বাতাসে তার সৌরভ পর্ব ২৪

0
232

#বাতাসে_তার_সৌরভ–২৪

” বেবি প্লিজ “সোহরাব সাহেবের মুখ অপরাধীদের মতো,” আই সেইড আই এম সরি …”
“নো নো ইউ আর রাইট, আমিই গ্রিডি!আর দোষ তো আমারই,আমি আমার অবস্থান ভুলে গিয়েছিলাম…”
” জেরিন, তুমি আমাকে গিল্ট ফিল করাচ্ছো, দেখ ডিউটির টাইম হয়ে গেছে তুমি এভাবে মুড বিগড়ে থাকলে…” সোহরাব সাহেব নিজের সবটা বলতে পারলেন না।রিসিপশন থেকে ফোন এলে তাকে অফিসে যেতে হলো।

যাবার আগে কিছু একটা রেখে গেলেন টেবিলের ওপর। জেরিন দেখেও না দেখার ভান করছে। আপাতত কেঁদে তার চোখ লাল, আরেকটু কাঁদলে ফুলে যেতো। সেটাই বেশি ইম্প্যাক্ট ফেলতে পারতো কিন্তু চেয়েও ব্যাপারটা আসছে না। কাল বেশ পরিকল্পনা করেই ছেলেকে তার খালারবাড়ি পাঠানো হয়েছে। জেরিনের জন্য আজ সারাদিন খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

সোহরাবের সাথে মনোমালিন্য হবার কারণ কিছুটা গুরুতরই। সোহরাব সাহেবের কানে কেউ ভরেছে যে সানশাইন বিল্ডার্সের একজন ডিরেক্টর শিমুল জেরিনের ভালোবন্ধু। টুকটাক তর্কে এই ব্যাপারটা নিয়ে বড় একটা ইসু তৈরি হয়ে গেছে। সানশাইন বিল্ডারস ইফতেখারদের, যাদের সাথে গ্যাব্রিয়েল কিচেনের জমি নিয়ে দ্বন্দ্ব চলছে। সোহরাব সাহেব রীতিমতো জেরায় ফেলে দিলেন।
বুড়ো রাজ্যের ঝামেলা মাথায় নিয়ে ঘোরে, জেরিনের কি এত খেয়াল থাকে? অবশেষে চোখের পানিতে সোহরাব ভড়কে গেছেন ঠিকই কিন্তু এটা যথেষ্ট নয়। তাদের সম্পর্কটা এই পর্যায়ে গিয়ে ধামাচাপা আর হয়তো দেয়া যাবে না। নদীটা সাতক্ষীরায় আটকে আছে এইখানে রাজিয়াও ছুটির জন্য প্যানপ্যান করছে।
” তোমার কথা বড় স্যার ফেলতেই পারবে না তুমি হলে স্পেশাল ”

কালই রাজিয়ার অভিজ্ঞ চোখে লুকায়নি কিছুই। এই ঘটনা শুধু রাজিয়ার মধ্যে আটকে থাকবে না আরও ছড়াবে। ছড়ানোর আগে জেরিনকে শক্ত অবস্থানে যাওয়া দরকার। যার কারণে আজ সারাদিনই সোহরাবের সামনে অশ্রু বিসর্জন করতে হবে। এই জমির ঝামেলা
সোহরাব একা সামাল দিতেও পারছেন না তার সাথে তার দুর্বলতাও জেরিনের মুষ্টিবদ্ধ। ছেলে আমেরিকার থেকে ফেরার আগেই কিছু হয়ে গেলে সবচেয়ে ভালো হয়। গ্যাব্রিয়েল ফিরে এসে কিছুই করতে পারবে না। তাছাড়াও হোটেলের যাবতীয় কাগজ সোহরাব সামদানীর নামে বলেই জানে। গ্যাব্রিয়েল তো বাংলাদেশীই নয় তার নামে এই দেশে কোন প্রপার্টি থাকার কথা নয়। যদিও এই বিষয়ে আরেকটু খোঁজ নেওয়া দরকার।
গভীর চিন্তার মাঝখানে জেরিন থেমে গেল, টেবিলের ওপর রাখা একটা চৌকো বাক্সে চোখ আটকে গেছে ৷

ক্লায়েন্ট মিটিং শেষ করে সোহরাব সাহেব নিজের ফ্ল্যাটে ফিরলেন রেস্টুরেন্টে ভালো লাগছে না, আজ শরীর ম্যাজম্যাজ করছে। জেরিনের সাথে একটু বেশিই চোটপাট করেছেন, বেচারি গাল ফুলিয়েছে। হাজার হলেও অল্পবয়সী মেয়ে অভিমান বেশি। মানুষ ধীরে ধীরে আবেগে যার ওপর নির্ভরশীল হয়ে যায় তার কাছ থেকে দূরে থাকতে ভালো লাগে না। কিন্তু সোহরাবকে সতর্ক থাকতে হবে। কোনো বোকামির জন্য গ্যাব্রিয়েল কিচেনের কোন ক্ষতি হতে দিতে পারেন না। যদিও ক্ষতি একটা ইতোমধ্যে হয়েই গেছে, নীতি মন্ডলের মত জাঁদরেল মানুষকে এই ঘটনার সাথে জড়িয়ে যাওয়া৷

” হেই রমি বয়! কি অবস্থা? ” সোহরাব সাহেবের ছেলের কথা ভাবতে ভাবতেই ছেলের কল চলে এসেছে । ভিডিও ক্যামেরায় রম্যের সুন্দর মুখটা কিছুটা ভারাক্রান্ত বলল,

” তেমন ভালো না একটু টেন্স ”

সোহরাব সাহেব মাথা নাড়লেন” অনি আমাকে বলেছে মিশেল নাকি ফিরে গেছে৷”

” সেটা ব্যাপার না, কিচেনের লোড কেমন একটু বলো। একটা বড় প্রবলেম এসে গেছে তোমার সাথে ডিসকাস দরকার.. ”

“কী সমস্যা? ”

” ইটস এবাউট মেহরোজ… আমার মনে হচ্ছে একটা বড়ো ঝামেলা হয়েছে ”

” রমি বুঝলাম না, তোমার ভয়েজ কেটে কেটে আসছে। রেস্টুরেন্টে লোড অবশ্যি আছে কয়েকটি পার্টি সামনে তবে… ”

” ডার্লিং আই জাস্ট কান্ট বিলিভ! ইজ দিস এ প্রপোজাল! ”

