#আমার_হিয়ার_মাঝে
লেখিকা: তাহসীন নাওয়ার রীতি
পর্ব:২২
অতীতে,
ক্লাস শেষে আশ্বিনের জন্য বসে অপেক্ষা করছে অধরা। পুরো বিশ মিনিট মহাশয়ের ক্লাসের বাহিরে অপেক্ষা করে অবশেষে সে জানতে পারলো যে আশ্বিন আজ কলেজ আসেননি। মুহূর্তেই মেজাজ খারাপ হয়ে যায় অধরার। উনি যে আজ কলেজ আসবেন না এই কথা তাকে আগে বললে কি ক্ষতি হতো? রাগে অভিমানে সে একাই হেটে এসে ধপ করে বসে পড়লো মাঠের এক কোণে।
আজ সকাল থেকেই সূর্যের প্রকোপ বেশি, ভেঁপসা গরমে জীবন যাত্রা এক প্রকার অতিষ্ঠ প্রায়। এই রোদের মাঝেই অধরা বসে মনে মনে আশ্বিনকে বকে যাচ্ছে।
‘তুমিই আমার জান, তুমিই আমার প্রাণ। আমার জানেমান..।’
হঠাত পুরুষ কণ্ঠে কথাটা শুনে অধরা ভ্রু কুঁচকে ফিরে তাকায় পেছনে। একটি ছেলে একটি মেয়ের হাত ধরে বসে প্রেম ভালোবাসার গল্প করছে। ছেলেটির কথায় মেয়েটির মুখে লাজুক হাসি ফুটে উঠল। আর, অধরার চোখ মুখে ফুটে ওঠে কঠোরতা।
এই কাঠ ফাটানো রোদে বসে তাদের এমন প্রেমালাপ সহ্য হচ্ছে না তার।
তাই তাৎক্ষণিক একটা ধমক দিতেই ভয়ে দৌড়ে পালায় দুজন। তাদের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে।
‘শুধু শুধু বেচারার উপর রাগ দেখাচ্ছো কেনো? তারা তো তোমার কোন ক্ষতি করেনি।’
কে কথাটা বললো তা দেখার জন্য মাথা তুলে তাকাতেই একজন সুঠাম দেহের সুদর্শন যুবককে দেখতে পায় অধরা।
‘আপনি রাফিন শাহরিয়ার না?’
‘তার মানে চিনতে পেরেছো আমায়। গতকাল দেখা হয়েছিলো আমাদের।’
‘হুম।’
ছোট করে উত্তর দেয় অধরা। এই মুহূর্তে আশ্বিনের অনুপস্থিতি তাকে অভিমানী করে তুলেছে। কতো প্ল্যান ছিলো আজকে তার আশ্বিনকে নিয়ে, সব নষ্ট হলো!
‘আশ্বিনকে মিস করছো?’
অবাক হয় অধরা। বিস্মিত হয়ে ফিরে তাকিয়ে থাকে সে রাফিনের দিকে।
‘আপনি কিভাবে জানলেন?’
উত্তর দেয় না রাফিন। একটা রহস্যের হাসি দিয়ে পাশে বসে পড়ে অধরার।
‘বলুন না, আপনি কিভাবে জানলেন?’
‘অনুমান করে বলেছি। তাছাড়া, তোমার আর আশ্বিনের বন্ধুত্বের গল্প কলেজ জুড়ে সবার মুখে মুখে। সেই অনুযায়ী ভাবলাম..।’
আর কথা বলে না অধরা। থম মেরে বসে আছে সে। রাফিন আশেপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নেয়।
‘অবশ্য আমার ধারণা ব্যাপারটা কেবল বন্ধুত্বে স্থায়ি নেই। মনের কোণে কোথাও হয়তো অনুভূতি একে সাড়া দিচ্ছে। তাই না?’
নিশ্চুপ অধরা। ফ্যালফ্যাল করে শুধু তাকিয়ে আছে সে রাফিনের দিকে। রাফিন যা বলছে তা কি সত্যি? আশ্বিনের জন্য তার মনে বন্ধুত্ব গড়িয়ে অনুভূতির বাসা বাঁধতে শুরু করেছে? অন্য কেউ এই প্রশ্ন করলে হয়তো অধরা তাকে একহালি কথা শুনিয়ে দিতো। কিন্তু এখন সে হতবাক। এই প্রশ্নটি যেন তাকে নিজেই নিজে করছে সে। তবে তা এখন প্রকাশ করতে চাইছে না। তাই কথা পাল্টে ফেলার উদ্দেশ্যে বললো,
‘আপনার ক্লাস শেষ?’
