আমার হিয়ার মাঝে পর্ব ২৪

0
666

#আমার_হিয়ার_মাঝে
লেখিকা: তাহসীন নাওয়ার রীতি
পর্ব:২৪

আজ দুদিন হলো অধরা আর আশ্বিনের আর আগের মতো কথা হয়না। একে অপরের খুব কাছে থেকেও যেনো তারা অনেক দূর।

সেদিন আশ্বিন ক্লাস শেষে অধরাকে খুঁজে না পেয়ে ইশাকে জিজ্ঞেস করতে যাওয়ার পথে রাফিন আর অধরাকে একসাথে ক্যান্টিনে বসে থাকতে দেখে সে। দুজনকে একসাথে গল্প করতে দেখে নীরবে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে তাদের দেখতে থাকে।
অধরা হুট করেই কিভাবে এতটা বদলে গেল? দুদিনের পরিচয়ে রাফিন তার এতো আপন হয়ে গেল! কথাগুলো মনে হতেই একরাশ অভিমান এসে ভর করে তার। মুহূর্তেই সে চলে যায় সেখানে থেকে।

এই দুদিন অধরা সারাক্ষণ মনমরা হয়ে ছিলো। বন্ধু মহলের কেউ তার সাথে কথা বলছে না। আশ্বিনও কেনো জানি তার থেকে দূরত্ব বজায় রেখে থাকছে। সে চেয়েছিলো আগের মতো আশ্বিনের সাথে কথা বলতে। কিন্তু আশ্বিন তাকে যথাসম্ভব ইগনোর করেছে। সবার এমন আচরণ তাকে ভেতর ভেতর ভেঙে দিচ্ছে। সে যে বাধ্য হয়েই রাফিনের সাহায্যে হাত বাড়িয়েছে। এই মুহূর্তে তো রাফিনের একজন ভালো বন্ধু প্রয়োজন, যেন সে দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবতে পারেন।

‘তুইও কি রেগে থাকবি আমার উপর, ইশা?’
হোস্টেল রুমে মুখোমুখি বসে অধরা ইশাকে কথাটা বললেও অপর প্রান্ত থেকে কোন উত্তর আসে না।
‘বুঝতে পেরেছি। ভালোই, আমার যখন তোদের সাহায্য প্রয়োজন তখন তোরা সবাই আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছিস।’
‘তুই নিজ ভুলে এই দায়িত্ব কাধে নিয়েছিস অধরা। এখন আমাদের দোষ দিবি না।’
কথাগুলো বলে ইশা পড়ায় মনোযোগ দেয়। নীরবে বসে থাকে অধরা। হুট করেই কেনো জানি কান্না এসে হানি দিচ্ছে তার। ফোনটা হাতে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে বারান্দায় এসে হাজির হয় সে। সাত পাঁচ ভেবে দুবার কল করে সে আশ্বিনকে। তিনবারের বার ফোন রিসিভ করে আশ্বিন।

