#এক_মুঠো_অনুভূতি💖
লেখিকা- তাহসীন নাওয়ার রীতি
পর্ব:১৯
আজ চারদিন ধরে ওহি সবাইকে একপ্রকার এড়িয়ে চলছে। জাইমার সাথেও সে প্রয়োজন ছাড়া কথা বলেনি। আশ্বিন নিজ থেকে ওহির সাথে কথা বলতে চাইলেও ওহি শুধু এতটুকুই বলেছে,
–আশ্বিন ভাইয়া, আমার কিছুই হয়নি। ঘোরাঘুরি আর ফাংশনের জন্য পড়ালেখার প্রতি অনেক অনিয়ম করেছি। তাই এখন পড়ায় মনোযোগ দিলাম, আর কিছুই না।
ওহির এই কথা আশ্বিনের বিশ্বাস হচ্ছে না। যে মেয়ে সারাদিন বকবক করে, গল্প গুজব করে কাঁটায় তার পক্ষে এতো সহজেই চুপচাপ হয়ে যাওয়া সম্ভব না। এদিকে, আফরাও এই কদিন ওসমানের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করে বারবার ব্যর্থ হয়েছে।
–বুঝলাম না, দুই ভাই বোনের হঠাত করেই কি এমন হয়ে গেলো? দুজনেই আমাদের ইগনোর করে চলেছে।
-বিষয়টা জানার জন্য আমার মাথায় একটা প্ল্যান এসেছে আফরা।
রোদ্দুরের কথায় সবাই তার দিকে ফিরে তাকায়। রোদ্দুর তাদেরকে নিজের কথাগুলো বলতেই সবাই রাজি হয়ে যায়।
বিকেলে,
নিজের রুমে বসে পড়ালেখা করছিল ওহি। হঠাত কলিং বেল-এর শব্দ শুনতে পায় সে। অনিচ্ছা সত্বেও রুম থেকে বেরিয়ে দরজার সামনে আসতেই দেখে ফারজানা বেগম দরজার বাহিরে কাউকে দেখে খুব খুশি হয়েছেন।
–এতোদিন পর তাহলে তোমাদের আসতে ইচ্ছে হলো আমাদের বাসায়? এসো ভেতরে এসো। এই ওহি, ওসমান! দেখো কারা এসেছে।
ওহি কিছুটা এগিয়ে আসতেই দেখে আফরা জাইমা, রোদ্দুর আর আশ্বিন। এদিকে মায়ের ডাক শুনে ওসমান তার রুম থেকে বেরিয়ে এসেছে। ফারজানা বেগম সবাইকে সোফায় বসিয়ে,
–তোমরা গল্প করো, আমি সবার জন্য চা নাস্তার ব্যাবস্থা করছি।
ওহির মা চলে গেলেই ওসমান আর ওহি তাদের পাশে বসে পড়ে।
–কি খবর তোমাদের? কেমন আছো?
–আমাদের কথা বাদ দাও ভাই, তোমাদের কি হয়েছে সেটা বলো। সেদিনের পর তো কোন খোঁজখবরই নেই।
–আমাদের কি হবে রোদ্দুর? আমরা ঠিক আছি। পড়া আর ক্লাস নিয়ে হঠাত করেই ব্যাস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। তাই….।
–ওহিও এই কথাই বলেছে আমাদের। আরে আমি বলি, কিসের এতো পড়া? পড়ার জন্য কি এভাবে দুনিয়া ছাড়া হয়ে যেতে হবে নাকি? আমি কতগুলো ম্যাসেজ দিয়েছি আপনাকে, সেগুলোর কোন উত্তর নেই।
আফরার কথায় ওসমান চুপ হয়ে যায়। ওহি এখনও মাথা নিচু করে বসে আছে। আশ্বিন ওহিকে এভাবে দেখে বুঝতে পারছে কিছু একটা হয়েছে। ওসমান কিছুক্ষণ চুপ থেকে চিন্তা ভাবনা করে,
–আপনি ঠিক বলেছেন আফরা। কোন কিছুর জন্য আমাদের এভাবে একা হয়ে, দিন দুনিয়া ভুলে থাকা ঠিক না। পড়ালেখার মাঝেই বন্ধু বান্ধদের সাথে আড্ডা দেওয়া আমাদের মনোবল আরও বাড়িয়ে দিবে। তাই না ওহি?