‘হুম। বাসায় যাবো ভেবেছিলাম, দেখো তোমার পাশে বসে গল্পে জুড়ে বসেছি।’
‘আপনার এখানে কেমন লাগছে? মানে এই নতুন পরিবেশে? বন্ধু হয়েছে আপনার?’
‘পরিবেশ ভালোই। এতোগুলো বছর যেই মেডিকেলে পড়েছি, যেই বন্ধুদের দেখেছি সেই স্মৃতি কাটিয়ে এখানে মনোনিবেশ করা কঠিন হবে। তবে বন্ধু এখনও কেউ হয়নি।’
‘আপনি চাইলে আশ্বিন ভাইয়াকে বন্ধু বানাতে পারেন। আশ্বিন ভাইয়া খুবই মিশুক ছেলে।’
‘সম্ভব না।’
‘কেনো?’
‘কারণ শুনেছি আশ্বিন লেখাপড়ায় অনেক ব্রিলিয়ান্ট। আর মেধাবী সহপাঠীদের সাথে আমি বন্ধুত্ব করি না, প্রতিযোগীতা করি।’
চুপ করে কিছুক্ষণ বসে থাকে দুজন। অধরার মাথায় বারবার ঘুরপাক খাচ্ছে গতকাল হাসান স্যারের বলা কথাগুলো। দায়িত্ব যখন সে নিয়েছে তাহলে পালন তো তাকেই করতে হবে। সেই কথার জের ধরে সে বলে উঠলো।
‘তাহলে আমার সাথে বন্ধুত্ব করতে পারেন। আমি এতোটাও মেধাবী ছাত্রী না। তাছাড়া আপনার ক্লাসেও পড়ি না।’
উত্তরে হেসে উঠে রাফিন। মাথা নেড়ে বন্ধুত্বের হাত মিলিয়ে নেয় দুজন।
————–
দীর্ঘ দুই ঘন্টা যাবত আশ্বিন বোঝার চেষ্টা করছে অধরার তার উপর রাগের কারণ কি? কিন্তু কিছুতেই হিসাব মেলাতে পারছে না সে। লাইব্রেরিতে বসে চিপস খেতে খেতে আপনমনে বই পড়ছে অধরা। আশ্বিন তার মুখোমুখি বসে আছে একটি বই নিয়ে। যদিও পড়া হচ্ছে না তার।
‘কি এমন করেছি আমি? বলবে তো নাকি?’
ফিসফিস করে কথাটা বলেও লাভ হয়নি আশ্বিনের। অধরা এমন ভাব নিয়ে আছে যেন সে কিছুই শুনতে পারেনি।
‘আশ্বিন। এই টপিকটা একটু বুঝিয়ে দিবে আমায়?’
মহিলা কণ্ঠ শুনে আড়চোখে একনজর পাশে তাকিয়ে দেখে অধরা। আশ্বিনও মুচকি হেসে জবাব দিচ্ছে তাকে।
‘আরে ইতু, বসো। এই ক্লাসটা হয়তো তুমি পাওনি। সমস্যা নেই, আমি সাহায্য করছি।’
কথাটা বলেই আশ্বিন ইতুকে পড়া বোঝাতে শুরু করে। অধরা কান খাড়া করে সবটা শুনছে।
মেজাজ আবারও বিগড়ে গেলো বলে। কোথা থেকে উড়ে আসা মেয়ের পড়া কিনা মহাশয়ের বুঝিয়ে দিতে হবে। কেনো কলেজে স্যার কি নেই নাকি? আপনমনে কথাগুলো ভাবছে অধরা।
‘অনেক ধন্যবাদ তোমাকে আশ্বিন।’
‘আরে ব্যাপার না। বন্ধুই তো বন্ধুদের সাহায্য করবে।’
মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে চলে যায় মেয়েটি। আশ্বিন বই গুছিয়ে অধরার দিকে ফিরে তাকাতেই ভড়কে যায় সে। কঠোর ভাবে তাকিয়ে আছে সে তার দিকে।
‘কি হয়েছে? এভাবে কি দেখছো?’
‘দেখছি আর ভাবছি। পুরান পাগল ভাত পায়না এখন আবার নতুন পাগলের আমদানি।’
‘মানে কি?’
‘ওইয়ে, পেছনে ফিরে দেখুন।’
অধরার কথা মতো পেছনে ফিরে আশ্বিন দূরে বসে থাকা মারিয়াকে দেখতে পায়। তার দিকেই তাকিয়ে আছে সে।
‘মারিয়া আবার কি করেছে?’
