#আমার_হিয়ার_মাঝে
লেখিকা: তাহসীন নাওয়ার রীতি
পর্ব:১৩
কাক ভেজা অবস্থায় পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে অধরা আশ্বিন। তাদের সামনে দাঁড়ানো রাশেদা খালার চোখ মুখে বিস্ময়! খালার পেছনে দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হেসে যাচ্ছে টুসি।
‘এই রাইতের বেলায় ছাদে গিয়া বৃষ্টিতে ভিজা লাগলো কেন? এখন তো অসুখ হইবো।’
লজ্জায় মাথা কা/টা যাচ্ছে অধরার, নতজানু হয়ে আছে সে। আশ্বিন নির্বিকার ভাবে দাঁড়িয়ে। যেনো কিছুই হয়নি।
অথচ কিছুক্ষণ আগেই কি সাবধানতার সাথে লুকিয়ে অধরা ঘরে প্রবেশ করছিলো, মহাশয়ের জন্য সব ভেস্তে গেলো।
‘খালা, তোমার বউমণীর ইচ্ছে করছিল বৃষ্টিতে ভিজতে। তাই আমাকেও জোর করে নিয়ে গিয়েছে।’
বিস্ফারিত দৃষ্টিতে অধরা ফিরে তাকায় আশ্বিনের দিকে। কোন কালে সে এরূপ কথা বলেছিলো? এতো বড় মিথ্যা অভিযোগ তার নামে?
মহাশয় কি চতুরতার সাথে নিজেকে বাঁচাতে খালার সামনে তাকে দোষী সাব্যস্ত করলেন। এ কি সাংঘাতিক ব্যাপার!
‘আইচ্ছা ব্যাপার না। নতুন নতুন বিয়া হইলে এমনই হয়। যাও ভেজা কাপড় পাল্টায় ফেলো, নাইলে পরে ঠান্ডা লাগবো।’
ধীর পায়ে হেঁটে নিজের ঘরের দিকে এগিয়ে যায় খালা। টুসি এখনও দাঁড়িয়ে, দুজনের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হেসে যাচ্ছে।
‘মামি আসার পর দেখি মামার ভালোই পরিবর্তন হয়েছে। মামা চালিয়ে যাও..।’
আর বলা হয়নি টুসির। আশ্বিন তাড়া করতেই দৌড়ে পালিয়ে যায় সে।
অধরা তাকিয়ে আছে আশ্বিনের দিকে কড়া চাহনিতে। এতো বড় মিথ্যে বলেও উনার কোনরকম অনুশোচনা নেই। আশ্চর্য ব্যাপার!
রান্নাঘরে এসেই চুলায় চা বসিয়ে দিয়েছে অধরা। ইতিমধ্যে ঠান্ডা লাগিয়ে ক্রমাগত হাঁচি দিতে শুরু করেছেন আশ্বিন মহাশয়। ছোট থেকেই নাকি উনার অল্পতেই ঠান্ডা জ্বর আসে। অথচ এ কথা জেনেও উনি কি নির্বিকার ভাবে বৃষ্টিতে ভিজেছেন। অধরা বুঝে পায় না মানুষ কিভাবে জেনে শুনে অসুস্থ হতে চায়?
দুকাপ লেবু চা নিয়ে অধরা রুমে প্রবেশ করে। আশ্বিন এর মাঝেই কাঁথা মুড়ি দিয়ে খাটে হেলান দিয়ে বসে আছেন।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে অধরা, এগিয়ে গিয়ে চায়ের কাপ তার হাতে দেয়।
‘কি দরকার ছিল বৃষ্টিতে ভেজার?’
মুচকি হাসি দেয় আশ্বিন। চোখ মুখ লালচে বর্ণ ধারণ করেছে ইতিমধ্যেই।
‘তোমার সাথে আবারো বৃষ্টি বিলাস করার অনেক ইচ্ছে ছিলো। সেই ইচ্ছে পূরণ করেছি, আর ফল স্বরূপ এই হাঁচি..।’
বিরক্ত হয় অধরা। অসুস্থ হয়েও উনার সাহিত্য কথা যাচ্ছে না। এভাবে জোর করে নিজেকে রোমান্টিক বর সাব্যস্ত করার কি খুব প্রয়োজন?