ওহি একনজর ওসমানের দিকে তাকিয়ে আনমনে মাথা নাড়ল। জাইমা এসে ওহির পাশে বসে,
–তাহলে কি এখন সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেলো?
–অবশ্যই। বাই দ্য ওয়ে, তোর কি খবর পুটি মাছ? তোর কথা তো আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। তুই যে এখনও এই পৃথিবীতে আছিস।
ওসমানের কথায় ওহি আর জাইমা বাদে সবাই একসাথে হেসে উঠে। জাইমা চোখ ছোট ছোট করে ওসমানের দিকে তাকিয়ে একটা ভেংচি কাটে।
সন্ধ্যার পর ছাদে পাশাপাশি বসে আছে ওহি আর আশ্বিন। সবাই মিলে গল্প গুজব আড্ডা দিলেও ওহি এখনও চুপচাপ বসে আছে। তাই আশ্বিন তাকে এখানে নিয়ে এসেছে।
–এখনো মন খারাপ?
ওহি কোন কথা না বলে চুপ করে আছে। আশ্বিন ওহির দিকে একনজর তাকিয়ে,
–ফাইজা, এভাবে আর কতো নিজের মাঝে কথা লুকিয়ে রাখবে? এমনিতেই তো আমাকে সারাদিন কি হলো না হলো এসব না বলে থাকতে পারো না। আর এখন যখন বলার প্রয়োজন তখন বলতে চাইছো না।
ওহি আশ্বিনের কথায় মাথা নিচু করে চোখ মুখে ফেলে,
–আমি আর ভাইয়া ছোট থেকে আমাদের বাবার কাছে পারফেক্ট হতে চেয়েছিলাম। ছোট থেকেই বাবাকে আমরা খুব কম সময়ের জন্য কাছে পেয়েছি কারণ বেশির ভাগ সময় বাবা তার ব্যাবসার জন্য বাহিরে থাকেন। আর যখনই বাসায় আসেন, তখনই আমাদের ছোটখাটো সব ভুলগুলো নিয়ে শাষণ করেন। তাই বাবার সাথে ছোট থেকেই আমাদের এক দূরত্ব তৈরি হয়।
বাবা সবসময় চাইতেন আমরা পড়ালেখা করে বড় কিছু হবো। আমরাও বাবার কথা মতো চলার চেষ্টা করেছি।একবার ভাইয়া স্কুলে ফার্স্ট হওয়ায় বাবা খুব খুশি হয়ে ভাইয়ার জন্য অনেক গিফট, মানে ভাইয়ার পছন্দের সবকিছু কিনে নিয়ে এসেছিলো। মা সেদিন আমাদের সবার পছন্দের খাবার রান্না করেছিলো। সেদিন প্রথমবারের মত আমরা স্বপরিবার মিলে বাহিরে ঘুরতে গিয়েছিলাম। একটা সুখি পরিবারের মতো।
ওহি কথাগুলো বলে চুপ হয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস নেয়। অনেক কষ্টে আটকে রাখা চোখের পানিগুলো এখন মুক্ত হয়ে ঝড়ে পড়ছে। আশ্বিন তার হাত ধরে তাকে শান্তনা জানায়।
–তারপর থেকে আমি আর ভাইয়া ভেবে এসেছি, আমরা যদি ভালো রেজাল্ট করি বাবা হয়তো আমাদের সময় দিবেন, ভালোবাসবেন। শুধুমাত্র বাবার কাছে ভালোবাসা পাওয়ার জন্য আমরা সব বাহ্যিক বিনোদন ত্যাগ করে পড়ায় মনোযোগ দিয়েছি, সব বন্ধু বান্ধব আত্মীয়স্বজনের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছি। আমাদের জন্য আমাদের মা তার পরিবারের থেকে এখন আলাদা হয়ে আছে।
কিন্তু আমাদের এই ধারণা আর সত্যি হয়নি, আশ্বিন ভাইয়া। তিনি আমাদের আর কখনো সময় দেননি, কখনও পাশে বসে স্নেহ করে বলেননি মা কেমন আছো তুমি? সবসময় আমাদের ভুল বুঝে থাকেন উনি। তবুও আমি আশায় আছি হয়তো কোন একদিন বাবা আমাকে বুকে জড়িয়ে বলবেন, আমার মেয়ে ওহি তার বাবার স্বপ্ন পূরণ করে দেখিয়েছে।
