বাতাসে তার সৌরভ পর্ব ২২

0
273

#বাতাসে_তার_সৌরভ–২২

চলতিপথে মেজাজ মর্জির সাথে রাস্তার মসৃণতার একটা সম্পর্ক আছে। মেজাজ রাস্তা দুইয়ে মিলে বিগড়ে থাকলে বিস্ফোরণ অবশ্যাম্ভাবী। এর মাঝে বাড়ন্ত আগুনে ঘি ঢালতেই শাহবাজ মুখ খুললেন,
” মেইয়ের বাড়ি দেইখেসিস শাহিন ! সেইরাম ব্রাট,(বিরাট) কী বলিস? ”

“জি চাচা, সবই ব্রাট,বাপ ব্রাট, মা ব্রাট মেইয়ে তো আরও ব্রাট” শাহিন প্রতুত্তর করলো চিবিয়ে চিবিয়ে ।

তর্কাতর্কিতে গেলে ভাইপোর মাথাগরম হয়ে যেতে পারে, শাহবাজ কথা ঘুরিয়ে বললেন, ” যাই বল তাগের গিফটও কলাম সেইরাম , খাটের ডিজাইন দেইখেসিস যে নকশা,আর কত বড়, এক্কেবারে খেলার মাঠ”

” সাথে মাদুর দেচ্ছে তো, তাগের দেওয়া মাঠে মেয়েই দখল কইরে বসপে, যিরাম ফেইলে ছড়ানো বডি!আমার বারো ঘাটের জল খেইয়ে শেষে জুইটেসে হাতি … ”

” তা তুমি কোনখানকার ফিরেস্তা রে,যেই যন্ত্রণা নে ছুটোয় এইনে এত ভালো বে (বিয়ে) দেচ্ছে, চোরের মা তো বাদ চোরেরই বড় গলা…শাহবাজের মুখে কথাগুলো চলে এলেও দমে গেলেন। এই জিনিসের সাথে ঝামেলা নয়। পাঁচবছর আগের শাহিনের সাথে গলা করা গেলেও উঁচু, লম্বা, মুশকো জোয়ানের সাথে ভেবে কথা বলতে হয়৷ মেয়ের বাড়ি ফিরতি পথে শাহিনের গজগজানি সারা মাইক্রোবাস যাত্রায় কমেনি৷

তবে বাড়ির প্রাঙ্গণে গেটের মুখে একটা ভ্যানগাড়ি ঘটনাটা কিছু পাল্টে দিলো ।
নীলরঙা ইয়ামাহা আর ওয়ান স্পোর্টস বাইক নামানো হচ্ছে ভ্যান থেকে৷ শাহিনের হবু শ্বশুরসাহেব পাঠিয়েছেন, অগ্রীম উপহার।

শাহবাজ উচ্ছসিত হয়ে এগিয়ে এলো,
” কীরাম জিনিস দেইখেসিস?মেয়ের স্বাস্থ্য বড়সড় হলি, মেয়ের বাপেরও মন বড় হতি হয় বুইছিস?

শাহীন এবার কিছু বলল না। উঁচু বড় বেশ জাঁদরেল দর্শন বাহন দেখে সমীহ চলে আসে সহজেই । শাহীনের চাইতে শাহবাজ এই ক্ষেত্রে বেশি উচ্ছাসিত।

” দুনিয়া দাবড়ে বেড়াবি , এরে কয় সম্রাটের বাহন”

শাহীন মুখ কালো করে সম্রাটের বাহন দেখছে। স্পোর্টস বাইকের পেছনের সিটগুলো বেশ উঁচু থাকে আর সামনের দিকে ঢালু হয়। যারা বসে বাধ্য হয়ে পশ্চাদশ উচিয়ে চালকের দিকে ঝুঁকে থাকে। তার পেছনে হস্তিনীকে ঝুঁকে থাকা কল্পনা করতেও কেমন দম আটকে যাচ্ছে। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকে চি চি করে হাসছে বাড়ির সামনের চাপকলটা।