সোহরাব সাহেব বিব্রত, উচ্ছাসিত জেরিন পেছন থেকে সোহরাবকে জড়িয়েও সামনে ধরা মোবাইলে ভিডিও কলটা খেয়াল করেনি।বিষয়টি বুঝে সে মুহূর্তে সরে গেল। একঝলকে রম্য কিছু বুঝলো কি না বুঝতে পারছেন না সোহরাব।সহজ ভাবে বলার চেষ্টা করলেন,

” রেন্ডম টকিং…তোমার ভয়েজ ভালো মতো শোনা যাচ্ছিলো না, যাহোক তুমি কিছু বলছিলে রমি? ”

” আপাতত থাক ড্যাড। এইসব টেনশন নেওয়া এই বয়সে তোমার পোষাবে না।আমি হ্যান্ডেল করব, তুমি চিল থাকো হ্যাভ ফান। ”

রম্য ফোন রেখে দিলো।বিষয়টি সে জানতো ঠিকই কিন্তু ব্যাপারটা এভাবে সামনে আসবে বুঝতে পারেনি৷ অর্ণব পাশে বসে মুচকি হাসছে। কঠিন বাস্তব সে বেশ ক্যাজুয়াল ভাবেই নেয়। তবে রম্যের মুড হুট করেই কেন যেন বিগড়ে যাচ্ছে। কঠিন তম পরিস্থিতিতে আমাদের কাছেরজনের নির্লিপ্ততা বড় পোড়ায়।

” বাচ্চা মেয়েটার কোন সমস্যা না হলেই হলো,,আমিই ওকে পাঠিয়েছিলাম। “রম্যের নিজ মুখে অজান্তেই বেরিয়ে এলো।

” মেয়েটার থেকে কাগজগুলোর চিন্তা আমার মাথা খেয়ে ফেলছে একটু উল্টোপাল্টা হলে পনেরো লাখ ডলারের ডিড সম্পূর্ণ পানিতে যাবে … ”

অর্ণবের কথায় রম্য অস্থির অনুভব করছে। নিশার ফোন পেয়ে পরিস্থিতি সম্পর্কে যা জেনেছে তাতে সে কাগজ উদ্ধার সহজও নয়।

” আমাদের বড়ো মামা এলাকার বাইরে তিনি এলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চলে আসতো কিন্তু তার আসার আগে দেরি না হয়ে যায়… ”
হাতে নদীর স্রোতের মতো সময় পা
রম্য উপায়ন্তর না দেখে বাংলাদেশের আরেক জায়গায় ফোন দিলো। এখন দেশের অবেলা হলেও সম্ভবত রম্যের নাম্বার দেখেই ফোন রিসিভ হলো,
” হ্যালো রাবেয়া আন্টি? তোমার একটু হেল্প লাগবে ”

*****
দুইদিন পেরিয়ে,

ছোট মফস্বল শহরে মানুষগুলো ঢিলেঢালা মেজাজের। পান থেকে চুন খসলে দেরি হয়না, মানুষ তার কাজ বাদ দিয়ে জড়ো হয়ে ঘটনা দেখতে চোয়াল ঝুলিয়ে তাকিয়ে থাকে।
শাহজাহান সাহেবের বাড়ির সামনে এমন চোয়াল ঝুলানো মানুষের অভাব নেই। হবেই বা না কেন, যশোর থেকে বড় বড় দুটো ট্রাক ভরা গাদা আর গোলাপে ফুল এসেছে বাড়ির উঠোনে।
ফুলের গন্ধে মৌ মৌ করা ঘটনা সবার জানা কিন্তু এই গন্ধে বমি আসার বিষয়টি নতুন। শাহজাহান সাহেবের তাই আসছে৷

চায়ের মধ্যে মাছি পড়লেও শাহজাহান সাহেব সেই চা জ্বাল দিয়ে চুমুক দিয়ে ফেলেন, এমন মানুষের জন্য এত টাকার ফুলের বিষয়টা হজমযোগ্য নয়। কিন্তু সময় খারাপ থাকলে গাধাকে বাবা ডাকতে হয় শাহজাহান সাহেবকে বাপ-দাদা-শ্বশুর সবই ডাকতে হচ্ছে৷ছেলে আগেই বিগড়ে ছিল এখন বাড়ির পরিবেশ খারাপ খারাপে নরক গুলজার। একে তো অর্ধলক্ষ টাকার ফুল তার সাথে ফুলের অর্ডারকারী চরিত্র। এই জিনিস গত পরশু এসে এমন নাটক শুরু করেছে যে বাড়ির সবার ঘাম ঝরে যাচ্ছে। ভেতর বাড়ি থেকে প্রজাপতির মতো উড়তে উড়তে আসছে নিশি।ফুল দেখে আহ্লাদে গদগদ।

” ওমা এসে গেছে! ফ্যান্টাস্টিক! খালু দেখেনতো কেমন, শোনেন দুপুরে বেগুনি অর্কিড আসার কথা আরও দুই ট্রাক বুঝলেন ”

” আরও দুই ট্রাক! ”

” হ্যাঁ শাহীন ভাইয়ার স্পেশাল পছন্দ! ওইগুলো ছাড়া তো হলুদ হবেই না”

-এক থাবড়া মেইরে উড়োয় দেবো ওপারে গিয়ে পড়বি। শালারা তামাশা দেখতি এইসেসাও… ”

শাহবাজ গজগজ করতে কর‍তে এগিয়ে আসছেন। মুখ বড়ভাইয়ের মতোই অন্ধকার।বিয়ে ভাঙার পর থেকে বিউটির বাবার ধারের টাকা ফেরতের চাপ বাড়ছে ক্রমে৷
” ভাইজান এইগুলা কলাম বাড়াবাড়ি হচ্ছে অবস্থা এমন হলি এই গাদার মালায় গলায় দড়ি দিতে হবে ” গজগজ করতে কর‍তে প্রচন্ড রাগ উপচে পড়লো বড় ভাইয়ের ওপর।

” কেন শাহবাজ চাচ্চু, আপনার ভালো লাগছে না আয়োজন ” নিশির আহ্লাদীকন্ঠ ব্যথিত শোনালো।

” পেটে বেশি রস হলি ঘুরোয় ঘুরোয় হা**তে মজা লাগে। আমাগের তো এত রস নেই। তারপরও যা করছ…”