ওহি কথাগুলো বলে চোখ মুখে ফেলে। আশ্বিন কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। তবে এটা তার কাছে পরিষ্কার যে, ওহি আর ওসমান সেদিনের পর থেকে কেনো এমন নিশ্চুপ হয়ে গিয়েছিল। হয়তো তাদের ঘুরতে যাওয়ায় তাদের বাবার ক্ষোভ প্রকাশ পেয়েছে, নাহলেও কোন পারিবারিক সমস্যা ছিলো যা ওহির মনকে গভীর ভাবে আঘাত করেছে।
–কেঁদো না, ফাইজা। তোমার এই স্বপ্নগুলো একদিন ঠিকই পূরণ হবে। একদিন আঙ্কেল তোমার সাফল্য দেখে স্তব্ধ হয়ে যাবে। ভার্সিটির সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে তুমি যেদিন আমার রেকর্ড ভাঙবে, সেদিন তোমার বাবা সহ পুরো ক্যাম্পাস তোমার সাফল্য দেখে তোমাকে চিনবে। সবাই তোমাকে ভালোবাসবে।
–আমি পারবো না এমন করতে, আশ্বিন ভাইয়া। আমি সেদিন এমনি কথাটা বলে ফেলেছিলাম। আমার দ্বারা কখনও এই রেজাল্ট করা সম্ভব না।
–কে বলেছে সম্ভব না? আমি আছি তো…। আমি তোমাকে সাহায্য করবো ফাইজা।
ওহি কিছুটা অবাক হয়ে,
–আপনি আমাকে আপনার রেকর্ড ভাঙতে সাহায্য করবেন? আপনি নিজেই নিজের কাছে হেরে যেতে চাইছেন আশ্বিন ভাইয়া?
ওহির কথায় আশ্বিন হেসে উঠে। হাত দিয়ে ওহির চোখ মুখে দিয়ে তার গাল টেনে ধরে,
–আমি হেরে যাবো কখন বলেছি তোমাকে? তুমি জিতে গেলেই তো আমি জিতে যাবো ফাইজা।
ওহি অবাক হয়ে আশ্বিনের দিকে ফিরে তাকায়। আশ্বিন ওহির হাত শক্ত করে ধরে,
–সবসময় নিজে জিতে গিয়েই জয় পাওয়া যায় না ফাইজা। আমি নাহয় এবার হেরে গিয়েই পুরো পৃথিবী জয় করে ফেলবো। আর আমার এই জয়টা তুমি ছিনিয়ে নিয়ে আসবে।
ওহি আশ্বিনের দিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে। আশ্বিনের কথার গভীর অর্থ বোঝার ব্যার্থ চেষ্টা করে যাচ্ছে সে। আশ্বিন ওহির চুলগুলো এলোমেলো করে তাকে কাল থেকে পড়ায় সাহায্য করার কথা জানিয়ে চলে যায়।
——————–
নতুন দিন শুরু হয়েছে নতুন এক আঙ্গিনায়।
ওহি এখন ঠিক আগের মতোই হাসি খুশি প্রাণবন্ত। সকাল থেকেই সবার সাথে খুনসুটি করে বেড়াচ্ছে সে। আশ্বিন তাকে কয়েকটা নোট দিয়ে পড়ার জন্য বলে গিয়েছে।
ইদানিং আশ্বিনের এই ব্যাবহার, তার আচরণ সবকিছুতেই ভালোলাগা খুঁজে পায় ওহি। এমন না যে আগে আশ্বিনের প্রতি তার এই ভালোলাগা ভাব ছিলো না। তবে কদিন ধরেই এই ভালোলাগা কেমন যেনো গভীর অনুভূতির সৃষ্টি করছে মনে। এখন প্রায়ই সে আশ্বিনকে চোখে হারায়। পড়ালেখার ফাঁকে এই অবসর সময়ে আশ্বিনের সাথে গল্প গুজব করে কাটাতে ভালো লাগে। তবে কি আশ্বিনের মতো ওহির মনেও এসেছে এই ভালোলাগার বসন্ত!
–এভাবে একা একা হাসছিস কেন তুই?
–কিছু বললে ভাইয়া?
–দুই মিনিট ধরে তোর ঘরে এসে তোকে দেখে যাচ্ছি, সেই কখন থেকে কোথায় হারিয়ে গিয়ে আপনমনে হেসে যাচ্ছিস। কাহিনী কি?
