এক মঠো অনুভূতি পর্ব ১৭+১৮

0
690

#এক_মুঠো_অনুভূতি💖
লেখিকা- তাহসীন নাওয়ার রীতি
পর্ব:১৭

কাঁচের চুরির দিকে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে ওহি। বরাবরই চুরির প্রতি তার এক দুর্বলতা কাজ করে। হঠাত তাদের মধ্যে থেকে নীল রঙের একসেট চুরি হাতে পড়ে দেখতে থাকে।
–আপা, চুরিটা আপনার হাতে অনেক সুন্দর লাগতেছে।
ওহি চুরি থেকে চোখ তুলে সামনে তাকিয়ে দেখে চুরি বিক্রেতা মহিলা তার দিকেই তাকিয়ে।
–ধন্যবাদ। কিন্তু আমি তো সাথে টাকা নিয়ে আসিনি। আর আমার ভাইয়াও ওদিকটা গিয়েছে। আমি নাহয় একটু পরে এসে চুরিটা কিনে নিবো।
–আচ্ছা, ঠিক আছে।

ওহি চুরি রেখে অন্যদিকে চলে যায়। ওসমান আফরা, রোদ্দুর আর জাইমা একসাথে ঘুরছে আর গল্প করছে। ওহিকে দেখেই ওসমান বলে উঠে,
–এসেছিস তুই? আমাকে না বলে কোথায় চলে গিয়েছিলি তুই?
–ভাইয়া আমি…।
–ওসমান ভাই, বাদ দাও। ওহি তো আর একা ছিলো না, তার সাথে তো আশ্বিন ছিলোই। তাই সমস্যা হতো না।
রোদ্দুরের কথায় ওহি কপাল কুঁচকে ফেলে। আশ্বিন ছিলো মানে! ওহি তো এতোক্ষণ একাই ঘুরঘুর করছিলো। হঠাত আশ্বিনের কণ্ঠ শুনে ওহি সহ সবাই পেছনে ফিরে তাকায়।
–মেলায় কি সারাদিন থাকবি নাকি তোরা? এবার চল যাই।
–আরে এখনও তো কিছুই ঘুরে দেখলাম না। এখনই কিসের যাওয়া?
আফরার কথায় জাইমাও তাল মিলিয়ে মাথা নাড়ে। রোদ্দুর তাদের দিকে তাকিয়ে সবাইকে নিয়ে চরকি চড়তে আসে।

বাকি সবাই হুরমুর করে চরকিতে উঠে পড়লেও ওহি চরকির দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে।
–আমি যাবে না। তোমরা সবাই যাও।
–আরে ওহি, ভয় পাচ্ছিস কেনো? আমরা আছি তো।
জাইমা কথাটা বলেই ওহির হাত টেনে তাকে পাশে বসিয়ে দেয়। ওহি উঠে যাওয়ার জন্য জোর করতে শুরু করে, তখনই ওহির মুখোমুখি এসে বসে আশ্বিন। আশ্বিনকে দেখে মুহূর্তেই ওহি চুপ হয়ে যায়। তখনই চরকি উঠতে শুরু করে। ধীরে ধীরে চরকির গতি বেড়ে যায়। ওহি সহ জাইমা, আফরা সবাই চিৎকার শুরু করে। ওহি বেচারি এমনিতেই ভয়ে ছিলো তার উপর জাইমাকে এভাবে চিৎকার করতে দেখে নিজেও চোখ বন্ধ করে চিৎকার করে যাচ্ছে। এদিকে ওসমান আর রোদ্দুর তাদের কর্মকান্ড দেখে হেসে যাচ্ছে।
অবশেষে চরকি থেমে যেতেই ওহি ধীরে ধীরে চোখ খুলে তাকায়। আফরা আর জাইমার দিকে তাকিয়ে দেখে তারা ভয়াত্ব দৃষ্টিতে স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। ওহি তাদের দিকে রাগি চোখে একবার তাকিয়ে সামনে ফিরে দেখে আশ্বিন দাঁতে দাঁত চেপে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ওহি আশ্বিনের এভাবে তাকিয়ে থাকা বুঝতে পারছে না।
–হাত ছাড়ো আমার।
ওহি হাতের দিকে তাকিয়ে দেখে সে আশ্বিনের হাত খামছে ধরে আছে। ভয়ে কখন এমন কাজ করেছে জানা নেই তার। সে সাথে সাথে হাত সরিয়ে নিতেই আশ্বিন নেমে যায়।

