আমার হিয়ার মাঝে পর্ব ১৭+১৮

0
782

#আমার_হিয়ার_মাঝে
লেখিকা: তাহসীন নাওয়ার রীতি
পর্ব:১৭

অধরা ধীর পায়ে হেঁটে হাসপাতালের ভেতর প্রবেশ করলো। আশ্বিনের হুটহাট এই কাজ তাকে লাজুক করে তুলেছে। কান দুটো গরম হয়ে আসছে তার। হয়তো আশেপাশের অনেকেই তাকিয়ে তাদের দেখছিলো। জনসমক্ষে এমন কাজ আশ্বিন কিভাবে করলো? আজ কোথায় ছিল সেই পুরনো লাজুক ছেলেটি?
————-

‘অধরা চলে এসেছে।’
জারিফ অনিক আর সাদমান একসাথে দাড়িয়ে ছিলো। অধরাকে দেখেই তারা এগিয়ে চলে আসে।
‘ইশা আসেনি? বাকিরা সবাই কি চলে এসেছে?’
‘হুম। ইশা আসছে, পথেই আছে। চল আগে স্যারের সাথে দেখা করে আসি। স্যার কিছু কথা বলবেন।’
জারিফের কথায় অধরা তাদের সাথে ভেতরে চলে আসে।

হঠাত ওয়ার্ডে চোখ যেতেই মারিয়াকে দেখতে পায় অধরা। মূহুর্তেই মেজাজ খারাপ হয়ে যায় তার। আসতে না আসতেই তাকেই কেনো দেখতে হবে। মারিয়া তখন রোগীর প্রেসার চেক করছে, দূর থেকে অধরাকে দেখতে পেয়ে মুখ ঘুরিয়ে নেয় সে। অধরাও এতে পাত্তা দেয় না। চলে আসে স্যারের কাছে। ক্লাসের সকলে দাড়িয়ে আছে এখানে, ইশাও চলে এসেছে এর মধ্যে।
‘আমি জানি তোমরা সব দায়িত্ব ভালোভাবে পালন করতে পারবে। তবুও যেহেতু এখনো তোমরা অনভিজ্ঞ, তাই কোন প্রয়োজন হলেই একে অপরের সাহায্য নিবে। মনে সাহস রাখবে। আর যথাসম্ভব ভালো কিছু শিখতে চেষ্টা করবে। বেস্ট অফ লাক।’
স্যার চলে যান সবাইকে বিদায় জানিয়ে। ক্লাসের সবাই গ্রুপ হয়ে নিজেদের কাজ বুঝে নিয়ে চলে আসে।

অধরা আর তার বন্ধুমহল একসাথে বারান্দা দিয়ে হেঁটে আসার সময় তাদের পথ আগলে দাঁড়ায় মারিয়া। মুখ ফুলিয়ে আছে সে। অধরা নির্বিকার।
‘তাহলে এখানেও চলে এসেছো আমাকে বিরক্ত করার জন্য?’
কপাল কুঁচকে ফেলে অধরা। এমন ভাবে বলছে যেন তার আর কাজ নেই মারিয়াকে বিরক্ত করা ছাড়া।
‘আপনাকে আমি বিরক্ত করি? একটু বলবেন আপু আমি আপনাকে কবে বিরক্ত করেছি?’
‘মুখে মুখে তর্ক করবে না অধরা। তোমার সাথে আমার অনেক বোঝাপড়া বাকি আছে। নেহাত এটা হাসপাতাল বলে এখন কিছু বলছি না। তবে তোমাকে আমি দেখে নিবো।’
পাশ কাটিয়ে চলে যায় মারিয়া। অধরা বাদে বাকি সবাই তাকিয়ে থাকে তার যাওয়ার দিকে।
‘এই মেয়ে নিজেকে কি মনে করে? আর কতো কাহিনী করতে চাইছে সে?’
জারিফের কথায় অধরা একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দেয়।
‘মারিয়া কখনোই দমে থাকার মেয়ে না। তার মাথায় কিছু না কিছু তো কাজ করছেই। দেখি এখন কি করে।’
————-