–কিছু না তো, এমনি। পড়া নিয়েই ভাবছিলাম।
–পড়া নিয়ে ভেবে হাসছিলি কথাটা কি বিশ্বাস করার মতো?
–আরে ভাইয়া, তুমি যাও তো তোমার ঘরে।
বাই দ্য ওয়ে, কাল বিকেলে যে আফরা আপুর সাথে পার্কে বসে আড্ডা দিচ্ছিলে, মাকে গিয়ে বলবো?
ওহির কথায় ওসমান থতমত খেয়ে যায়। খাট থেকে উঠে সোজা বসে,
–আ…আরে মাকে কেনো বলবি? তুই যেমন ভাবছিস তেমন কিছুই না..আসলে আমি গিয়েছিলাম পার্কে ঘুরতে। তারপর সেখানে আফরার সাথে দেখা হয়েছে তাই আরকি…।
ওসমানের এমন ভয় ভয় কণ্ঠ শুনে ওহি অনেক কষ্টে নিজের হাসি চাপিয়ে রেখেছে। তখন ওসমান তার দিকে তাকিয়ে,
–এক মিনিট! আমি যে পার্কে ছিলাম এটা তুই জানলি কিভাবে? মানে, তুইও পার্কে গিয়েছিলি।
ওসমানের কথায় ওহি আঁতকে উঠে। সে তো নিজের কথার জালে নিজেই ফেঁসে গেলো! বেচারি ক্লাস শেষে আশ্বিনের কাছে পড়া শেষ করে একসাথে একটু ঘুরতে গিয়েছিলো। সেখানেই আফরা আর ওসমানকে দেখে কোনমতে পালিয়ে এসেছে। আর এখন সে নিজেই এই কথা ওসমানকে বলে দিলো!
–হ্যাঁ! ইয়ে..মানে…গিয়েছিলাম একটু ঘুরতে।
–কার সাথে?
–কা..কার সাথে আবার? একাই গিয়েছিলাম।
–ওহি! তোর কাজকর্ম আচরণ কিন্তু সুবিধার লাগছে না। প্রেম টেম করছিস নাকি? মাকে বলতে হবে আমার, দাঁড়া।
–আরে ভাইয়া, কিসের প্রেম ভালোবাসা? এসব আবার কি জিনিস? এই শব্দের অর্থই তো আমি জানি না। মনে হচ্ছে মাঝে মাঝে নাটক সিনেমায় শুনেছি খালি।
–ও আচ্ছা!
–হুম। আর, তুমি মাকে বলে দিলে কিন্তু আমিও বলে দিবো।
–কি বলে দিবে আমাকে?
ফারজানা বেগম ওহির রুমে প্রবেশ করে কথাটা বলে উঠে। ওসমান আর ওহি একে অপরের দিকে তাকিয়ে চোখ দিয়ে ইশারা দেয়।
–কিছু না মা। ওহি পড়া চুরি করছিলো তাই বলেছি তোমাকে বলে দিবো। এই মেয়ে, ভালো করে পড়।
ওসমান ওহির মাথায় আলতো করে বারি দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। ওহি ভাইয়ের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে হেসে উঠে।
–চলবে(ইনশাআল্লাহ)
#এক_মুঠো_অনুভূতি💖
লেখিকা- তাহসীন নাওয়ার রীতি
পর্ব:২০
লাইব্রেরীতে বসে আশ্বিনের দেওয়া নোটগুলো দেখছে ওহি। পাশে বসে জাইমা বইয়ের দিকে হাসি হাসি মুখ নিয়ে তাকিয়ে আছে। ওহি তার ভাব ভঙ্গি কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে,
-ব্যাপার কি বল তো? মনে হচ্ছে আজ তুই অনেক খুশি! কিছু কি হয়েছে নাকি, এভাবে সাজগোজ করে ভার্সিটি এসেছিস?
–আগে বল তো আমাকে কেমন লাগছে? সব ঠিকঠাক আছে তো?
ওহি ভ্রু যুগল কুঁচকে জাইমার দিকে ভালোভাবে তাকিয়ে,
–ঠিকই তো আছে। হঠাত এতো সিরিয়াস হয়ে সাজগোজ করলি কেনো তুই? কোথাও যাবি নাকি?