‘চা খেয়ে নিন। রাতের খাবারের পর ঔষধ খেয়ে নিলে আশা করি জ্বর আসবে না।’
বাধ্য ছেলের মতো চায়ের কাপে চুমুক দেয় আশ্বিন। পাশে বসে অধরা একনজর ফিরে তাকায় তার দিকে। প্রকাশ করছে না তবে তাদের মাঝে সেই ভুল বোঝাবুঝির পর আর একসাথে বৃষ্টি ভেজা হয়নি দুজনের।
অধরারও যে খুব ইচ্ছে ছিল আশ্বিনের হাতে হাত রেখে বৃষ্টি বিলাস করার। তখন অবশ্য ভাবেনি যে তার ইচ্ছে অচিরেই পূরণ হতে যাচ্ছে। আনমনে হেসে উঠে সে।
————-
ভোরের কিরণ এসে হানি দিচ্ছে চারদিকে। জানালা ভেদ করে আসা সেই আলো আশ্বিনের চোখে পড়ার আগেই ঘরের পর্দা টেনে দেয় অধরা। বেচারা শেষ রাতে তীব্র জ্বরে কাতর ছিলো। ঘুমের মাঝে আশ্বিনের গায়ে হাত রেখে সেই তাপমাত্রা অধরাকে চমকে দিয়েছে।
ফল স্বরূপ, মহাশয়ের ইচ্ছে অনুযায়ী রাত জেগে উনার কপালে রুমাল ভিজিয়ে দিতে হয়েছে অধরার।
মহাশয় তখন অচেতন অবস্থায় থাকলেও অধরার কেনো জানি মনে হয়েছে আশ্বিন মিটিমিটি হেসে যাচ্ছিলো। আচ্ছা জ্বরের ঘোরেও কি কেউ হাসে?
সকাল সকাল রান্নাঘরে এসে উপস্থিত হলো সে। রাশেদা খালা এর মাঝেই সকালের নাস্তা তৈরির প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
‘বাজানের জ্বর উঠছে বউমণী?’
‘জি খালা। কাল রাতে জ্বর বেড়ে গিয়েছিলো, এখন একটু সুস্থ আছেন।’
‘আমাকে ডাকলা না কেন? বাজানরে সেই ছোট থেকে দেখতাছি বৃষ্টিতে ভিজলেই অসুখ করে। চিন্তা কইরো না ঠিক হইয়া যাইবো।’
মাথা নেড়ে হ্যা বোঝায় অধরা। ঘড়ির দিকে একবার তাকিয়ে নেয়। আজ আর কলেজ যাওয়া হবে না তার। এই মুহূর্তে আশ্বিনের পাশে থাকাটা তার প্রয়োজন।
তবে ভালো হতো যদি একবার রোদ্দুরের সাথে দেখা করে কথা বলা যেতো। কিন্তু আপাতত এই বিষয়ে কোন কিছু ভাবছে না সে।
‘বাজানের জন্য কি নাস্তা তৈরি করমু?’
একটু ভাবুক হয়ে পড়ে অধরা। তার জানা আছে আশ্বিনের প্রিয় খাবার কি! তাই মুচকি হেসে কাজে লেগে যায় দুজন। কাজের মাঝেই মনে পড়ে যায় অতীতের স্মৃতি…।
——————–
অতীতে,
হোস্টেল থেকে কেউ অধরার পিছু নেয়, ঘটনাটা চরমভাবে ভীতির সঞ্চার করেছে অধরার মনে। যার ফলে আজ দুদিন হলো সে হোস্টেল থেকে বের হয়নি। যদিও ইশা তাকে ভরসা দিয়ে বলেছিলো হোস্টেল সুপার রুমি ম্যামকে জানানো হয়েছে, আর কোন সমস্যা নেই। তবুও অধরার মন সায় দিচ্ছে না। কারা কেনো এভাবে তার পিছু নিচ্ছে? তাকে কেনো ধরতে চাইছে?
‘অধরা চল আজ কলেজ যাই। ক্লাসগুলো ইমপরটেন্ট, এভাবে মিস দেওয়া ঠিক হচ্ছে না।’
‘যদি আবারো সমস্যা হয় কোন?’