রোদ্দুর আর ওসমান পাশাপাশি বসে আছে আর তাদের মুখোমুখি বসেছে আফরা জাইমা আর ওহি। আফরা ব্যাগ দিয়ে রোদ্দুরকে একটা বারি দিয়ে।
–তোর জন্য আজ আমার জান বেরিয়ে যাচ্ছিলো। ফাজিল ছেলে, তোকে তো আমি..।
–আরে আফরা, তুই যে এমন ভিতু। এটা তো আমি ভুলেই গিয়েছিলাম।
রোদ্দুর কথাটা বলেই ওসমানের সাথে হাসতে শুরু করে। জাইমা আর আফরা মুখ ফুলিয়ে বসে আছে। তখন আশ্বিন সবার জন্য আইসক্রিম নিয়ে আসে।
ওহি আইসক্রিম খেতে খেতে আশ্বিনের হাতের দিকে তাকিয়ে দেখে তার হাত অনেকটা কেঁটে গিয়েছে। খারাপ লাগে ওহির, সে তো ইচ্ছাকৃত ভাবে এমনটা করেনি।
খাওয়া শেষে সবাই মিলে যাওয়ার জন্য গাড়িতে এসে বসে। আশ্বিন গাড়ি স্টার্ট দেয় তখন আফরা আর জাইমা তাদের ছোট খাট কেনাকাটা গুলো দেখতে থাকে। ওহি সেদিকে তাকাতেই তার চুরিগুলোর কথা মনে পড়ে যায়।
–ভাইয়া আমি তো একটা চুরি…।
কথাটা বলেই থেমে যায় ওহি। এখন আর বলে লাভ নেই, মেলা থেকে তারা অনেকটা দূর চলে এসেছে।
–কিছু বলবি ওহি?
–না ভাইয়া। কিছু না…।
ওহি কথাটা বলে মন খারাপ করে গাড়ির সিটে হেলান দেয়। আশ্বিন লুকিং গ্লাস দিয়ে ওহির দিকে একবার ফিরে তাকায়।
—————-