–হ্যাঁ। রোদ ভাইয়া বলেছে আমাকে কোথায় যেন নিয়ে যাবে।
–ওহ! এই ঘটনা তাহলে..।
জাইমা কথাটা শুনেই লজ্জা লজ্জা ভাব নিয়ে তার মুখ ঢেকে ফেলে। ওহি আড়চোখে জাইমার ভাব দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পড়ায় মনোযোগ দেয়।
–তুইও আমাদের সাথে যাবি ওহি।
–আমি গিয়ে কি করবো? কাবাবে হাড্ডি হওয়ার ইচ্ছে আমার নেই।
–বেশি বুঝিস না তো। আশ্বিন ভাইয়া, আফরা আপু সবাই যাবে, তাহলে তুই যাবি না কেনো? আমার সাথে তুইও যাবি।
–আচ্ছা ঠিক আছে।
ওহি কথাটা বলতেই রাফিন লাইব্রেরীতে প্রবেশ করে ওহির সামনে এসে বই নিয়ে বসে। দুজন টুকটাক গল্প করে নিজেদের পড়ায় মনোযোগ দেয়। জাইমা একবার রাফিনের দিকে তাকিয়ে আবার ওহির দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভেবে উঠে চলে যায়।
ক্লাস শেষে দুজন আশ্বিনের গাড়িতে এসে বসে আছে। আশ্বিন হাসান স্যারের রুম থেকে বেরিয়ে এসে গাড়ি স্টার্ট দেয়। তখন জাইমা আশ্বিনের দিকে তাকিয়ে,
–আশ্বিন ভাইয়া, রোদ ভাইয়া কোথায়? উনি যাবেন না?
–রোদ আর আফরা আগেই চলে গিয়েছে জাইমা। আমাকে বললো তোমাদের নিয়ে যেতে।
–ওহ আচ্ছা।
জাইমা আর কথা না বারিয়ে চুপচাপ বসে থাকে। এদিকে ওহির কেনো জানি ব্যাপারটা সন্দেহজনক মনে হচ্ছে। ঘুরতে যাবে রোদ্দুর আর জাইমা, তাহলে তারা সাথে যাচ্ছে কেনো? কিছু একটা তো চলছেই আশ্বিন ভাইয়া আর রোদ্দুর ভাইয়ার মনে। কিন্তু কি?
কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা একটা রেস্টুরেন্টের সামনে চলে এসেছে। আশ্বিন গাড়ি পার্ক করে তাদের নিয়ে রেস্টুরেন্টের হলরুমে চলে আসে। সেখানে যেতেই ওহি আর জাইমা অবাক হয়ে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। পুরোটা রুম ফুল আর ক্যান্ডেল দিয়ে সাজানো হয়েছে।
–আশ্বিন ভাইয়া! এখানে কি কারো বিয়ে হবে নাকি? আমরা মনে হয় ভুল জায়গায় চলে এসেছি।
ওহির কথায় আশ্বিন তার দিকে ফিরে তাকিয়ে,
–না। আমরা ঠিক জায়গাতেই আছি।
–মানে কি? এখানে রোদ্দুর ভাইয়ার বিয়ে হচ্ছে! সেদিন ভাইয়া বলেছিলো জাইমাকে সারপ্রাইজ দিবে। এখন দেখছি ভাইয়া হুট করেই তার বিয়েতে আমাদের দাওয়াত দিয়ে সারপ্রাইজ দিলো। আহারে আমার বান্ধবীটা। জাইমা’রে তোর কপাল পু/ড়ে গেলো রে।
ওহির কথায় জাইমা তার দিকে ফিরে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মুহূর্তেই কান্না শুরু করে। জাইমার এভাবে হুট করেই কান্না দেখে ওহি তাকে শান্ত করার পরিবর্তে উল্টো আরো আজগুবি কথা বলে তার মাথা নষ্ট করতে থাকে।
এদিকে ওহির কথা আর জাইমার এমন ম/রা কান্না দেখে আশ্বিন কিছুক্ষণ আহাম্মকের মতো দাঁড়িয়ে তাদের কর্মকান্ড দেখছে। বিষয়টা হাতের নাগালের বাহিরে চলে যাওয়ার আগেই সে বিষয়টা সামলে নিতে চেয়েও কোনভাবেই জাইমাকে শান্ত করতে পারছে না, আর না পারছে ওহিকে চুপ করাতে। শেষে মাথা ঠান্ডা করে নিচে গিয়ে আফরাকে ডেকে নিয়ে আসে।
–কি হয়েছে জাইমা? কাঁদছো কেনো তুমি?
