তুমি আমি দুজনে পর্ব ৬০

0
2397

#তুমি_আমি_দুজনে
#লেখিকা_হুমাইরা_হাসান
পর্ব- ৬০

কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে জীর্ণ শীর্ণ অবস্থা। বিছানার সাথে পাতলা শরীর টা যেন লেপ্টে আছে। জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলার ফোস ফোস শব্দ ছাড়া শুধুমাত্র ঘড়ির টিকটিক শব্দটাই কর্ণগোচরে পৌঁছানোর মতো।
ঘুমের রেশ কাটার সাথে সাথে নেত্রপল্লবের মৃদু কম্পন দৃশ্যমান। ঘমটা হালকা হতেই আস্তে আস্তে ক্লান্ত চোখ খুলে তাকাল তুরা। মাথাটা প্রচন্ড ভারি লাগছে, সারা শরীরে ব্যথার উপস্থিতি টের পাচ্ছে খুব কড়াভাবে। হালকা ঝাপসা চাহনি খুলল বেশ আস্তেধীরে। প্রশস্ত চাহনিতে তাকালে নিজের একদম সামনেই আহানকে দেখতে পেল। চেয়ারে বসে মাথা এলিয়ে পড়ে আছে। ঘুমাচ্ছে কিনা স্পষ্ট বুঝতে পারল না তুরা। ভ্রু যুগল আপনা আপনি কুচকে এলো। কনুইয়ে ভর করে উঠতে গেলেই বা হাতে তীক্ষ্ণ যন্ত্রণাভূত হতেই চোখ মুখ খিঁচিয়ে কিঞ্চিৎ আর্তনাদ করে উঠল।
তুরার অস্পষ্ট শব্দে আহানের সবেমাত্র লেগে আসা চোখ খুলে যেতেই তুরাকে আধশোয়া অবস্থায় দেখে তড়িৎ ওর কাছে এগিয়ে গিয়ে আগলে ধরে বলল

-লেগেছে তুরা? তুমি উঠতে কেন গেলে। স্যালাইন চলছে তো।

-আ আমার কি হয়েছে? এটা কেন লাগিয়েছেন আমার হাতে?

আধো আধো গলায় বলল তুরা, আহান একহাতে খুব সাবধানে তুরাকে শুইয়ে দিয়ে পাশে বসে বলল

-কিছু লাগবে তোমার?

মাথা নাড়িয়ে না বলল তুরা, ছলছল চোখে আহানের দিকে তাকিয়ে আবারও বলল

-এটা কেন লাগিয়েছেন বলুন না, খুলে দিন আমার ব্যথা করছে

ভীষণ ক্লান্ত গলায় বলল তুরা, কথার সাথে কণ্ঠনালী কেঁপে উঠল। কয়েকদিন ধরেই অসুস্থতার দরুন আগে থেকেই শরীর ভীষণ দূর্বল ছিল। আর কাল রাতের মধ্যে আরও কয়েক ধাপ মিইয়ে গেছে যেন।
তুরা নিষ্পলক তাকিয়ে থাকলেও আহান প্রত্যুত্তর করল না। খুব যত্নসহকারে তুরার হাতের নিচে একটা বালিশ রেখে বলল

-নড়াচড়া করবে না, এটা কিছুক্ষণের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে।

-এক্ষুনি খুলে দিন। আমার লাগছে,এটা রাখব না আমি

আহান লাল হয়ে আসা ক্লান্ত চোখে তাকাল তুরার দিকে। বেশ খানিক সময় নিয়ে তাকিয়ে থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল

-আর একটু পরেই খুলে দিচ্ছি

তুরার অভিমান হলো, কিঞ্চিৎ ভয় কাজ করল অন্তস্থলে। ওর হাতে সেলাইন কেন লাগিয়েছে? কি হলো ওর? বেশ অনেক দিন ধরেই শরীরটা তার খারাপ, কাল রাতে হুট করে ঘুমের মাঝেই গা গুলিয়ে উঠল, ঘুম ভেঙে ছুটে ওয়াশরুমে ঢুকতেই গড়গড় করে বমি করে ফেলল। আহান টের পেলে এগিয়ে এসে ওকে ধরে ঘরে আনলে মাথাটা ঘুরিয়ে উঠল, সারা শরীরে কেমন কাঁপন ধরেছিল। পরপর তিনবার বমি করে শরীরের সমস্ত শক্তিটুকুও যেন নিঃশেষ হয়ে গেছে, গা এলিয়ে পড়ে যেতে নিলে আহান ওকে বসিয়ে রুবিকে ডাকতে গেলে তুরার আবারও মুখ ভরে বমি আসে, কোনো মতে শরীর টাকে এগিয়ে ওয়াশরুম পর্যন্ত নিলেও বিছানা অব্দি ফিরতে পারেনি,,মাথাটা কেমন ঝিম ধরে সারা শরীর অবশ করে দিল।
এরপর আর কিছুই মনে পরছে না তুরার, ঘুম ভেঙেই নিজেকে বিছানাতে হাতে স্যালাইনের সুচ বিদ্ধ অবস্থায় পেল। আহানের চোখ মুখ শুকিয়ে আছে, ও কিছু বলছে না কেন? কি হয়েছে তুরার? অযাচিত ভয়ে ভেতরটা গুমরে আসলেই বুদ্ধিহীনের মতো বলল

-আপনি কথা বলছেন না কেন? কি হয়েছে আমার! আমার কি কঠিন কোনো অসুখ করেছে? আমি কি মরে যাব? বলুন নাহ,চুপ করে আছেন কেন?

তুরার ক্লান্ত গলাটাও যেন বেশ জোরালো শোনালো আহানের কানে। কিন্তু ওর এ প্রশ্নের উত্তর কি দেবে ওর মাথায় আসছে নাহ। বিভ্রান্তের মতো স্থির দাঁড়িয়ে রইল খানিক, কোনো উত্তর না দিয়েই ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল গটগট করে । তুরা আহানের যাওয়ার পানে অসহায় চোখে তাকিয়ে রইল।বুক ফেটে কান্না আসছে হাজারো বেহিসাবি চিন্তা মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে অনিচ্ছা সত্ত্বেও, ভেতরটা অস্থির হয়ে উঠল খুব!

……………..

তীব্র জ্বরের তোপে লাল হয়ে আসা চোখ মুখে রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে সাদমান। বার কয়েক পলক ঝাপটাল,কিন্তু সামনের দৃশ্যের কোনো পরিবর্তন নেই, স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে সাদমান ওর সামনে বসে থাকা ফারিহাকে। কিন্তু ও এখানে? কিভাবে? এত সকালে ও কি করে এলো? আর সে নিজেও বা এখানে কি করে এলো। কিছুই বুঝতে পারছে না, পুরো মাথা টা গুলিয়ে জগাখিচুরি হয়ে গেছে।
ফারিহা কোনো নড়চড় হীনা স্থির তাকিয়ে আছে সাদমানের দিকে, বিব্রতকর চেহারায় নিজের গালে হাত রাখল সাদমান। বা পাশের গালটা এখনও জ্বলছে। তার মানে থাপ্পড় টা সত্যিই খেয়েছে, স্বপ্ন নয়। আগামাথা কিছু বুঝত্র না পেরে সাদমান গলা উচিয়ে চেঁচিয়ে বলল

-মা,আমার ঘরে আসো, ভয় করছে আমার

সাদমানের কথা শেষ হতে যতটুকু দেরি, ফারিহা ঝড়ের বেগে উঠে এসে পাশ থেকে একটা খাতা তুকে ধুপধাপ কয়েকটা পিঠের উপর বসিয়ে ঝাঝালো গলায় বলল

-আরেকবার ম্যা ম্যা করবি তো ছাগলের সাথে বেঁধে রেখে ঘাস খাওয়াব তোরে। সা লা অকম্মা, খাইসটার বংশধর

-সকাল বেলা করে এসে রিলিফের মালের মতো কয়েক ঘা বসায় দিলি,আমার আমার গুষ্টি তুলে যা তা বলছিস।

এক হাত দিয়ে গা ডলতে ডলতে মুখ খানা ফুলিয়ে ফুসকা বানিয়ে বলল সাদমান। আরও কিছু বলতে গেলেও ফারিহার অগ্নিশর্মা চোখ দেখে কিছু বলার সাহস করল নাহ।

-রাত করে সিড়ির উপর চিত হয়েছিলি কেন? ম’রে পরে থাকতে ইচ্ছে করেছিল?