‘আপনি আমার সাথে আগের মতো কথা বলছেন না আশ্বিন। আমাকে ইগনোর করছেন কেনো? কি করেছি আমি?’
উত্তর আসে না অপর প্রান্ত থেকে। এবার আর নিজেকে সামলাতে পারে না অধরা। চোখ বেয়ে নেমে আসে অশ্রুধারা।
‘কথা বলছেন না কেনো?’
‘কি বলবো আমি? তাছাড়া, তোমার সময় কোথায় আছে আমার সাথে কথা বলার? আমি ভাবছিলাম হঠাত কি মনে করে কল করলে আজ? কারণ গত দুদিন আমার সাথে কথা বলার, ফোন কিংবা একটা ম্যাসেজ দেওয়ার তো প্রয়োজন মনে করোনি তুমি।’
‘আপনি কেনো দেননি ফোন?’
চুপ হয়ে যায় আশ্বিন। উত্তর দেওয়ার মতো কথা তার জানা নেই। সে যে বলতে পারছে না যে, ভালো লাগে না তার রাফিনকে আর অধরাকে পাশাপাশি দেখলে। সে যে খুব করে চায় অধরা শুধু তার সাথে থাকুক। তার সকল দুষ্টুমি, পাগলামি সব কিছু ঘিরে সেই থাকুক।
‘কারণ, তোমার এখন কথা বলার মতো নতুন বন্ধু আছে। ব্যস্ত থাকো তুমি এখন।’
‘আর আপনি? আপনি বন্ধু না আমার? আমার কোন গুরুত্ব নেই আপনার কাছে?’
‘তুমি আমার কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ অধরা। তুমি কেনো বুঝতে চাইছো না, রাফিন ছেলে হিসেবে সুবিধার না। তুমি দেখোনি সে কিভাবে সেদিন তোমার সব বন্ধুদের, আমাকে রোদকে সবার সামনে অপমান করেছে?’
‘রাফিন ভাইয়া ইচ্ছে করে এমনটা করেনি। উনি আসলে..।’
কথাটা বলতে গিয়েও থেমে যায় সে। হাসান স্যার নিষেধ করেছিলেন রাফিনের ক্লাসের কাউকে ব্যাপারটা না জানাতে। দ্বিধায় পড়ে যায় সে, আশ্বিন যে তাকে ভুল বুঝে যাচ্ছে। এই মানুষটার অনুপস্থিতি তার সহ্য হয়না, দুদিন অনেক চেষ্টা করেও তাদের যোগাযোগ সম্ভব হয়নি।
‘তুমি এখনও তার পক্ষে কথা বলবে অধরা?’
‘উনি এমনটা ইচ্ছে করে করেননি। আপনি আমার কথা বিশ্বাস করুন। আমি বলছি তো, উনি..।’
কথাটা শেষ করার আগে অধরার ফোনে কল আসতে থাকে। থেমে যায় অধরা, ফোনের উপর রাফিনের নাম দেখে।
‘ফোন আসছে আমার। আমি একটু পরে কল দিচ্ছি।’
‘রাফিন কল করেছে?’
‘হুম।’
মৃদু স্বরে কথাটা বলতেই একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দেয় আশ্বিন।
‘আল্লাহ হাফেজ।’
আর কোন কথা আর বলার নেই তার, ফোন কেটে দেয় সে।
থমকে গিয়ে বসে থাকে অধরা। একটি পরিস্থিতি তার সবটা বদলে দিচ্ছে। না জানি এর শেষ কবে হবে।
—————-

দেখতে দেখতে দেড় মাস পার হয়ে যায়। অধরার সাথে আশ্বিনের দূরত্ব আগের থেকেও অনেক বেশি। সবাই দুজনের এমন পরিবর্তন দেখে হতভম্ব। কলেজের নবিতা ডোরেমন জুটি ছিলো দুজন। এখন একে অপরের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন।
অধরাকে আর তার বন্ধুদের দেখা যায় রাফিনের সাথে। আর আশ্বিনকে দেখা যায় রোদ্দুরের সাথে, শুধু যোগ হয়েছে মারিয়া। একই কলেজে, একই ছাদের নিচে থেকে দুজন অচেনা অজানা।

রাফিন এখন আগের থেকে অনেকটা সুস্থ। আগের মতো এখন হুটহাট সে অস্বাভাবিক আচরণ করে না। অধরা আর তার বন্ধুদের সহযোগিতায় রাফিনের ঔষধ আর সকল নিয়ম মোতাবেক থেকেছে সে।