দুপুর গড়িয়ে বিকেল। প্রথম দিনের ডিউটি শেষে এখন সময় বাড়ি ফিরে যাওয়ার। হাসপাতাল থেকে বেরুতেই আশ্বিনকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে অধরা। হাতে লাল গোলাপের তোড়া।
‘আপনি শুধু শুধু কষ্ট করে আসলেন কেনো? আমি তো একাই যেতে পারতাম।’
প্রতিউত্তর দেয় না আশ্বিন। আলতো করে ফুলগুলো এগিয়ে দেয় অধরার দিকে। অধরা কথা না বাড়িয়ে তা হাতে তুলে নেয়। গাড়িতে এসে বসে দুজন। আশ্বিন ড্রাইভ করছে।
‘কেমন ছিল আজকের দিন?’
‘ভালোই ছিলো। আশ্বিন জানেন আপনি? তিন নম্বর ওয়ার্ডে আজ একজন বৃদ্ধ লোককে ভর্তি করানো হয়েছে। আমাদের গ্রুপের দায়িত্ব ছিল এই ওয়ার্ডের উপর। বৃদ্ধ লোকটা পথে এক্সিডেন্ট করায় গুরুতর আহত হয়েছেন, স্থানীয় লোকজন উনাকে নিয়ে এসেছে। অতপর উনার ফোন থেকে নম্বর বের করে উনার পরিবারকে জানানোর পর ঘন্টা খানেক পর তারা চলে আসে।’
কথাগুলো বলে অল্প থামে অধরা। একনজর ফিরে তাকায় আশ্বিন।
‘তারপর? উনার অবস্থা কি বেশি গুরুতর?’
‘হ্যা, কিছুটা। জ্ঞান নেই। আমার সবচেয়ে খারাপ লেগেছে উনার স্ত্রীকে দেখে। অনেকটা ভেঙে পড়েছেন উনি। কান্না করছিলো অনেক। বৃদ্ধ বয়স, তবুও নিজ হাতে উনার স্বামীর সেবা যত্ন করছেন।’
মন খারাপ হয় অধরার। আশ্বিন মুচকি হেসে বলে উঠে,
‘কষ্ট পেয়ো না। মনে সাহস রেখে চেষ্টা করো উনাকে সুস্থ করে তোলার।’
‘হুম।’
আর কথা বাড়ায় না দুজন। ইতিমধ্যে গাড়ি এসে থামে তাদের ফ্ল্যাটের সামনে। গাড়ি থেকে নেমে অধরা আশ্বিনের দিকে ফিরে তাকায়।
‘আপনি আসবেন না?’
‘না, আমার আজ নাইট ডিউটি আছে। তুমি রাতের খাবার খেয়ে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ো। রাত জেগে অসুস্থ হয়ে যেও না।’
উত্তর দেয় না অধরা। আশ্বিন আর দেরি না করে চলে যায় হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। হাতে থাকা ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অধরা।

আশ্বিনের জন্মদিন কাল। ভেবেছিলো রাতে ছোট খাটো একটা আয়োজন করে তাকে সারপ্রাইজ দিবে। কিন্তু তা আর হলো কোথায়? বিষন্ন মনে উপরে চলে আসে সে।
———–

ঘড়িতে রাত আটটা। পড়ার টেবিলে বসে আপনমনে পড়ছে অধরা। হঠাত পেছন থেকে কেউ একজন তাকে জড়িয়ে ধরায় চমকে উঠে সে। ভড়কে গিয়ে পেছনে ফিরে দেখে আরশি।
‘কেমন সারপ্রাইজ দিলাম ভাবি?’
‘অনেক বেশি। আমি তো চমকে গিয়েছিলাম।’
হেসে উঠে আরশি। তাদের কথার মাঝে দৌড়ে রুমে এসে উপস্থিত হয় টুসি।
‘মামি, খালামণি আসছে মামার জন্মদিন করার জন্য। কিন্তু মামা তো নাই।’
‘নেই মানে? ভাইয়া কোথায় গিয়েছে?’
অধরার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে আরশি। তিনজন একসাথে খাটে এসে বসেছে।
‘আজ নাইট ডিউটি উনার। রাতে ফিরবে না বলেছেন।’
‘মানে? আজই হতে হলো নাইট ডিউটি? রোদ কিছু করতে পারলো না?’
আফসোস হচ্ছে আরশির। বেচারি দূর থেকে একাই চলে এসেছে ভাইয়ের জন্য। এখন কিনা ভাই থাকবেই না!
‘আচ্ছা আরশি, তুমি আগে ফ্রেশ হয়ে এসো। তারপর কথা বলছি।’