‘মনে হচ্ছে না আর কিছু হবে। তাছাড়া জারিফ, সাদমান আর অনিক বাহিরে দাড়িয়ে আছে। চল সাহস করে রওনা দেই, বাকিটা আল্লাহ ভরসা।’
সম্মতি দেয় অধরা। সত্যিই তো, এভাবে কদিন সে হোস্টেলে বসে থাকবে? তাই ইশার কথায় তাদের সাথে কলেজের উদ্দেশ্যে রওনা দেয় সে।
‘অধরার সাথে তাদের কিসের শত্রুতা? কেনো এই পিচ্চি মেয়েটাকে এভাবে ভয় দেখাতে চাইছে তারা? কিছু জানতে পেরেছিস তুই?’
‘গতকাল রাতে আমার গার্ড ছেলেগুলোকে ধরে ফেলেছে। তারা নিজ মুখে স্বীকার করেছে, কেউ একজন তাদের টাকা দিয়েছিলো অধরাকে ভয় দেখিয়ে এখান থেকে ফিরে যেতে বাধ্য করতে। ভাগ্য ভালো সঠিক সময়ে তাদের ধরে ফেলেছি। কিন্তু এদের পেছনে আসল অপরাধী কে, সেটা এখনও জানা যায়নি। তিনজনের কেউ তার চেহারা দেখেনি, শুধু একটা মেইল আর কিছু টাকা পাঠিয়ে ছিলো তাই।’
‘অধরার কোন পারিবারিক শ/ত্রু কি এমন করেছে?’
‘জানি না রোদ। তবে আমি সতর্কতার জন্য গার্ড ঠিক করেছি, তারা অধরাকে আড়াল থেকে দেখে রাখবে। বিষয়টা গোপন রাখিস, কেউ যেন না জানে।’
হেসে উঠে রোদ্দুর। প্রিয় বন্ধুর ইদানিং ভালোই পরিবর্তন হচ্ছে। লক্ষণ ভালো না, প্রণয়ের সূচনা নয় তো?
‘কি ব্যাপার বল তো আশ্বিন! কদিন ধরে দেখছি অধরা নিয়ে তুই অনেক সিরিয়াস। আমি কি ধরে নিব যে..।’
থেমে যায় রোদ। কপালে ভাঁজ পড়ে আশ্বিনের। সেদিনের পর থেকে রোদ উঠতে বসতে তাকে আর অধরাকে নিয়ে খোঁটা দিয়েই চলেছে। রাগ হলো তার, কিছু বলতে নিবে তার আগেই..।
‘আশ্বিন ভাইয়া..!’
গেইট দিয়ে প্রবেশ করেই দৌঁড়ে ছুটে আসে অধরা। আশ্বিন মুচকি হেসে তার মাথার চুলগুলো এলোমেলো করে দেয়।
‘এতোদিন পর তাহলে আসা হলো..। আজ কোন সমস্যা হয়নি তো আসতে?’
‘না। সব ঠিকঠাক ছিলো। আমরা সবাই একসাথে এসেছি।’
‘ভালো করেছো। এখন ক্লাসে যাও। ক্লাস শুরু হয়ে যাবে তোমাদের।’
মাথা নেড়ে সম্মতি দিয়ে চলে যায় অধরা। আশ্বিন তার যাওয়ার দিকে লক্ষ্য করে দূর থেকে মারিয়া তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। এই কদিন বারবার আশ্বিনের আশেপাশে ঘুরঘুর করেও কোন পাত্তা পায়নি সে।
মারিয়ার আচরণ তার ভালো লাগে না, তাই যতটুকু সম্ভব তাকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে। আশ্বিনের দৃষ্টি অনুসরণ করে রোদ্দুরও ফিরে তাকায় মারিয়ার দিকে। মারিয়ার চোখ মুখে স্পষ্ট রাগের ছাপ।
‘বাই এনি চান্স, এসব মারিয়ার কাজ নয় তো?’