আর মাত্র এক মাস আছে ফাইনাল পরীক্ষার। সবাই যে যার মতো ব্যস্ত পড়ালেখায়। শেষ মুহূর্তে পড়ার প্রস্তুতির জন্য রোদ্দুর চলে এসেছে আশ্বিনের ফ্ল্যাটে।
‘দুদিন পর পরীক্ষা, মাথাই কাজ করছে না আমার। মনে হচ্ছে এখনও কিছুই পড়িনি।’
বইয়ের পাতা পাল্টে কথাটা বলে আশ্বিনের দিকে ফিরে তাকায় সে। নির্লিপ্ত হয়ে বসে আছে আশ্বিন।
‘কোন ধ্যানে আছিস তুই? পড়বি না? নাকি এখনো অধরার জন্য বিলাপ করবি?’
বিরক্তি ভাব নিয়ে ফিরে তাকায় আশ্বিন। এই ছেলে সবসময় তার মন খারাপ মুহূর্তে যত সব বেহুদা কথা বলেছে।
‘অধরাকে যখন এতোই ভালোবাসিস তাহলে প্রকাশ কর তার কাছে। শুধু শুধু রাগ অভিমান করে তাকে অন্য কারো দিকে ঢেলে দিচ্ছিস কেনো?’
ভ্রু কুঁচকে থাকে আশ্বিন। রোদ্দুর তাকে কি বলতে চাইছে?
‘কি বলবো আমি?’
‘কি বলবি মানে? আশ্বিন তুই ভালোবাসিস অধরাকে। এই এক মাসে বুঝতে পারলি না তুই তাকে ছাড়া কেমন অসহায়? কোথায় গিয়ে তুই অধরাকে মনের কথা বলবি, তাকে রাফিনের দিকে না যেতে ধীরে ধীরে বোঝাবি। এমন কিছু না করে উল্টো তুই অধরাকে দেখিয়ে ওই মারিয়ার সাথে ঘুরিস।’
রোদ্দুরের শেষ কথায় আছে ক্ষোভ। একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে আশ্বিন। হয়তো রোদ ঠিক বলছে। তার চেষ্টা করা উচিত।
‘বল, এখন কি করবো আমি?’
‘কি করবি মানে? ফোন কর অধরাকে, বল আজ বিকেলে তোদের ওই লেকের পাড়ে দেখা করতে।’
কিছুক্ষণ ভেবে মাথা নেড়ে সম্মতি দেয় সে।

বিকেলে,
একটি আকাশী শাড়ি পরে অধরা তৈরি হয়ে আছে লেকের ধারে যাওয়ার জন্য। তার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না আশ্বিন তাকে দেখা করতে যেতে বলেছেন, ঠিক আগের মতোই। মনে মনে অনেক খুশি সে। হালকা করে সাজগোজ করে জলদি তৈরি হচ্ছে।
‘এই নে গাঁজরা। খোঁপায় পড়লে তোকে অনেক সুন্দর লাগবে। বাই দ্য ওয়ে, এতো সুন্দর করে সেজেছেন, কোন বিশেষ কিছু আছে নাকি?’
একটা লাজুক হাসি দেয় অধরা। আশ্বিন তার কাছে সবসময়ই বিশেষ। এতদিন পর তাকে নিজ থেকে ফোন করেছে তাই আবেগ ধরে রাখতে পারেনি। জলদি তৈরি হয়ে ইশাকে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে আসে সে।

সেই পুরনো বেঞ্চে বসে আশ্বিনের অপেক্ষা করছে অধরা। একটু আগেই মহাশয় জানিয়েছেন উনি প্রায় পৌঁছে গিয়েছেন। তাই অধীর আগ্রহ নিয়ে বসে আছে সে। হঠাত কেউ একজন পেছন থেকে তার মাথায় টোকা দিতেই অধরা আশ্বিন ভেবে মুচকি হেসে পিছনে ফিরে থমকে যায়।
‘আপনি?’
‘হ্যা আমি, মনে হচ্ছে আমাকে দেখে চমকে গিয়েছো?’
‘আপনি এখানে কি করছেন রাফিন ভাইয়া?’
‘কি করবো? ঘুরতে এসেছিলাম। দেখছো না আজকের আবহাওয়া কতো সুন্দর? ভালোই হলো তোমাকে পেয়ে, একজন সঙ্গি পেয়ে গেলাম।’
চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে অধরা। আশ্বিন হয়তো যে কোন মূহুর্তে চলে আসবে। আর এসেই যদি সে রাফিনকে দেখে…।
‘আমি আসলে একটা দরকারে এসেছি..।’
‘হুম, সাজগোজ করে এসেছো। কারো সাথে দেখা করতে?’
‘জি। আসলে আশ্বি..।’