চোখে পড়লো বাড়ির ঠিকে ঝির পাশে মুখ হাত ধুচ্ছে এক দীর্ঘাঙ্গি শ্যামলা তরুণী। মেয়েটাকে শাহিন চিনলো না।চেনার কথাও না এমন ধরনের মেয়েরা সোজাসুজি তার দিকে তাকায় না। এই মেয়েটা সিক্ত মুখে হাসিমুখে সরাসরি তাকিয়ে আছে। বিষয়টি বাস্তব লাগছে না তার থেকে বড় কথা হেঁটে মেয়েটার যত কাছে যাচ্ছে ততই মনে হচ্ছে এই মেয়েটা আসলে প্রিয়াঙ্কা চোপড়া। এই পাড়াগাঁয়ে প্রিয়াঙ্কা চোপড়া আসবে কীভাবে মাথায় ঢুকছে না। অবিশ্বাস্য ভাবে প্রিয়াঙ্কার হাসি আরও প্রসারিত হয়েছে, বলছে,

” শাহিন ভাই! কেমন আছেন? বিয়ের অনেক অভিনন্দন ”

“এ কীডা, নদী? ” পেছন থেকে শাহবাজের বিস্মিত কন্ঠ।

” জি চাচা, ভালো আছেন?”

” আলহামদুলিল্লাহ তু তুমি কিরাম আছ, শুনলাম ঢাকায় পড়তিসো…

নদী হাসলো,” জি চাচা, আমিও শুনলাম আপনাকে নাকি কুকুর কামড়েছিল? সত্যি নাকি?”

” কিসের সত্যি… আজেবাজে কতা! ” শাহবাজ মাথা নাড়িয়ে হুট করে ব্যস্ত হয়ে গেলেন , ” ও শাহিন আমি ভেতরবাড়ি গিলাম, ভাইসাবের খবর দিতি হয়, তোর বাইক এইসেছে।”

শাহিনকে রেখে শাহবাজ দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলেন। নদীর সাথে চোখাচোখি হতেই সাবলীল প্রশ্ন ” ভাবি কেমন? ”

” তার মতোই, তবে তুমি তো আর নদী নেই, একেবারে ঝরনা হয়ে গেছ ”

নদী হেসে ফেলল, “দোয়া করেন শাহিন ভাই যেন বান না চলে আসে।”
*****
সকালের স্নিগ্ধতা কেটে চড়চড়ে দুপুরের উত্তাপ ছড়াচ্ছে। রানুখালার ছেলের বিয়ে উপলক্ষে তুলনামূলক লোক সমাগম কমই। রোদমাখা বাতাসে সবজি বাগাড়ের গন্ধ। পাশ থেকে রানুখালার চিৎকার,
” ও মা**গুলোন ঘটঘটায় যে তেল ঢালসিস বলি তোর বাপের বাড়ির থে নিয়ে এইসেসিস? ”

বড়মামিকে দেখা গেল বিরক্তমুখে বৈঠকঘর থেকে বের হলেন। জোড়া যে স্বর্গ থেকে তৈরি হয়ে আসে এটা বড়মামিকে দেখলেই বোঝা যায়। অবিকল বড়মামার মতো ঠান্ডা গম্ভীর চরিত্রের। চট করে রাগেন না। তবে এই বাড়িতে এলে রানুখালার খেজিবাজ স্বভাব দেখে কারো মাথার ঠিক থাকে না।যার কারনে মামীরাও সহজে আসতে চান না। কিন্তু এবার মনে হয় বড়মামার ঝাড়িতে না এসেও পারেননি।

মামির সাথে কথা বলতে মন চাইছে, কিন্তু নদী ঘরের বাইরের পাকের ঘরে যেতে গিয়েও গেল না। মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। কিন্তু থেকে থেকে বিরক্তিতেও মাথা ধরে আসছে।