রিসোর্টে এসে ঘুরঘুর করে সবাই ক্লান্ত হয়ে আছে। ওহি তাদের থেকে দূর এসে একা একাই লেকের পাড়ে বসে পড়ে। হঠাত কারো উপস্থিতি বুঝতে পেরে পেছনে ফিরে দেখে আশ্বিন। সে ধীরে ধীরে ওহির পাশে এসে বসে।
–আশ্বিন ভাইয়া, দেখুন কতো মাছ!
–হুম। একা বসে আছো কেনো?
–কিছু মুহূর্তে আছে যেগুলো একা উপভোগ করতেই বেশি ভালো লাগে। তবে, এখন আপনি সঙ্গ দিলেও আমার খারাপ লাগবে না।
আশ্বিন ওহির দিকে তাকিয়ে কিছু না বলে চুপ করে থাকে।
–আশ্বিন ভাইয়া, আপনি এখনও আমার উপর রাগ করে আছেন? আপনার কি সত্যিই মনে হয় আমি আপনাকে নিষেধ করে রাফিন ভাইয়াকে বলেছি রোহানকে একটা শিক্ষা দিতে?
–না! আমি জানি তুমি রাফিনকে কিছু বলো নি।
–তাহলে আপনি রাগ করেছেন কেনো?
ওহির কথায় আশ্বিন চুপ হয়ে যায়। ওহিকে কিভাবে বোঝাবে সে তার রেগে থাকার কারণ যে ভিন্ন। প্রিয় মানুষের উপর অন্য কারো কর্তৃত্ব মেনে নেওয়া কারো পক্ষেই সম্ভব না, আশ্বিনও তাদের থেকে ব্যতিক্রম কেউ নয়।
আশ্বিন কিছু না বলে ওহির দিকে একটা প্যাকেট এগিয়ে দেয়। ওহি তার দিকে তাকিয়ে কিছুটা অবাক হয়ে,
–কি এটা?
–খুলে দেখো।
ওহি আগ্রহ নিয়ে প্যাকেট খুলে দেখে এটা তার মেলায় পছন্দ করা সেই চুরি। ওহি অবাক হয়ে আশ্বিনের দিকে তাকিয়ে দেখে সে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে লেকের পানির দিকে।
–আপনি এটা কখন নিয়ে এসেছেন?
–যখন সবার জন্য আইসক্রিম নিয়ে আসতে গিয়েছিলাম।
–তার মানে আমি যখন একা একা চুরি দেখছিলাম তখন সত্যিই আপনি আমার আশেপাশে ছিলেন।
ওহির প্রশ্নের কোন উত্তর দেয় না আশ্বিন। ওহি খুশি হয়ে চুরিগুলোর দিকে তাকিয়ে একটা লাজুক হাসি দেয়।
–কেউ চুরি উপহার দিলে কিন্তু সেটা পরিয়ে দিতে হয়।
ওহির কথায় আশ্বিন অবাক নয়নে তার দিকে ফিরে তাকায়। ওহি ততক্ষণে আশ্বিনের দিকে চুরিগুলো এগিয়ে দিয়েছে। আশ্বিন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে চুরিগুলো ওহির হাতে পড়িয়ে দেয়।
–ধন্যবাদ।
ওহি এখন নিজেই নিজের এমন কাজে অবাক হচ্ছে। কিভাবে সে আশ্বিনকে চুরি পড়িয়ে দিতে বললো! লাজে কানগুলো গরম হয়ে আসে তার। আশ্বিন অন্যদিকে ফিরে আছে, তাই হয়তো দেখতে পারছে না ওহির গালের রক্তিম এই আভা।

দূর থেকে আফরা, রোদ্দুর আশ্বিন আর ওহিকে একসাথে দেখে একটা বিজয়ের হাসি দেয়। অবশেষে তাদের রাগের বরফ গলে গিয়েছে। আফরাকে হাসতে দেখে ওসমান বলে উঠে,
–সুন্দরী মেয়েদের অকারণে দেওয়া হাসিটা কিন্তু দেখার মতো হয়।
আফরা ওসমানের দিকে তাকিয়ে,
–কিন্তু আমি তো জানতাম শ্যামবর্ণ-মায়াবী মানুষের হাসি বেশি সুন্দর হয়।
–তাই নাকি?
–হুম। এই যেমন আপনি..।
আফরার কথায় ওসমান হেসে উঠে,
–জানতাম না তো। আপনার কাছে কথাটা জেনে অনেক ভালো লাগলো।
–কেনো? মেডিকেলে পড়েন, সেখানে কোন সুন্দরী আপনাকে কথাটা বলেনি?
–আর সুন্দরী! পড়ার চাপে কখন রাত হয় কখন দিন, তা দেখারই তো কখনো সময় পাইনি।
–ভালো কিছু পেতে হলে, কিছু সেক্রিফাইজ তো করতেই হয়।
–হুম।
আফরা আর ওসমান কথা বলছিলো তখন আশ্বিন আর ওহি এদিকে ফিরে আসে।
——————–

সন্ধ্যা হয়ে আসছে। চারদিকে ঠান্ডা বাতাস, যেকোন সময় হয়তো বৃষ্টি হবে। সবাই রাতের আধারে আগুন ধরিয়ে গোল হয়ে বসে গানের কলি খেলছে। একে একে সবাই গান গাওয়ার পর আশ্বিনের গানের সময় আসে। রোদ্দুর গিটার আশ্বিনের দিকে এগিয়ে দেয়। ওহি ভ্রু কুঁচকে আফরার কানে কানে,
–আপু, আশ্বিন ভাইয়া গান গাইতে পারেন?
–কি বললে? ওহি, তোমার কোন ধারনাই নেই আশ্বিনের গানের কণ্ঠ কতো সুন্দর। শুধু দেখতে থাকো।
ওহি আর কথা না বাড়িয়ে আশ্বিনের দিকে ফিরে তাকায়। আশ্বিন ইতোমধ্যেই গিটারে সুর তুলে গান শুরু করেছে,