মাথা নেড়ে হ্যা বুঝিয়ে চলে যায় আরশি। টুসি বসে আছে অধরার পাশে।
‘মামি, আমার মনে হয় আজকে মামা ইচ্ছা করেই আসবে না। যে কিপটা আমার মামা, মনে হয় খরচের ভয়ে লুকিয়ে আছে।’
হেসে উঠে অধরা। আলতো করে হাত বুলিয়ে দেয় তার মাথায়।
‘চিন্তা করো না টুসি বুড়ি। মামার জন্মদিন হবে। সারপ্রাইজ নাহয় আমরা হাসপাতালে গিয়েই দিবো।’
‘কিভাবে?’
একটা রহস্যের হাসি দেয় অধরা।
—————-

‘ভাবি তোমার মনে হয় আমাদের প্ল্যান সফল হবে? যদি এতরাতে আমাদের হাসপাতালে ঢুকতেই না দেয়? তখন কি?’
‘আগে যেয়ে তো দেখি কি হয়।’
আর কথা বাড়ায় না কেউ। টুসি আরশি আর অধরা রওনা দিয়েছে আশ্বিনের কাছে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। পথে একবার অধরা রোদ্দুরের সাথে কথা বলে সব ঠিকঠাক করে নেয়।

এদিকে,
আশ্বিন ওয়ার্ডে একবার ঘুরে এসে তার কেবিনে এসে বসেছে। পাশে বসে আছে রোদ্দুর, মনোযোগ তার ফোনের দিকেই।
‘আমার বোন নিশ্চয়ই এতো রাতে তোর সাথে গল্প করছে না। কাকে লাইন দিচ্ছিস আবার? দেখ আমার আরশিকে কষ্ট দিলে কিন্তু তোর খবর আছে রোদ।’
ভড়কে যায় রোদ্দুর। যার জন্য করলো চুরি, সেই বলে চোর! আশ্বিনের জন্মদিনের জন্য কোথায় সে প্ল্যান করছে, আর মহাশয় উল্টো তাকেই দোষ দিলো।
‘তুই কি ভালো হবি না? আমাকে কি মনে হয় তোর?’
প্রতিউত্তরে একটা রহস্যের হাসি দেয় আশ্বিন। রেগে যায় রোদ্দুর। ধুম করে একটা ঘা বসিয়ে দেয় আশ্বিনের পিঠে।
‘বউ রেখে প্রথম নাইট ডিউটিতে এসেছিস তো, তাই মন মেজাজ ভালো নেই তোর। তাই তোর কথায় আমি কিছু মনে করলাম না।’
একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দেয় আশ্বিন। মনে হয় বউ নিয়ে কতো সুখ শান্তিতে দিন পার করছে সে!
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রোদ্দুরকে কিছু বলতে নিবে তখনই কেবিনের দরজা নক করে কেউ। রোদ্দুর দরজা খুলে দিতেই আরশি এসে জড়িয়ে ধরে আশ্বিনকে। হতভম্ব হয় সে। আর যাই হোক বোনকে এতো রাতে এখানে আশা করেনি মহাশয়।
‘আরশি? তুই এতো রাতে এখানে? কখন এসেছিস?’
‘ভাইয়া..ভাবি..!’
কথাগুলো বলে জোরে জোরে শ্বাস নিতে থাকে সে। মাথা ঘুরে উঠে আশ্বিনের। অধরার কিছু হয়নি তো আবার?
‘কি হয়েছে অধরার? ঠিক আছে তো?’
মাথা নেড়ে না বুঝায় সে। চোখ মুখে কান্নার ছাপ।
‘ভাবি নিচে। তাকে নিয়ে এসেছি। জলদি চলো।’
এক মুহূর্ত দেরি করে না আশ্বিন। পাগলের মতো দৌড়ে নিচে যেতে শুরু করে সে। পিছু নেয় রোদ্দুর আর আরশি।
নিচে এসে গাড়ি পার্কিং এর কাছে টুসিকে দেখতে পায় আশ্বিন। ভ্যা ভ্যা করে কান্নায় ব্যস্ত সে।
‘টুসি, অধরা কোথায়? তোমার মামি কোথায়?’
উত্তর নেই টুসির। ভয়ে কান্নায় ব্যস্ত সে। কোনরকম হাত উঠিয়ে ইমার্জেন্সির দিকে ইশারা দিতেই তাকে নিয়ে চলে আসে এখানে।

