বাতাসে তার সৌরভ পর্ব ২৫

0
278

#বাতাসে_তার_সৌরভ–২৫

শহরের থেকে গ্রামে বিয়ের রিচুয়াল গুলো অনেক বেশি অথেনটিক হয়ে থাকে । ভিনদেশী কেউ এমন অনুষ্ঠানে আসার সুযোগ পেলে ছাড়তে চায় না। যে কারণে নদীর গায়ে হলুদের প্রচুর বিদেশি অতিথির ভীড়।
সুন্দরবনের কাছে ইউনাইটেড ন্যাশানের অধীনে একটা বন্যসম্পদের রিসার্চ টিমের সাথে এখানকার ইউ এন ও স্যারের মিটিং ছিল। মালেকা ফেরদৌস টিমের কাউন্সিলর।সাতদিন গভীর জঙ্গলে কাজ করে সবাই ক্লান্ত ছিল। বিদেশি সহকর্মীদের একটু রিফ্রেশমেন্টের জন্য এলাকার সম্ভ্রান্ত বাড়ির বিয়ের অনুষ্ঠানে যেতে আগ্রহ প্রকাশ করলেন। ইউ এন ও স্যার দ্রুতই ব্যবস্থা করে দিলেন।

শাহীনের বাবা শাহজাহান গোলদার এখানকার নামী ব্যবসায়ী। সরকারি ঠিকাদারি কাজে ইউ এন ও স্যারের সাথে যোগাযোগ হতে থাকে। মালেকার অতিথি নিয়ে প্রবেশ কঠিন হলো না। শাহজাহান সাহেবও সানন্দে রাজি হয়ে গেলেন। বাড়িতে বিলিতিরা এলে এলাকায় তার সম্মান বাড়বে।

বিদেশি অতিথিরা ক্যামেরা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে যাই দেখছে ক্লিক ক্লিক করে যাচ্ছে।এরা ইউরোপের নানান দেশের বাসিন্দা,তাদের ঢাকা থেকে হঠাৎ আসা আগন্তুককে নিয়ে একটা চাপা কৌতূহল থাকলেও অনুষ্ঠানের উত্তেজনায় চেপে গেছে।
অনুষ্ঠানে হলুদের বর-কনে বাদ দিয়ে সবার চোখ তাদের দিকে আবদ্ধ । উজ্জ্বল ত্বকের প্রতি বাঙালি জাতির একটা বিচিত্র মোহ কাজ করে, ঘন্টার পর ঘন্টা অপলক তাকিয়ে থাকে। এদের মাঝে এলে রম্যের চিড়িয়াখানার বাদরের প্রতি কেমন সমবেদনা হতে থাকে।

যদিও এখন এসব চিন্তার অবকাশ নেই, মন প্রতিমুহূর্তে প্রশ্ন করছে এভাবে আসা রম্যের ঠিক হলো কিনা। তার কয়েক হাত দূরেই স্টেজে বসা তার দীর্ঘ যাত্রার অবশেষ লক্ষ্য, কিন্তু যেন রাস্তা এখনো দুর্গম।

নিশির সাথে কয়েক দফা কথা হবার পরে হুট করে ফোন সুইচড অফ।রম্যকে দ্রুত দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল। টানা আঠেরো ঘন্টার জার্নি সেরে রাবেয়া আন্টির উত্তরার বাসায় চারঘন্টার ন্যাপ নিয়েছে ; এরপর নাকেমুখে কিছু খেয়ে ডমেস্টিক ফ্লাইট ধরে যশোর; যশোর থেকে বাইরোড খুলনা, সে থেকে সাতক্ষীরা। অনন্ত পথের যাত্রার ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য ছিল, তবে মন শান্ত হয়েছে বাস্তবে কণেরূপে একটা চেনামুখ দেখে।

একটা চেনা ট্রেডিশনাল পোশাকে কারো ব্যক্তিত্ব এত বদলে যায়! রম্য যাকে দেখছে সে সম্পূর্ণ ভিন্ন একজন,যার রূপ কোন গ্রিক গডেসের চাইতে কম নয়।
চিনেও যেন অচেনা,ভালো মতো নিশ্চিত হতেই এগিয়ে গিয়েছিলো আরও সামনে।চোখে চোখ পড়তেই কয়েক মুহূর্তের জন্যে মেহরোজের মুখভঙ্গি পাল্টে গেল।
পাশে বসা নিশি ইশারায় বলে দিল চুপ থাকতে। এখন নিশির মোবাইলেও যাচ্ছে না
রম্য অদ্ভুত দ্বিধা নিয়ে দাঁড়িয়ে, তার সামনে যে অনুষ্ঠান হচ্ছে তাও অদ্ভুত। এক একজন এসে একটা পাত্রে হলদে একটা পেস্ট থেকে একটু পেস্ট নিয়ে মেহরোজের গালে ঘষে দিচ্ছে আর মিষ্টি খাওয়াচ্ছে।লোকে-লোকারণ্য বাড়ি সবাই এক এক করে এসে এভাবে খাওয়াতে লাগলে এই অদ্ভুত অনুষ্ঠান শেষ হতে গোটা রাত লেগে যাবে।

হলুদ মাখানো অনুষ্ঠানের মাঝে স্টেজে গান উদ্দাম নাচ শুরু হলো।তীব্র শব্দে কান পাতা দায়। একসময় মেহরোজ আর নিশিকে আর দেখা গেল না। রম্য এমন বিচিত্র অবস্থায় পড়বে জীবনে ভাবেনি।

-স্যার, টেক দিস! ফিলিংগুড।

রম্য দেখলো অনুষ্ঠান আয়োজকের কেউ ট্রেতে ঘোলাটে পানির মতো কিছু দিয়ে আপ্যায়ন করছে। তার সাথে সঙ্গী-সাথীরা সবাই ছোট ছোট চুমুকে খাচ্ছে। এই দেশে খুলেআম এলকোহল খাওয়ার নিয়ম নেই। তবুও বিদেশিদের জন্য ভিন্ন ব্যবস্থা কিনা জানে না। রম্য তবু এড়িয়ে গেল,

– ভয় নেই কোকনাট ওয়াটার, খেয়ে নাও ভালো লাগবে, এত স্ট্রেসের পর শক্তি দরকার তোমার ” মধ্যম উচ্চতার শ্যামবর্ণের ছেলেটার মুখে স্পষ্ট আমেরিকান উচ্চারণ।আগুন্তক হাসিমুখে এগিয়ে এলো।

– গ্যাব্রিয়েল সামদানী ঠিক তো, আমি মবিন। ড্রিংকসটা খাও এরপর তোমার ওয়াশরুম যাবার দরকার হবে।

রম্য চমকে উঠলো, “আমি বুঝলাম না। ”

– বুঝবে, চল আমি তোমাকে ওয়াশরুমে নিয়ে যেতে যেতে বুঝাই।

মবিন ছেলেটার চোখের ইশারায় কিছু ছিলো রম্য দ্রুত ডাবের পানিটা শেষ করে নিলো।মবিন সাবধানে তাকে বিয়ের স্টেজের কোলাহলে থেকে সরিয়ে নিলো।

— তুমি কি মেহরোজের কাজিন?

– না এখানে তোমার মতোই অতিথি, পার্থক্য হলো আমি এখানে নিশির সাথে এসে আটকে গেছি, তুমি যেকোনো সময়ে আটকে যাবার রিস্কে আছ।

-এখানের সিচুয়েশন কিছুই বুঝতে পারছি না।
– বোঝানো কিছুটা জটিল কারণ সিচুয়েশনও জটিল।

– মেহরোজের সাথে দেখা করা খুব জরুরি৷ এটা কি সম্ভব?