আফরা এসে জাইমার পাশে বসে পড়ে। জাইমা বেচারীর কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠে গিয়েছে। ওহি জাইমার অবস্থা দেখে চুপ হয়ে যায়। ছোট থেকেই জাইমা একটুতেই এভাবে কান্না করে, আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ওহি প্রথমে শুধুমাত্র জাইমাকে ভয় দেখানোর জন্য মজা করে কথাগুলো বললেও, এখন নিজের কাছেই খারাপ লাগছে তার। ওহি চুপ করে আড়চোখে একবার আশ্বিনের দিকে তাকাতেই দেখে সে রাগী ভাবে ওহির দিকে তাকিয়ে আছে।
ঠিক তখনই রুমের লাইট অফ হয়ে যায়। ওহি হঠাত করেই চমকে উঠে আশ্বিনের হাত ধরে ফেলে কি হলো তা বোঝার চেষ্টা করতে থাকে। তখনই পুরো রুমে হালকা নীল আলো জ্বলে উঠে আর দরজার সামনে কারো উপর সাদা আলো পড়ে। সবাই সেদিকে তাকিয়ে দেখে রোদ্দুর হাতে গিটার নিয়ে তাদের দিকেই এগিয়ে আসছে। জাইমা সহ সবাই চুপ হয়ে রোদ্দুরের দিকে তাকিয়ে আছে।
“কারণে অকারণে নিষেধে বা বারণে
তোমার নামেই যতো জোছনা নিলাম
নিয়মে অনিয়মে দহনে বা ধারণে
আমায় নিখোঁজ ভাবো বা পাশেই ছিলাম
চোখে জল নোনা কি
নিয়ে গেলো জানাকি
কেনো আমি পথে একা দাঁড়িয়ে
আলোদের পিয়নে সোডিয়াম নিয়নে
সবাই কোথায় হারিয়ে…
আমি তোমার দ্বিধায় বাঁচি
তোমার দ্বিধায় পুঁড়ে যাই
এমন দ্বিধার পৃথিবীতে
তোমায় চেয়েছি পুরোটাই….”
রোদ্দুর গান শেষ করে ধীরে ধীরে জাইমার সামনে এসে দাঁড়ায়। তখন রুমে আবারও লাইট জ্বলে উঠে। জাইমা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে রোদ্দুরের দিকেই। রোদ্দুর আশ্বিনের দিকে গিটার দিয়ে একটা গোলাপ ফুলের তোড়া নিয়ে জাইমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে। ওহি আর আফরা তখন জাইমার পাশ থেকে উঠে সরে যায়। জাইমা এখনও অবাক হয়েই তাকিয়ে আছে। রোদ্দুর জাইমার চোখের পানি মুছে দিয়ে,
“তোমার চোখের পানিতে নয়,
তোমার ঠোঁটের এই হাসির সাথে আমি অভ্যস্ত।
তোমার কষ্টের কারণ হয়ে নয়,
তোমার খুশির কারণ হয়ে আমি থাকব অনন্ত।
তুমি মিশে আছো আমার দৈনন্দিন জীবনের অভ্যাসে,
এ নিয়ম পরিবর্তন হওয়ার নয়।
তুমি কি, আমার হৃদয়ের প্রশান্তির কারণ হবে?
ভালোবাসাবে আমায়?”
রোদ্দুরের কথায় জাইমা খুশি হয়ে মাথা নাড়িয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে। সবাই মিলে খুশিতে হাত তালি দিতে শুরু করে তখনই উপর থেকে তাদের উপর গোলাপের পাপড়ি পড়তে থাকে।
ওহি খুশি হয়ে জাইমা আর রোদ্দুরের দিকে তাকিয়ে আছে। আশ্বিন ওহির দিকে একনজর তাকিয়ে সবার খাবারের ব্যবস্থা করতে চলে যায়।
খাওয়া শেষে রোদ্দুর আফরা আর জাইমা একসাথে বসে গল্প করছে। ওহি তাদের থেকে একটু দূরে বসে তাদের দেখে যাচ্ছে তখনই আশ্বিন এসে তার পাশে বসে।
–তাদের একসাথে খুব সুন্দর লাগছে তাই না আশ্বিন ভাইয়া?