“দূরে দূরে কেনো থাকো? পাশে এসে হাতটি ধরো।
চোখে চোখ রেখে বলো, ভালোবাসো।
ক্লাসের ফাঁকে তোমায় দেখে প্রথম প্রেমে পড়া।
তোমায় দেখে ভালো লাগা, তোমায় ঘিরে সব চাওয়া।
তুমি দূর.. থেকে কেনো হাসো?
আড়াল.. থেকে আমায় কাছে ডাকো।
কিছু মেঘ অগোচরে, ঠিক বৃষ্টি নামার পরে।
শীতল হাওড়া বইছে যেনো তোমায় দেখে,
আমি যাচ্ছি ডুবে ঘোরে, কোন রুপকথার দেশে।
আর আঁকছি তোমায় মনেরই ক্যানভাসে।”

আশ্বিনের গানের মাঝেই হঠাত বৃষ্টি শুরু হয়। ওহি আর আশ্বিন বাদে সবাই উঠে দাঁড়িয়ে দৌঁড়ে রিসোর্টের ভেতর চলে যায়। ওহি এখনো মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে আশ্বিনের দিকে। বৃষ্টির ফোঁটা বেয়ে পড়ছে আশ্বিনের চুল থেকে মুখে। অথচ দুজন তাকিয়ে আছে দুজনের দিকেই।

–চলবে(ইনশাআল্লাহ)

#এক_মুঠো_অনুভূতি💖
লেখিকা- তাহসীন নাওয়ার রীতি
পর্ব:১৮

সময়ের সাথে সাথে বৃষ্টির বেগ কিছুটা কমে এসেছে। তাই সবাই ফিরে যাওয়ার জন্য গাড়িতে এসে বসে। আশ্বিন সবকিছু ঠিকঠাক করে এসে গাড়ি স্টার্ট দেয়। গাড়ি চলছে তার আপন গতিতে। ঝিরঝির বৃষ্টি, অন্ধকার মেঘলা আকাশ তার সাথে তাল মিলিয়ে মেঘেদের ডাক, সব নিয়ে প্রকৃতির অদ্ভুত সৌন্দর্য ফুটে উঠেছে। ওহি জানালা দিয়ে তাকিয়ে সেই সৌন্দর্য উপভোগ করছে।

হঠাত তার হাতের চুড়ির শব্দ শুনে চোখ নামিয়ে হাতের দিকে তাকায়। চোখের সামনে ভেসে উঠে আশ্বিনের চুড়ি পড়িয়ে দেওয়া সেই মূহুর্ত। চুড়িগুলোয় আলতো করে হাত বুলিয়ে সামনে আশ্বিনের দিকে ফিরে তাকায়। হয়তো তখন আশ্বিন না দেখলে আজ প্রিয় চুড়িগুলো তার রেখেই আসতে হতো। কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই হঠাত হাঁচি দেয় ওহি। ওসমান ওহির দিকে তাকিয়ে,
–দেখেছিস ঠান্ডা লেগে গিয়েছে তোর। সবসময় একটু বৃষ্টিতে ভিজলেই এমন হয়। কি দরকার ছিল তখন বৃষ্টির মাঝে দাঁড়িয়ে থাকার?
–ভাইয়া, আমি…।
কথাটা বলতে বলতে আবারও হাঁচি দেয় ওহি। আশ্বিন লুকিং গ্লাস দিয়ে একবার ওহির দিকে তাকায়। আফরা ওহির দিকে টিস্যু এগিয়ে দিয়ে,
–আরো তখন কতোগুলো আইসক্রিম খেয়েছো! এর জন্যও তো হতে পারে।
ওসমান আফরার কথায় ওহিকে বকতে শুরু করে। ওহি চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে নেয়।
সবাইকে তাদের বাসায় নামিয়ে দিয়ে আশ্বিন ওহির বাসার সামনে আসে।
–বাসায় চলো আশ্বিন। বৃষ্টি একটু কমে গেলে নাহয় যাবে।
–সমস্যা নেই, ওসমান ভাই। আমার একটু কাজ আছে তাই এখনই যেতে হবে।
–ঠিক আছে তাহলে। সাবধানে যেও।
ওসমান কথাটা বলেই ওহিকে নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে তাদের বাসার গেইটে ঢুকে পড়ে। ওহি যাওয়ার সময় পেছনে ফিরে একবার আশ্বিনের দিকে তাকিয়ে দেখে আশ্বিন তার দিকেই তাকিয়ে আছে। ওহি কিছু না বলে চলে যেতেই আশ্বিন গাড়ি ঘুরিয়ে চলে যায়।
——————