সাদা বেডের উপর আধশোয়া অবস্থায় বসে আছে অধরা। একজন নার্স তার কপালে ব্যান্ডেজ করতে ব্যস্ত। আশ্বিন দৌড়ে চলে আসে এখানে।
‘কি হয়েছে তোমার? অধরা!’
‘কপালে একটু কেটে গিয়েছে। তেমন গুরুতর কিছু হয়নি।’
‘দেখি আমি…কিভাবে হয়েছে এসব?’
ধমকে উঠে আশ্বিন। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে তিনজন।
রোদ্দুরের মাথায় কিছুই ঢুকছে না। এই না ঘন্টা খানেক আগে ফোন করে বললো তারা আসছে? এর মাঝে কি এমন হলো?
টুসি ভয় পেয়ে আছে, হেঁচকি তুলে কান্না করছে সে।

‘আরশি, বলবি আমায় কিছু?’
‘ভাইয়া আমরা তিনজন তোমার জন্মদিন পালন করতে গাড়ি দিয়ে আসছিলাম। ভাবি ড্রাইভ করছিলো। হঠাত গাড়ির ব্যালেন্স হারিয়ে এলোপাথাড়ি চলতে শুরু করলো। আর তখন একটা ছোটখাট এক্সিডেন্ট হয়।’
‘কিহ?’
অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে সে অধরার দিকে। অধরা একটা মুচকি হাসি দেয়।
‘শুভ জন্মদিন আশ্বিন।’
রাগ হয় তার। এই সিরিয়াস মূহুর্তেও এই মেয়ে কিনা জন্মদিন নিয়েই আছে? রাগে দাঁতে দাঁত চেপে তাকিয়ে থাকে আশ্বিন। অধরা চুপচাপ। সাথে বাকিরাও চুপ।

–চলবে(ইনশাআল্লাহ)

#আমার_হিয়ার_মাঝে
লেখিকা: তাহসীন নাওয়ার রীতি
পর্ব:১৮

গাড়িতে পাশাপাশি বসে আছে অধরা আশ্বিন। তাদের পেছনে বসেছে আরশি আর টুসি। মধ্যরাতে অধরাকে নিয়ে ফ্ল্যাটের উদ্দেশ্যে ফিরে যাচ্ছে সবাই। অধরা সহ আরশি আর টুসি নিশ্চুপ। কেননা আশ্বিন সেই কখন থেকে গম্ভীর হয়ে আছে। কোন সাড়াশব্দ না করে আপনমনে গাড়ি ড্রাইভ করছে সে।
আড়চোখে একবার আশ্বিনের মুখ পানে ফিরে তাকায় অধরা। কোথায় ভেবেছিলো আশ্বিনকে সারপ্রাইজ দিবে, কিন্তু কি থেকে কি হয়ে গেল? এখন তারই নিজের কাজে এতোবড় সারপ্রাইজ পেয়ে গেলো সবাই।
কিন্তু অধরার প্রশ্ন হলো, গাড়ি হঠাত নষ্ট হলো কবে? আর কিভাবে? সে তো ভালো ভাবেই ড্রাইভ করছিলো!