–হুম। মনের মিল থাকলে, ভালোবাসা এসে সাড়া দিবেই।
–রোদ্দুর ভাইয়া আজ কি সুন্দর করে জাইমাকে প্রোপজ করলো! অনেক বেশি কিউট লেগেছে আমার কাছে। মানতে হবে, ভাইয়ার ভালোবাসা প্রকাশের পদ্ধতিটা খুব সুন্দর ছিলো।
ওহির কথায় আশ্বিন তার দিকে ফিরে তাকিয়ে,
–প্রকাশ না করলে কি ভালোবাসা বোঝানো যেতো না ফাইজা?
ওহি আশ্বিনের কথায় চুপ হয়ে যায়। সে কথার অর্থ বোঝার জন্য আশ্বিনের দিকে ফিরে তাকায়। আশ্বিন তার দিকে তাকিয়ে,
–আমি তো শুনেছিলাম, ভালোবাসা গোপনেই বেশি সুন্দর। যাকে ভালোবাসি তার কাছে নিজের মনের অব্যক্ত কথাগুলো প্রকাশ না করলেও ব্যাবহার, আচরণ আর আগলে রাখা দেখেই সে বুঝে যাবে তাকে কতটা ভালোবাসি। আর, অপ্রত্যাশিত কথাগুলো যদি সে বুঝতেই না পারে, তবে সেই সম্পর্কে ভালোবাসি কথাটা শুধু মুখেই প্রকাশ পায়, হৃদয়ে না।
আশ্বিন কথাগুলো বলে সেখান থেকে উঠে চলে যায়। ওহি আশ্বিনের যাওয়ার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।
–এর দ্বারা কি বোঝালেন আশ্বিন ভাইয়া? উনি কি নিজের মনের কথাগুলো বোঝার ইশারা দিলেন আমায়?
আনমনে কথাগুলো বলে উঠলো ওহি।
——————-
দেখতে দেখতে সময় অতিবাহিত হলো সময়ের গতিতে। চলে এসেছে সকলের ফাইনাল পরীক্ষা। সবাই এখন পড়া নিয়ে মহাব্যাস্ত। আর একসপ্তাহ পর থেকে পরীক্ষা তাই ওহি লেগে পড়েছে তার স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে।
আশ্বিন আফরা মিলে রোদ্দুরের বাসায় এসেছে এক সাথে পড়ার জন্য। কিন্তু আফরা আর আশ্বিন পড়লেও, রোদ্দুর কখন থেকে বিছানায় শুয়ে শুয়ে জাইমার সাথে ফোনে গল্প করছে।
আশ্বিন আর আফরা সেদিকে পাত্তা না দিয়ে নিজের মতো করেই পড়ে যাচ্ছে। হঠাত ধপ করে কিছু পড়ার শব্দ শুনে দুজন চমকে উঠে সামনে তাকিয়ে দেখে রোদ্দুর কথা বলতে বলতে হুশ হারিয়ে খাট থেকে পড়ে গিয়েছে। আশ্বিন রোদ্দুরের কাজে হেসে উঠলেও আফরা বিরক্ত হয়ে,
–এখন থাম তো রোদ। যেভাবে হুশ জ্ঞান হারিয়ে জাইমার পেছন লেগেছিস, কদিন পর যে পরীক্ষা সেই খেয়াল আছে তোর?
–একে কিছু বলিস না আফরা। নিজে তো ফেল করবেই, জাইমাকেও ফেল করাবেন উনি।
–ফেল কেনো কবরো আমি? তোরা দুজন আছিস কি জন্য? আমায় পাশ করতে সাহায্য করবি তোরা।
–এই চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে পড়তে শুরু কর। একটা লাইনও দেখাবো না আমরা। তাই বলছি, এখনও সময় আছে তুইও পড়, জাইমাকেও পড়তে’দে।
আফরা কথাটা বলে রোদ্দুরের দিকে বই এগিয়ে দেয়। রোদ্দুর মুখ বাঁকিয়ে বই নিয়ে পড়তে শুরু করে।
রাত প্রায় দশটা! ওহি ওয়াশরুম থেকে হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে এসেছে। নাওয়া খাওয়া বাদে বাকিটা সময় পড়ার টেবিলেই অতিবাহিত হচ্ছে তার। মুখ মুছে টাওয়াল রেখে পড়ার টেবিলে এসে বসতেই ফোনে একটা ম্যাসেজ আসে। ওহি ফোন হাতে নিয়ে দেখে আশ্বিনের ম্যাসেজ,
“একটু নিচে আসবে ফাইজা? অনেক জরুরী।”
ম্যাসেজটা দেখে ওহি ভ্রু কুঁচকে ফেলে। নিচে যাবো মানে? আশ্বিন কি নিচে দাঁড়িয়ে? সে দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে বারান্দায় এসে নিচে তাকিয়ে দেখে আশ্বিন দাঁড়িয়ে তাকে ইশারায় নিচে যেতে বলছে। ওহি অবাক হয়ে আশ্বিনকে ফোন করে,
–আপনি এতো রাতে এখানে কি করছেন?