সময় বয়ে বদলে যায় প্রকৃতি, নদীনালা, খালবিল সবকিছু কিন্তু কিছু কিছু জায়গা একটা অদ্ভুত স্থবিরতা পেয়ে যায়। একই রকম দমবন্ধকর পরিবেশ, একই চিৎকার কোলাহল, ঘুরপাক খেতে থাকে। রানুখালার বাসাও তার ব্যতিক্রম নয়৷ ঢাকায় জীবনটাকে থিতু করতে যুদ্ধ করতে হয়েছে, কিন্তু ফিরে এসে এখন বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে এই বাড়িতে তার দশবছর কেটেছে। রানুখালা তাকে দেখে খুশি কি দু:খী বলা যাচ্ছে না।

সকালে দেখেই সহজ গলায় বললেন, ‘ এইয়েসিস, ভালো হয়েসে মুখ হাত ধুইয়ে পাকের ঘরে আই দিনি। ”

নদী কথাটার গা করেনি। রানুখালা ভুলে গেছে, শেকল ভাঙার সাহস যে করে তার সাথে সর্দারী চলে না।নদী এখানে যে কাজে এসেছে সেটার লক্ষ্যে কিভাবে পৌঁছানো যায় ভেবে বের করতে হবে।
নদী নিজের ঘরে যেতে যেতে একটা উটকো জৈব গন্ধ পেল নাকে। বামদিকে মুড়েই নাহার বেগমের ঘর, ঢুকতেই বুড়ি আধশোয়া হয়ে নড়ে উঠলেন যেন।সাদা চুল এই কয়দিনে শনের মতো হয়েছে। মুখ যেন আরো কিছুটা ছোট, স্বাস্থ্য ভেঙেছে অনেকটা। নদীর ছায়া দেখেই মিনমিনে একটা কন্ঠস্বর,–

” ও বউ, আমি বইলেসিলাম এই গুলোন নি (নিয়ে) যেইতে তোমার ওই বিটি গুলোন … ”

” দাদি আমি নদী, ভালো আছ?”নদী নাকে ওড়না চেপে কথা বলছে। ভয়ংকর গন্ধ গোটা ঘর জুড়ে।

” কিডা, ওরে নদী তুই!সেই ভেইগে গিয়ে এই এলি মুখপুড়ি?”

” আমি তো মুখপুড়ি, তুমি তো এখনো বানভাসি। বিছানা ভিজিয়ে বন্যা বানাচ্ছ”

নদী এককোনায় দলা করে রাখা কাথা আর তোষকের দিকে তাকিয়ে মুখ বিকৃত করলো।
নাহার বেগম কাঁদকাঁদ গলায় বললেন,

” মা*গিগুলোনরি এত করে কলাম রাতে পানি দিবি নে, আজও দিয়ে গেল…এত কইরে ঘন্টা বাজালাম মরার মতো ঘুমুয়েসে সব। ”

নদী একটা লাঠি যোগাড় করে যাবতীয় কাথা সরিয়ে রাখলো বাথরুমের বালতিতে। তোষক ছড়িয়ে দিলো বারান্দায়। বুড়িকে একপাশে রেখে বিছানার চাদর পালটে দিলো। কাজের মাঝে তাড়া করে ফিরছে ভয় , কিন্তু সেই সাথে মনে পড়ছে শত মাইল দূরথেকে ভেসে আসা একটা আওয়াজ

” মেহরোজ এটা খুবই জরুরি তুমি বুঝতে পারছ না, একটা পাওয়ারফুল গ্রুপ উঠে-পড়ে লেগেছে আমাদের অস্তিত্ব ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য। এই কাগজ আর পেনড্রাইভ যদি ভুল কারো হাতে যায় বা ভুল কেউ পড়ে ফেলে, অনেক বিজনেস সিক্রেট রিভিল হবে। গ্যাব্রিয়েল কিচেন নিয়ে আমাদের স্বপ্ন, প্ল্যানিং সব কিছু শেষ হয়ে যাবে…”

“স্যার কিছু শেষ হবে না, আমি
যেভাবে পারি পেপারস গুলো নিয়ে আসবো, দুই দিনের মধ্যে নিয়ে আসব ”

“প্রমিজ মি মেহরোজ ”

” আই প্রমিজ”

প্রতিজ্ঞা রাখতে নদীর সেই মুহূর্তে মনে হচ্ছিল আগুনেও ঝাঁপ দিতে পারবে। এখন এই চেনাবাড়ির গোলকধাঁধায় নদী ফেঁসে যাচ্ছে। রাগ উঠছে সুবর্ণা আর তৃষার ওপর। ওরা যখন নিজচোখে দেখেছে ব্যাগটা রানুখালা লাগেজের মধ্যে ঢুকিয়েছে তাহলে তখন তাকে বললো না কেন?