” কী করসে কাকা?ঘুরোয় ঘুরোয় হা**তিসে কিডা আমিও দেখি তারে ” শাহবাজের পাশে শাহীন এসে দাঁড়িয়েছে। শাহবাজের চেহারা মুহুর্তে ছাইবর্ণ।

শাহীন বলল” নিশি ভাইয়ের বে আয়জন কইরে ব্রাট অপরাধ কইরে ফেলেছে মনে হচ্ছে। ”

নিশি সাহস করে বলল,দেখ না শাহীন ভাইয়া আমি চলে যাব, তোমাদের বিয়ের একটা ফাইন ভিডিও এলবাম করতে চাইছি, কিন্তু খালু চাচ্চু মনে হচ্ছে আমার উপর রাগই করে আছে ”

শাহীন হেসে বলল,” আহা রাগ করেনি নিশি, ঘটনা হয়েছে কি চাচার আয়োজনটা মজা পাচ্ছে না। আমি ঠিক কইরেসি আরও ইন্টারেস্টিং কিছু করব বুঝতি পেইরেছ, আজ হলুদের স্টেজে টিপ নিশানার পেরেকটিস হবে। এই ধর চাচার দুই হাতে আর মাথা উপরে আপেল দিয়ে দাঁড় করাবো সবার সামনে তারপর এই পিস্তল দিয়ে এক্কেবারে উড়োয় দেবো।’
শাহজাহান শাহবাজ বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে। শাহীন হেসে বলল, ” আপেল ওড়াবো, চাচার কিছু হবি নানে, একেবারে ঠুসঠুস! কী চাচা এখন আয়োজন পছন্দ হয়েছে? ”

শাহবাজের মুখে পূর্ণ হাসি খেলা করছে ” হে হে হে আমার তো শুরু থেকেই ভাল্লাগসে! এরাম আয়োজন না হলি কি চলে? ”

শাহজাহান সাহেব শান্তমুখে পুত্রের কর্মকাণ্ড দেখছেন, শরীর চিড়চিড় করে উঠলেও কিছুই বলার নাই।ঘুরেফিরে রাগ উঠছে শালিকার উড়নচণ্ডী মেয়ে নিশির ওপর। ওইদিকে বিউটিদের বাড়িতে ছেলের দাদীর অসুস্থতার বাহানায় বিয়ে ঠেকিয়ে রাখা হয়েছে৷গত পরশু রাতে শাহীনের হঠাৎ মাথা চাড়া দেয়া পাগলামিটা সামাল কীভাবে দেয়া যায় ভেবে আকাশ-পাতাল করছিলেন,হঠাৎই বিশাল গাড়ি নিয়ে নিশি হাজির হলো। এসেই হইচই। পাগলকে বড় কৌশলে সাকো নাড়াতে নিষেধ করা হলে পাগলও ইশারা বুঝে লাফানো শুরু করল।
ফাপড়ে পড়েছেন শাহজাহান সাহেব।

ঝুড়িভরা ফুল ভেতর বাড়িতে বয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, শাহজাহান সাহেবের বুকের মাঝে যেন চুরি চলছে।৷ নিশির সাথে এসে জুটেছে আরেক ছোড়া। দেখে নিশির মতো বিপদজনক মনে হচ্ছে না। ত্রিশের কাছাকাছি বয়স। তবে প্রচন্ড চতুর ছেলে, আসার পর পর খুব দ্রুতই ঘরের সবার সাথে কিছু একটা সম্পর্ক করে ফেলেছে। এমনকি রানুও আজ সকালে হেসে হেসে গল্প করছিলো। কিন্তু শাহজাহান ছেলেটার কাছ থেকে সতর্ক থাকেন। এই ধরনের চরিত্রগুলো হয় একেবারে সরল অথবা ভয়ংকর জটিল ধরনের হয়৷ মানুষকে কঠিন বিপদে ফেলে চিকন গলি দিয়ে সরে যায়। এখনো কেমন শীতল চোখে ফুলের ঝুড়ির দিকে তাকিয়ে আছে। যেন ফুলগুলো বিশেষ।
শাহীন নিজেও ফুলগুলোর পেছনে যাচ্ছিল…

” শাহীন ভাইয়া আমি কনফিউজড! “নিশির পেছন থেকে চিৎকার।
” দেখেন না, আপনার আর নদীর নামটা কোন রঙের গোলাপ দিয়ে লিখবো? লাল রঙ সুন্দর লাগবে কিন্তু হলুদের অনুষ্ঠানের জন্য আনা হলুদ গোলাপ, নাকি…?. ” শাহীন চিন্তিত হয়ে নিশির পাশে দাঁড়িয়ে গেল।

ঘরের মাঝে ফুলের ডালা নামাচ্ছে মবিন। ফুলবহনকারী শ্রমিক সাবধানে মবিনের হাতে বুঝিয়ে চলে গেল।

” এত্তগুলোন ফুল দে হবে কিরে,” বিছানায় অর্ধশায়িতা নাহার বেগম জানালায় বড় বড় চোখে দেখছেন।

নদী থমথমে গলায় বলল ” গলায় দড়ি দেব দাদি”

” দড়ি না গো, শাহীনরি মালা পরাই দে গো বোন, তুই বাড়িতে ফিরে এলে সময় মতোন কটা ভাত জুটবে… “নাহার ফোকলা দাঁতে হাসছেন।

নদী ছোট একটা নিঃশ্বাস ফেলল। এই জগতে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রাণীও মৃত্যুর আগে নিজের স্বার্থের পুজারী হয়, নাহার বেগমের আর দোষ কী?নদীর ভাগ্যটাই হঠাৎ বিগড়ে বসে আছে। সাতক্ষীরায় তার বন্দী জীবনের প্রায় চারদিন পার হলো। প্রচন্ড জ্বর এসে শুরুতে মহা সর্বনাশ হবার থেকে বেঁচেছিল।
কিন্তু বড়োমামা মোজাফফর সাহেব এখনো ফিরতে পারেননি। দোকান পোড়ার সাথে আরও কি পুলিশের কেস কাচারির ঝামেলা হয়েছে। ফোনে জানিয়েছেন ফিরতে আরো দুতিন দিন লাগবে।বড়মামি মেজমামি এই পর্যন্ত তাকে শান্ত থাকতে বলেছে কিন্তু সরু নজরে তাকিয়ে থাকেন রানুখালা। তার নিয়োজিত দুজন প্রহরী নদীর দিকে চোখ রাখে সব সময়।বাথরুম গেলেও একজন থাকে দরজার কাছে।বড়োমামা ফেরার কথায় শাহীনের ভেতর ভয় ঢুকেছে। তিনি আসার আগে বিয়েটা করে ফেলবে। বাড়ির চারিদিকে শাহীনের সাঙ্গপাঙ্গদের পাহারাদার বসেছে। ।