খাটের এক কোণায় পরে থাকা ভেজা জলপট্টি দেওয়া কাপড় টা তুলতে তুলতে বলল ফারিহা। সাদমান গম্ভীরমুখে বলল

-সেটা আমার ব্যাপার, তোকে ভাবতে হবে নাহ। তুই সাত সকাল করে আমার বাড়িতে আমার ঘরে কেন এসেছিস। তোর নাকি বিয়ে?

-হ্যাঁ তো বিয়ে হবে বলে কি আমি বাড়ি থেকে বেরোতে পারব না?

ফারিহার দায়সারা উত্তরে সাদমানের ভীষণ রাগ হলো। সে তো আশা করেছিল ফারিহা হয়তো বলবে এ খবর মিথ্যে,কোনো বিয়ে ঠিক হয়নি তার। সাদমানের রুষ্ঠতা আরও বাড়িয়ে দিয়ে ফারিহা ওর হাতটা সামনে ধরে বলল

-এই দেখ আমার এঙ্গেজমেন্টের রিং, সুন্দর নাহ?

-বাড়ি যা তোর রবিন ভাই তো দেখলে উল্টা পালটা ভাববে তাই না? বর হতে চলেছে

খোঁচা দেওয়ার মত করে বলল সাদমান। ফারিহা সেদিকে ধ্যান না দিয়ে বলল

-হ্যাঁ তাও ঠিক, কিন্তু যতই হোক তুই তো বন্ধু। বিয়ে করব অথচ তোকে দাওয়াত দেব না তা তো হতে পারেনা। তাই তোকে বলতে এসেছিলাম। কিন্তু এসে দেখি তুই ঘুমের ঘোরে কিসব আবল তাবল বকছিস তাই তো ধ্যান ভাঙাতে কানের নিচে গরম বাতাস করলাম।

সাদমানের মেজাজ তড়তড় করে বেড়ে উঠল। ধপ করে বিছানা থেকে নেমে চোখ মুছে চশমা টা চোখে পরে বলল

-বলা শেষ? এবার আসতে পারিস

-আজব তো! তুই এভাবে বলছিস কেন। আমি আসব কি যাব তোর কি তাতে। আসলে আমারই দোষ আন্টি যখন বলল রাতে জ্বরে মাথা ঘুরে সিড়িতে পরেছিলি তখন দয়া হয়েছিল বলেই দেখতে এসেছিলাম। কিন্তু তুই তার যোগ্যই না

-হ্যাঁ তাই তো। আমি কেন যোগ্য হবো যত যোগ্যমান যোগ্যধারী তো তোর ওই ছ্যাছড়া রবিন তাই তো?

-দেখ কথা তোর আর আমার মাঝে হচ্ছে। এসবে উনাকে আনবি না বলে দিলাম।

-কেন খুব লাগছে? দরদ উতলে পরছে তাই না? কি করেছে ও যে এত পেয়ার মহব্বত উতলে আসছে তোর! বলব আমি একশ বার বলব।

-তোর সাথে কথা বলাটাই ভুল হয়েছে আমার। তুই আসলেই জঘন্য ফালতু একটা ছেলে। থাক,আমি যাচ্ছি। তোর সামনে থাকার নূন্যতম ইচ্ছে আমার নেই

বলেই সাদমান কে পাশ কাটিয়ে যেতে লাগল ফারিহা। সাদমানের মাথায় যেন রক্ত চড়ে গেল এবার। কাল ওদের দুজনকে একসাথে দেখার পর থেকে মাথা গরম হয়ে আছে ওর। তার উপর ওই রবিন নামের ছেলেটার নাম ফারিহার মুখে শুনে গা পিত্তি জ্বলে উঠছে সাদমানের। হুট করে পেছন থেকে ফারিহার হাত চেপে ধরে এক টানে নিজের সামনে দাঁড় করাল, হিসহিসিয়ে বলল

-কোথায় যাচ্ছিস, ওই রবিনের কাছে যাচ্ছিস তাই তো?

-আমার হাত ছাড় সাদমান

-ছাড়ব না,কাল তো ঠিকই ওই ছেলের সাথে চিপকে যাচ্ছিলি। আজ আমি ধরেছি তো কি ফোস্কা পরে যাচ্ছে?