আল্লাহতালা মনে হয় সব সময় পরিকল্পনা করতে থাকেন কতরকম নতুন ঝামেলায় তাকে ফেলবেন। চাপারাগ বল্কে উঠে পড়লো বিছানার চাদরের ওপর।নাহার বেগমের বালিশের তলায় একটা বড় চাবির ঝাড়।

” ওইখানেই থাক ওটা, ” রানুখালা ঘরের দরজায় নাকে কাপড় চাপা দিয়ে দাঁড়িয়ে, ” বে বাড়িতে বুড়ির ঘরে কেউ সহজে আসে-যায় না, ওইখানেই রেখে দিয়েছি চাবি। তুই ঘর গুছোয়ে পাকির ঘরে যা দিনি, চৌদ্দ কাজ এমনিতে পইড়ে আছে।উনি এইসেছে বুড়ির সেবা কত্তি।”

-ও বউ আমারি কটা খাতি দেলো না, বেলা গড়ায় গেলো পায়েসের গন্ধ এইসেছে…”নাহার বেগমের চিকন কন্ঠ।

” তা দেবে বৈকি আরও দুই দফা হাগেন মোতেন তারপর খাওয়ার ব্যবস্থা হবেক্ষণ।” রানুখালার রাগের আগুনে ঘি পড়লো আরও ” আমি বাঁচতিসিনে নিজের জ্বালায় বুড়ির আছে শুধু গেলার খায়েশ।”

নদী ঘরটা গুছিয়ে বেরিয়ে এলো, বুড়ির চোখে অসহায় খিদে। পাকের ঘরে কিছু পেলে কারো হাতে পাঠিয়ে দিতে হবে।এই বাড়ির দেয়াল ছাদ জানালায় লেপ্টে থাকা স্মৃতি থেকে থেকে ক্ষোভ তৈরি করলেও অদ্ভুত একটা মায়াও আছে।

পাকের ঘরে রাজ্যের রান্নার আয়োজন৷ সবই যেন নদীর জন্য বসে আছে, রানুখালা ঠিকই করে রেখেছেন নদীর হাতে কী কী বসাবেন। নদীর শরীরে এখনো যাত্রা ক্লান্তি ঘরে গিয়ে একঘন্টা ঘুমিয়ে নিলে হয়তো ভালো লাগতো৷ রানুখালা ব্যস্ত হয়ে সব তরি তারকারি এগিয়ে দিচ্ছে৷

” গলদা চিংড়িগুলোন দেইখেসিস? তোর খালু জ্যান্ত এইনেসিলো ঘের থেকে, এইগুলো কাচা মরিচ দে (দিয়ে) মালাইকারী বসাবি, দেইখেসিস কীরাম বড় বড় …”

নদী উত্তর দিলো না। হ্যাঁ এর থেকে বড় গলদাও সে দেখেছে বলা যায় বিশাল বড় ৷ কি যেন বলে সেটাকে, লবস্টার।

গ্যাব্রিয়েলস কিচেনে প্রতি বৃহস্পতিবার একটা মজার ব্যাপার হয়। কিচেন শেফদের ডিনারে ফুড চ্যালেঞ্জ হয়। হোটেলের মেনু নয়, শেফদের নিজেদের জন্য আলাদা রান্না হবে। দুজন শেফ দুটা আইটেম রেডি করবেন বাকিরা মার্কিং করবে কারটা বেশি সুস্বাদু।