– তোমার পক্ষে গাছে ওঠা সম্ভব?

মবিন ঘুরে তাকিয়েছে। রম্য দেখলো তারা কথায় কথায় বিয়ে বাড়ির ঝিলিমিলি আলোর থেকে দূর বাড়ির পেছন দিকে চলে এসেছে। দেয়াল ঘেষে থাকা বেশ বড় ছড়ানো গাছ সেখানে।আলো আধারিতে একটা বাশের মই দেখা যাচ্ছে একটা কিশোর বালক সেটা ধরে আছে । রম্য হতভম্ব।

মবিন হাসিমুখে বলল- অনুষ্ঠানে নদী মানে তোমার মেহেরোজ হলো মধ্যমনি।তাকে বের করা সহজ না একমাত্র ছাদই নিরিবিলি। এই গাছের বেশ ভারি ডাল দিয়ে ছাদে চলে যাওয়া যায়। একটু সাবধানে যেতে হবে পারবে তো?

” পারতে হবে ”

রম্য এগিয়ে গেল সিড়ির দিকে। মবিন হেসে অনুসরণ করতে করতে বলল
” বিশেষ কারো জন্য এমন কিছু করা যেতেই পারে, কী বল? ”

রম্য কিছু বলতে গিয়েও বলল না। মবিনকে কেন যেন ব্যখ্যা করতে ইচ্ছে হলো না। ব্যখ্যাটা যদিও তার কাছেও এখন অস্পষ্ট।

***
উদোম নাচে ফেটে পড়ছে স্টেজ।

” আমার ঘুম ভাঙাইয়া গেল গো…”

পুরো পাড়াশুদ্ধ সবার ঘুম ভাঙলেও গায়কের থামার নাম নেই। লাগাতার সাতবারের মতো স্টেযে গায়ক একই গান গেয়ে যাচ্ছে। কোন ভাবে থামলেই শাহীনের বন্ধুবান্ধব ধমকে উঠছে।শাহীনের হাতের বিশেষ বস্তু তার আত্মা শুকিয়ে দিয়েছে।
গায়ক বেচারা অসহায়ের মতো গাইতে গাইতে এদিকওদিক তাকাচ্ছে৷ বড় মামি নাজিয়ার মনে হলো বন্দুকের নলের আগে এই তামাশা সহ্য করাও আরেক শাস্তি। এমন ভয়ের কারণেই নদী চলে এসেছে স্টেজ থেকে।।মেয়েটাকে তার বড় মামা কী নিয়তে এনেছিলেন আর কী হচ্ছে!

– আসলেই এইসব কী হচ্ছে?

ভারী গুরুগম্ভীর কন্ঠে নাজিয়া চমকে তাকালেন। মোজাফফর সাহেবের বিস্ময় নিয়ে সামনে তাকিয়ে আছেন। প্রচন্ড ঝামেলার মধ্যে দায়সারা ভাবে দিনে একবারই মেপে পরিবারের সাথে কথা বলতেন এই দিকের অবস্থার খোঁজ নেওয়া হয়নি।ফিরে এসে দেখেছেন চারিদিক ঝলমল করছে বিয়ে বাড়ির সাজে । রানু দেখা যাচ্ছে ছেলের বিয়ের কাজ বেশ এগিয়েই নিয়ে গেছে। এইদিকে নদীর জন্য ঠিক করা খুলনার ছেলেটার পরিবার আবার যোগাযোগ করেছিলো। তারা এখনো আগ্রহী, নদীর বলা চলে সৌভাগ্য। যাক, ফারা কাটিয়ে ভাগ্নের বিয়েটার পরের দিন নদীরটার দ্রুত ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু এই ভিড়ের মধ্যে নদী আছে কোথায়?

*****

” এই এত মাথায় পানি ঢালছিস মেকাপ তো সব ধুয়ে যাবে রে ”

” মাথা ঘোরাচ্ছে মামি “নিশির কথায় মেজমামি কান্তা একটু ভীতু চোখে তাকালেন।” মাথা ঘোরাচ্ছে মানে কেন ঘোরাচ্ছে? ”

” শব্দ অনেক মামি ,এইজন্য মাথা ঘুরছে ” কান্তামামি আশ্বস্ত হলেন। সঙ্গদোষে সর্বনাশের সুক্ষ্ম ভয় থাকে। নিশির যা ইতিহাস তাতে মাথা ঘোরানোর চিহ্ন বিশেষ আমোদের কথা না।
নদী যদিও বেশি কথা বলছে না। তার সারা শরীর বেশটুকু ভিজে। কিছুটা যেন কাঁপছেও। তবে তার কাঁপুনি আরও বাড়াতে নতুন অতিথি এলো ঘরে।

বিদেশিদের সংস্থার কাউন্সিলর মালেকা। বাথরুম যাবার ছুতোয় ঘরে ঢুকেছিলেন। নদীর সাথে টুকটাক কথার একপর্যায়ে নিচুগলায় বললেন —
” রাবেয়া আমার বেশ ভালো বন্ধু, যখন জেনেছে আমি সুন্দরবন থেকে টিম নিয়ে ফিরছি আমায় সাহায্যের জন্য রিক্যুয়েস্ট করল। গ্যাব্রিয়েলকে আমরাই রিসিপ করেছি৷ তোমার সাথে মিট করার উদ্দেশ্যেই ইউ এন ও স্যারকে পটিয়ে টিম নিয়ে আসা। এখন কীভাবে কী করবে দ্রুত ভেবে বের কর। আমার জন্য জায়গাটা নতুন,এবং বেশ ঝুঁকির”

কথোপকথনের মাঝেই মালেকার মোবাইলে কল এলো। কিছু কথা বলে তিনি এগিয়ে দিলেন নদীর দিকে
” মেহরোজ ”

নদী উত্তর দিলো না তার হৃদপিণ্ডর কাঁপুনি থেমে গেছে।ওপাশ থেকে মধুর কন্ঠ –” কথা বলতে পারবে? ডকুমেন্টস গুলো…”

” আমার কাছে স্যার, ” এতক্ষণে কথা বলল নদী” আমি কি মালেকা ম্যামকে দিয়ে দেব? ”

“মোটেও না! এটাই বলতে চাইছিলাম; আমি ছাড়া কারো হাতে দেবে না। আমি মনে হয় ভুল সময়ে এসেছি , কিন্তু কোন উপায় ছিল না কাগজগুলো খুব জরুরি ”

নদী উত্তর দিলো না, হ্যাঁ কাগজগুলো অবশ্যই জরুরি তবুও কেন যেন ভেতরে চাপা হতাশা; সাথে একটা প্রশ্ন, এমন কী আছে এই ডকুমেন্টসে?