‘এখানেই কি বসে থাকবে? নাকি উপরে যাবে?’
আশ্বিনের কথায় হুশ ফিরে অধরার। গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে তাদের ফ্ল্যাটের সামনে। আরশি আর টুসি ইতিমধ্যে গেইট দিয়ে প্রবেশ করে চলে গিয়েছে। একনজর আশ্বিনের দিকে তাকিয়ে দ্রুত নেমে চলে আসে অধরা। এই মুহূর্তে আর কথা বাড়িয়ে বকা খাওয়ার ইচ্ছে নেই তার।

‘এহন যদি বড় কোন ক্ষতি হইয়া যাইতো? তুমি ওই নষ্ট গাড়ি নিয়া কেন গেছিলা বউমণী?’
‘সেই গাড়িটা যে নষ্ট ছিলো সেটাই তো আমি জানতাম না খালা।’
অসহায়ভাবে কথাগুলো বলে মাথা নিচু করে ফেলে অধরা।
গাড়িটা আগে থেকেই নষ্ট ছিলো। অথচ সে জানতোই না। আজ তার ভুলের জন্যই টুসি আর আরশির বড় কোন ক্ষতি হতে পারতো। না জেনে না বুঝে সে কিভাবে এই বোকামি করলো ভাবতেই মাথা ঘুরে যাচ্ছে তার।
‘আইচ্ছা বাদ দেও, যা হওয়ার হইছে। ভাগ্য ভালা যে বড় কিছু হয় নাই। বউমণী তুমি যাইয়া এহন ঘুমাও। ঘরে যাও।’
অধরা মাথা নেড়ে চলে আসে রুমে। আশ্বিন তখন বারান্দায় দাঁড়িয়ে কার সাথে যেন ফোনে কথা বলছে, হয়তো রোদ্দুর। অধরা আর দেরি না করে চুপচাপ গিয়ে শুয়ে পড়ে খাটের এক পাশে। এই মুহূর্তে তার বকা শোনার বিন্দু মাত্র ইচ্ছে নেই। আর সারাদিনের পরিশ্রম মুহূর্তেই তাকে ঘুমের দেশে তলিয়ে নেয়।

‘ভাবি উঠে পড়ো। অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে তো। উঠো।’

আরশির ডাকে আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে অধরা। পিটপিট করে চোখ মেলে তাকিয়ে ঘড়ির কাঁটায় দশটা ত্রিশ বাজতে দেখে চমকে উঠে সে।
‘এতো দেরি হয়ে গিয়েছে? অথচ আমি ঘুমিয়েই ছিলাম? আমার তো ক্লাস মিস হলো আজ।’
‘আরে চিন্তার কিছু নেই ভাবি। কাল রাতে ঘুমের ঔষধ খেয়েছিলে তাই উঠতে দেরি হয়েছে, ব্যাপার না। আর কলেজ নিয়ে তুমি একদম ভাববে না। ভাইয়া সকালে উঠেই তোমার কলেজ গিয়ে সাতদিনের ছুটি নিয়ে এসেছে।’
থতমত খেয়ে যায় অধরা। সাতদিনের ছুটি মানে? হঠাত করেই আশ্বিন তার ছুটি নিয়ে আসলো কেনো?
‘মানে? ছুটি কিসের?’
‘কিসের আবার? আমরা সবাই তো একটু পর ময়মনসিংহ রওনা দিচ্ছি। মা খুব রেগে আছে ভাইয়ার উপর। এক্ষুনি যেতে বলেছে সবাইকে। সকালে ফোন করে ভাইয়াকে অনেক বকেছে মা। কেনো ভাইয়া নষ্ট গাড়ি ঠিক না করে রেখে দিলো, তাই তোমার এই দূর্ঘটনা হয়েছে।’
‘কিন্তু, এখানে উনার কি দোষ ছিলো? আমারই জানা উচিত ছিল যে..।’
‘আরে ভাবি বাদ দাও না। জলদি ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে নাও। ভাইয়া হাসপাতাল থেকে চলে আসলেই সবাই রওনা দিবো।’
চলে যায় আরশি। মুখটা ভাড় করে বসে থাকে অধরা। বেচারা আশ্বিন মহাশয়, তার জন্য জন্মদিনের শুভেচ্ছা শোনার পরিবর্তে এখন বকা শুনে যাচ্ছেন।
অধরা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওয়াশরুমে চলে আসে।
—————-