পরিস্থিতি শাহীন দুদিন আগেই নিয়ন্ত্রণে এনে ফেলেছিল হুট করেই নিশির আগমন। তার গাড়ি ঘরের উঠোনে আসার পর, শাহীন উত্তেজিত হয়ে ভেতরবাড়ি কাঁপিয়ে দিলো।

” এইখানে ছয়টা গুলি পুরো লোডেড বুঝতিসাও?.কোন ঝামেলার পিলেন থাকলি সবার কলাম মাথা উড়োয় দেবো।
কোন হেরিতেরি কত্তি পারবা না কেউ।নদীর সাথে আমার বে যদি না হয় তাহলি… ”

শাহীনের হম্বিতম্বি ভড়কে গেল নিশিকে হাসিমুখে বাড়ির বাউন্ডারিতে ঢোকার পর,- “ওহ মাই হড আমার দুই কাজিনের ইন্টার ম্যারিজ কত্তো এক্সাইটিং।সোওঅঅ কিউউউট! ওহ শাহীন ভাই আর নদু, ইউ আর লুক টু কিউট টুগেদার! আমেরিকা যাবার আগে নিজেহাতে আমি বিয়ের ভিডিও এলবাম বানাবো ওইখানে গিয়ে এডিট করে ইউটিউবে ছেড়ে দেব। ”

নিশির তিড়িংবিড়িং আহ্লাদী দেখে বাড়ির লোকেরা থতমত খেয়ে গেল।
তবে মবিন ছেলেটা এর মূল রহস্যটা বয়ান করেছিল।

” নিশি যেভাবে রেগে মেগে রওনা দিয়েছিল তাতে কন্ট্রোল কিছু তো হতই না হিতে বিপরীতই হতো।আমরা আগে নিকটস্থ থানায় রিপোর্ট করতে পারতাম যেহেতু জানলাম যে মানুষটার মাথায় কিছু সমস্যা আছে এবং সে তার নিজের কিছু উগ্র বন্ধু দিয়ে বাসার চারিদিক নজরবন্দি করে রেখেছে, না বাসা থেকে কাউকে বের হতে দিচ্ছে না নিজে বের হচ্ছে কাজেই সে খুব প্যারানয়েড অবস্থায় আছে। আপাতত সরাসরি পুলিশ খবর দেবার চিন্তার থেকে দূরে থাকতে হবে। শাহীনের অবস্থা বুঝে নয় পুলিশ তার নিজেদের হিসাব মতো কাজ করবে, এই অবস্থায় যেটা করতে হবে শাহীনের বিশ্বাসটা আগে জয় করতে হবে। এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করতে হবে যে সে অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আসে। একেবারে টের না পেয়ে। ”
সাতক্ষীরার যাত্রা পথে মবিন নিশির মগজধোলাই করে নিয়েছে ভালো ভাবে। যার কারণে রঙ্গমঞ্চের প্রথম দৃশ্য ভালো ভাবেই সামলানো গেছে। শাহীন নিশির ওপর পূর্ণ ভরসা করতে শুরু করেছে৷ বাড়িতে মহা সমারোহে হলুদের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হচ্ছে,আপাত শাহীন খুবই খুশি৷ বিশ্বাস জয় করে নিলে প্ল্যানের নতুন ধাপে যেতে হবে। এই ধাপ আরও একটু কঠিন।

” আমার কেন যেন ভয় হচ্ছে মবিন ভাই” নদীর ম্লান কন্ঠে মবিন তাকালো, ” কেন যেন নিজের জন্য নয় আপনারা যেন নিরাপদ থাকেন সেই চিন্তা করছি”

” তোমার মনে হয় এই ঝামেলা থেকে বের হতে পারবে না?মবিন ফুলের ডালা রাখতে রাখতে জিজ্ঞেস করলো।।

” আমার মনে এইবার ধরা খেতে হবে সময় সব সময় সঙ্গ দেয় না মবিন ভাই ”

” সময় আমাদের সঙ্গ কখনোই দেয় না, সঙ্গ দেয় সময় থাকতে আমাদের বুদ্ধি”

” আমার বুদ্ধি কাজ করছে না”

” করবে ইনশাআল্লাহ। শোনো দুই ধরনের মানুষেরা যোদ্ধা হয় এক হলো যাদের পেছনে বিপদ লেগে থাকে যেমন তুমি, আরেক হলো যারা বিপদকে নিজের পেছনে লাগিয়ে রাখে, বা খাল কেটে ডেকে নিয়ে আসে যেমন নিশি। ”

নদী হেসে ফেলল।

” ভরসা রাখো নদী, নিশিকে যতোটুকু চিনেছি ও তোমাকে না নিয়ে ফিরবে না, আর আমাকেও যেতে দেবে না।

মবিন হেসে দ্রুত বিদায় নিলো। তাকে নিয়ে নাহার বেগমের কৌতূহল কমে না,
” এই চাওয়াল কিডা রে? তোর ওই ডিস্কো বোনের সাথে এইয়েসে,যাক তার তালি এত দিনি গতি হইলো ”

” তাও ভালো, সবাই তো আর মোহনার দেখা পায় না,নিশির জীবনে অন্তত ভোর আসুক” নদীর গাঢ় কন্ঠের দ্যোতনা এড়ালো না বুড়ির কানে।কাছে এসে হুট করে নদীর মুখে ফুউউউউ দিয়ে দিলেন নদী সরে গেল দ্রুত,

” আরে সরিসিস ক্যান লো মুখপুড়ি, দোয়া কইরে ফু দি দেলাম! দেখিস কত বড় রাজপুত্তুরের সাথে ঘর করিস।”

*******
দেখতে দেখতে সময় পার হচ্ছে। নদীর বড় মামি মেজমামি স্বাভাবিক চলাচল করতে পারলেও কেউই ঘরের বাইরে পা রাখতে পারছেন না। শাহীন তার সাঙ্গপাঙ্গদের প্রহরা বসিয়েছে বাড়ির সীমানার দূর দূরান্ত পর্যন্ত, যাদের স্বভাব চরিত্র বিশেষ সুবিধার নয়। বের হতে পারছে না নিশি ও মবিনও। এখন বাড়ির বড় মুরব্বি মোজাফফর সাহেবের অপেক্ষা করা ছাড়া কোন উপায় নেই।