হঠাৎই মবিনের কন্ঠ ” নদী আমরা ছাদে কতক্ষন থাকতে পারব জানি না যে করে হোক দ্রুত চলে এসো ” কথা বেশি এগোলো না। নদীর ঘরে লোকজন বাড়ছে, উঁকিঝুঁকি মেরে বউ দেখতে চাইছে। রানু হেঁটে আসছে এদিকে , মালেকা দ্রুত বের হয়ে গেলেন।কান্তা মামি নদীকে আবার স্টেজে নিয়ে যেতে চাইলেন। নিশি নিষেধ করলো, এত মিষ্টি খেয়ে নদীর এসিডিটি হয়েছে কিছুক্ষণ না হয় রেস্ট নিক।

রানুও সম্মতি দিলেন বাইরে শাহীনের গুন্ডা বন্ধু বান্ধব বিনা কারণে হল্লা করছে। এর মধ্যে থাকায় কাজ নেই হাজার হলেও হবু পুত্রবধূ। ঘরভরা গ্রামের লোক নিরিবিলি ঘর বলতে নাহার বুড়ির ঘর। বুড়ির ঘ্যানঘ্যান আর গন্ধের কারণে কেউ সেখানে যেতে চায় না। রানু তার পুত্রবধূকে পাঠিয়ে দিলেন সেখানে । নাহার বুড়ির খিদে লেগেছিল রানুকে দেখে পেনপেন শুরু করলেন।

“এই এত ঝামেলার মধ্যি নলা পড়া বন্ধ হয় না আপনার? ” রানু যেতে যেতে শাশুড়ীকে ধমকে উঠলেন। একবাটি পায়েশ ঠেলে দিয়ে বললেন,” এই গিলে মুখ সিলাই কইরে বসপেন। হলুদ গায়ে উইঠেসে, আজ কলাম নদী আপনার হাগামোতা সাফ করতি পারবে না।
আর যদি কোন আওয়াজ শুনিসি, তাহলি স্টোররুমি পাঠায় দোবো।
রানুখালা শাশুড়ির ঘরের দরজা ভিড়িয়ে গটগট করে বেরিয়ে গেলেন। নদী থম ধরে বসে আছে।

” আমরা অপেক্ষা করছি, তাড়াতাড়ি এসো।” মেসেজ দেখে নিশির রাগে পিত্তি জ্বলে গেল।এই মবিনটার মাথায় মগজ বলতে কিছু নেই? হ্লুদ আসরে জিএসকে দেখে কথা বলতে গিয়েছিল,তখন মবিনই বাধা দিলো নিশির অতি উৎসাহ দেখে এই অবস্থায় যেকেউ সন্দেহ করতে পারে । গ্যাব্রিয়েল পড়বে বিপদে।

সে কিছু ব্যবস্থা করছে বলে বেরিয়ে গেল, বাড়িটা চারিদিক চক্কর দিলো, এই হলো ব্যবস্থা!বাবুর্চিকে নিয়ে গাছ বেয়ে ছাদে উঠে গেছে। নদীকেও নিতে হবে। সব কি এত সোজা? বাড়ি ভেতর থেকে ছাদে ওঠার দুটা পদ্ধতি, সামনের বৈঠকখানার পাশ দিয়ে উঠে যাওয়া সিঁড়ি। অথবা পেছনের উঠোনে চাপ কলের পাশ দিয়ে দেয়াল বেয়ে ওঠা খাড়া লোহার আরেকটা সিড়ি।

সামনের দরজায় লোকে লোকারণ্য পেছনের বারান্দায় লাগোয়া দরজায় তালা ঝোলানো। সেটা সাধারণত খোলা থাকলেও আজ চাবি রানুখালার কোমরে। এর সমাধান নিশি ভেবে বের করতে পারছে না।

– কিরে মুখপুড়ি কান্তিসিস ক্যান?মা-বাপির কতা মনে পত্তিসে?কী লো মেইয়ে?নাকি বাসরঘরির জন্য ভয় লাগতিসে?

নাহার বেগম খোনা গলায় বকে যাচ্ছেন নদী নিজেকে সামলে রাখতে পারছে না। তার হাতের মুঠোয় গ্যাব্রিয়েলের পেনড্রাইভ। এইই তাহলে গুরুত্বপূর্ণ। তীব্র ভয়ের সাথে অদ্ভুত একটা হতাশা তাকে দুর্বল করে দিচ্ছে।অনুষ্ঠানে হঠাৎ করে তাকে দেখে কিছু অবিশ্বাস্য অনুভব হয়েছিল। কেন শুধু শুধু অলীক স্বপ্ন দেখা? নদী এত বোকা কেন?

নিশি এক ধাক্কা দিয়ে যেন তার ঘোর কাটিয়ে দিলো,” ছিচকাঁদুনি ছেড়ে একটা আইডিয়া দে, ছাদে ওঠার আর কোন পদ্ধতি তুই জানিস?

– আমি শুধু জানি ওর কথা যদি কেউ জেনে যায়, সর্বনাশ হয়ে যাবে। ভয় লাগছে নিশি”

নিশি রেগে গেল, -একট আধাপাগলের সাথে জীবন শেষ করতে ভয় লাগছে না? তোর জন্য যে জীবনবাজি নিয়ে এলো, ছাদে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে ; তুই বসে ন্যাকামি করছিস ”

-বুকের পাটা না থাকলি পিরিত মারাতি বইলেছিল কিডা?

নিশি নদী নাহার বুড়ির কথায় চমকে গেল। বুড়ি তার হাতের কাছের একটা মুড়ির টিন থেকে একগোছা চাবি বের করে দিলেন।মাথা দুলিয়ে বললেন,

” এই তালি ঘটনা, তুমি ঢাকায় লাইলি গিরি কইরে এইখানি বইসে নাটক কচ্ছ? আমিও তাই বলি কেঁইদে যাচ্ছে ক্যান।দাঁড়া দেখাচ্ছি”
নদী ভয়ে ভয়ে দেখল, বুড়ি মাথা ঘুরিয়ে আশেপাশে খুঁজছেন কিছু,রানুখালাকে কি ডাকবেন?
” ধর, সারাবাড়ির ডুবলিকেট চাবি এইখানে। পালাতি পারলে এখনই পালা গে যা”
নাহার তার তোশক উলটে একছড়া চাবি বের করে ছুড়ে দিলেন মেয়েদের দিকে
নিশি নদী বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে। নাহার বেগম মাথা নেড়ে বললেন, ” আমারি আপন রক্ত এত করেনি যা তুই কইরেসিস, তোরি বদ্দোয়া করিনি কখনো।আমি কি জানিনে এরা কি চিজ? যিরাম আমার ছাওয়াল সিরাম হইলো বউ দুইয়ে মিলে জানোয়ার পয়দা কইরেসে। ওই ইবলিশ শয়তানের সাথে জীবন নষ্ট করিসনে বোন, চলে যা যেখানে যাতি চাস। আল্লাহ তোর সহায় হোক। ”

*****
গানে মত্ত সারাবাড়ি, রাজ্যের লোক সামনের উঠোনে ভিড় করেছে। পেছন বারান্দার দরজা খুলে দেয়াল লাগোয়া খাড়া লোহার সিড়ি বেয়ে সাবধানে উঠতে হলো। এই দিকটায় তেমন মানুষও নেই।

মরিচবাতির আলোয় ছাদ ঈষৎ আলোকিত। পশ্চিম কোণায় আলোটা যেন আরেকটু বেশি৷ কালো শার্ট নীল জিন্সস গ্যাব্রিয়েল চিন্তিত মুখে রেলিংয়ে বসে তবুও কী সুন্দর লাগছে । নদী একঝলক দেখে নিজেকে শাসন করলো,মানুষটার এই অধীরতা তার জন্য নয়। নদীর সমস্যা নিজেই মেটাবে, জি এসকে দ্রুত তার আমানত বুঝিয়ে দেয়া দরকার।

নদী স্বাভাবিক শান্তভঙ্গিতে এগিয়ে গেল, গ্যাব্রিয়েল উঠে দাঁড়িয়েছে। নিশি এগোলো না, মবিনও সরে গেল একটু দূরে। দুজন ছাদের দুই দিকের সিড়ির মুখে প্রহরায় চলে গেল কোন অলিখিত নির্দেশনায়।গ্যাব্রিয়েল তাকিয়ে আছে সরাসরি।

” মেহরোজ তুমি কেমন আছ?”