গাড়ি থেকে নেমে অধরা বাদে সবাই চলে গিয়েছে বাসার ভেতর। আশ্বিন গাড়ি থেকে ব্যাগ পত্র বের করছে। অধরা চুপচাপ পাশে দাঁড়িয়ে আছে তার।
মহাশয় গতকাল রাত থেকে একটি কথাও বলছেন না। অনেক রেগে আছে হয়তো।
সে যে মহাশয়ের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে সেদিকে খেয়াল নেই আশ্বিনের। ব্যাগ হাতে নিয়ে ধীরে ধীরে বাসার দিকে এগিয়ে যায় সে। পিছু নেয় অধরা, সেও আগ বাড়িয়ে কথা বলছে না। না জানি কখন আবার ধমক দিয়ে উঠে।

‘এইতো চলে এসেছে আমার মেয়েটা। দেখি তো মাথায় কতটা ব্যথা পেয়েছো?’
আশ্বিনের মা দৌড়ে এসে অধরাকে জড়িয়ে ধরে তার কপালের আঘাত দেখতে থাকে।
‘মামুনি, আমি ঠিক আছি।’
‘একদম কথা বলবি না। আমি দেখতেই পাচ্ছি কেমন ঠিক আছিস। তোর মা বাবা এখন কি বলবে বল তো?’
‘মামুনি, এতো অস্থির হওয়ার কিছু নেই। আমি একদম ঠিক আছি। এটা তো সামান্য ব্যাপার। চলো বাবার সাথে দেখা করি।’
মামুনির হাত ধরে অধরা প্রবেশ করে ভেতরে। পুরো বাড়ি জুড়ে আশ্বিনের প্রিয় সব খাবারের সুগন্ধ! বুঝতে আর বাকি নেই, মামুনি উনার ছেলের জন্মদিন উপলক্ষে বড় সড় আয়োজন করে রেখেছেন।

‘বুঝলি মা? ভেবেছিলাম আরশি তোদের আজ এখানে নিয়ে আসলে আশ্বিনের জন্মদিন উপলক্ষে একটা ফ্যামিলি গেট টুগেদার করবো। অনেক দিন বাসায় কোন আয়োজন হয়নি। তাছাড়া তোদের বিয়ে যেভাবে হুট করে হলো কেউ তো তোকে এখনও দেখতেই পায়নি। তাই আমি আর তোর মা মিলে কত সব ভেবে রেখেছিলাম।’
অধরা নিশ্চুপ। মামুনির সাথে রান্নাঘরে এসে খাবারের আয়োজন দেখছিলো সে। তখন ড্রইং রুম থেকে আশ্বিন আর বাবার কণ্ঠস্বর শোনা যায়। হেসে গল্প করছে দুজন।
প্রথম দিন থেকে দেখে এসেছে এই বাবা ছেলের মাঝে অনেক মিল। দুজন যেন একে অপরের বন্ধু!
‘কি ভাবছিস?’
‘কিছু না মামুনি। তো কখন আসবে সব মেহমান?’
‘বিকেলে আসার কথা ছিল। কিন্তু আশ্বিনের বাবা চাইছে না এই আয়োজন করতে। তোর এই অবস্থা…!’
‘মামুনি আমি সত্যিই ঠিক আছি তো। আমাকে নিয়ে এতো অস্থির হয়ো না। আশ্বিনের জন্মদিন বারবার আসবে না, তাছাড়া উনার গতকাল থেকে মন ভালো নেই। সবার মাঝে থাকলে হয়তো উনারও ভালো লাগবে।’
মুচকি হেসে সম্মতি জানায় আশ্বিনের মা। অধরাকে ফ্রেশ হতে বলে হাতের কাজগুলো গোছাতে শুরু করেন উনি।
————–

অতিথিদের ভীড়ে পুরো বাড়ি টইটম্বুর। সবাই মূলত এসেছে নতুন বউ দেখার উদ্দেশ্যে। অধরা বিকেল থেকেই ব্যাস্ত, প্রতিটি সদস্যের সাথে পরিচয় হয়ে কুশল বিনিময় করতে হচ্ছে তাকে। অথচ শত ব্যস্ততার মাঝেও বারবার চোখ ঘুরিয়ে খুঁজে চলেছে সে আশ্বিনকে।
মহাশয় সেই যে সমবয়সী কিছু ভাইদের পেয়ে গল্পে মেতে উঠে ছাদে চলে গিয়েছে, ফিরে আসার আর খবর নেই।