ড্রইং রুমের সোফার উপর বসে আছেন ওহির বাবা। উনার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন ফারজানা বেগম। ওসমান আর ওহি ঘরে প্রবেশ করে বাবাকে দেখে দাঁড়িয়ে যায়। বাবার তো ব্যবসার কাজে দূরে ছিলেন, আজ তো উনার আসার কথা না, তবে কি তাদের ঘুরতে যাওয়ার খবর পেয়েই চলে এসেছেন? ওহির কথাটা মনে হতেই সে ওসমানের পিছনে সরে আসে। ওসমান ওহির এমন কাজে একনজর ওহির দিকে তাকিয়ে,
–কেমন আছো বাবা? কখন এসেছো?
–বিকেলেই এসেছি। এসেই তোমাদের সাহস দেখে অবাক হলাম।
বাবার কথায় ওসমান মায়ের দিকে ফিরে তাকায়। ফারজানা বেগম তখন ওসমানের থেকে চোখ সরিয়ে অন্য দিকে ফিরে। মায়ের এমন কাজে ওসমান বুঝে যায়, বাবাকে মা বলে দিয়েছে তাদের পিকনিকের কথা।
–ওহির সব ফ্রেন্ডের সাথে একটু পিকনিকে গিয়েছিলাম আমরা।
–আমার কাছে অনুমতি নিয়েছিলে ওসমান? আমার কথার উপর কিভাবে এমন করেছো?
–বাবা, আমরা তো শুধু…।
–একটা কথাও বলবে না তুমি। ওহি একটা মেয়ে, তার কিসের এতো বন্ধু থাকবে? তার উপর সবাইকে নিয়ে ঘুরতে যাচ্ছে, কতটা লজ্জার কথা।
–বাবা, ওহি তো একা যায়নি। আমি ছিলাম ওহির সাথে।
–আজ নাহয় ছিলে, কিন্তু তুমি কতোক্ষণ তার সাথে থাকবে ওসমান? ওহি দিন দিন যেভাবে বেপরোয়া হয়ে যাচ্ছে, তাকে মানুষ করা এখন আমার জন্য জরুরি হয়ে গিয়েছে। নয়তো ভবিষ্যতে আমার সম্মানে দাগ ফেলতে সে একবারও ভেবে দেখবে না।

বাবার কথা ওহি মাথা নামিয়ে রাখে। দুচোখ নিয়ে তার নোনাজল গড়িয়ে পড়ে। একটু ঘুরতে যাওয়ার জন্য বাবা তাকে নিয়ে এমন কিছু ভাববে জানা ছিলো না তার। ওসমান বাবার কথায় রেগে উঠে,
–এসব কি বললে তুমি বাবা? ওহি তোমার…।
ওহির উপর তোমার বিশ্বাস না থাকলেও, আমার বোনের উপর আমার পুরো বিশ্বাস আছে। তুমি ওহিকে কতোটুকু চেনো বাবা? কি জানো তার বিষয়ে? ছোট থেকেই তো দেখে এসেছি তুমি ব্যাবসার কাজ নিয়ে ব্যাস্ত। আমাদের দেওয়ার মতো সময় তোমার কখনও হয়ে উঠেনি, বাবা। তাই তোমার হয়ে আমি নিজে ওহিকে ছোট থেকে বড় করেছি। আমি জানি আমার বোনের কোনটা প্রিয়, কোনটা অপ্রিয়, কি তার ভালো লাগে, আর কি না। তুমি তো কখনো কোন কিছুর জন্য ওহিকে সাপোর্ট করোনি, বাবা। কিন্ত ওহির সফলতা নিয়ে ঠিকই বড়াই করেছো।
–ওসমান! বাবার সাথে এভাবে কথা বলছো তুমি?
–আমি এসব বলতে চাইনি মা। কিন্ত সত্যি এটাই যে, বাবার কথা মতো চলে আমি আমার সারাজীবন পড়ালেখার ভেতর কাটিয়ে দিয়েছি। কতোই আর বয়স ছিলো আমার, যখন ভাইদের সাথে বিকেলে একটু খেলতে গিয়েছিলাম বলে বাবা আমাদেকে সব আত্মীয়স্বজনের থেকে আলাদা করে দিয়েছিলো। বাবার কথা শুনতে, বাবাকে খুশি করতে আমি আর ওহি ছোট থেকেই সকল বাহ্যিক বিনোদন বাদ দিয়ে পড়ালেখাকে আপন করে নিয়েছি। তবুও দিন শেষে আমরা দুজন উনার ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য না। বাবার কেনো মনে হয়না, যে আমরা একজন মানুষ।