আর বলা হয়নি তার। একটু দূরে পেছনে এসে হাজির হয় আশ্বিন। রাফিনকে এখানে দেখে অবাক হয় সে। অধরা শেষ পর্যন্ত এখানেও রাফিনকে নিয়ে এসেছে? কথাটা মনে হতেই অধরার প্রতি রাগ হচ্ছে তার।
এদিকে,
অধরা আশ্বিনকে দেখে থমকে যায়। ভয়ে ভয়ে মাথা নেড়ে বোঝাতে চাইছে সে রাফিনকে নিয়ে আসেনি। কিন্তু মহাশয় তার বোঝার আগেই রাগে হাতে থাকা লাল গোলাপ ছুঁড়ে ফেলে চলে যেতে শুরু করে।
এই ভয়েই ছিল অধরা। রাফিনের পাশ কাটিয়ে দৌড়ে যেতে থাকে সে আশ্বিনের পিছু।
‘আশ্বিন ভাইয়া, আমার কথাটা একবার শুনুন। প্লিজ! আমি জানতাম না উনি এখানে আসবেন। আশ্বিন ভাইয়া…।’
কথা শোনার নাম নেই তার। দ্রুত গতিতে সে গাড়িতে উঠে চলে যায় সেখান থেকে। একা দাঁড়িয়ে থাকে অধরা। ভাঙা ভারাক্রান্ত মনে! আজ যেন কান্নার বাধ ভেঙ্গে গিয়েছে তার। আশ্বিন কিভাবে তাকে একা ফেলে চলে গেছে? একটুও বিশ্বাস করলো না তাকে?

এদিকে পেছনে দাঁড়িয়ে রাফিন সবটা নীরবে দেখতে থাকে।
————

সকাল সকাল কলেজে এসেই রোদ্দুর হন্যে হয়ে খোঁজে যাচ্ছে রাফিনকে। আশ্বিন গতকাল সারারাত তার পাশেই ছিলো। কতটা আহত হয়েছে সে, বন্ধু হিসেবে সেই আন্দাজ আছে তার। তাই সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুজনের মধ্যে দেয়াল সৃষ্টিকারী রাফিনকে সে জব্দ করবে।
‘কি সমস্যা তোমার? অধরা আর আশ্বিনকে মাঝে দূরত্ব তৈরি করে দাঁড়িয়ে আছে কেনো? কি চাও তুমি?’
সবে মাত্র কলেজ এসে বাইক পার্ক করছিলো রাফিন। এর মাঝে রোদ্দুরের কথায় আরো বিরক্ত হয় সে।
‘কি বলতে চাও তুমি? অধরা আমার বন্ধু।’
‘কিসের বন্ধু? এই বন্ধুত্বের কোন দাম নেই, যে কিনা নিজের জন্য তাকে সবার থেকে আলাদা করে ফেলে। তোমার আসার আগে অধরা চঞ্চল ছিলো, হাসিখুশি ছিলো। দেখো এখন কেমন মনমরা হয়ে গিয়েছে। বন্ধু বলো, তার মর্যাদা দাও তাকে?’
‘অধরা যথেষ্ট ভালো আছে। তুমি এসব শুধুমাত্র তোমার বন্ধুর জন্য বলছো। তুমি চাও দুজন এক হোক। এটাই তো? আসলে কি জানো? আশ্বিনের মতো ছেলে অধরাকে ডিজার্ভই করে না।’
‘আর এই কথা বলার তুমি কে হও?’
রেগে গিয়ে কথাগুলো বলতে থাকে রোদ্দুর। কথায় কথায় দুজনের মাঝে ঝামেলা শুরু হয়। আশেপাশের সবাই দাঁড়িয়ে তামাশা দেখতে শুরু করে, আশেপাশের ছড়িয়ে যায় তাদের খবর।

এদিকে রোদ্দুর রাগের বশে রাফিনের শার্টের কলার চেপে ধরায় মাথা খারাপ হয়ে যায় রাফিনের। পুরনো রোগ ফিরে আসতে শুরু করে তার। মুহূর্তেই তার হেলুসিনেশন হতে থাকে যে তাকে সবাই পাগল বলে মজা করছে।
তাই রেগে গিয়ে এক ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় সে রোদ্দুরকে। আর পাশে পরে থাকা মাঝারি আকৃতির একটি লোহার রড তুলে নিয়ে আচমকা মা/র/তে শুধু করে সে রোদ্দুরকে। হঠাত মাথায় স্বজোরে এক আঘাত করতেই মাথা ফেটে জ্ঞান হারায় রোদ।

‘রোদ্দুর ভাইয়া….!’
দূর থেকে দৌড়ে ছুটে এসে রোদ্দুরের কাছে বসে পড়ে অধরা। রাফিনকে ইতিমধ্যে সবাই দূরে সরিয়ে দিয়েছে। হতভম্ব হয়ে অধরা একবার রোদ্দুরের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে ফিরে তাকায় রাফিনের দিকে।

–চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here