একবার চ্যালেঞ্জ হলো চিংড়ির।সেদিন দেখা গেল কেউ রাজি হয় না। সবার কেমন গড়িমসি। নদী কিছু না বুঝেই হুট করে বলে ফেলল,” আমি নেব চ্যালেঞ্জ আমি খুব ভালো চিংড়ির রান্না জানি৷” সবার ঠোঁটে সে কি চাপা হাসি৷ জিএসও শুনে ঠোঁট টিপে হাসলো, “বেশ তো তোমার যা যা দরকার সালেম ভাইকে বলে দেবে সে ম্যানেজ করবে। আমিও দেখতে চাই কতটা ইনোভেটিভ রাঁধ।”

নদী খুশি কিন্তু বাকিদের ঠোঁটের দুর্বোধ্য হাসির অর্থ বুঝলো না।।এটা পরিস্কার হলো রাতে,যখন খোদ জি এসকে তার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে পেয়ে গেল। আর কী ভয়াবহ তার চ্যালেঞ্জ, প্রায় দেড়হাত লম্বা দুটা লবস্টার তিনি বাটার ক্রিম দিয়ে বেক করবেন৷ কত দ্রুত কেচি চালিয়ে লবস্টারের মাঝ বরাবর তিনি কেটে ফেললেন, এরপর ভেতরের শাঁস নিয়ে আলাদা ভাবে রেডি করলেন। ঘটনা দেখে নদীর চোয়াল ঝুলে পড়লো। লজ্জায় মাথা কাটা যাবার অবস্থা।

“এসব কি হচ্ছে শুনি?” পাকের ঘরের দরজায় নাজিয়া বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে আছেন। নদী বড় মামিকে দেখে সালাম দিলো, বড়মামির রাগ তবুও কমলো না,রানুখালার দিকে ঘুরে বললেন, ” সারারাত বাসে বইসে মেইয়েটা এসেছে, এখনও দুটো ঘন্টা হয়নি তাও তোমার সহ্য হইলো না রানু?এভাবে তারি পাকের ঘরে ঢুকোয় দেলে? তুমি কি মানুষ? ”

” ওমা এসব কী বলস ভাবি , আমি কখন ঢুকালাম ও তো নিজ থেকে জিদ কইরে ঢুইকেসে। মায়ের ঘরে ঢুকেসিল আমি কলাম বেরিয়ে ঘরে গিয়ে… ”

” তা তুমি কি বইলেসো আমারি বুঝাতি এইসো না, দুনিয়ার মানুষ তুমারি আর চিনতে বাকি রাখেঞ্জ। এই নদী, বেরিয়ে আয়। রাজ্যের মেহমান আসপে বাড়ি। চুলোর তাতে মুখ পুড়ানোর কাজ নেই, বেরো৷ ”

রানুখালার মুখ অন্ধকার, ভেতর ভেতর গজগজ। তবে নাজিয়া মামি গুরুত্ব দিলেন না, রানুখালাকে বললেন নদীর জন্য আনা শাড়িটা বের করে দিতে। রানুখালার মনেই পড়ছিলো না কোন শাড়ি। নাজিয়া আরেকটু কড়াভাবে মনে করানোর পর মনে এলো।

রানুখালা আলমারি খুলে খুঁজে বের করলেন, দেখা গেল শাড়ি তিনি হবু তার বউমার শাড়িগুলোর মাঝে তুলে রেখেছিলেন।

” এই নে নদী যা তো মা, একটু সময় নিয়ে গোসলটা সেইরে ফেল গিয়ে।যাত্রা ক্লান্তি একেবারে দূর হয়ে যাবে। রাজ্যের মেহমান আসতিসে ঘরে। ”

রানুখালা এর মাঝে ফুসে উঠলেন, ” আহারে দরদ কত,আমি পাকির ঘরে ঢুকোচ্ছিলাম উনি টেনে এইনে মেহমানদারী করাচ্ছে”

” তোমার থেকে ভালো রানু। নিজের ছেলের বে, কোন খেয়াল আছে?. আপ্যায়নের মতো বাড়িতে মানুষই নেই,” এরপর নদীর দিকে ফিরে বললেন, ” শাড়িটা তোর জন্যি যশোর থেকে আনা দেখ সুন্দর ন? ”

নদী বড়মামির দেয়া গোলাপির ওপর সাদা এপ্লিক্সের শাড়িটা দেখে যথেষ্ট খুশি দেখাতে পারলো না। ততক্ষণে রানুখালার আলমারিতে ওপরের তাকে গুজে রাখা হলুদ ব্যাগ টেনে নামিয়েছে। নিশ্চিতভাবেই এটা গ্যাব্রিয়েলের৷ নদীর প্রশ্ন,

” এই ব্যাগ এইখানে কেন খালা?”