” ভালো আছি স্যার ”

রম্য নদীর আপাদমস্তক দেখে হেসে বলল,” আমি দেখতে পাচ্ছি সেটা,
ব্রাইডাল লুকে তোমাকে অন্যরকম দেখাচ্ছে। খুবই অন্যরকম মানে,খুব সুন্দর … ”

নদী উত্তর দিলো না।রম্য একটু সময় নিয়ে বলল,

” হুট করে এসে আমি তোমাকে ইমবেরেস করতে চাইনি, কিন্তু উপায় ছিলো না ; এখন খুব গিল্ট ফিল হচ্ছে”

” এই যে ব্যাগ স্যার”

স্বল্প বাক্যব্যয়ে নদী হলুদ ব্যাগটা এগিয়ে দিলো।কেন যেন কথা বাড়াতে ভালো লাগছিল না তবু বলল ” সব ঠিক আছে নাকি খুলে দেখে নিন প্লিজ ”

” নিশ্চয়ই ঠিক আছে “রম্য ব্যাগ খুলে দেখলো না। মেয়েটার ওপর এমনি চাপ যাচ্ছে। তার সামনে দাঁড়িয়ে আর কি বলবে বুঝে পেলো না।বলার অনেক কিছু থাকলেও কখনো কখনো শব্দরা বিদ্রোহ করে বসে। রম্য একটু সামলে হাল্কা গলায় বলল, ” এনিওয়েজ কনগ্রেচুলেশনস ফর ইউর নিউ লাইফ। শুনলাম কাজিনকেই বিয়ে করছ, ভালো। তবে আমার জানা ছিল না তোমার ফিয়োন্সে আছে ”

নদী নিরুত্তর।

” আশাকরি বিয়ের পর তুমি আরও উদ্যমী হয়ে নিজের ক্যারিয়ার গড়বে, তোমার হাজবেন্ড নিশ্চয়ই সাহায্য করবেন তোমাকে, সিরিমনি সামলে দ্রুত ফিরে এসো…”রম্য কথাগুলো খুব হাল্কাভাবে বলছে।

” আমি আর ফিরতে পারব কি না জানি না স্যার”

” স্যরি, বুঝলাম না ”

” কিছু না , আমি দু:খিত স্যার যে আমার ভুলের জন্য আপনাকে এতদূর জার্নি করে আসতে হলো। তবে এখন আপনার এখানে থাকা নিরাপদ নয় ”

রম্য একটু ব্যস্ত হয়ে দাঁড়ালো, আসলেই ঠিক, এখন আমার যাওয়া দরকার…, মেহরোজ!

” জি ”

” তুমি কাঁদছ কেন? “রম্যের চোখে-মুখে বিস্ময়।

” স্যার বেটার ইউ লিভ ইমিজিয়েটলি, এখানে আপনাকে আমার সাথে কেউ দেখলে অনেক বড় সমস্যা হয়ে যাবে…”

মবিন রম্যের ইশারা বুঝে ফিরে আসছে, তাকেও যেতে হবে। অতিথিকে নিরাপদে পৌঁছে দিতে হবে। কিন্তু রম্য যেন অনড়,বলল,

” তুমি কাঁদছ কেন এটা শুনে যাই ”

নিশির পেছন থেকে খোঁচা দিলো ” বল একটু, ওর জানার দরকার! এই বাবুর্চিই সব নষ্টের গোড়া”

নদী অস্থির হয়ে বলল ” মবিন ভাই প্লিজ আপনি উনাকে নিয়ে যান।স্যার ভালো থাকবেন বেঁচে থাকলে দেখা হবে, আমি নিচে গেলাম… ” নিশিকে রেখেই নদী দ্রুত লোহার সিড়ির দিকে যাচ্ছে হঠাৎ পিছুডাক

” মেহরোজ তুমি আমার সাথে যাবে? ”

নদী বিস্মিত মবিনের মাথায় হাত, নিশির ঠোঁটে হাসি। তাকে দেখে রম্য সাহস পেয়ে বলল,

“এতদিনে কিছুটা চিনেছি তোমায়, তুমি কাঁদছিলে কারণ তুমি এটা চাও না। না চাইলে এটা হওয়াও উচিত নয়, আমার সাথে চল মেহরোজ। আমার মনে হয় এটাই সেরা যা আমি করতে পারি তোমার জন্য, প্লিজ লেটস গো..”

নদী অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে, রম্য তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে সহজ ভাবে!

” হা করে দেখছিস কি গাধী রওনা দে ” নিশি ধাক্কা দিয়ে এগিয়ে দিলো নদীকে।

মবিনের মাথা ঘুরছে, নিচে লোকাল থানার ওসি তক্কে তক্কে আছে শাহীনকে পাকড়াও করতে !এইদিকে কনে পালালে নিশ্চিত একটা ভজঘট লাগবে ।মবিন
চিন্তিত হয়ে এলো নিশির দিকে” এটা তো কথা ছিল না আমরা তো অন্যভাবে বিয়ে ভাঙতাম, নিশি এটা…”

নিশি ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দিলো তাকে, ” আরে তুমি অফ যাও রে ভাই।দেখছ না ড্রামা ক্রিয়েট হচ্ছে?এদিকটা আমি সামলে নেব, আল্লাহ ভরসা! যা হচ্ছে পারফেক্ট, শুধু একটা বিষয়ই উইয়ার্ড ”

” কী?”

“না মানে নদীটারই কপাল ফাটা, বিয়ের আসরে জামাইকে ফেলে বাবুর্চির সাথে পালাচ্ছে হা হা হা.. ”

মবিন ছোট একটা নি:শ্বাস ফেলল।এই মেয়েটা এত অদ্ভুত কেন?

*****

” ওমা গো! শানু তুই? শেষ মেষ এলি তবে ” রানুর উচ্ছাসে শানু তেমন প্রতিক্রিয়া করলো না। লাগেজ হাতে বিরক্ত হয়ে এগোলো মনে চাপা উদ্বেগ।শাহিন পাগল টা খুলে আম ঘুরছে নিশিটা কোন বোকামি করে বড় মূল্য না দেয়৷ দুইদিন ভেবে অবশেষে আমেরিকার টিকিট ক্যানসেল করে সাতক্ষীরার জন্য বাইরোড রওনা দিয়েছেন। এত এত ভিড়ে নদী বা নিশির দেখা পাচ্ছেন না।নিশিটা তো ফোনও তুলছে না কোথায় আছে কে জানে।প্রচন্ড চিন্তায় ভাইবোন কারো সাথেই কথা বলতে মন চাইছে না শানুর। তবুও বড়ভাইয়ের চোখ এড়ালো না।

” মেয়েদের উদ্ধার করেন ভাইজান এই পাগল সবাইরে মেরে ফেলবে” শানুর কথায় মোজাফফর সাহেব গম্ভীর হয়ে গেলেন

এই দিকে হলুদের স্টেজে অতিথিদের মনোরঞ্জনের দায়িত্ব নিয়েছেন খোদ বর মহাশয়। বেসুরো গলায় কয়েকটা গান শুনিয়ে ইতোমধ্যে কয়েকজনের কানে তালা পড়ে গেছে। বিলিতি অতিথিরা যা দেখছেন তাতেই মুক্ত হচ্ছেন, ইতোমধ্যে বরের সঙ্গীতচর্চা শুনে তাদের ঠোঁটে কৌতুকের হাসি খেলছে।

তাদের টিম লিডার মালেকা চোরাচোখে খুঁজছে গ্যাব্রিয়েলকে। স্টেজে মূল্যবান বক্তব্য দিচ্ছে শাহীন —
” ভাই বন্ধুরা আমার জীবিতাবস্থার দিন ফুরালো, কাল থেকে আমি হয়ি যাবো মিরিত বা বিবাহিত। তাই ভারাক্রান্ত মনে আজ খেলা হবে।আজ আমি আমার টিপ নিশানা দেখাবো। এইবিষয়ে আমার কিরাম টেলেন্ট ছেল সবারি দেখাতি চাই। হাত তোলেন কিডা কিডা দেখতি চায়.. ”