–কয়েকটা নোট দেওয়ার ছিলো তোমাকে। এই কদিন তো দেখা হয়নি, পরীক্ষার আগে দেখা হবেও না। তাই দিতে এসেছি।
–নোটগুলো তো আপনি কাল সকালেও দিতে পারতেন।
ওহির কথায় আশ্বিন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে,
–আমি এতসব ভেবে দেখিনি। তুমি জলদি এসে নোট নিয়ে যাও।
–আমি এতো রাতে নিচে কিভাবে আসবো আশ্বিন ভাইয়া? মাকে কি বলবো আমি? আর আশেপাশের কেউ দেখে ফেললে কি মনে করবে?
–ফাইজা, তুমি কি ঘন্টার পর ঘন্টা এখানে দাঁড়িয়ে থাকবে নাকি? নোট গুলো নিয়েই তো চলে যাবে।
–তবুও। আশ্বিন ভাইয়া…।
–ফাইজা, তুমি আসবে নাকি না?
–আসছি।
আশ্বিনের কথায় বোঝাই যাচ্ছে সে আর কথা বাড়ালেই সে রেগে যাবে। ওহি কি করবে বুঝতে না পেরে ধীরে ধীরে রুম থেকে বেরিয়ে একবার মায়ের রুমে আর ওসমানের রুমে উকি দিয়ে খুব সাবধানের সাথে গেইট খুলে নিচে নেমে আসে।
আশ্বিন তখন বাইকের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। ওহিকে এভাবে চো/রে/র মতো আশেপাশে তাকিয়ে আসতে দেখে আশ্বিনের অনেক হাসি পাচ্ছে। তবে মেয়েটিকে এই মুহূর্তে অদ্ভুত মায়াবী লাগছে তার কাছে।
ওহি আশ্বিনের সামনে এসে চশমাটা ঠিক করে ফিসফিস করে,
–আপনার জন্য আমাকে এভাবে লুকিয়ে আসতে হলো। কি দরকার ছিলো আপনার এতো রাতে এখানে আসার।
ওহি আপনমনে তাকে কথাগুলো বললেও সেদিকে কোন খেয়াল নেই আশ্বিনের। সে মুগ্ধ হয়েই তাকিয়ে আছে ওহির দিকে। কেনো যেন ওহিকে আজ অনেক মিস করছিলো সে। তাই তো, নোটের বাহানায় চলে এসেছে তাকে দেখার জন্য।
–আশ্বিন ভাইয়া। আমার কথা শুনতে পারছেন আপনি?
–কি? ওহ হ্যা, শুনতে পারছি। এই নাও তোমার নোট।
–ধন্যবাদ।
ওহি নোট নিয়ে চলে আসতে নিতেই আশ্বিন তার হাত ধরে তাকে থামিয়ে দেয়। ওহি আশ্বিনের দিকে ফিরে তাকাতেই আশ্বিন ওহির কাছে এসে আলতো করে তার সামনের চুলগুলো কানের পিঠে গুজে দেয়। ওহি তার এমন কাছে খানিকটা অবাক হয়েই তাকিয়ে আছে। আশ্বিন ওহির চোখের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বলতে নিবে তখনই ওসমান উপর থেকে ওহিকে ডাকতে শুরু করে। ওহি চমকে উঠে আশ্বিনের থেকে দূরে সরে গিয়ে,
–আশ্বিন ভাইয়া, আপনি এখনই চলে যান।
–আরে ফাইজা…।
কে শুনে কার কথা! ওহি আশ্বিনকে যাওয়ার জন্য ধাক্কা দিতে থাকে তাই আশ্বিন বাধ্য হয়ে সেখান থেকে চলে যায় আর ওহিও উপরে চলে আসে।
–চলবে(ইনশাআল্লাহ)