“আমার ব্যাগ এইখানে ছাড়া কোথায় থাকবে? ” রানু ব্যাগটা টেনে নিলেন।

” আপনার ব্যাগ? এটা তো আমার ব্যাগ ”

” শানুর দেয়া ব্যাগ তো, তোরি একটা দিয়েছে আমারি একখান দিয়েছে, এইখান আমার তুই গুলোয় ফেলেসিস ”

নদী হতভম্ব হয়ে খালার দিকে তাকিয়ে রইলো। মানুষ চোখে চোখ রেখে নাকি মিথ্যা বলতে পারে না, আসলে কথাটা মিথ্যা। বোধহয় চোখে চোখ রেখে মানুষ সবচেয়ে বেশি মিথ্যা বলে।তবে খুশির বিষয় ব্যাগটা সরিয়ে বিশেষ ঘাটাঘাটি রানু করেননি কাগজগুলো এখনো বহাল তবিয়তে আছে।মিশন সাতক্ষীরার প্রথম লেভেল পার করা গেছে। নদীদ লক্ষ্য জানা হয়ে গেছে।
*****
চেনা পৃথিবী দূর চলে গিয়ে হঠাৎ করে কাছে এলে সবই অপরিচিত লাগে। নদীরও এইবাড়িতে ধাতস্থ হতে হচ্ছে। পাশের বাড়ির দেয়ালে নক্সকরা গোবরঘুটে, গলি থেকে বাচ্চাদের চিৎকার, বাড়িরকাছেই ঝাঁক বেধে দাঁড়ানো বাশঝাড়, তার ওপারে মোল্লাবাড়ির বিশাল পুকুর, গোটা রাস্তা নিয়ে চলা রাজহাঁসের সর্দারি চাল, কোণার দিকে চাপকলের আওয়াজ; হঠাৎ করে মনে হলো শহরে রানুখালার সর্দার ছিল না তার সাথে ছিল না গ্রামের স্নিগ্ধতা।

দুপুরের দিকে সত্যি সত্যি বাড়িতে বেশ কিছু মেহমান এলো। বড় বড় দুটা গাড়ি ভরা বেশ ভারী কাপড়ে সাজগোছ করা মহিলারা, দেখেই বোঝা যায় সম্ভ্রান্ত ঘরের।ভালো রান্নার সাথে সেন্টের সুবাস মিশে একাকার ঘরের বাতাস । মোজাফফর সাহেবের মুখ প্রসন্ন। স্ত্রী নাজিয়া জানিয়েছে নদী স্নান করে তৈরি৷

– কিছু টের পায়নি তো?

-কিছু না, বইলেছি শাহিনের শ্বশুরবাড়ির লোক এইসেছে। কিন্তু ছেলে কোনটা গো?

মোজাফফর সাহেব ইশারায় দেখিয়ে দিলেন, লাল পাঞ্জাবি পরা বেটেখাটো ছেলেটাকে দেখে একটু নিরাশ হলেও নাজিয়া সামলে নিলেন।

মোজাফফর সাহেব স্ত্রীর মন পড়ে ফেললেন ” পুরুষ মানুষির সৌন্দর্য হইলো তার শিক্ষায়,সামর্থে আর মর্যাদায় বুঝতি পারিসো? দু দুইখান মাছের ঘের, বছরে কোটিটাকার লেনদেন নিজের পায়ে দাঁড়ানো ছেইলে ”

” বিয়ে হলি নদী ঘাড়ের কাছে পইড়ে থাকবে ”