-ও ধরতেই পারে, কারণ ও আমার..

-আর আমি? আমি কে তাইলে?

ফারিহাকে সম্পূর্ণ করতে না দিয়েই বলল সাদমান। এ পর্যায়ে এসে ফারিহা এক ঝটকায় ওর হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল

-তোর সাহস কি করে হলো আমার সাথে এভাবে কথা বলার, তুই কে? কেন এমন বিহেভিয়ার করছিস তুই।

-আমি সাদমান, আমি তোকে ভালোবাসি, আর তোর সাথে অন্য কাওকে আমি সহ্য করব নাহ। তাই এমন করছি

চেঁচিয়ে উঠে বলল সাদমান। ফারিহা মুহুর্তেই স্থির হয়ে গেলো। অপলক তাকিয়ে রইল সাদমানের রাগান্বিত টকটকে চেহারার দিকে। ও কি ঠিক শুনল? এটা সাদমান বলল? সত্যিই বলল! মাথা গুলিয়ে গেল ফারিহার। অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে পা পিছিয়ে নিতে লাগলে সাদমান আবারও এগিয়ে এসে ওর সামনে দাঁড়িয়ে বলল

-শুনতে পেয়েছিস এবার? আই লাভ ইউ। আর ওই রবিনকে আমি তোর ছায়াও পারাতে দেব নাহ বিয়ে তো দূর, ওকে বলে দিবি এখান থেকে চলে যেতে না তো..

সামনে আর বলতে পারল না সাদমান। তার আগেই ফারিহা চলে গেছে। সাদমানের মুখ থেকে প্রথম দুটো বাক্য শোনার সাথে সাথেই এক ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে। সাদমান কয়েক মুহূর্ত হতভম্বিত হয়ে তাকিয়ে ওর পিছু নিতে গেলেও পারল নাহ। ততক্ষণে ও গাড়িতে উঠে চলে গেছে অনেক খানি দূরে। সাদমানের নিজেকে কেমন শূন্য শূন্য লাগছে। কি হলো এটা? হুট করেই কিভাবে ও ফারিহাকে কিসব বলল। কিভাবে বলল? কিন্তু পরমুহূর্তেই রবিনের সাথে ফারিহার এঙ্গেরজমেন্টের কথা মনে পরতেই চোয়াল শক্ত হয়ে এলো৷ আর যাই হোক বলে যখন দিয়েছেই ফারিহাকে ও ছাড়বে নাহ আর। যাই হয়ে যাক ওই রবিন কেন অন্য কোনো ছেলের সাথেই ফারিহাকে ও সহ্য করবে না!

…………..

একটা মেয়ে যখন বুঝতে পারে তার গর্ভে আরও একটি প্রাণ বেড়ে উঠছে, তখন এর থেকে সুখকর কিছু আর দুনিয়াতে আছে বলে মনে হয়না! একটি জীবন, ছোট্ট শরীর আষ্টেপৃষ্টে মিশে আছে তার গর্ভে অবিচ্ছেদ্য অংশের মতো। এই অনুভূতিতা কতটা প্রখর আর পবিত্র তা একজন মা ই বুঝতে পারে যখন তার গর্ভে লালিত হয় ছোট্ট একটা জীবন
তুরা কিরকম অভিব্যক্তি করবে সেটা নিজেও বুঝতে পারছে না। খবরটা শোনার পর থেকে থ মেরে আছে। আনন্দানুভূতি, আবেগ,পুলকে আপ্লূত হয়ে স্তব্ধ হয়ে গেছে। কাঁপা কাঁপা হাতটা নিজের পেটের উপর রাখল। যেন ছোট্ট শরীরের একটা অস্তিত্ব খুব গাঢ় ভাবে উপলব্ধি করতে পারল তুরা, চোখ মুদে এলেই কোণা বেয়ে গরম জল গড়িয়ে পরল। ওর গর্ভে যে আহানেরই একটা অংশ বেড়ে উঠছে! এটা ভাবতেও কি প্রতিক্রিয়া দেওয়া উচিত তুরা বুঝে উঠতে পারছে না। একটা মেয়ের কাছে মা হওয়ার চেয়ে বড় প্রাপ্তি, উপহার আর কি হতে পারে!

