#আমার_হিয়ার_মাঝে
লেখিকা: তাহসীন নাওয়ার রীতি
পর্ব:০৪
রুম থেকে বেরিয়ে মামুনির সাথে গল্প করতে করতে টুকটাক রান্নায় সাহায্য করছে অধরা। কথায় কথায় অধরা জানতে পেরেছে যে আশ্বিনের সাথে তার বিয়ের পরিকল্পনা এমন হুট করেই নেওয়া হয়নি, দীর্ঘদিন ধরেই দুই মায়ের এই প্ল্যান ছিল। গতকাল সকাল সকাল মামুনি আশ্বিনকে মিথ্যা বলে ঢাকা থেকে নিয়ে এসেছে ঠিক তার মায়ের মতোই। কথাগুলো শোনার পর অধরার মনে এক সুপ্ত অভিমানের সৃষ্টি হয়। বিয়ের কথা বলতেই কেনো রাজি হয়ে গিয়েছে আশ্বিন? সত্যিই কি আশ্বিনের মনে তার জন্য কোন অনুভূতির সৃষ্টি হয়নি? অতীতের সবটাই কি শুধুমাত্র তার একান্ত অনুভূতি ছিল?
‘অধরা! কি এতো ভাবছিস?’
‘কিছু না মামুনি।’
‘আমি টেবিলে নাস্তা সাজিয়ে দিচ্ছি। তুই গিয়ে একটু আশ্বিন আর আরশিকে ডেকে নিয়ে আয়।’
‘ঠিক আছে।’
ধীর পায়ে হেঁটে আশ্বিনের রুমে প্রবেশ করে অধরা। রুমের কোথাও আশ্বিন নেই, বারান্দা থেকে শোনা যাচ্ছে তার কণ্ঠস্বর। হয়তো ফোনে কারো সাথে কথা বলছে। অধরা নিঃশব্দে বারান্দা পর্যন্ত আসতেই শুনতে পায়,
‘হ্যা মারিয়া, কেমন আছো?’
‘এইতো ভালো। লোক মুখে শুনলাম বিয়ে করেছো? কথাটা কি সত্যি?’
‘হুম, গতকাল মায়ের অসুস্থতার কথা শুনে ময়মনসিংহ এসেছিলাম। বিয়ের বিষয়ে আগে থেকে কোন ধারনা ছিলো না আমার।’
‘তোমার সাথে কিছু কথা ছিলো আশ্বিন। দেখা করতে পারবে?’
‘আচ্ছা, ঠিক আছে। ঢাকা আসি তারপর দেখা হবে।’
আড়াল থেকে কথাগুলো শুনে অধরার বুঝতে আর বাকি নেই যে এখনও আশ্বিনের সাথে মারিয়ার যোগাযোগ হয়। এতসব কাহিনীর পরও মারিয়ার উপর আশ্বিনের বিশ্বাস আছে, অথচ তারই মিথ্যা কথায় সেদিন কীভাবে অধরার মন ভেঙেছিলো আশ্বিন!
নিজের উপর আফসোস হচ্ছে তার। কেনো ভাগ্য তাকে আবারও অতীতের মুখোমুখি করলো? আর সেও কেনোই বা এতোটা সাবলীল ভাবে এই ভাগ্য মেনে আশ্বিনকে নিজের জীবনে জড়িয়ে নিলো?
অধরার এসব ভাবনার মাঝেই আশ্বিন বারান্দা থেকে বেরিয়ে অধরাকে দেখে খানিক অবাক হয়।
‘কি হয়েছে?’