‘অধরা মা, সব ঠিকঠাক আছে তো?’
‘হুম। তুমি কোথায় ছিলে আম্মু? তোমার তো এখানে এসে সবার আগে আমার সাথে দেখা করার দরকার ছিলো।’
‘আমি তো দেখা করতেই চেয়েছিলাম। কিন্তু তোমার শাশুড়ি আশাকে চেনো না? আসার পর থেকেই যেভাবে গল্প শুরু করলো!
যাই হোক, কলেজে সব ঠিক আছে তো? আশ্বিনের সাথে মানিয়ে নিতে সমস্যা হচ্ছে না তো? আসলে এভাবে হুট করেই বিয়ে হলো তাই..।’
কথাগুলো বলে কিছুক্ষণ চুপ থাকে অধরার মা। একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দেয় অধরা।
‘এখন এসব কথা বলা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন আম্মু। বিয়ের আগে তো একবারও আমার মতামত নেওয়ার প্রয়োজন মনে করলে না তোমরা। এখন বিয়ে হয়েছে আল্লাহ্‌র ইচ্ছায়, আমার ভাগ্যে যেভাবে লেখা ছিলো সেভাবেই। তাই সবটা মেনে নিয়ে তো এগিয়ে যেতে হবে। তাই না?’
‘এর মানে? তবে কি, তুমি আশ্বিনের সাথে ভালো নেই মা?’
অধরা প্রতিউত্তরে কিছু বলতে যাবে তার আগেই দেখে আশ্বিনের বাবা পাশ কাটিয়ে চলে গেলেন। থমকে যায় অধরা। বাবা কি তবে সব শুনে ফেললেন? এখন উনি কি ভুল বুঝবেন তাকে!
চিন্তায় পড়ে যায় অধরা। মায়ের দিকে একনজর তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস নেয় সে।

ছাদের এক কোণে বসে আছে অধরা। রাতের খাওয়া শেষে অনেকেই চলে গিয়েছেন। এখন শুধু মামুনির কিছু বান্ধুবী মিলে বসে আড্ডা দিচ্ছেন। এতোক্ষণ ধরে সবার মাঝে থেকে মাথা ধরে আসছে তার। তাই ছাদে এসেছে খোলা আকাশের নিচে বাতাস উপভোগ করতে।
আকাশে চাঁদের দেখা নেই, কালো মেঘে মেঘাচ্ছন্ন। একটা বেঞ্চে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে একমনে। হঠাত পাশে কারো উপস্থিতি পেয়ে অধরা পাশ ফিরে দেখে আশ্বিনের বাবা।
‘একা বসে আছিস কেনো মা? খারাপ লাগছে?’
‘না বাবা। এমনি বসে আছি।’
‘বুঝেছি। আমার মেয়েটাও আশ্বিনের মতোই কোলাহল মুক্ত! ঠিকই আছে, সবাই যদি তোমার মামুনির মতো বাচাল হয় তবে কারো মাথা ঠিক থাকবে নাকি?’

হেসে উঠে দুজন। পাশাপাশি বসে নিরবে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে বাবা। অধরা নির্বিকার। অনেক কথাই সে বলতে চাইছে বাবাকে।
‘বাবা আসলে..।’
কথাটা আর শেষ করা হয়নি অধরার। বাবার কথার প্রতিউত্তরে থমকে যায় অধরা।
‘আমি জানি মা তুমি কি বলতে চাইছো। আশ্বিনের সাথে তোমার সম্পর্কটা যে এখনও স্বাভাবিক না, সেটা আমি জানি। একটা ভুল বোঝাবুঝি কিভাবে দুজনের মাঝে দূরত্ব তৈরি করেছে…!’
কথাগুলো বলে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাবা। অধরা হতভম্ব! তারমানে বাবা সব জানেন? কিভাবে জানলেন এইসব কথা?
‘বাবা, আপনি…?’
অধরার প্রশ্নে হালকা হেসে উঠে বাবা। আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে উঠে..

–চলবে(ইনশাআল্লাহ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here