শাহিন কথা বলতে বলতে তার পকেট থেকে রুপালি রঙের ধাতব আগ্নেয়াস্ত্রটা বের করল দর্শকদের মধ্যে মৃদু শোরগোল। শাহিন ভাবলেশহীনভাবে বলে যাচ্ছে —
” আমি চালি অলিম্পিকও খেলতি পারতাম, তা আর হইলো না। তবে আজ আমার বিয়ের আগের রাতে আমি আমার হবু ইস্ত্রীকে এই বিরল ট্যালেন্ট দেখাতি চাই! সবাই কলাম দেখবেন। ”

মোজাফফর সাহেব বিস্ময়ভাব কাটাতে কাটাতে স্টেজের দিকে এক পা দুই পা করে আগাচ্ছেন। সূক্ষ্ম সন্দেহ হচ্ছে শাহীন সম্ভবত নেশা জাতীয় কিছু খেয়েছে৷ হাতের বন্দুকটা থেকে ভুলভাল গুলি চলে গেলে সর্বনাশ। অতিথিদের মধ্যে বেশ ক’জন বিদেশীও দেখলেন। মোজাফফর সাহেব আরেকটু এগিয়ে যেতেই গা ঘেঁষে চোখাচোখি হল একজনের সাথে। তরুণ ভদ্রলোককে দ্রুতই চিনে ফেললেন, লোকাল থানার ওসি আসাদ মোল্লা। মান্যগণ্য মানুষ হিসেবে মুখচেনা।
” স্যার! ”
” মোজাফফর সাহেব! আপনি? ”

” আমার বোনের বাড়ি”

” তার মানে বর আপনার ভাগ্নে? ”
” জি দুর্ভাগ্যবশত ” আসাদ দ্রুত হিসাব মেলালো এই আধাপাগল গোটা পরিবারকে জিম্মি করে নাটক করছে বর্তমানে চাচা শাহবাজের দিকে নিশানা করছে
” এই যে আমার চাচারি দেইখেসেন, আমার চাচা কলাম ব্রাট কামেল মানুষ, বুঝতি পারিসেন ব্রাট তার সাহস, ” শাহীন একটা আপেল শাহজাহানের মাথায় রাখলো,” এই যে আপেল দেখিসেন এইটা তার মাথার ওপর নিয়ে এমনে দাঁড়ায় থাকবেন আর আমি কী করব… ”

” পিস্তল আমার হাতে দিয়ে দেবেন ”

পেছন থেকে স্পষ্ট কন্ঠে ঘুরে তাকাল শাহীন।আসাদ মুখে মাস্ক পরে দাঁড়িয়ে আছে হঠাৎ একটা কার্ড এগিয়ে দিয়ে বলল,” এই ছবি কি আপনারা দেখুন তো? শাহীন সরু চোখে সতর্কভাবে ঘুরে তাকাল।

” পিস্তলটা দিয়ে দিন ” আসাদের স্পষ্ট নির্দেশে শাহীন তেড়েমেরে এগিয়ে যেতে যেতে কিছু পরিবর্তন হলো, শান্তভঙ্গিতে পিস্তল এগিয়ে দিলো। আসাদ দ্রুত সেটা হস্তগত করলো। হাইওয়েতে একদল ফ্রডকে হাতেনাতে ধরার পর তাদের কাছে পাওয়া স্কোপোলামিন ড্রাগ অর্থাৎ ডেভিলস ব্রেথ জিনিসটা এত ভালো ব্যবহার হবে বুঝতে পারেনি। স্টেজে দাঁড়ানো শাহীনের চোখ জোড়ায় বোবা দৃষ্টি।

মোজাফফর সাহেবের চোখাচোখি হতেই কথা জড়িয়ে বলল,” মামা আমি এখন বে করব কীরাম কইরে ,এই বিটা আমার যে সব লুইটে নেল.. ” পুরাটা শেষ করার আগেই প্রবল চড়ে ভূপতিত হলো।

” তোরে লুইটেসে শুধু, বেন্ধে পিটানো দরকার, উল্টো ঝুলোয়ে মেইরে কাচা কাচা না করলি লাইনে আসবি না; নি যাও এরে ”

মোজাফফর সাহেবের বজ্রকঠিন কন্ঠে দ্রুত শাহীনকে সরিয়ে নেওয়া হলো।সেই সাথে ওসি আসাদও একটা সুখবর দিলেন,
” এটা তো লাইটার গান, স্টিল বডি আসলির মতোনই দেখতে তবে লাইটার ”

আসাদ ট্রিগার টিপে দেখালো, পিস্তলের নলে একটুকরো আগুন উঁকি দিচ্ছে।মুহূর্তে স্বস্তির একটা নি:শ্বাস পড়লো চারিদিকে।এদিকে রানু তার ছেলে উদ্ধারে ব্যাতিব্যস্ত, শাহজাহান সাহেব সমুন্ধিকে বোঝাতে চাইছেন শাহীন আসলে ফাজলামো করছিল। এসব কথা আমলে না নিয়ে মোজাফফর সাহেব নদীর খোঁজ করলেন, ” মেয়েটার খোঁজ কর, বল ভয়ের কিছু নেই বড়মামা এইসে গেছে। ”

” ও ঘরে নেই ”

নাজিয়ার কাচুমাচু মুখ দেখে মোজাফফর সাহেব যেন অথৈজলে পড়লেন,শানু বলল “নিশ্চিত আমার নিশির কাজ আরে আশেপাশে আছে কোথাও ধইরে আনো, পাগলের ভয়ে পালিয়েছে ”

” ভয়ে পালিয়েছে না কারো সাথে জানিনে। পাশের বাড়ির কিডা ছাদ থেকে দেইখেসে, এক বিদিশি ছেলের সাথে ছাদে উইঠে কথা বলতিসে, “নাজিয়ার নিচুকন্ঠ শুনে মোজাফফর সাহেব স্থির তাকিয়ে আছেন।

নাজিয়া বললেন ” মনে হচ্ছে ছাদ দিয়ে ভেগেছে, কিন্তু এও কি সম্ভব? ”

মোজাফফর সাহেব উত্তর দিলেন না চোখের সামনে ঢাকায় দেখা লম্বা বিলিতি ছোকড়ার মুখ ভেসে উঠছে। বিষয়টি অবাস্তব লাগলেও এর সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না । এই জগতে অসম্ভব কিছু নেই।

*****

মবিনের গাড়িটা পেছনের মাঠে দাঁড় করানো ছিলো বলে রক্ষা।স্বদলেবলে উঠে পড়া গেছে। রাতের রাস্তায় মাথা ঠান্ডা রেখে গাড়ি চালানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। তেল ভরা হয়নি, ভরার সময় পায়নি, এর মধ্যে গাড়ি বসে গেলে আরেক যন্ত্রণা।টেনশনে স্টিয়ারিংয়ে মবিনের হাত কিছুটা কাঁপছে। কানের পাশের চুল বেয়ে চিকন সুতোর ঘাম নেমে যাচ্ছে। নিশির মেজাজ আরেক দফা খারাপ হলো

” আরে তুমি তো ধরা খাওয়াবা দেখছি একটু জোরে টানা যায় না? ”

” কি জানো নিশি, আমার শখ হলো হেলেদুলে গাড়ী চালানো, তাছাড়া মেয়ে ইলোপ করায় আমি বিশেষ এক্সপার্ট তো, এইজন্য আরামে চালিয়ে যাচ্ছি।
আর আমি যেভাবেই চালাই তুমি কেন আসলা? তোমার তো বিয়ে বাড়িতে সামলানোর কথা না?”