ওহির বাবা চুপচাপ দাঁড়িয়ে ওসমানের কথাগুলো শুনছে। ফারজানা বেগম একবার ওহির বাবার দিকে তাকিয়ে এসে ওসমানকে ইশারায় চুপ হতে বলে।
–তাকে থামিও না ফারজানা। একে তো আমাকে না বলে ঘুরতে গিয়ে অন্যায় করেছে, এখন এসে আবার আমার মুখের উপর কথা বলছে। আমার অনুপস্থিততে এসব শিখিয়েছো তুমি তাদের?
–আমি..? আমি এসব কিছুই…।
ওহির বাবা আর কথা না বাড়িয়ে রুমে চলে যায়। ওসমান তার বাবার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে নিজের ঘরে চলে যায়। ফারজানা বেগম কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে ওহির উপর রেগে,
–কি দরকার ছিল ঘুরতে যাওয়ার? তোমার এই ঘুরতে যাওয়ার জন্যই এখন বাবা ছেলের মাঝে ঝামেলা হলো। এখন আমাকেও ভুল বুঝেছেন উনি।
ফারজানা বেগম কথা বলে চলে যায়। ওহি এখনো নিবর দর্শক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
এসব কিছু তার জন্য হয়েছে! হাতের পিঠ দিয়ে চোখ মুছে নিজের ঘরে চলে এসে খাটের উপর শুয়ে পড়ে। চোখের জল যেনো আজ কোন বাঁধাই মানছে না। সারাদিনের সকল ভালোলাগা মুহূর্তেই ফিকে হয়ে উঠেছে তার কাছে।

এদিকে,

পার্কের নির্জন প্রহরে একাই বৃষ্টি বিলাস করছে আশ্বিন।গাড়ির উপর বসে আছে সে। বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটা তাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে তখন ওহির সাথে বৃষ্টি ভেজা সেই মূহুর্ত। অদ্ভুত এক ঘোরের মাঝে চলে গিয়েছিলো সে। বারবার নিজের মনকে প্রশ্ন করে যাচ্ছিলো, তার গাওয়া গানটি কি ওহিকে উদ্দেশ্য করেই ছিলো? সত্যিই কি দিন দিন ওহির মায়ায় নিজেকে হারিয়ে ফেলছে সে? তবে কি সে ভালোবেসে ফেলেছে তার পিচ্চি চশমাকে?
কথাগুলো ভেবে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওহিকে কল দেয়। কিন্তু ওহির ফোন রিসিভ না করায় ব্যাস্ত আছে ভেবে ফোনটা রেখে দেয় আশ্বিন।
এই প্রথম এতোটা সময় ধরে সে বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছে আশ্বিন। ছোটখাট বিষয় গুলো উপভোগ করতে কেনো যেন এখন ভালোই লাগে তার। হয়তো তার জীবনের বসন্তের ফুল ফুটে উঠেছে তাই।
—————

