মন শুধু মন ছুঁয়েছে
তামান্না জেনিফার
পর্ব আট
__________________
দুদিন শ্বশুরবাড়ি কাটিয়ে সোহেল আবার ঢাকার পথে রওনা হয় ৷ দুই দিনে ইয়াসমিনের সাথে তার ভালো সময় কেটেছে ৷ আশ্চর্যজনক ভাবে এই দুই দিনে তার একবারও অদিতির কথা মনে পড়েনি ৷ নতুন শরীরের কাঁচা গন্ধেই বুঁদ হয়ে ছিল সে ৷ এখন বাসে বসে তার অদিতির কথা মনে পড়ছে ৷ অদিতির
জন্য তার এই অনুভূতির নাম কি ভালোবাসা ? হতে পারে আবার নাও হতে পারে ….
মোবাইলে রিঙ হচ্ছে ৷ ইয়াসমিন কল করেছে ৷
—হ্যালো মিনমিন
—আবার মিনমিন কইছেন ? আপনেরে না কইছি মিনমিন কইবেন না ৷ আমার বাপে আমার নাম রাখছে ইয়াসমিন , সেইটারে আপনে বানাইলেন মিনমিন , কিছু হইলো !
—আরে আদর করে ডাকি ৷ বলো কল করেছো কেন ?
—আমার জামাইরে আমি কল দিমু , এই জন্যে কারণ লাগবো !
—হা হা হা … কারণ লাগবে না ৷ বাসে তো , অনেক শব্দ হচ্ছে ৷ তোমার ওখানকার নেটওয়ার্কও ভালো না ৷ তাই বলছিলাম দরকারি কথা শেষ করে রেখে দেই ৷
—ক্যান ! আমি কলপাড়ে খাড়াইয়া আছি , এইহানে পুরা নের্টক ৷ আপনে দূরে যাইয়া আমারে ভুইলা গেছেন …. শহরে যাইয়া আবার শহরের মাইয়্যাগো পাইলে ঘরের বউরে ভুইলা যাইবেন… কবে আইবেন কন , আমার ভালো ঠেকে না …
—পাগল মেয়ে কী বলে ! এখনও তো ঢাকায় পৌছাতেই পারলাম না ৷ এর মধ্যেই আসার কথা কিভাবে বলি ৷
—অত কিছু জানি না আমি , কবে আইবেন কন … নাইলে আমারে নিয়া যান ৷ আপনেরে ছাড়া আমার ভালো লাগে না ৷
—আমারও তোমাকে খুব মনে পড়ছে ৷ কথা দিচ্ছি জলদি ফিরবো ৷
—না এমনে না , আপনে আমারে ডেট দেন
—এভাবে ডেট দিবো কিভাবে ?
—না , আপনে ডেট না দিলে আমি ফোন থুমু না
—আচ্ছা সামনের বৃহস্পতিবার রাতে রওনা দেবো ৷ দুইদিনেই স্বামীর ভক্ত হয়ে গেছো দেখি… হা হা হা
—হাইসেন না তো , আমার স্বামীর ভক্ত আমি হমু না তো কেডা হইবো !
—অন্য কেউ যদি হয় ?
—তার চোখের পুতি আমি তুইলা মার্বেল বানায়া খেলমু …. আপনে খালি আমার , আমার একলার
—আচ্ছা মিনমিন ,আমি শুধু তোমার একার ৷ এখন রাখি ৷ পরে কল দেবো ৷
—আচ্ছা ৷ ভালোভাবে পৌছান ৷
সোহেল ফোন রেখে হাসে ৷ ইয়াসমিন আর অদিতি , দুজনের জন্যই তার বুকের ভেতর অদ্ভুত এক অনুভূতি হচ্ছে ৷ দুজন মানুষকে কি ভালোবাসা যায় ? ভালোবাসা সম্ভব ?
সোহেল হা হা করে হেসে উঠে ৷ পাশের সিটে বসা ভদ্রলোক বিরক্ত হয়ে তার দিকে তাঁকায় ৷ সোহেল সে দৃষ্টি অগ্রাহ করে শীষ দিতে চেষ্টা করে ৷
ঢাকায় পৌছাতে পৌছাতে সন্ধ্যা হয়ে যায় ৷ আলিমের সাথেই প্রথম দেখা করে সে ৷ নিজের বিয়ের কথা আলিমের কাছে সম্পূর্ন চেপে যায় সে ৷ আলিমকে দেখেই বলে
—অয় , মাস্টারনীর বেটির খবর কি রে ?
—ওস্তাদ , হ্যার দিলে তো আপনের জন্য আগুন লাইগা গেছে ….কাইল আমারে রাস্তায় দেইখা থামায়া আপনের কথা জিগাইছে ৷ আমি খালাম্মা মইরা গেছে কইলাম ৷ কইলাম গেরামে গেছেন ৷ হ্যায় একখান নাম্বার দিছে , কইছে আইলেই যেন কল দেন ৷
—আব্বে এইটা তো জব্বর খবর দিছোস ! মাস্টারনীর দিলে আগুন জ্বালামু এইবার ৷ হ্যার মাইয়ারে একটু আদর সোহাগ কইরা লই ,তারপর খেলা হবে … যা , একটু মাল সামান জোগার কর ৷ কমছে কম চাইরটা স্টিক যেন হয় ৷ আমরুলের মায়ের ডেরায় যায়া আমার নাম ক , অরিজিনাল জিনিস দিবো ৷
—আচ্ছা ওস্তাদ যাইতাছি , নাম্বারডা এহনই দিমু না আইসা …
—আইসা দে , এখন একটু বড়ভাইয়ের লগে দেখা করতে যামু ৷ হালার কাছে কিছু টেকাটুকা পাওয়া যায় কী না দেখি ৷ মাস্টারনীর চাকরি নট কইরা দিলাম , কিছু তো দিলো না ….