” তোমার হাতে এই বাচ্চাদের ছাড়তে ভরসা হচ্ছিল না, সো আই চেইঞ্জ মাই মাইন্ড ”

” ওইদিকে অনুষ্ঠানে পাগল ঠান্ডা হয়নি, এদিকে বউ ভাগিয়ে কিডন্যাপিংয়ে কেস না খেয়ে ফেলি। ”

” বেশ করেছি, পাগল না চটলেও পালাতে তো হতোই, শাহীন না হলেও বড়মামা নদুকে মাছের ঘেরওয়ালার সাথে বিয়ে দিয়ে দিতো ”

” তার মানে নদীর বিয়েটা কম্ফোলসারি ছিলোই ” মবিনের কন্ঠে বিস্ময়।

“মবিন কোন সমস্যা?” এতক্ষণে রম্য কথা বলল।

মবিন মাথা নেড়ে ইংরেজিতে বলল” মেইনরোডে ওঠার আগ পর্যন্ত সমস্যাই। এরমধ্যে গ্রামের লোক টের পেলে সোজা ইট, বাঁশ, লাঠি নিয়ে দৌড়াবে, মুহূর্তে আব্বার গাড়ি পাউডার হয়ে যাবে আর আব্বা পিটিয়ে আমাকে পাউডার বানাবে”

” তাহলে তো রিস্ক হয়ে গেল মনে হচ্ছে “রম্য চিন্তিত গলায় বলল।

নিশি নদীকে খুঁচিয়ে বলল,” রিস্ক হলে আমাদের হয়েছে। বাবুর্চির আর কী টেনশন? ও তো ডকুমেন্টস নিতে এসেছিল, এখন মবিনের গাড়িতে করে আমাদের ঢাকা পর্যন্ত লিফট দিচ্ছে, নারে নদী? ”

নদী নিশির প্রশ্নের কোন উত্তর দিল না
সে হলুদ ব্যাগ ঘেটে কি যেন খুঁজছে।
সামনের সিটের রম্যও তাকিয়ে আছে, অবাক হয়ে বলল- মেহরোজ কাগজ সব ঠিক আছে তো?

” কাগজ ঠিক আছে স্যার, শুধু একটা ছোট সমস্যা ”

” ছোট সমস্যা তো, ঢাকায় গিয়ে সলভ করে নিও ” মবিনের মেজাজ কিছুটা ফুরফুরে, এতক্ষণে সে গাড়ি মেইনরোডে তুলে ফেলেছে।

” হোয়াট ডিড ইউ সে , ছোট সমস্যা? ” রম্যের কন্ঠে আতঙ্ক। কথাটা যেহেতু মেহরোজ বলেছে তার মানে ইটস নট এ ছোট সমস্যা।

নদী ক্ষীণগলায় বলল,”পেনড্রাইভটা বাড়িতেই স্যার, দাদির ঘরে। ফিরতে হবে উপায় নেই”

” নদু কা বাচ্চা থাপ্পড় খাবি “নিশির চিৎকারেও কোন লাভ হলো না। রম্য বুঝলো এই গমন কোন অর্থবহন করবে না।

আধাঘন্টা পরের দৃশ্যপট,

আলোকচ্ছটায় ঝলমলে বিয়েবাড়ির অদূরে ঘন বাঁশঝাড়ের আড়ালে দাঁড়ানো গাড়িতে স্থির হয়ে বসে মবিন আর রম্য। নিশির ফোন গাড়িতেই রেখে গেছে।সেটা থেকে থেকে বেজে যাচ্ছে। তাদের আপাত ধারণায় বিয়েবাড়িতে গান বাজনায় মত্ত অতিথিরা। ছেলের দাদির ঘরে বউ শুয়ে আছে জানে বাকি অতিথিরা। যেই রাস্তা দিয়ে তারা বেরিয়েছিল অর্থাৎ বাড়ির লাগোয়া গাছে মই দিয়ে ছাদে উঠে উঠোনের সিড়ি দিয়ে মেয়েরা ঘরে প্রবেশ করেছে। আশার কথা হলো তখনও পেছনের উঠোনে কেউ ছিল না। নদী একাই যেতে চেয়েছিল কিন্তু নিশি তাকে একা ছাড়বে না। এখন চুপচাপ মেয়েদের ফিরে আসার দূরাশা নিয়ে বসে থাকা ছাড়া কোন উপায়ও নেই। তবে জগতে অসম্ভবও কিছু না।

এখানে লোকাল থানার ওসি মবিনের ভাইয়ের ভালো বন্ধু। সেই সাদা পোশাকে আজ এসেছিল শাহীনকে পাকড়াও করতে। এখন কোথায় আছে মবিন জানেনা। তাকে সবকিছু খুলে বললে হয়তো সব সহজ হয়ে যেত।এক দুবার মোবাইল তুলে আসাদের সাথে কথা বলার চিন্তাও করেছিল। ফোন কবে থেকে সুইচড অফ আছে, মেয়ে দুটোকে নিয়ে রওনা দেবার পর খোলার সাহসও পাচ্ছে না। কোনভাবে হোক সে ব্যাপারটায় জড়িয়ে গেছে এখন এদের থেকে পালিয়ে বেঁচে লাভ নেই।

” ওরা ফিরতে না পারলে আমাদের কি করা উচিত? “রম্য হঠাৎই বলল।

” পেনড্রাইভ নিয়ে চিন্তা করো না, নদী সেটা খুঁজে পেলে আমি গিয়ে যেভাবে পারি নিয়ে আসবো ”

” ও প্লিজ ডউ দ্যাট মবিন, এটা খুব জরুরি ”

মবিন মাথা নেড়ে বলল ” আমি নিশ্চিত! তবে নদী সমস্যায় না পড়লেই হলো”

রম্য একটু ইতস্তত করে বলল , ” ধরা পড়লে ওর কেমন সমস্যা হতে পারে? ”

” অনেক কিছুই, বাংলাদেশের কন্ডিশনে মেয়েদের জন্য অনেক কিছুই ফরবিডেন। আর সেসব কাজ বিচারের জন্য মহান মহান সব বিচারকরা দাঁড়িয়ে যায়।
বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে নদী এমন ভয়ংকর ফরবিডেন কাজ করে বসেছে। ওর পরিবার কতটা সহনশীল তার আন্দাজ আমার নেই। লেটস হোপ ফর দি বেস্ট”

এমন সময় বাঁশঝাড়ের পাশ দিয়ে চলা নিঝুম রাস্তায় সূক্ষ্ম সঞ্চালন। মবিন দেখলো নদীর মামাতো বোন বেলা আর মালেকা এসে উপস্থিত। মবিনের দিকে বেলা এগিয়ে এলো, ” মবিন ভাই এই যে পেনড্রাইভ নদীপু আপনারে দিতি বলিসে আর বলিছে তাদের অপেক্ষা না করে আপনাদের রওনা হতে ”

রম্য পেনড্রাইভ হাতে নিয়ে আশ্বস্ত হলো। মালেকা বলল, এই বাড়িতে বিরাট নাটক হয়েছে, পাগল জামাইকে পাকড়াও করা হয়েছে । বাঁচা গেল। যাহোক গ্যাব্রিয়েল তুমি তোমার জিনিস পেয়েছ, এখন দ্রুত রওনা দেওয়া যাক ,রাবেয়াকে আমি কল দিয়ে জানাচ্ছি। আমাদের গাড়ি আর কিছু দূরেই দাঁড়িয়ে আছে। তোমার অপেক্ষা করছে। মবিন সাহেব, থ্যাংকস আ লট ভাই ”