আজ সকালেই আহান যখন তুরাকে ঘরে রেখে বেরিয়ে গেল তখন ওর ভীষণ কষ্ট লেগেছিল। অজানা ভয় আশংকায় ভেতরটা অস্থির হয়ে উঠছিল। খানিক বাদেই রাইমা এসেছিল ওর ঘরে, একে একে রুবি, আমেনা ও এলো। সকলের আচরণ হতভম্ব তুরার ঘোর ভাংলো যখন রাইমা ওর প্রাণোচ্ছল কণ্ঠে বলল

-এবার আমার ঘাপুসের সাথে তোরও তো একটা ঘুপুস আসছে রে তুরা। এ বাড়ির প্রথম সন্তান। আমার আরও একটা পিচ্চি আসছে। এত খুশি কোথায় রাখব বল তো?

এ কথা টা শোনার পর তুরা ঠিক কতখানি সময় বাকরুদ্ধ হয়ে ছিল ওর ও জানা নেই। তবে ওর এই হতবিহবলতাকে সবাই স্বাভাবিক ভাবেই নিয়েছে। বরং তারা তো আনন্দ উল্লাসে মত্ত। ইনসাফ উচ্ছ্বসিত হয়ে আর গাড়ি ভরে মিষ্টি এনেছে, মাহিদ, তহমিনা ও এসেছিল। সকলের সামনে অদ্ভুত একটা জড়তা আড়ষ্টতা জাপটে ধরেছিল তুরাকে। ও কল্পনাও করেনি এমন কিছু। বেশ কয়েকদিন ধরেই ওর শরীরের কন্ডিশন ভালো ছিল না।ঘন ঘন জ্বর আসতো, ঠিক মতো খেতে পারত নাহ,রাতে ঘুম হত না বারবার গা গুলিয়ে আসতো। কিন্তু এগুলোকে স্বাভাবিক অসুস্থতা ভেবে আমলে নেয়নি তুরা।
কিন্তু আজ ওর সমস্ত ঘোর কেটে গেল, নিজে কিসব উদ্ভট কথা ভেবেছিল সেসব ভাবতেই হাসি পেল।
সকলে মিলে প্রাণভরে দোয়া করেছে তুরাকে, রাইমা তো খুশিতে বাক-বাকুম। কিন্তু এত সবের মাঝেও তুরা নির্বিকার কারণ আহান সেই সকালে বেড়িয়েছে এখনো ফেরেছি। আর তুরা সকালে ওতবার জিজ্ঞাসা করা সত্ত্বেও আহান উত্তর দেয়নি,কেন? তাহলে কি আহান খুশি না? ও চাই না এই বাচ্চাটাকে? আহানের সকালের ব্যবহার তুরা সারাদিনে কিছুতেই ভুলতে পারল নাহ।
ঘড়িতে এগারোটা বেজে গেছে, একটু আগেই রাইমা আর রুবি গেল ঘর থেকে। সারাটা দিন তুরার সাথে সাথেই ছিল সকলে। কিন্তু এখন এই ঘরে তুরার বুক ফাটিয়ে কান্না আসছে। আহান কি তবে খুশি হয়নি?

বেশ অনেকটা সময় অতিবাহিত হলে দরজার নব মোচড়ানোর শব্দে সজাগ হলো তুরা, এতক্ষনেও ঘুমাইনি, বিছানায় গা এলিয়ে পরে আছে চুপচাপ।
পায়ের শব্দটা আস্তে আস্তে কাছাকাছি এলেও চোখ খুলে তাকাল না তুরা। হুট করেই ভারি একটা শরীর আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরল তুরাকে, চোখ খুলে তাকাতেই আহানকে নিজের খুব কাছে আবিষ্কার করলো। আহানের হাতের চাপ আরও গাঢ় হলো ক্রমশই। সর্বশক্তি দিয়ে জড়িয়ে ধরল তুরাকে, গলায় মুখ গুঁজে দিয়ে বেসামাল ভাবে নিঃশ্বাস ছাড়ছে। তুরার দম বন্ধ হয়ে আসলেও কোনো শব্দ করল নাহ
আহান আস্তে আস্তে আরও গভীর ভাবে জড়িয়ে ধরল তুরাকে,প্রচন্ড শক্ত বাহুবন্ধনীতে আবদ্ধ হয়ে ওর পিষে যাওয়ার জো। আহান নিজের ঠোঁট দুটো গাঢ়ভাবে চেপে ধরলো তুরার গলায় কাঁধে। জড়ানো কণ্ঠে বলল