—মাস্টারনী বলে কেস করছে স্কুলের চেয়ারম্যানের নামে ৷ চাকরি ক্যান নট করলো এই জন্যে ৷
—শালীর এত ত্যাজরে ! শালীর ত্যাজ কমলো না .. এহন তো হ্যার মাইয়্যারে না হ্যারেই আদর সোহাগ করন লাগবো দেখতাছি ! বুইড়া হাড্ডি জন্যে ঐদিকে যাইতাছি না ৷ আচ্ছা দেখি না বড় ভাই কী কয় …
—আচ্ছা , আপনে যান ৷ আমিও আমরুলের মায়ের ডেরায় যাই ৷ **কি বেটি আবার সইন্দা না হইতেই ঘরে খদ্দের ঢুকায় ৷
—যা , আমার নাম নিবি ৷
আলিম আর কথা না বলে সামনের দিকে হাঁটা দেয় ৷ আজ তার বড় আনন্দ হচ্ছে ৷ ওস্তাদ ফিরে আসছে , ওস্তাদ না থাকলে কেউ তাকে দাম দেয় না , নিজেরে এতীম এতীম লাগে ৷ এই ঢাকা শহরে তার শক্তিই তার ওস্তাদ সোহেল ৷ এমন মানুষের জন্য জান দেওয়াও যায় ৷ কিন্তু ওস্তাদকে বলা হয়নি , মাস্টারনী কেসে তার নামও দিছে ৷ পুলিশ তাকে খুঁজতেছে ৷ এই কথাটা বলা উচিত ছিল ৷ এই কথাটা বলার জন্য আলিম আবার পেছনে ফিরে গিয়ে দেখে সেখানে সোহেল নাই ৷
নেশার জিনিসপত্র নিয়ে ফিরে এসেই আলিম শোনে সোহেলকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে ৷ আলিম মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে , এখন কী করবে সে ….
ব্যাপারটা এত দ্রুত হয়ে গেছে , সোহেল নিজেও বোঝেনি ৷ নেতার সাথে দেখা করার জন্য বের হয়েছিল সে ৷ দশ কদম না যেতেই সাদা পোশাক পরা পুলিশ তাকে আচমকাই ধরে ফেলে ৷ এতটাই দ্রুত সব হয়েছে যে দৌড়ে পালাবার মতো সুযোগও পায়নি ৷ পুলিশ ভ্যানে বসে বারবার করে নেতার নাম বলেছে ৷ কিন্তু নেতার নাম শুনেও পুলিশদের মধ্যে কোন ভয় দেখা গেল না ৷
থানার লকআপে বসে বসে নিজের উপর রাগে ফেঁটে পড়ছে সে ৷ কী কী ভেবেছিল আর কী হচ্ছে ! মাস্টারনী এত সাহস কোথায় পেলো ! আর কেস করেছে স্কুলের চেয়ারম্যানের নামে , তাকে কেন ধরলো পুলিশ …..
***********
সোহেলকে যে পুলিশ ধরে ফেলেছে এই খবরটা শোনার পর থেকে সুস্মিতা আনন্দে আছে ভীষণ ৷ কিন্তু অদিতি ভেতরে ভেতরে শেষ হয়ে যাচ্ছে ৷ তার মনে হচ্ছে অপরাধী সোহেল না , অপরাধী তার মা ৷ বয়স তো কম হয়নি , আর কতদিন স্কুলে চাকরি করতো , কয়েক বছর পর তো এমনিতেও রিটায়ামেন্ট নিতেই হতো ৷ সেটা একটু আগে হয়েছে তার চেয়াম্যানের জন্য , অযথা সোহেলকে টানাটানি করছে তার মা …
অদিতির মা স্কুলের দাড়োয়ানের সহযোগীতায় স্কুলে ঢুকে সিসি টিভি ফুঁটেজ বের করে এনেছে ৷ সেটা দেখিয়েই সোহেলের নামে মামলা করেছে ৷ সেই ফুঁটেজ অদিতিও দেখেছে ৷ কথা বলার এক পর্যায়ে সোহেল যে পিস্তল বের করেছিল সেটাও দেখেছে ৷ কিন্তু তার মন বলছে যা সে দেখেছে এটা সত্যি নয় ৷ হয়তো সোহেলও কোন বিপদে পড়ে এমন করেছে ৷ হয়তো তাকে ট্র্যাপে ফেলে এসব করিয়ে নেওয়া হয়েছে ৷
এমন সরল চোখের মানুষ এমন ভয়ঙ্কর হতেই পারে না ৷ আর স্কুল যার সে টাকা দিয়ে দিচ্ছে তাহলে তার সমস্যা কোথায় ! আর অহনা , তার বোন …. মায়ের সাথে তাল দিয়ে যাচ্ছে ! নিজের বোনের দিকে তাঁকালে ঘৃনায় মুখে থুথু জমছে অদিতির ৷ এতটা তার মা কখনই করতো না , সব বুদ্ধি অহনার …
মানুষটার মা মারা গেছে , এর মধ্যে পুলিশের ঝামেলা … পুলিশগুলো যদি ওকে মারে , ভেবেই অদিতির চোখে পানি চলে আসে ….
********
গত দুই দিনে বোনের কার্যকলাপ আর আচরণের পরিবর্তন স্পষ্ট হয়ে চোখে পড়েছে অহনার ৷ তার মনে কু ডাক ডাকছে … অদিতি কোন বিপদে পড়েনি তো ! সে কোন ভুল পথে পা বাড়ায়নি তো !
চিন্তায় অহনার বুকে চাপ ধরে আসে …
চলবে…