মবিন কিছুটা ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেছে। বিরাট নাটকের এত সহজ সমাপ্তি ঠিক যেন আশা করেনি।আপাত সরল অংকের মাঝামাঝি উহ্য কিছু যেন অসমাপ্তই রয়ে গেল।

মালেকা রম্যকে তাড়া দিচ্ছে, ” এখন দেরি করে লাভ নেই, গ্যাব্রিয়েল বা রম্য, তোমাকে আজরাতে খুলনার একটা হোটেলে থাকতে হবে। কাল দুপুরে যশোর থেকে ঢাকার ফ্লাইট। তোমায় ঠিকঠাকভাবে বাড়িতে পৌঁছে দিলেই আমার শান্তি। ”

রম্য তার কাগজ বুঝে গাড়ি থেকে নেমে গেল। মবিনের সাথে করমর্দন করল “থ্যাংকস ফর এভরিথিং মবিন, তুমি ছাড়া এটা সম্ভব হতো না ”

মবিন মনে মনে হাসলো। নিশির মতো সেও মনে মনে আশা করেছিলো একটা প্রেমকাহিনী দেখবে। বাস্তব বড় স্বার্থপর। গ্যাব্রিয়েল তার কাজ বুঝে চলে যাচ্ছে ।বাঁশঝাড় ঘেরা রাতের সরু রাস্তায় দূর থেকে তার ছায়া লম্বা থেকে লম্বা হচ্ছে।

” কী হলো গ্যাব্রিয়েল ? মালেকার কথায় মবিন খেয়াল করল গ্যাব্রিয়েল যেতে যেতে থেমে গেছে।

মবিন এগিয়ে গেল, “কোন সমস্যা ? ”

রম্য অনেকটা নদীর মতো করেই টেনে টেনে বাংলায় বলল,”একটা ছুটো সমস্যা ”

*****

” জি, জি আমরা রেডি আছি। কোন অসুবিধা নেই হয়েছে কি আমার বোনের ছেলেটা কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। এইজন্য তার বিয়েটা একটু পিছিয়ে গেল। তবে আপনাদেরতো কথা দিয়েছিই। আপনারা কাল আছেন তো। হ্যাঁ হ্যাঁ আগামীকাল রাতেই আসেন আমার বাড়িতে। আল্লাহ চাইলে তখনই সব ফাইনাল হবে। ”

মোজাফফর সাহেব বেশ সাবধানে কথা সারলেন। নদীর জন্য ঠিক করা খুলনার পাত্রদের আশ্বস্ত করা জরুরি ছিলো। অনেক বছরের পুরনো সম্পর্ক পরিবারটার সাথে।তারা এত আগ্রহ দেখাচ্ছে তা ফেলনা করা যায় না। যদিও শাহীনকে ঠান্ডা করে নদীকে পাওয়া যাচ্ছে না কথাটা শুনে হুটকরে প্রেশার বেড়ে গিয়েছিল। বিলিতি ছেলে নিয়ে আকাশ কুসুম ভেবেই গায়ে কাঁটা দেয়। তবে সুখের কথা হলো তাকে পাওয়া গেল সহসাই। শাহীনের দাদির ঘরেই ছিলো সে।শাহীনকে আটকে রাখা তার ঘরে থেকে থেকে সেখান থেকে চিৎকার আসছে।ওসি সাহেব এখনো বিদায় নেয়নি। নিশির কোন বন্ধু নাকি খবর দিয়ে ওসিকে ডেকে এনেছিল। নিশির কোন বন্ধু বিচক্ষণ এতটা আশা করা যায় না, তবে হলে সেটা ভালো খবর। এটা বিশাল একটা কাজের কাজ হয়েছে।

এদিকে নদীর সাথে নিশিকে ফিরে পেয়ে শানু দ্রুতই একপাশে নিয়ে গেলেন। মূলত তিনি এসেছেন মেয়েকেই উদ্ধার করতে।
নিশি বড়মামাকে কিছু বলতে চাইলেও শানুর যুক্তিতে চুপ করে গেল, ” পাগল ঠান্ডা হয়েছে আর বিয়ে হচ্ছে না। ক্লা পরশুর মধ্যে নদীকে নিয়ে ভালোয় ভালোয় ঢাকায় ফেরা যাবে।এরমধ্যে তুমি বড় মামার সাথে কোন ঝামেলা করবে না।শাহীনকে বিয়ের উস্কানি দিয়ে জল এতদূর গড়িয়েছ, তোমার ওপর এমনিতেই চটে আছে। ”

এদিকে মোজাফফর হোসেন সাহেব
খুলনার পাত্রপক্ষ সামলে নদীকে জেরা করতে ছাড়েননি, “গোটা বাড়ি খুঁজতিসে তোরে এতক্ষণ কোনে ছিলি? ”

” ছাদে মামা”

“ছাদে কী কত্তি?”

উত্তর নেই।

মোজাফফর হোসেন সাহেব বললেন, বল কোন ভয় নেই! শাহীনরে ঘরে আটকে রেখেছে। আবার মেন্টাল হাস্পাতালে পাঠাবে। আমি থাকতে তোর কোন অনিষ্ট হতি দেব না”

” আমাকে ঢাকায় পড়াশোনা করতে দেন মামা, আমি বিয়ে করতে চাই না”

” বললাম তো পাগলের সাথে তোমার বিয়ে হচ্ছে না যেখানে আমি চাবো সেইখানেই হবে। তবে তুমারিও সাবধানে থাকতি হবে।বাপ-মা ছাড়া মেইয়েগুলোনের কি শান্তি আছে, এগের বাড়তি সতর্ক থাকা লাগে। দেখ একটু কি আড়ালে গিয়েছ মানুষ বানায়ে কত কথা বলতিছে কার সাথে না ভেইগে গিয়েছিস, আরেকটু হলি পুলিশরে বলা লাগতো, এখন সত্যি কইরে বল, ছাদে গিয়েছিলি কেনো .. ”

” তোমার খোঁজ করতিসে “বড়মামী দরজায় দাঁড়িয়ে স্বামীর কথার মাঝে বলে উঠলেন।

” রানু আর শাহজাহান হলি বল দাঁড়ায় থাকুক, ছেলেরে যে পুলিশি দেইনি এই অনেক ” মোজাফফর সাহেবের কন্ঠে বিরক্তি।

” তারা না ” নাজিয়া একটু শঙ্কিত গলায় বললেন, ” বিদেশি এক ছেলে একটু আগেও বিদেশিদের সাথে এইইসেছিল। বলতিসে নদীরে চেনে। তোমার সাথে কথা বলতি চায়। পাশের বাসার ওরা এরেই মনে হয় দেইখেছিল”

স্ত্রীর শেষ কথায় মোজাফফর সাহেবের শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বইয়ে দিলো।

******
বৈঠকখানায় বেশ গুরুগম্ভীর সমাবেশ। মোজাফফর সাহেব, নাজিয়া, শাহজাহান সাহেব, নতুন আগত অতিথি, মালেকা,শানু, মবিন; নিশি আর নদী বড়দের নির্দেশে চুপচাপ ঘরের এক কোণায় দাঁড়ানো।
” তুই তো বললি ফাইলের জন্য এসেছে”নিশি বন্ধ ঠোঁটে খোচাচ্ছে নদীকে,” ফাইল পেনড্রাইভ দুটোই বাবুর্চির হাতে, এখন ফিরে এসেছে কেন?”