রাগ উঠে যায় অধরার। নিজের চোখের সামনে ভেসে উঠে অতীতের কিছু কথা।
বাসায় বিয়ে করা বউ থাকতেও উনি কিনা ঢাকায় ফিরে মারিয়ার সাথে দেখা করবেন। ইচ্ছে করছে এই মুহূর্তেই আশ্বিনকে দুচারটা কড়া কথা শুনিয়ে দিতে, কিন্তু না। রাগের মাথায় হুটহাট সিদ্ধান্ত নিয়ে পরবর্তীতে আফসোস করার কোন ইচ্ছেই নেই তার। তবে নিঃসন্দেহে এতো সহজে ওই মারিয়াকে অধরা ছাড়বে না, একবার ঢাকা ফিরে যাক, এর একটা বিহিত করেই ছাড়বে সে।
‘মামুনি খাওয়ার জন্য ডেকেছে আপনাকে।’
দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে সামলে নিয়ে কথাগুলো বলেই সে চলে যায়। আশ্বিন নির্লিপ্ত ভাবে অধরার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। সে ভালো করেই জানে অধরা এতক্ষণ ধরে তার ফোনে বলা কথাগুলো শুনছিলো। তবে অধরার এমন নিরব প্রত্যাখান সে আশা করেনি, ভেবেছিলো অতীতের কথা বলে রাগ দেখাবে। তখন হয়তো নিজের ভুল স্বীকার করে বিষয়টা হালকা করা সম্ভব হতো।
নাস্তার টেবিলে বসে একসাথে নাস্তা করতে ব্যস্ত সবাই। খাওয়ার মাঝে মাঝে সবাই মিলে টুকটাক গল্প করলেও আশ্বিন নিরবে গোগ্রাসে খেয়েই চলেছে। আশ্বিনের দিকে একনজন তাকিয়ে রাগে গা রি রি করে উঠছে অধরার।
‘আমি বুঝতে পারছি না তোরা এতো শীঘ্রই কেনো ঢাকা ফিরে যেতে চাইছিস? নতুন বিয়ে হয়েছে, কিছুদিন না হয় দূরে কোথাও ঘুরে আয়।’
আশ্বিনের বাবা ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলতেই তাতে সম্মতি দেন আশ্বিনের মা আর আরশি। কিন্তু আশ্বিন তা মানতে নারাজ।
‘বাবা, আমার ডিউটি আছে। নতুন জয়েন করেছি,এখনই কাজে ছুটি নেওয়া ঠিক হবে না। তাছাড়া অধরার এখন ক্লাস মিস না দেওয়াই ভালো।’
অধরা কিছু না বলে সবার অগোচরে একটি ভেংচি কাটে। নিজে যাবে মারিয়ার সাথে দেখা করতে আর মহাশয় বাহানা দিচ্ছেন অধরার ক্লাসের!
আশ্বিনের বাবা কিছুক্ষণ ভেবে চিন্তে মাথা নেড়ে,
‘ঠিক আছে। তাহলে আজ বিকেলে অধরার বাসায় থেকে কাল ফিরে এসে বিকেলে নাহয় চলে যেও।’
‘জি বাবা।’
রুমে এসে গোছগাছ শুরু করেছে অধরা। গতকাল ভুল বশত তার ফোন বাসায় রেখেই চলে এসেছে সে। নয়তো এতক্ষণে প্রিয় বন্ধুদের নিজের বিয়ের খবর জানিয়ে ভালো এক পরামর্শ নিতে পারতো।
আশ্বিন রুমে এসে কিছুক্ষণ অধরার কাজ পর্যবেক্ষণ করে,
‘এত সবকিছু নেওয়ার কি প্রয়োজন? কাল সকালেই তো চলে আসবো আমরা।’
আশ্বিনের এই কথার প্রসঙ্গে অধরা কোন উত্তরই দেয় না। সে নিজের মতো করে ব্যাগ গুছিয়ে একটা নীল রঙের শাড়ি নিয়ে রেডি হয়ে আসে।
সাধারণত ছেলেদের পছন্দের রঙ এই নীল। আর পছন্দের এই রঙে যদি প্রিয় মানুষটি আবৃত থাকে তবে তার মায়াবী জাল থেকে এই মনোমুগ্ধকর চাহনি ফিরিয়ে আনা বড় কঠিন। যা এই মুহূর্তে হারে হারে টের পাচ্ছে আশ্বিন। আয়নার কাছে দাঁড়িয়ে চুলে চিরুনি করার সময় একনজন আশ্বিনের এমন হতভম্ব হয়ে থাকা দেখে বিস্মিত হয় অধরা। মাথা ঘুরিয়ে ভ্রু কুঁচকে আশ্বিনের দিকে তাকাতেই আশ্বিন কিছুটা লজ্জা পেয়ে রেডি হতে চলে যায়।
————-
ঘণ্টা খানেকের মাঝেই অধরা আশ্বিন চলে এসেছে তাদের গন্তব্যে। গাড়ি থেকে নেমে অন্যমনস্ক হয়ে অধরা যেই না বাড়ির দিকে যেতে যাবে ঠিক তখনই,
‘অধরা!’
চমকে উঠে পিছু ফিরে দেখে অধরা। আশ্বিন গাড়ি পার্ক করে তার কাছে এসে,
‘তুমি বাসায় যাও। আমি একটু সামনে যাচ্ছি, কিছুক্ষণের মাঝেই চলে আসবো।’
‘কোথায় যাচ্ছেন?’
‘একটা জরুরী কাজ করা বাকি। এখনি চলে আসবো, বাসায় জিজ্ঞেস করলে বলে দিও। আর সাবধানে থেকো।’
অধরাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই চলে যায় সে। ব্যাপারটা চরম ভাবে খটকা লাগে তার। কি এমন জরুরি কাজ পড়ে গেলো তার এর মাঝেই। নয় ছয় ভাবতে ভাবতে বাসায় প্রবেশ করতেই ছোট ভাইয়ের চিৎকারে চমকে উঠে।
‘আম্মু আপু চলে এসেছে।’
অধরার ছোট ভাই অভির ডাকে বসার ঘরে এসে ভিড় জমে স্বজনদের। বাড়ির মেয়ে ফিরে আসায় যে খুশি নিয়ে সবাই উপস্থিত হয়েছিলো। আশ্বিনের অনুপস্থিতি সেই খুশি নষ্ট করে।
‘আশ্বিন কোথায়? তুমি একা এসেছো মা?’