চমকে উঠে ফিরে তাকায় আশ্বিন। খানিক চিন্তা ভাবনা করেও এর পেছনে মারিয়ার কাজ বলে মনে হচ্ছে না তার।
‘আরে না! মারিয়া এমন কেনো করবে? তাছাড়া অধরার সাথে মারিয়ার কিসের শত্রুতা?’
দমে যায় রোদ্দুর। হয়তো ঠিক বলছে আশ্বিন। না জেনেই কাউকে দোষারোপ করা ঠিক হবে না। তাই সকল চিন্তা বাদ দিয়ে দুজন চলে যায় ক্লাসের উদ্দেশ্যে।
—————–
ক্লাস শেষে অধরা আর তার বন্ধুমহল যাচ্ছে ফুচকা খাওয়ার উদ্দেশ্যে। কলেজ গেটের বাইরে এসে রোড ক্রস করতেই হঠাত সেদিনের ওই ছেলেগুলো অধরার সামনে এসে হাজির হয়। মুহূর্তেই চমকে যায় অধরা। ভয়ে এক চিৎকার করে জারিফ অনিক আর সাদমানের পেছন গিয়ে লুকিয়ে পড়ে সে।
‘আপু আমাদের আর ভয় পাবেন না। আমরা আসলে সেদিনের আচরণের জন্য আপনার কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছি।’
ভয়ে গুটিসুটি হয়ে অধরা তাদের আড়াল থেকে উঁকি দিয়ে তাদের দেখছে। আজ ছেলে তিনজনের চোখ মুখে অনুশোচনা। জারিফ আর অনিক গিয়ে তাদের সাথে ঝামেলা করতে চাইলে..।
‘আমাদের ভুল হয়েছিলো ভাই। তাই আমরা নিজেদের ভুল স্বীকার করতে এসেছি। আশ্বিন ভাইয়ের সাথে আমাদের কথা হয়েছে। আর কখনো এমন হবে না।’
খানিকটা চমকে উঠে অধরা। আশ্বিন! উনি তাহলে এদের ধরেছেন? কিন্তু কিভাবে? আর কি এমন করেছেন যে তারা নিজ থেকে এসে অধরার কাছে ক্ষমা চাইছে? এসব প্রশ্ন ভাবাচ্ছে অধরাকে।
ফুচকার দোকানে বসে সবার কথা শুনে যাচ্ছে অধরা। আশ্বিন তার জন্য এতসব করলো ব্যাপারটা নিয়ে সবাই খোঁচা দিচ্ছে তাকে। অধরা নীরবে সবটা শুনে যাচ্ছে, যেন তার কোন প্রতিক্রিয়া নেই। আপনমনে ফুচকা মুখে পুরে যাচ্ছে সে।
‘আরে একা একাই খাবে নাকি তোমরা?’
হঠাত কারো কথা শুনে সবাই পাশে ফিরে তাকায়। রোদ্দুর আর আশ্বিন এসে তাদের পাশে বসেছে।
‘আরে রোদ ভাই, আপনাদের অপেক্ষায় ছিলাম। মামা আরো দুই প্লেট ফুচকা দিয়ে যান।’
সাদমানের কথায় মুহূর্তেই ফুচকার প্লেট হাতে নিয়ে হাজির হয় দোকানের ছোটু।
সবাই নিজেদের মতো গল্প গুজব করে খেয়ে চলেছে। কিন্তু বিপত্তি হয়েছে আশ্বিনের, অতিরিক্ত ঝাল খাওয়ায় সে কখনো অভ্যস্ত নয়। তাই দুটো ফুচকা খেয়েই সে প্লেট হাতে নিয়ে চুপচাপ বসে আছে। ইশা কয়েকবার লক্ষ্য করে তার গতিবিধি।
‘ভাইয়া, সব ঠিক আছে তো? কোন সমস্যা?’
‘না না। কোন সমস্যা নেই।’
আর কথা বাড়ায় না ইশা। যে যার মতো করে খাওয়া শেষ করে বিল মিটিয়ে চলে যায়। শুধু থেকে যায় অধরা আর আশ্বিন। বেশি ঝাল খাওয়ায় এর মাঝেই আশ্বিনের চোখ মুখ কাল গরম হয়ে গিয়েছে। তবুও কোন টু শব্দ করছে না সে।
অধরা একনজর তার দিকে তাকিয়ে দৌড়ে গিয়ে একটা আইসক্রিম কিনে নিয়ে আসে। আশ্বিনের দিকে তা এগিয়ে দেয়।
‘ধন্যবাদ।’
‘আশ্বিন ভাইয়া, একটা কথা বলি?’
