেন্ট!
স্বপ্নিলের মুখ দেখে আর কিছু বলার সাহস পায়না রাহিতা। সে বুঝে নিশ্চয়ই কিছু ঝামেলা হয়েছে নয়তো স্বপ্নিল এভাবে হুট করে যেতে বলতোনা। তাই মন খারাপ পাশে রেখেই রাজি হয় সে। সব ভাবনা ফেলে দুপুরের খাওয়া শেষে রুমে ঢুকতেই পায়চারি করতে থাকা চিন্তিত স্বপ্নিল চোখে পড়ে ওর। রাহিতাকে আসতে দেখেই স্বপ্নিল এগিয়ে এসে উত্তেজিত কণ্ঠে বলে,
—একটা ঝামেলা হয়ে গেছে, রাহি!
#চলবে
কেউ পর্বকে ছোট বলবেন না। সারাদিন তীব্র গরমে অতীষ্ঠ-অসুস্থ হয়ে আর লিখার ইচ্ছে থাকেনা আজকাল। তবুও ধারাবাহিক লিখছি তাই দিতে বাধ্য একপ্রকার। সুস্থ থাকলে আগামী পর্ব জলদি দিবো ইন শা আল্লাহ।