এদিকে বিয়ে বাড়ি ঘিরে বাইরের মানুষের উৎসাহের সীমা নেই। চারিদিকে লোকজন আগ্রহ নিয়ে সাজসজ্জা দেখছে। স্টেজের কাজ এগিয়ে এই ভিড়ের মধ্যেই মবিন সাবধানে একটা কোণা বেছে নিয়েছে। ফুলের ডালার মাঝে লুকানো ট্যাবলেটের পাতা দ্রুতই হস্তগত করেছে। তবে কিছুটা কনফিউজড। ফোনে কথোপকথনের আরেকটু নিশ্চিত হতে চাচ্ছে,ওপাশ থেকে বলছে,

” তুই যে কোম্পানি মেনশন করেছিস সেটা যশোরের কোন ফার্মেসিতে পাইনি তাই নতুন কোম্পানিরটা পাঠালাম ”

” এতে কাজ হবে? ”

” হবে তো অবশ্যই, একটাতেই ফুল টং হয়ে থাকবে ”

” উহু টং হবার জন্য না… ”

মবিন তার ভাইয়ের সাথে বেশি একটা কথা চালাতে পারলো না। লোক সমাগম এখানেও বেড়ে যাচ্ছে। এর মাঝেই নিশিকে দেখা গেল হাতের ট্রেতে পায়েসের বাটি। মবিন একবার বলেছে সে পায়েস খায় না তবুও নিশি নিয়ে এসেছে। সচেতন ভাবে কারো প্রতি বাড়তি খেয়াল দেখানো এই মেয়ের স্বভাব না৷ এগুলো অবচেতনে আসে, মবিন তাই তর্কে গেল না শান্তমুখে পায়েস নিলো।নিশি চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল,-

” পানি খেতে সমস্যা হচ্ছে নাতো? সাগর কাছাকাছি তো এখানের পানি কিন্তু সামান্য নোনতা ”

” তা ঠিক তবে আমার কোথাও সমস্যা হয় না”

নিশি হাসলো,” আই থট সো, তুমি সম্ভবত ককরোচ গোত্রের । যেকোনো সিচুয়েশনে এডজাস্ট করে ফেলো। হা হা হা ”

মবিনকে হাসলো না দেখে নিশি সামলে নিলো,দ্রুত বলল” সরি ফর ব্যাড জোক। ”

” কিন্তু এটা জোক নয়, সিরিয়াসলি না করলে ধরা খেতে হবে” মবিন আড়াল করে নিশির হাতে ট্যাবলেটের পাতা গুজে দিলো বলল,” দুটো ট্যাবলেট সাবধানে মেশাতে হবে ”

” কাজ হবে? ”

” হওয়া উচিত, তার ঘুমে ঢলে পড়ার পর ওয়েপেনটা সরাতে হবে। একটা কলের অপেক্ষায় আমার ভাই লোকাল থানাতেই বসে থাকবে,ইতোমধ্যে পুলিশ সাদা পোশাকে সাবধানে টহল দিচ্ছে, তবে সবচেয়ে আগে মেইক শিউর যেন শাহীনই খায়।”

” ওই পাগলরে খাওয়াইতে ফর্মুলা এপ্লাই কর‍তে হবে যেটা মোটামুটি অব্যর্থ ”

” কীভাবে? ”

” যেভাবে তুমি তালে তালে পায়েশটা খেয়ে নিলে ” মবিন অবাক হয়ে খেয়াল করলো আসলেও সে পায়েস খেয়ে নিয়েছে।সবুজে ঘেরা সাতক্ষীরার জলবায়ুর মাঝে কিছু আছে, একটু পরপর খিদে চনমন করে। আর স্বীকার করতেই হবে নিশির আত্মিয়াদের হাতের রান্না খুবই চমৎকার। এরা বলা যায় বর্ন টেলেন্ট।

নিশি আরও কিছু বলতো কিন্তু কথা আগালো না, উল্টো মুখ অন্ধকার করে ফেলল। কারণ রানু খালা এদিকে আসছে হাসিমুখে ” ও তোরা গল্প করসিলি?”

” না খালামনি আমরা ফাকে বসে প্রেমালাপ করছিলাম, এভাবে ভাবলে মেবি ইউ উইল ফিল বেটার”

মবিন বিব্রত রানুর মুখ অন্ধকার। নিশি বিরক্ত হয়ে উঠে চলে গেল। মবিনের সাথে চোখাচোখি হলে আন্তরিকতার অভাব হলো না রানু,

“ও তো এমনি একটু পাগল..তা তুমারি চা দেব বাবা?

” না আন্টি মাত্র পায়েস খেলাম ”

” এইসে পরে মেলাগুলোন কাজ কইরেসো,তা নিশি খুব ভালো বন্ধু তোমার, না? ”

” বন্ধুর আগে কলিগ, আমরা একই স্কুলে পড়াতাম ”

” তা শুনলাম ঢাকায় বাড়ি আছে তোমাগের, বাবা নাকি ব্রাট সরকারি ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন ”

” জি রোডস এন্ড হাইওয়ের ”

“যাক আমাগের নিশির তাহলি সুমতি হইয়েসে, তা ওর সম্পর্কে তুমি তো মনে হয় সবই জানো তাই না? ”

” মনে হয়… ”

” আসলি যে ঝড়টা মেইয়েটার উপর দিয়ে গেলো… এক মহা বদের পাল্লায় পইড়েছিল,মেইয়েটার বোকামির জন্যি কতবড়ো মূল্য দিতি হইলো, মাঝখানে আমাগের প্রাণ ওষ্ঠাগত । তুমি এসব তো জানোই তাই না?’