-তুরা, তুরা আমাদের একটা বাবু হবে, ছোট্ট একটা শরীর আসবে, এই যে এইখানে, এইখানে আস্তে আস্তে বড় হয়ে উঠবে ও

বলে তুরার পেটের উপর হাত রেখে বলল

-এখানে একটা বাবু আছে তুরা, তোমার আর আমার, আমাদের বাচ্চা। আমাদের মাঝে আরও একটা ছোট্ট প্রাণ আসছে তুরা। আমি কিভাবে সামলাবো, কিভাবে বলব কি চলছে আমার ভেতরে! অগোছালো অনুভূতি গুলোর জন্যে আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি

অভিমানের পাল্লা তড়তড় করে বেড়ে উঠল তুরার, এতক্ষণ কোথায় ছিল লোকটা, সারাদিনেও আসল না!

-সরে যান,ছাড়ুন আমাকে। এতক্ষণ কোথায় ছিলেন? আমার কাছে আসতে মন চাইনি? এখনও চলে যান আপনি

আহান কানে নিল না তুরার কথা।বরং ওর গলায়, ঘাড়ে অসংখ্য চুমু দিয়ে ভরিয়ে দিল। গভীর আবেশে উষ্ণ হয়ে আসল তুরার শরীর। আহান ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলে তুরার মুখের কাছে মুখ এনে ওর গলায় কপালে থুতনিতে আবারও কয়েকবার ঠোঁট ছোঁয়ালো। সম্মোহনী গলায় বলল

-সকালে ডক্টর যখন তোমায় চেকাপ করে বলল তুমি প্রেগন্যান্ট তখন আমি ঠিক কত বড় শক খেয়েছি বোঝাতেও পারব না। ঠিক কি বলব কিরকম অভিব্যক্তি করব আমি বুঝছিলাম নাহ। সকালে তুমি যখন বারবার আমাকে প্রশ্ন করছিলে ততবার আমার বুকের মাঝে ঝড় উঠছিল। কিছুতেই মুখ ভেদ করে কিছু বলতে পারছিলাম নাহ। আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না আমি বাবা হবো তুরা, ছোট্ট একটা বাবু আমাকে আধো আধো বুলিতে বাবা ডাকবে,আমার কোলে উঠবে। তোমার আর আমার ভালোবাসার চিহ্ন দুহাতের অস্তিত্বে আসবে। আমি কিছুতেই সামলাতে পারছিনা নিজেকে তুরা,এত সুখ এই অনুভব আমি কি করে সামলাবো বলোনা

শরীর জুড়ে শীতল স্রোত বয়ে গেলো তুরার, গলার কাছে উষ্ণ পানির অস্তিত্ব অনুভব করল।তবে কি আহান কাঁদছে?
তুরা নিজের প্রবল আবেগে উন্মাদ হয়ে জড়িয়ে ধরলো আহানকে। এতক্ষণের সুপ্ত আবেগ সম্বেদন আহানের হৃদয়স্পর্শী বাক্যে আরও উতলে পরলো। দু’হাতে আহানকে বুকের মাঝে ঝাপটে ধরে কয়েকবার ঠোঁট ছোঁয়ালো। আনন্দ, সুখে চরমভাবে বেশামাল হয়ে কান্নামিশ্রিত গলায় বলল

-ভালোবাসি মাস্টার মশাই, আপনার মত ব’জ্জাত গোমড়ামুখো লোকটাকে অসম্ভব ভালোবাসি আমি।

হেসে ফেলল আহান। তুরার ঠোঁটে গভীর একটা চুম্বন এঁকে আবারও বুকের মধ্যে মিশে রইলো। অদ্ভুত সম্মোহনী ভালো লাগা কাজ করছে দুজনের মাঝে, ক্রমেই আরও শীতল হয়ে উঠছে দুজনের বন্ধন, দুজন মানুষ তাদের ভালোবাসার প্রণয়ের সিক্ত অনুভূতির বেড়াজালে জর্জরিত হয়ে মিশে গেল।
.
.
.
চলবে ইনশাআল্লাহ

#Humu_❤️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here