” জানি না”

“উহ, ন্যাকা চন্ডি রে”

শানুর চোখের ধমকে সতর্ক হলো দুজন।
মোজাফফর সাহেবের সামনে শান্তমুখে মেরুদণ্ড সোজা করে বসা একজন শ্বেতাঙ্গ যুবক। নিখুঁত বিলিতি সুপুরুষ হতে যার একটাই বৈপরীত্য চোখ আর চুল বাঙালিদের মতো ঘন কালো। এই ছেলেটার সাথে ঢাকায় একবার দেখা হলেও কথা তেমন হয়নি। আজ সে নিজেই এসেছে কথা বলতে। মোজাফফর সাহেব ইংরেজি বোঝেন, তবে ইংরেজদের মুখ থেকে বোঝেন না।এরা অর্ধেক কথা বলে, বাকি অর্ধেক মুখের ভেতর জাবর কাটে।যদিও এইছেলেটা কথা বলছে বেশ নমনীয় কন্ঠে ধীরে ধীরে। শানু আর মবিন তার তর্জমা করছে।

শান্ত বৈঠকে রানু তার মতো গজগজ করেই যাচ্ছে “মেইয়ের চরিত্রের নেই ঠিক।উপরি উপরি বেতে রাজি হইয়ে তলে তলে এই কইরে বেড়াচ্ছিল। এখন আমার সরল সোজা ছেইলের ওপর সবাই দোষ চাপাচ্ছে। ”

” তোর জিনিস তুলে নেবার স্বভাবটা ঠিক হলি, তোর সরল সোজা ছেলেরেও কেউ কিছু বলতো না” শানু বিরক্ত হয়ে বললেন।

মোজাফফর সাহেব মবিনের কাছে আদ্যপ্রান্ত শুনে বুঝলেন রানুটা ব্যাগ চুরি করে নিয়েই সব ভ্যাজাল লাগিয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ ফাইল উদ্ধারে এই ছেলে আমেরিকা থেকে চলে এসেছে বিষয়টি অদ্ভুত জেনেও বেশি খোদাই করার প্রয়োজন বোধ করলেন না।

মবিন বলল,” মামা৷ তেমন কোন ব্যাপার হলে তো আর সে আপনার সাথে দেখা করতেই আসতো না তাই না? ও বেচারা চাইছে না যে নদীর কোন সমস্যা হোক ”

মোজাফফর সাহেব বুঝলেন। নদী চাকরি করত ঢাকায় এই তথ্যটাও নতুন পেলেন।কোথায় চাকরি করতো কি ঘটনা জানতে আর ইচ্ছে হলো না। মাথা গরমের পরিস্থিতিতে মাথা গরম করা সবচেয়ে বড় বোকামি। বন্ধুর ছেলের সাথে বোনঝির হিল্লে হবার আগ মুহূর্তে এই ব্যাপারটা নিয়ে ঝামেলা পাকালে গ্রামে ক্যালেঙ্কারির শেষ থাকবে না। মোজাফফর মাথা ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করলেন।

” আচ্ছা যাক ভুল বুঝাবুঝির অবসান হয়েছে । এখন সব কিলিয়ার” মোজাফফর সাহেব বললেন।

” বোঝার জন্য ধন্যবাদ ” রম্যের শান্তকন্ঠ।

শাহজাহান কিছু চটে বললেন ” বোঝার জন্যি ধন্যবাদ মানে কি, আপনি এইভাবে আমাগের বাড়ি আসপেন এমন কইরে মেইয়ের সাথে কথা বইলে যাবেন এখন আসপেন নাটক করতি আর আমরা মেইনে নোবো? ”

মোজাফফর সাহেব ধমকে চুপ করালেন। ছেলের অপমানে মা-বাবা দুজনই পরোক্ষভাবে জ্বলছে। নিজ বাড়িতে এমন বিব্রতকর অবস্থায় শাহজাহানও ফুসেফুসে উঠছেন ” এরামভাবে আসা কোন আইনে পড়ে না, আমার হলিও হতি পারতো পুত্রবধূর সাথে গোপনে দেখা করতি এইসেছিলেন, আমরা চালি অনেক ভ্যাজাল করতি পারি, একেবারে ষোলশিকের মধ্যে চলে যাবেন ”

” আমেরিকান নাগরিকের সাথে ভ্যাজাল এত সহজও না খালু, কুটনৈতিক ঝামেলায় পড়ে যাবেন। পারলে নিজের ছেলেকে ষোলশিক থেকে বাঁচান, বড়মামা বহুত ঝামেলা করে পুলিশ সরিয়েছে”

নিশির কথায় শাহজাহান আরও ফুসে উঠলেন। মোজাফফর আর শানু দ্রুত নিয়ন্ত্রণ করলেন তাদের। নিশি মায়ের কাছে ধমক খেল।।

মালেকাও গ্যাব্রিয়েলকে নিয়ে দ্রুত প্রস্থান করতে চাইছেন।কায়দা করে বাকি বিদেশি কলিগদের পাঠিয়ে দিয়েছেন। শাহবাজ আর শাহজাহান এলাকার প্রভাবশালী মানুষ। একে তো হুমকি তার উপর ইউ এন ওর মাধ্যমে বিয়েতে এসেছিলেন কোন ভাবে ঝামেলায় জড়ালে রিপোর্ট হবে হেড অফিসে। এখানে প্রজেক্ট আগানো মুশকিলে পড়বে। মালেকাও কথায় কথায় উঠে দাঁড়িয়ে বললেন

” এখন মনে হয় আমাদের যাওয়া উচিৎ।”

মোজাফফর সাহেবও সম্মত হলেন সাথে সাথে , কাল সকালে তিনিও ভাগ্নিকে খুলনা শহরে তার বাড়িতে নিয়ে যাবেন। সেখানে কিছু টের পাবার আগে নদীর আকত হয়ে যাবে। গ্যাব্রিয়েল হাত বাড়িয়ে করমর্দন করছে মোজাফফর সাহেবের, নদীর দিকে তাকিয়ে বলল–

” ওকে মেহরোজ, তোমার আঙ্কেল পারমিশন দিয়েছে, লেটস গো”

নদী বাকরুদ্ধ, রম্যের কথায় যেন গোটা ঘরে বাজ পড়লো। মোজাফফর সাহেব বললেন ” লেটস গো মানে? ”

” মানে আপনার কাছে তো সব ক্লিয়ার এখন কি আমরা যেতে পারি”

গ্যাব্রিয়েলের এই ইংরেজিটা বুঝলেন মোজাফফর সাহেব

” অবশ্যই! কষ্ট করে সব বোঝাতে ফিরে এসেছিলে এইজন্য ধন্যবাদ; নাও বেটার ইউ লিভ আরলি”

” আই উইল লিভ স্যার, এলঙ উইথ ইউর নিইস’

মোজাফফর সাহেব এইবারো বুঝলেন না। ঘরের অনেকেই বুঝলো না।শুধু নিশি কিছুটা নড়েচড়ে উঠলো, এতক্ষণে বাবুর্চি লাইনে এসেছে। মবিনের মুখে আবারও চিন্তা। এই ছেলের ভাবগতিক বোঝা ভার।
মালেকা গ্যাব্রিয়েলের কাছে এসে নিচু গলায় বলল,” কন্ট্রোল ইউর সেল্ফ, কেন ঝামেলা করছ এখন তোমার রওনা দেওয়া উচিত, রাত বাড়ছে ”

“আমি জানি রাত বাড়ছে, কিন্তু মেহরোজকে না নিয়ে তো আমি যাবো না৷ আমি ফিরেছিই তার জন্য ”

মোজাফফর সাহেব তার সামনে দাঁড়ানো যুবকের কথায় হতভম্ব। সেটা তার স্পর্ধা না, তার মুখে স্পষ্ট বাংলা শুনে বলা মুশকিল।

(চলবে)

#শারমিন_আঞ্জুম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here