“সবটা জানি না, তবে আমার মনে হয় এখনই সব জানা তত জরুরি বা শোভনীয় না। এখনো আমরা নিছকই বন্ধু ”

মবিন স্টেজ সাজানোর কাজের কথা বলে বিদায় নিলো। রানু ভ্রুকুটি করে তাকিয়ে রইলেন৷
ছেলেটাকে শুরু থেকেই সন্দেহজনক চরিত্রের কাতারে লিখেছিলেন এখন অপছন্দের কাতারে ফেলে দিলেন।

*****

” এত ডিটেইলস জেনে কী হবে? আর ধুর…”
নিশি ইংরেজিতে কারো সাথে ফোনে কথা বলে যাচ্ছে। পাকের ঘরের টিনের ছাদে বৃষ্টির শব্দ নিশির কথা অস্পষ্ট করে দিচ্ছে ক্রমে। নদীর ততটা মনোযোগও নেই। রানুখালা আজ সকালের কিছু কথা তার ভেতরের সাহসকে ধাক্কা দিয়েছে জোরালো ভাবে৷নাস্তা করতে করতে খুবই নির্লিপ্ত ভাবলেশহীন ভাবেই বললেন, ” শোন নদী, আমার এইখানে থাকতি তোর আপত্তি তা আমি জানিনে তা নয়। কিন্তু যে অবস্থা চলতিসে তুই বাড়ির বাইরে একটা কদম টিকতে পারবি নানে।
একে তো শাহীনের জিদ তার ওপর ওর ওসব গুন্ডাপান্ডা বন্ধুগুলোন এই মুহূর্তে নড়া তো সম্ভব না।এরা পুরো বাড়ির চারিদিকে ছড়ায় ছিটোয় আছে একটু হেরিতেরি দেখলি.. । আমি যে তারি বুঝাতে চাইনি তা কিন্তু নয়, তবে ভেইবে দেখলাম এই বিয়েতে তোর লোকশানির থেকে লাভই বেশি। ওই একখানই ছেইলে, যা আছে তা তো সবই তোর, আর তুই আমার মরা বোনের মেইয়ে। বাপের ছায়া নেই,অন্য কেউ মিষ্টি কতায় তাগের বাড়িতে নিয়ে যেতো ঠিকই, কিন্তু ফাকে পেইয়ে তোরি কিরাম আছাড় মারবে ধারণা আছে? দুনিয়া এত সহজ না। না জেনে বিষ খাওয়ার চেয়ে জেনেশুনে তিতা চিরতা খাওয়া সুবিধের না?হাজার হলিও আমারি তো তুই চিনিস, আমি আর যাইহোক তুরি মেইরে তো ফেলব না। আর একটু আধাপাগল জামাই পাওয়া কিরাম ভাগ্যের কতা তুই জানিস?তোরি পালি মাথায় কইরে নাচবে আমার ছেলে।”

রানুখালার কাছ থেকে নদী স্পষ্ট জবাব পেয়ে গেছে৷ এখন মনে হচ্ছে খোদ রানুখালারই যোগসাজশ যেখানে সেখানে তার মুক্তি নেই।
বাতাসে পেয়াজ বেরেস্তার সৌরভটা বিয়ে বাড়ির আমেজ ছড়াচ্ছে। দুরের শিলপাটায় মেহেদী বাটা হচ্ছে, হিন্দি গানের মিউজিক ভেসে আসছে, সব আয়োজন এই পুরনো কারাগারে
তাকে আবদ্ধ রাখার জন্য।
চন্দ্রমল্লিকাকে ফিরে পাওয়ার স্বপ্ন স্বপ্নই ছিলো। হয়তো অনেক কিছুই স্বপ্ন ছিলো। ফিরে গেলেও সেটা কখনোই সম্ভব হতো না। সে মানুষটা তো বিয়েতেই বিশ্বাসই করতো না।আজ একাকী নিভৃতে ভাবে তার কথা। গ্যাব্রিয়েল কিচেনে একবার বেশ বড় ওয়েডিং পার্টি ছিলো।
এমন অনুষ্ঠান হলে নদীর উৎসাহ যেন দ্বিগুণ হতো, শহুরে বিয়ের চকচকে ব্যাপারগুলো চোখে ধন্দ্ব লাগানোর মতো।
” পুরোপুরি মেকি একটা অনুষ্ঠান, বিয়েটা আজকের পৃথিবীতে আননেসেসারি থিং”
অনুষ্ঠান সেরে একান্তে গ্যাব্রিয়েলের কথায় চোয়াল ঝুলে গিয়েছিল নদীর। জিএস হেসে বলল “লিসেন একসময় আমাদের সমাজটা সিভিলাইজড ছিলো না, কড়া কিছু নিয়ম কানুন তৈরি করা হয়েছিলো যেন মানুষ নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে চলে। কিন্তু মেইন কারণ হলো জৈবিক প্রয়োজন মেটানো । সেটার জন্য এখন এগুলো দরকার নাই ”

“মানুষের বিয়ের দরকার নাই? ” নদী হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল

‘কারো সাথে ফিজিক্যাল হবার জন্য তাকে বিয়ে করা জরুরী না , আই মিন একটা সার্টিফিকেট তার সাথে ইন্টিমেট হবার পারমিশন দেয় না , তার সাথে মেন্টালি কানেক্টেড থাকাটা জরুরি ওটা ঠিক থাকলেই হয় ‘

নদী গম্ভীর গলায় বলল,’বিয়ের আগে যদি মেন্টাল কানেকশন হয়ে যায় ? ”

জি এস হেসে বলল ,’ ইফ দেয়ার এনাফ লাভ এন্ড এট্রাকশন ইটস কোয়াইট ন্যাচারাল ,দে সুড লিভ টু গেদার উইথ আউট এনি কন্ডিশন ‘

‘কন্ডিশন তো আছে, এই পদেরগুলোকে আগে চ্যালাকাঠ দিয়ে পিটিয়ে নেওয়া। কারণ এমন লোকদের আবজাব ভূষি দিয়ে মাথা ভরা থাকে ”

” মেহরোজ আমি তোমার বাংলা বুঝতে পারছি না কেন? ”

নদী হেসে উত্তর দিলো, ” কথাগুলোর প্রপার ইংরেজি হয় না তো স্যার এইজন্য বুঝতে পারছেন না। ”

বেলা গড়ানোর সাথে সাথে বাইরের মাইক্রোফোনের শব্দ হচ্ছে, লাইভ
গানের আয়োজন হবে। হলুদের স্টেজ তৈরি শেষ প্রায়।সাথে মানুষের ভিড় বাড়ছে। নদীর মাথা ব্যথায় ফেটে যাবার অবস্থায়। বাথরুমে গিয়ে ঘাপটি মেরে বসে থাকবে নাকি বুঝতে পারছে না। এর মাঝে বাইরে কিছু একটা হয়েছে বেশ হইচই । উঁচুগলায় কথা শোনা যাচ্ছে,

” ও মেজআপা দেখ বাইরে কারা কারা এইসেছে! ” মেজভাবি হন্তদন্ত হয়ে বলতে এলে রানু তটস্থ হয়ে গেল ” কিডা পুলিশ? ”