মায়ের প্রশ্ন শুনেও চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে অধরা।
হুট করেই তার জীবনে এতো বড় ঝড় নিয়ে আসার আগে কেনো তার অনুভূতি জিজ্ঞেস করলেন না তিনি? মায়ের প্রতি একরাশ অভিমান নিয়ে নিজের রুমের দিকে যেতে যেতে,
‘সামনেই গিয়েছেন এক জরুরি কাজের জন্য। চলে আসবেন, চিন্তার কিছু নেই।’
মেয়ের উত্তরে ফারজানা বেগম বুঝে যান অধরার অভিমান। অধরার বাবার দিকে ফিরে তাকাতেই তিনি অধরাকে সবটা মেনে নিতে কিছুটা সময় দিতে বলেন।
মেয়ের হুটহাট রাগ করা, আবার সব রাগ ভুলে গিয়ে সবকিছু স্বাভাবিক ভাবে থাকার আচরণে অভ্যস্ত তিনি।
নিজের ঘরে খাটের উপর হেলান দিয়ে বসে ফোনে তার বন্ধু মহলের সব ম্যাসেজ দেখে যাচ্ছে। গতকাল মায়ের অসুস্থতার কথা বলে চলে আসার সময় সবাই বারবার করে বলেছিলো আন্টির খবর তাদের জানাতে। কিন্তু পরিস্থিতি অন্যরকম হয়ে যাওয়ায় তাদের কিছুই বলা হয়নি তার। তাই বিস্তারিত জানতে ইশার নম্বরে ফোন করে সে।
‘কি ব্যাপার অধরা? বাসায় গিয়ে দেখছি আমাদের কথা ভুলেই গিয়েছিস। একটা ম্যাসেজ করে তো জানাতে পারতি। যাই হোক আন্টি এখন কেমন আছে?’
‘মা ভালো আছে। শুধু আমি ভালো নেই।’
‘কেন? তোর আবার কি হয়েছে? নিশ্চয়ই কাল স্টেশনের ওই দোকানটার চা সিঙ্গাড়া খেয়ে এখন তোর পেট খারাপ?’
‘আরে চুপ কর তো। এখানে আমার জীবনের চরম কাহিনী ঘটে গিয়েছে। জানিস তুই কি হয়েছে?’
‘কি?’
অধরা একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে প্রথম থেকে সবটা বলে দেয়। আশ্বিনের সাথে অধরার বিয়ের কথা শুনে ইরা বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। দুমিনিট স্তব্ধ হয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে ফোন কেটে দেয় সে।
আচমকা এমন কাজে অবাক হয় অধরা। কিন্তু পর মুহূর্তে মনে পড়ে তার অতীতের সবকিছু সাথে তো তারাও জড়িত ছিলো। হয়তো তার মতোই অবাক হয়েছে ইশা। তাই হয়তো এমন খটকা লেগেছে তার।
ফোনটা পাশে রেখে খাটের উপর শুয়ে পড়তেই হঠাত মনে পড়ে সকালে আশ্বিনের কাবার্ডে ছোট্ট বক্সের ভেতরে থাকা নূপুরের কথা। তড়িঘড়ি করে উঠে বসে অধরা।
তখন নুপুরটা দেখে বিস্ময়ের শীর্ষে পৌঁছে গিয়েছিলো সে। কিন্তু রুমে আশ্বিনের আগমন দেখে তা স্বযত্নে রেখে দেয়।
তবুও মনের গহীনে প্রশ্ন থেকে যায়, তার হারিয়ে যাওয়া নুপুর আশ্বিনের কাছে কিভাবে এলো?
এই নুপুর তো সেদিন রেণুর বাসা থেকে পালিয়ে আসার পথে হারিয়ে ফেলেছিল সে। এতোগুলো দিন পর শখের নুপুর পেয়েও যতটা না খুশি হয়েছে, তার চেয়েও বেশি অবাক হয়েছে অধরা।
আবারও মনে পড়ে যায় সেদিনের কথা…।
–চলবে(ইনশাআল্লাহ)
((আসসালামু আলাইকুম। ভুল ত্রুটি ক্ষমার চোখে দেখবেন। দুদিন ধরে ঠান্ডা জ্বর, গতকাল রাতে জ্বর বেড়ে যাওয়ায় গল্প লেখার সুযোগ পাইনি। কিন্তু বিকেলের দিকে জ্বর কিছুটা কমে আসায় এখন গল্প দেওয়া। আমার জন্য দোয়া করবেন।))