নাজিয়া বিড়বিড় করে বলে বেরিয়ে গেলেন। নদীটার জন্য একটু মায়া লাগলো। বেচারি নিজের স্বামী হিসেবে কেমন বর আশা করেছিল তা জানা হবে না। যদিও নব্বুই ভাগ অল্পবয়সী মেয়েদের স্বপ্নভঙ্গ কাজির সামনে কবুল বলা থেকেই শুরু হয়। আপসোস হচ্ছে তার দুটো ছেলেমেয়ে এখনো কিশোর বয়সে,
যদি শাহীনের বয়সী ছেলে থাকলে মেয়েটাকে নাজিয়াই রেখে দিতেন। ঘরের সব কাজ জানা লক্ষীমন্ত মেয়ে, তার ওপর বংশটাও কত উঁচু ছিল। আহা বাপের ছায়াটা থাকলে আজ রাজরানীর মতোই হয়তো বিয়ে হতো।

নাজিয়া ছোট নিঃশ্বাস গোপন করে নদীর খোঁজে গেলেন। নদীকে পাত্র দেখানোর ব্যাপারটা বুঝতে দেওয়া যাবে না, কিন্তু আজকালকার মেয়েরা পেটের থেকে পেকে আসে। এখন সব কিছু ছকে পড়ে উতরে গেলেই হয়।
নদী দেখা গেল তৈরি হয়ে গেছে৷ একটা কথা স্বীকার করতেই হলো ঢাকার বাতাসে কিছু আছে নদীর চেহারা চাল চলনে কেমন ধারালো ভাব চলে এসেছে।
সাজতে জানলেও তেমন সাজেনি। স্নান করেছে, চুল আঁচড়েছে গুছিয়ে পাট পাট করে শাড়িও পরেছে। তবে নাজিয়ার বিরক্তির কারণ হলো নদী তার বড় মামার মেয়ে বেলাকেও সাজিয়ে বসে আছে৷ কিছু বলাও গেল না। নাজিয়া সাবধানেই একটু উদাসীন থাকলেন। দুইবোনকে মেহমান আপ্যায়নের ট্রে হাতে ধরিয়ে ড্রইংরুমে পাঠিয়ে দিলেন।পাত্রপক্ষকে নদীর স্পষ্ট ছবি দেয়া হয়েছে, তারা চিনে নিলেই হলো।

নদীর বুকে দুরুদুরু ডাক। এর আগেও এমন কুটুম এলে নদীর চেষ্টা থাকতো ফাঁকেচোরে কোনভাবে সেজেগুজে যদি তাদের সামনে পড়া যায়। কেউ যদি তাকে পছন্দ করে নিয়ে যায়; যেভাবেই হোক এই বাড়ী থেকে যদি তার মুক্তি মেলে।

পৃথিবী চিনে আজকে নদী সেই চাহিদা পুরোপুরি উল্টে গেছে।এখন সে জানে বিয়েটাই তার জীবনের মূল লক্ষ্য নয়। তাকে যেতে হবে অনেকটা পথ। জীবনের লক্ষ্য বদলে গেলে হয়তো কারাগারের অর্থটা বদলে যায়।

ড্রইংরুমে বড়দের সতর্ক দৃষ্টি , নদী সাবলীলভাবেই সবাইকে আপ্যায়ন করল, সবাইকে শরবত এগিয়ে দিল । নতুন মেহমানরা সহজেই চিনে নিল তাদের কাঙ্ক্ষিত পাত্রীকে। বেশি একটা প্রশ্নের সম্মুখীন নদীকে হতে হলো না। বড় মামা পরিচয় করিয়ে দেবার পর শুধু একজন মহিলা জানতে চাইলেন আমার ভাইয়ের মেয়ে ইডেনে পড়ে। তুমি তো একই কলেজে?

” জি না আন্টি আমি আলাদা ক্যাম্পাসে আমাদেরটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্ডারে ইডেনের পাশেই ”

“ঢাকায় একা থাকো ভয় লাগে না?”