” আরে না, ইউ এন ও সাহেবের সাথে আরও কারা কারা। এই যে টাউনের বড় এন জি ওর লোকজন। শাহজাহান ভাই তাগের নাকি ডেইকে নিয়ে এসেছে তার বন্ধু মানুষ ভাইপোর হলুদ দেখতি এইসেছে দেখা করতি চায়।’
রানু বুঝলো ভেঙে যাওয়া বিয়ের মেয়ে পক্ষদের হুমকি সামলাতে শাহজাহান ভি আইপি ম্যানেজ করে ফেলেছে।

ঘটনা শুনে নিশি চিন্তিত হয়ে নদীর পাশে বসলো। অনুষ্ঠান শুরু হয়ে যাচ্ছে এখনো আসল পরিকল্পনায় আগানো যায়নি।সুযোগই নেই। রানু বড় অতিথিদের আপ্যায়ন করতে যেতে যেতে হবু পুত্রবধূর দিকে ফিরলেন,
” এখন সঙের মতো বইসে থেইকো না, যাও একটু মুখ হাত ধুয়ে শাড়িখান পইরে এইসো, আর নিশি একটু সাজায়গুজোয় দে দিনি। কালো মুখখান যেন একটু ফর্সা লাগে তাড়াতাড়ি অনুষ্ঠান শুরু করতি হবে”

রানু চলে গেলে,নদী স্থির দাঁড়িয়ে। ঠান্ডা গলায় নিশিকে বলল,” নিশি আমি দাদির বোরখা পরে আসছি আমার সাথে ছাদে উঠবি? ”
” ছাদে? ”
” হ্যাঁ পাশের আমগাছের লাগোয়া ডাল দিয়ে যেভাবে তুই পালিয়েছিলি একবার আজ আমি ট্রাই দেব, দেখি কে আটকায় ”
নিশি দেখলো নদী সত্যিই নাহার বেগমের ঘরে গিয়ে তার বোরখা তুলে আনছে৷

” ও নদীপু কোতাও যাচ্ছ? একটু চা বানাতি হতো শাহীন ভাই বইলেছে তোমার হাতেরতাই খাবে ”

বেলার কথায় নদীর ভাবান্তর হলো না,বলল” এখন সময় নেই রে আমার সাজতে যেতে হবে” নদী দ্রুত তার ঘরে যাচ্ছে তার ঘর থেকে বোরখা পরে পেছনের উঠান সেখান থেকে ছাদের সিড়ি। নিশি হুট করে বাধা দিলো,
” চা টা বানিয়েই যা। শখ করে খেতে চেয়েছে বেচারা আর জীবনে আর জোটে কি না”
*******
হলুদের অনুষ্ঠানের হলুদ লাগানোর আগেই বেশ গানের আয়োজন হয়েছে। বিশাল জাকজমক আর মানুষের আগ্রহের মধ্যে বর কনের দেখা নেই কোথাও৷ বেশ কয়েকবার শাহীনের খোঁজ হয়েছে। শাহীন নাকি ঘরে রেডি হচ্ছে৷ নদী নিশির কথায় শান্ত হয়ে সেজেগুজে বসে আছে। খুব আশ্চর্যজনকভাবে অল্প প্রসাধনীতেও তাকে দেখাচ্ছে হলুদ তাঁত পরা ইন্দ্রাণীর মতো। শ্যামলা গায়ের এত সুন্দর হলুদ কনে দেখা যায় না সহসা। সে স্টেজে এখনো যায়নি, কারণ শাহীনের রুম বন্ধ। নিশি ক্রমাগত অভয় দিচ্ছে। মাঝখান থেকে মবিন খোঁজ নিয়ে গেছে

” শাহীন চা টা খেয়েছে তো? শিওর তো? ”
” কতবার বলব? ”

” যতক্ষণ আমি শিওর না হচ্ছি, সে পুরো ঘুমিয়ে গেলে বাকিদের সন্দেহ হবে এরপর আমি এগিয়ে দরজা খোলার চেষ্টা করব।তবে জেগে থাকলে সব বানচাল”

” কিচ্ছু বানচাল হবে না ও না ঘুমালে মাথা বাড়ি দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেব, আমি তো আছিই এইখানে কোথাও তো যাচ্ছি না ”

মবিন মাথা নেড়ে বলল” তুমি আছ বলেই টেনশনটা বেশি ”

কনে রূপে নদী অবাক হয়ে দুজনের তর্ক দেখছে৷ মবিনভাই মানুষটা যে অসাধারণ এটা বলার অপেক্ষা রাখে না তবে এটা নিশির বোঝা আগে দরকার৷
স্টেজে গান চলছে, বর কনে কারোর কোন খবর নেই। জেলার বড় বড় হর্তাকর্তারা অতিথি হয়ে এসেছেন, এসেছে বিদেশি এনজিওর লোকজন, বর কনের খোঁজ করছেন। অথচ আজ যেন শাহীনের পাগলামি আরও বেড়েছে৷
শাহজাহান বিরক্ত হয়ে ছেলের দরজায় কড়া নাড়লেন।

” আমার ঘুম ভাঙাইয়া গেল গো মরার কোকিলে ”
গানের তালে শাহীনের বন্ধুরা নেচে-কুঁদে যাচ্ছে। মবিনের হাসি পাচ্ছিলো পরিকল্পনা মতো সব আগালে কোকিলের সহজে ঘুম ভাঙবে না, এর কিছুক্ষন পর কী হতে যাচ্ছে তা আন্দাজ করেই মজা লাগছে।স্থবির হওয়া ঢিমতালে থাকা জীবন কিছুটা গতি পেয়েছে।পার্থিব ভয়ডর মবিনের এমনিতেই একটু কম, তবে আধাপাগল মেয়েটার সাথে এসে এত বৈচিত্র্যময় অভিজ্ঞতা হবে ভাবেনি। এদিকে মঞ্চে উদ্দাম গান চলছে..

” আমার উদাসী বানাইয়া গেল বসন্তেরই কালে গো… ”

” মরার কোকিলেএএএএ!”