‘হুম বলো।’
‘ওই ছেলেগুলোকে আপনি কিভাবে ধরলেন? আমার কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছিলো। আপনি কি সত্যিই সিনেমার নায়কদের মতো তাদের মে/রে তক্তা বানিয়ে দিয়েছেন?’
ভ্রু কুঁচকে ফিরে তাকায় আশ্বিন। খাওয়া বন্ধ করে অধরার মাথায় আলতো করে বাড়ি দেয় সে।
‘সবসময় মাথায় এসব চিন্তা ভাবনা ঘুরে তোমার? আমি কেনো তাদের মা/র/বো? তাছাড়া তাদের গায়ে কি তুমি আঘাতের চিহ্ন দেখেছো কোন? আমি শুধু তাদের সাথে কিছু জরুরি কথা বলেছি..আর তোমার কাছে ক্ষমা চাইতে বলেছি। ব্যাস, এইটুকুই।’
চোখ ছোট ছোট করে অধরা ফিরে তাকায় আশ্বিনের দিকে।
এইটুকুই? অথচ কি না কি ভেবে বসে ছিল সে। আর বাস্তবে তার কুল কিনারা পর্যন্ত যায়নি ঘটনা। অবশ্য ঠিকই আছে। আশ্বিন শান্তশিষ্ট প্রকৃতির মানুষ, তার পক্ষে কখনই রাগারাগি, মা/র/ধ/র করা সম্ভব না। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দুজন পাশাপাশি হাঁটতে শুরু করে রাস্তার পাশ ধরে।
–চলবে(ইনশাআল্লাহ)
#আমার_হিয়ার_মাঝে
লেখিকা: তাহসীন নাওয়ার রীতি
পর্ব:১৪
ক্লাসে বসে নিজেদের পড়া ঠিকঠাক করছে আশ্বিন আর রোদ্দুর। কিন্তু আশ্বিনের চোখ বারবার যাচ্ছে সামনে বসে থাকা ছেলেটির দিকে। মেডিকেলে পড়ার এতগুলো বছরেও তো এই ছেলেকে কোনদিন তাদের ক্লাসে দেখেনি সে। তবে আজ হঠাত তাদের ক্লাসে কি করছে?
‘আশ্বিন! ধ্যান কোথায় তোর? কখন থেকে বলছি এই টপিকটা বুঝিয়ে দে আমায়। শুনছিস না?’
‘খেয়াল করিনি। আচ্ছা রোদ, ওই ছেলেটা কে? মাহিনের পাশে বসে আছে যে।’
রোদ্দুর ফিরে তাকায় ছেলেটার দিকে। বুঝতে আর বাকি নেই, আশ্বিনও ছেলেটিকে দেখে তার মতোই অবাক হয়েছে।
‘ছেলেটার নাম রাফিন। হাসান স্যারের কেমন যেন পরিচিত হয়। শুনেছি কোন এক সমস্যার কারণে মাইগ্রেশন নিয়ে রাজশাহী থেকে এখানে এসেছে।’
‘এই ফাইনাল ইয়ারে মাইগ্রেশন? আমাদের ইন্টানশিপ তো আর কয়মাস পর থেকেই শুরু হবে। শেষ মুহূর্তে এসে মাইগ্রেশন নেওয়ার কি প্রয়োজন ছিল?’
‘হাসান স্যারই ভালো জানেন। তবে ছেলেটা কেমন যেন, খুব গম্ভীর। কথা বলতে গিয়েছিলাম আমি, আমার কোন প্রশ্নের উত্তরই দিলো না।’
ভ্রু কুঁচকে দূর থেকে রাফিনের দিকে ফিরে তাকায় আশ্বিন। কোন ভাবেই হিসেব মেলাতে পারছে না সে। কেমন যেন খটকা লাগে তার। তবুও আর চিন্তা না করে নিজের পড়ায় মনোযোগ দেয়।
লাইব্রেরি থেকে বেরুতেই আশ্বিন অধরাকে হাসান স্যারের রুম থেকে বেরিয়ে আসতে দেখে। মুহূর্তেই কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে তার। নিশ্চয়ই আবার বকা খেয়ে এসেছে এই মেয়ে। না জানি আজ কোন কান্ড ঘটিয়ে এসেছেন উনি!