‘কি আর করবে? আপনার পেছন তো মারিয়া ঘুরেই কুল কিনারা পাচ্ছে না। এখন আবার এই ইতু। ভালোই।’
‘আরে এসব কি বলছো? ইতু মোটেও এমন মেয়ে না। অনেক ভালো মেয়ে সে।’
থমকে যায় অধরা। কানের কাছে বেজে যাচ্ছে অনেক ভালো মেয়ে সে কথাটি। রাগ হচ্ছে তার। এখনি ইচ্ছে করছে মেয়েটির চুল ছিঁড়ে দিতে।
‘এতোই যখন ভালো মেয়ে, তাহলে আর দেরি করছেন কেনো? শুভ কাজে দেরি কিসের? আমিও অনেক দিন হলো কোন বিয়ে শাদি খাচ্ছি না।’
দাঁতে দাঁত চেপে কথাটা বলেই উঠে চলে আসে অধরা। আশ্বিন হতভম্ব হয়ে চেয়ে থাকে তার যাওয়ার দিকে। হঠাত কি হলো এই মেয়ের? কি এমন কারণ এই অদ্ভুত আচরণের?
রাগে দুঃখে একা হেঁটে আসতে গিয়ে কারো সাথে ধাক্কা খেতে গিয়েও নিজেকে সামলে নেয় অধরা।
‘সাবধানে চলাফেরা করবে না? কি নিয়ে এতো হাইপার হচ্ছো?’
মুখ তুলে তাকাতেই রাফিনকে দেখতে পায় সে। কিছুক্ষণ আমতা আমতা করেও কিছুই বলতে না পেরে বলে উঠে।
‘ইয়ে আসলে, আপনাকে আমার বন্ধুদের সাথে পরিচয় করানোর ছিলো। আমার মনে হয় সবাই মিলে আড্ডা দিতে পারলে আপনি সহজেই এই পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে পারবেন।’
‘ঠিক বলেছো। তো কোথায় তোমার বন্ধুরা?’
‘চলুন আমার সাথে।’
রাফিন আর অধরা পাশাপাশি যেতে শুরু করে।
এদিকে, আশ্বিন বই গুছিয়ে রেখে বেরিয়ে আসতেই রাফিন আর অধরার কথা বলে একসাথে চলে যাওয়া দেখে কিছুটা খটকা লাগে।
‘অধরা কবে থেকে রাফিনের সাথে মিশতে শুরু করলো?’
কথাটা চিন্তায় ফেলে দেয় তাকে। চোখের সামনে দিয়ে দুজন হেটে ক্যান্টিনের দিকে চলে গেল। বিষয়টা একদম ভালো লাগছে না তার। কেননা সে যতটুকু বুঝেছে, রাফিন ছেলেটা কিছুটা অস্বাভাবিক। হুটহাট সে মানুষের সাথে বাজে ব্যবহার করতেও পিছু পা হয়না।
অধরা মিশুক প্রকৃতির মেয়ে, যদি বন্ধুত্ব করতে গিয়ে কোন কারণে কষ্ট পায়। কথাটা মনে হতেই চুপ হয়ে যায় সে।
তাছাড়া, কেনো যেনো অধরার পাশে রাফিনকে তার সহ্য হচ্ছে না। তাই একবার তাদের পিছু যেতে চেয়েও থেমে যায় সে। নিরবে চলে যায় ক্লাসের উদ্দেশ্যে।
বিকেলে,
একটি রেস্টুরেন্টে পাশাপাশি বসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে আলোচনা করছে অধরা আর বন্ধুমহল।
‘তুই হঠাত ওই রাফিন ভাইয়ার সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলি কেনো?’
‘এটাই তোদের বলার ছিলো ইশা।’
‘কি?’
‘শোন সবাই। গতকাল হাসান স্যার আমাকে রাফিন ভাইয়ার ব্যাপারে কিছু কথা বলেছেন। রাফিন ভাইয়া এই মুহূর্তে বাকি দশ জন স্বাভাবিক মানুষদের মতো না। উনি উনার পরিবার হারানোর শোকে মানসিক ভাবে ট্রমায় আছেন। যার ফলে উনার ব্রেইনে ইফেক্ট ফেলেছে এসব।
বছর খানেক হলো উনি একটি রোগে আক্রান্ত। মানে উনি সারাক্ষণ স্বাভাবিক ভাবে থাকলেও, হঠাত উনি অল্প সময়ের জন্য মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে পাগলো শুরু করেন। আর ভয়ের ব্যপার হলো উনি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে গেলেও কি কি করেছেন সব ভুলে যান।’
‘কিহহ?’
অধরার কথায় চমকে উঠে সবাই।
–চলবে