ভয়ংকর হেড়ে গলার বিশালবপু কোকিল হঠাৎ হাজির হয়েছে, সুর তাল লয় সব হুট করে থেমে গেল।গায়ক, দর্শক সবাই চমকে তাকিয়ে আছে।
স্টেজের মুখে দুটো চরিত্র দাঁড়িয়ে আছে একজন যেন ঠিক স্থির নয়। পা দুটো টলছে নিজের মতো। শাহীন তার চাচাকে ধরে রেখেছে শক্ত করে। শাহবাজ যদিও সহজ থাকতে চাইছে কিন্তু হুট করে কেন যেন বেশ ফুর্তি ফুর্তিভাব এসে সব আড়ষ্টতা গায়েব। মাইকের কাছে এগিয়ে এসে বেশ চড়া গলায় বলছেন —

” আরে গান ইস্টপ কইরলে কেন? গাও মরার কোকিল গাও , না পারলি বল আজ আমি গেইয়ে দেবো, এমন গান গাবো কোকিল জীবনে আর ঘুমোবে না…”

“চাচা আপনি ঘরে গিয়ে আরাম করেন না হয় ” শাহিনের কন্ঠে বিরক্তি।

” আরে না, আজ হইলো গে তোমার ইশপিশাল ডে, আরামির সুযোগ আছে? আজ তো ফুর্তি করব, মহামান্য অতিথিবৃন্দ , আজ আমার ভাইপোর ব্রাট বড় দিন। আজ হইলো তার বডি ইয়োলো…”

শাহবাজ হাল্কা ঢুলুনি চালে স্টেজে দাঁড়িয়ে বকে যাচ্ছে,মবিন হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে নিশি আর নদীর দিকে। নিশি খুঁজে বেড়াচ্ছে বেলাকে,খপ করে ধরে প্রশ্ন, ” এইই, চায়ের কাপ কাকে দিয়েছিলি? ”

” ঘরে দিয়ে এইসেছিলাম শাহবাজ কাকা জোর কইরে খেয়ে নেলো ”

নিশির রাগে মাথা ঘুরছে। এইদিকে স্টেজে শাহবাজ বকে যাচ্ছে তাকে থামানো আরেক কঠিন ব্যাপার..

” আজ আমার ব্রাট আনন্দ হচ্ছে, আমার এই ভাইপো হইলো ফিরিশতার ছানাপানা গোত্রের বুইছেন। ক্লাস নাইনি থাকতি বিছানার নিচে মেইয়ে মানুষের ছবি নে ঘুমাতো, একটু জামা কাপড় কম পরা মেইয়ে মানুষ আরকি; তবে অশ্লীল নয় ৷ আরে শুধু মেয়ে মানুষির ছবি তো, সাথে পুরুষ থাকলি না অশ্লীল হইতো বুঝতি পারিসেন না? হে হে হে ”

শাহজাহান এই পর্যায়ে ভাইকে জবরদস্তি নামিয়ে দিলেন স্টেজ থেকে।
” একে গরম, তার উপরি বিয়ের টেনশন, আমার ভাইয়ের শরীর একটু খারাপ যাচ্ছে এইজন্য ক্ষমা চাচ্ছি, যথেষ্ট রাত হলো আমরা নাহয় মূল অনুষ্ঠান শুরু করি ”

শাহীন লাল পাঞ্জাবি পরে নিজের সিংহাসন আসীন হলো, সবার মাঝে তোড়জোড় পড়েছে বউকে স্টেজে তুলে আনার জন্য । তীব্র আশঙ্কায় নদীর বুক কাঁপছে।

” তুই যাবি না কিছুতেই না! ”
নিশি নদীর হাত শক্ত করে ধরে আছে।

” অনেক হয়েছে এখন যেতে দে আমায় নিশি। পালিয়ে সব সময় নিয়তি বদলানো যায় না”

নদী উঠে দাঁড়াল,নিশি স্তম্ভিত। নদী ঘুরে তাকালো,” ভালো কথা, তুই ফিরে গেলে আমার লাগেজ থেকে হলুদ চামড়ার ব্যাগটা সাথে নিয়ে যাস, জরুরি ডকুমেন্টসগুলো গ্যাব্রিয়েলের আমানত ফিরে অবশ্যই দিয়ে দিস ,আমি কথা দিয়েছিলাম ”

নদীকে তার দুই মামি শান্ত মুখেই স্টেজে নিয়ে আসছেন ।পেছন পেছন নিশি অসম্ভব শক্তমুখে এগোচ্ছে,না এত সহযে সে ছেড়ে দেবে না। চোরা নজরে খুঁজছে আশেপাশে কোন শক্ত লাঠি আছে নাকি , আজ দরকার হলে সত্যিই মাথা ফাটাবে শাহীনের।

স্টেজে প্রায় শত মানুষের সামনে নদীর হুট করে অনুভব শূন্য লাগছে৷ তীব্র শোক মানুষের অনুভবের ক্ষমতা কমায়। নদী জানে না তার সাথে কী হচ্ছে বা কি হতে যাচ্ছে। তার সামনের বাস্তবটা দারুণভাবেই অগ্রহণযোগ্য কিন্তু বাস্তব। দমবন্ধ অবস্থায় চোখের সামনে এখনো অসম্ভব স্বপ্নটা ভাসছে, দেখতে পাচ্ছে পুরনো ঠিকানা অতীতের হাতছানি । মন অস্ফুটে বলছে, ” এতটাই ছিল স্বপ্নের পথ চলা, চন্দ্রমল্লিকা আমায় ক্ষমা করো তোমাকে আর ফিরে পাওয়া হলো না ”

” মাই গড নদী, বাবুর্চি! ”

” ভালো ” নদীর আনমনে উত্তর।

” ভালো না, টেনশন; সামনে তাকা গাধী, সত্যিই বাবুর্চি!”

নিশির চাপাকন্ঠে কী যেন ছিল, নদী সামনে তাকালো মুহূর্তে শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। সামনে বেশ কিছু বিদেশি ছবি তুলছে, জাতিসংঘের বড় প্রজেক্টের কর্মকর্তা তারা, ইউ এন ও ম্যাডামের সাথে বেড়াতে এসেছে। তবে তার মাঝেই মিশে থাকা একটা চেনামুখ, বড় বড় চোখে তাকিয়ে আছে নদীর দিকে, দৃষ্টিতে কেমন নি:শ্বাস বন্ধকরা অনুভব।

নদীর অবিশ্বাসকে আরেক কাঠি সন্দেহ ছড়িয়ে দিলো নিশি,
“তুই তো দেখি ভালো ঘটনা ঘটিয়ে এসেছিস, গ্যাব্রিয়েল এইখানে! ডালাসে না ছিল, কীভাবে এলো, কখন এলো, কেমনে কী রে? “‘

(চলবে)
#শারমিন_আঞ্জুম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here