এদিকে অধরা স্যারের রুম থেকে বেরিয়ে আসতেই দূর থেকে আশ্বিনকে দেখে হেসে উঠে দৌঁড়ে এদিকেই আসতে থাকে। তখনই পাশ কেটে একটি ছেলে দৌড়ে যাওয়ার সময় অধরাকে ধাক্কা দেওয়ার সে নিচে পড়ে যায়। দূর থেকে আশ্বিন তা দেখতে পেয়ে দৌড়ে এদিকে এগিয়ে আসতে থাকে।
‘পাজি ছেলে! কতো বড় সহস আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে, আবার সরি না বলেই চলে গেলো!’
অধরা হাত ঝাড়তে ঝাড়তে ছেলেটির যাওয়ার দিকে রেগে তাকিয়ে থাকে। ঠিক তখনই একটি হাত অধরার দিকে এগিয়ে আসায়, অধরা কপাল কুঁচকে মুখ তুলে তার দিকে ফিরে একটি অপরিচিত মুখ দেখতে পায়। ছেলেটি তার উঠার জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।
‘এভাবেই বসে থাকবে নাকি উঠে দাঁড়াবে?’
অধরা কিছুক্ষণ ড্যাবড্যাব করে তার দিকে তাকিয়ে হাত ধরে উঠে দাঁড়ায়।
‘ধন্যবাদ।’
কোন উত্তর না দিয়ে ছেলেটি শুধু তাকিয়ে থাকে নির্লিপ্ত ভাবে। অস্বস্তি হয় অধরার। জোড় পূর্বক একটা হাসি দিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে আসার প্রস্তুতি নিতেই শুনতে পায় তার কণ্ঠস্বর।
‘এই পিচ্চি, কোন ইয়ার?’
ভড়কে যায় অধরা। কণ্ঠস্বরে কি অদ্ভুত কঠোরতা! ঠোঁটের কোণেও কোন হাসি নেই। যেন এই মুহূর্তে কোন কারণে চরম বিরক্ত উনি।
‘ফাস্ট ইয়ার।’
‘নাম কি?’
‘অধরা ওহি।’
ছেলেটি অধরার দিকে কিছুটা এগিয়ে এসে কিছু বলার উদ্যোগ নিবে তখনই আশ্বিন চলে আসে। এক টানে অধরাকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে এসে,
‘ঠিক আছো অধরা? কোথাও লাগেনি তো? সবসময় শুধু লাফালাফি, একটু শান্ত হয়ে থাকতে পারো না?’
অধরা চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে একজন অপরাধীর ন্যায়। আড়চোখে একবার ফিরে তাকায় পাশে দাঁড়ানো ছেলেটির দিকে। এবার আশ্বিনও লক্ষ্য করে তাকে,
‘ধন্যবাদ তোমাকে। আসলে…।’
আর বলার সুযোগ হয়নি আশ্বিনের। ছেলেটা একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে,
‘তুমিই আশ্বিন, রাইট? কলেজ আসার পর থেকেই তোমার কথা শুনে যাচ্ছি। আমি রাফিন, রাফিন শাহরিয়ার।’
রাফিন তার হাত এগিয়ে দেয় আশ্বিনের দিকে। আশ্বিন মুচকি হেসে হাত মিলিয়ে নেয়।
‘শুনেছি তোমার ব্যাপারে, মাইগ্রেশন নিয়ে এসেছো। যাই হোক, কোন প্রকার সাহায্য প্রয়োজন হলে আমাকে বলবে। আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করব সাহায্য করার।’
হেসে উঠে রাফিন, তবে তা ক্ষণিকের জন্য। মাথা নেড়ে একনজর অধরার দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে পাশ কেটে চলে যায় সে। আর কেউ না বুঝলেও আশ্বিন লক্ষ্য করে অধরার দিকে রাফিনের এরূপ দৃষ্টি। তবে সে এতে গুরুত্ব দেয়না।
আর অধরা বিস্ফোরণের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রাফিনের যাওয়ার দিকে। ছেলেটির নাম শুনেই, মাথা ঘুরে উঠেছে তার। তবে কি এই সেই ছেলে যার কথা…।
‘হাসান স্যার কেনো ডেকেছেন তোমায়? আবার কোন অঘটন করেছো তুমি অধরা?’