জ্বর আর প্রচন্ড মাথা ব্যাথা নিয়েও ভার্সিটির জন্য রেডি হচ্ছে ওহি। বাবা কাল সারাদিন রাগ দেখিয়ে সকালেই চলে গিয়েছেন। আর ওসমান মা-বাবা দুজনের উপরই অভিমান করে একপ্রকার তাদের এড়িয়ে চলছে।
–ভার্সিটি যাচ্ছো মা?
রুমে মায়ের কণ্ঠ শুনে ওহি একনজর মায়ের দিকে ফিরে তাকায়।
–হুম।
–আমার উপর এখনও রেগে আছো? সেদিন আমার মাথা ঠিক ছিলো না, তাই কথাগুলো বলে ফেলেছিলাম। মায়ের উপর আর রেগে থেকো না। তোমার বাবা, ওসমান সবাই রেগে আছে আমার উপর।
–রাগ করিনি মা। এমনি ভালো লাগছে ন। ভার্সিটি থেকে এসে কথা হবে, এখন আসছি।
ওহি কথাটা বলেই কাধে ব্যাগ ঝুলিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে পড়ে। ফারজানা বেগম মায়ের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

চুপচাপ একের পর এক ক্লাস করে যাচ্ছে ওহি। জাইমা ওহির গতিবিধি লক্ষ্য করে,
–কি হয়েছে তোর বল তো?
–কোথায়? কিছু হয়নি। কি হবে?
–এভাবে চুপচাপ করে থাকার মেয়ে তো তুই না। আর কাল সারাদিন আমার ফোন রিসিভ করিস নি কেনো?
–ভালো লাগছে না জাইমা। আজ বাসায় চলে যাই।
জাইমা ভ্রু কুঁচকে ওহির কপালে হাত রেখে,
–তোর তো জ্বর! এই শরীর নিয়ে ক্লাসে এসেছিস? এখনই বাসায় গিয়ে রেস্ট নে। আমাকে সাথে যেতে হবে?
–না আমি যেতে পারবো।
–ঠিক আছে। পৌঁছে ফোন করে জানিয়ে দিস।
ওহি মাথা নেড়ে ক্লাস থেকে বেরিয়ে যেতেই রাফিন তার সামনে আসে,
–ওহি, এই নাও নোটগুলো। যেগুলো বলেছিলে সব গুলোই মনে হয় আছে। তবুও কোনটা বাদ পড়লে আমাকে বলবে।
–ঠিক আছে ভাইয়া। অনেক ধন্যবাদ।
–আরে ব্যাপার না। তুমি কি অসুস্থ?

ওহি কথাটা বলতে গিয়ে পিছনে তাকিয়ে দেখে আশ্বিন যেতে যেতে তাদের দিকে তাকিয়ে মাঠের কাছে রোদ্দুরের পাশে বসে পড়ে।
–তেমন কিছু না ভাইয়া। একটু ঠান্ডা লেগেছে। আচ্ছা, আমি পরে কথা বলবো এখন বাসায় যাচ্ছি।
ওহি কথাটা বলে রাফিনের কাছে বিদায় নিয়ে মাথা নিচু করে আশ্বিনদের পাশ কাটিয়ে চলে যায়। আফরা আর রোদ্দুর ওহিকে ডাকতে গিয়েও কিছু বলে না। আশ্বিন ওহির যাওয়ার দিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে। তখন জাইমা তাদের কাছে আসায় রোদ্দুর বলে,
–ওহির কি হয়েছে জাইমা?
–জানি না। আমাকেও কিছু বলছে না, ক্লাসেও চুপচাপ ছিলো। কিছু হয়তো হয়েছে।
–হয়তো। তাই তো ওসমানও আমার ফোন,ম্যাসেজ কোন কিছুর উত্তর দিচ্ছেন না।
জাইমা আর আফরার কথায় আশ্বিন রোদ্দুরের দিকে তাকায়,
–কিছু একটা হয়েছে। কিন্ত কি?

–চলবে(ইনশাআল্লাহ)

((আসসালামু আলাইকুম। সবাইকে পহেলা ফাল্গুন এবং ভালোবাসা দিবসের শুভেচ্ছা। ধন্যবাদ))

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here