চোখ ছোট ছোট করে অধরা ফিরে তাকায় আশ্বিনের দিকে। সবসময় তাকে নিয়ে এমন কেনো ভাবে আশ্বিন?
‘আমি কিছুই করিনি। বরং স্যার আমাকে ডেকে অনেক প্রশংসা করেছেন। আমি নাকি ভালো মেয়ে হয়ে গিয়েছি। যদিও আমি সব সময়ই ভাল ছিলাম।’
হেসে উঠে আশ্বিন। আলতো করে অধরার গাল টেনে ধরে, তার হাতের কনুইয়ে আঘাতের চিহ্ন দেখতে পায় সে।
‘চলো ঔষধ লাগিয়ে দেই। তারপর শুনবো স্যার এবার কি শান্তি দিয়েছেন তোমাকে।’
‘আবার বলে এই কথা? আরে কিছু করিনি তো আমি। আশ্বিন ভাইয়া আপনিই বলেন, আমার মতো শান্তশিষ্ট নম্র ভদ্র মেয়ে আগে কখনো দেখেছেন আপনি?’
আশ্বিন কোন কথা না বাড়িয়ে অধরার হাত ধরে হেঁটে যেতে থাকে। এদিকে অধরা আশ্বিনের দিকে তাকিয়ে একা একাই কথা বলে যাচ্ছে। যেন নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে ব্যস্ত সে।
আর এই সব কিছু দূর থেকে রাফিন এক ধ্যানে তাকিয়ে তাদের খুনসুটি দেখতে থাকে।
—————–
বর্তমানে,
রাশেদা খালার ডাকে হুশ ফিরে আসে অধরার। আশ্বিনের জন্য পাতলা করে সবজি খিচুড়ি রান্না করেছে সে। প্লেটে খাবার তুলে ধীর পায়ে হেঁটে সে চলে আসে রুমে। পুরনো স্মৃতিগুলো মাথা চারা দিয়ে উঠছে তার। রাফিনের কথা মনে হতেই তার সেই অতীত মনে পড়ে। কি এমন হতো যদি সেদিন রাফিনের জন্য আশ্বিন তাকে ভুল না বুঝতো। সে কি এতোই অবিশ্বাসের পাত্রী ছিলো?
‘আশ্বিন, উঠুন। ফ্রেশ হয়ে এসে খাবার খেয়ে নিন। আপনার ঔষধের সময় হয়ে যাচ্ছে।’
আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে আশ্বিন। রাতের আকস্মিক জ্বরে তীব্র মাথা ব্যাথা হয়ে আছে তার, শরীরটাও অনেক দূর্বল। তাই উঠে ঠিকমতো দাঁড়াতেও পারছে না সে। অধরা আশ্বিনের অবস্থা দেখে তাকে ধরে ওয়াশরুমে এগিয়ে নিয়ে যায়।
‘আজ আর আপনার ডিউটিতে যেতে হবে না। মানুষের কি চিকিৎসা করবেন আপনি? ডাক্তার সাহেব তো নিজেই অসুস্থ হয়ে গিয়েছেন।’
‘আমিও তাই ভাবছিলাম। তবে একদিক দিয়ে কিন্ত ভালোই হয়েছে। আজ তুমি আমার ডাক্তার, দেখি আমার বউ কিভাবে আমার সেবা যত্ন করে।’
ধক করে উঠলো অধরার বুক। বউ! শব্দটা যেন তাকে শিহরিত করতে চাইছে। স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সে। আশ্বিন এর মাঝেই ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে খাটে এসে হেলান দিয়ে বসেছে।
‘আপনার নাস্তা। জলদি খেয়ে নিন, ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।’
‘খাইয়ে দাও।’
চলে আসতে নিতেই তার কথায় থমকে যায় অধরা। এসব কি বলছে আশ্বিন? হঠাত করে কি হয়ে গেল এই ছেলের? তাকে কি সে লজ্জায় ফেলতে চাইছে? অধরা কিভাবে পারবে তাকে খাইয়ে দিতে?
‘আমি চামচ এনে দেই?’
হেলান দিয়ে বসে এক দৃষ্টিতে অধরার দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে না বোঝায় আশ্বিন। অধরা পরে যায় দ্বিধা দন্ডে। এখন কি করবে সে?
আশ্বিন বেশ উপভোগ করছে অধরাকে বিরক্ত করে। অনেক কষ্ট দিয়েছে এই মেয়ে তাকে। পাগলের মতো তার জন্য কেঁদেছিলে একটা সময়, এখন সময় এসেছে সব শোধ তোলার। তবে অধরাকে কোন কিছু বুঝতে দিতে চায় না সে। তাই নির্বিকার ভাবে টিভির রিমোট হাতে নিয়ে টিভি দেখতে শুরু করে।
অধরা পড়েছে দারুণ বিপাকে। সাত পাঁচ ভেবে হাত ধুয়ে এসে বসে পড়ে আশ্বিনের পাশে। স্বযত্নে খাবার মুখে তুলে দেয় তার।
নীরবে হেসে যায় আশ্বিন। পলকহীন ভাবে একমনে তাকিয়ে থাকে সে অধরার দিকে। অধরা যেন তাকে অদৃশ্য এক মায়ার টানে বাঁধতে চাইছে। অদ্ভুত নেশায় আকৃষ্ট করতে চাইছে তাকে।
‘আপনি টিভি ছেড়ে রেখে আমাকে দেখছেন কেনো?’
নতজানু হয়ে অধরা অনেক কষ্টে কথাগুলো বললো। আশ্বিনের এই দৃষ্টি তাকে অস্বস্তিতে ফেলে দিচ্ছে। একরাশ লাজ এসে ভর করছে মনে। চোখ মুখে খেলে যাচ্ছে রক্তিম আভা।
আশ্বিনের কোন উত্তর না পেয়ে সে ফিরে তাকায় তার দিকে। আশ্বিন যেন ধ্যান ছাড়া হয়ে দেখে যাচ্ছে তাকে। দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয় অধরা। এ কেমন পরিস্থিতিতে পড়লো সে? চোখ মুখ নতজানু করে আছে।
জানালা থেকে আসা বাতাসে সামনের ছোট চুলগুলো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে অধরার। আশ্বিন চলে যায় ঘোরের মাঝে। টিভিতে বেজে ওঠে গান,
“আমি তোমার মনের ভেতর একবার ঘুরে আসতে চাই।
আমায় কতটা ভালোবাসো সেই কথাটা জানতে চাই।
ভালোবাসার যতো কথা হৃদয় দিয়ে শুনতে চাই।
তুমি শুধু আমার হবে, পৃথিবীকে বলতে চাই।
আমি তোমার মনের ভেতর একবার ঘুরে আসতে চাই।
আমায় কতটা ভালোবাসো সেই কথাটা জানতে চাই।”
লজ্জায় মাথা কা/টা যাচ্ছে অধরার। আর এখানে বসে থাকা তার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই তাড়াহুড়ো করে উঠে দাঁড়াতে নিতেই হঠাত পা পিছলে গিয়ে পড়ে আশ্বিনের বুকের উপর। তাকে ধরতে গিয়ে অজান্তেই কোমরে হাত রাখে আশ্বিন। থমকে যায় অধরা। আশ্বিনের এতোটা কাছে কখনোই আশা হয়নি তার। তাই আচমকা এক চিৎকার করে ওঠে বসে দৌড়ে পালিয়ে যায় রুম থেকে। হেসে উঠে আশ্বিন।
‘আমার থেকে পালিয়ে যাবে কোথায় অধরা?’
–চলবে(ইনশাআল্লাহ)
((চলে এসেছে অধরা আর আশ্বিনের মাঝে ঝামেলার সৃষ্টি করতে আমাদের রাফিন ভাই।))