” মেয়েদের সাথে সাবলেটে থাকি ,
শুরুতে একটু ভয় লাগতো এখন আর লাগে না ”

ব্যাস এতটাই ছিল প্রশ্নোত্তর পর্ব। ছেলে আলাদা কথা বলার চেষ্টা করেছিলো বড়োমামা ইশারায় না করে দিলো৷ পরে অন্য সময় কথা বলানো হবে।এদিকে এত গাদা মেহমানের মাঝে নদীর কেমন যেন বিরক্ত লাগছে, মেহমানরা কেমন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে ছিল। তবে স্বস্তির বিষয় শাহবাজকে কোথাও দেখতে
পেলো না। কিছুক্ষণ পর মেহমানদের দোতালার ছাদে নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানে প্যান্ডেল খাটিয়ে খাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে।

নিচের ঘরে নাহার বুড়িকে খাবার দিতে গিয়ে দুশ্চিন্তা পিছু ছাড়লো না। হাতের কাছে আলমারির চাবি, তবে এত মানুষের মধ্যে ব্যাগটা সরায় কীভাবে?নাহার বুড়ি ভালো খাবার মুখে দিয়ে মাথা দোলাচ্ছে আরামে,

” তোর ঘটনা কীরে, এমন পাখির মতন ছটফট করতিসিস, নাগর মনে ধইরেসে কোন? একা একা সোহাগে বিড়বিড় করিস.. ”

” সোহাগে না টেনশনে দাদি, জিনিস চুরি হয়ে গেছে, উদ্ধার মুশকিল ”

বুড়ি হুট করে ভাত মুখেই নদীর দিকে ফু দিলেন। নদী বিরক্ত হয়ে সরে গেল, ” চটিস ক্যান রে মা**গ মুশকিল আসানের দোয়া পইড়ে দেলাম ”
নদী আশা ছেড়ে দিল। রানু খালার যা ভাব ভঙ্গি তাতে স্বেচ্ছায় তিনি ব্যাগ দেবেন না। হে মাবুদ সাহায্য কর।

সম্ভবত মাবুদের সেই মুহূর্তে মুড সম্ভবত ভালো ছিলো, মেহমান আপ্যায়নের মাঝে রানুখালা হঠাৎ নিচে নেমে এলেন,

” এ নদী শোন, ওপরে মেহমান খাচ্ছে একটু আমার ঘরে গিয়ে বোস চুপচাপ। দুনিয়ার শাড়ি কাপড় বউয়ের গয়না সব আলমারিতে ঠাসা, রাজ্যের মানুষ আসছে যাচ্ছে কোন দিক দে চোর ঢুইকে না গেলেই হইলো, যা যা শিগগির যা”

নদী বিস্ফোরিত চোখে বুড়ির দিকে ফিরে চাইলো। ” দাদী তোমাকে এই মুশকিল আসান দোয়া আবার পড়তে হবে পারবে তো? ”
*******

” তার মানে তুমি বলতে চাচ্ছ যে পেপারসগুলো তোমার সাথে লাগেজে চলে গেছে? ”
” আর কি বলছি ড্যাড একেবারেই খেয়াল ছিল না। আসার তাড়ায় আমিই ভুল ফাইলটা তুষারকে দিয়ে পাঠিয়েছিলাম। রিয়েলি সরি ড্যাড ”

” ইটস ওকে রমি। যাক বাঁচালে, এই কয়দিনে টেনশনে আমার প্রেশার অনেকটা বেড়ে গিয়েছিল ”

” রিল্যাক্স থাকো ড্যাড নিজের খেয়াল রাখো আমি একটা কাজ করি ,এক সপ্তাহ আগেই চলে আসি ”

” না না ইউ ইনজয় ইউর টাইম সান, আমি একেবারে ঠিক আছি অনি কোথায়, তোমার সাথে, কী অবস্থা ওর? ” সোহরাব সামদানী আরও কিছু টুকটাক কথা বলে নিশ্চিন্ত হলেন।

রমি বাবার ফোন ছেড়ে একটা নি:শ্বাস গোপন করলো। জেরিনের সাথে বাবার সম্পর্কটা খটমটে হলেও এটাই রিয়েলিটি। বিষয়টা তিনি নিজ থেকে বলেননি তবে রম্য বোকা নয়। বুঝতে পেরেছিল আগেই। একদিকে ভালোই হয়েছে তিনি ওই দিকে বিজি থাকলে রম্য এই রেস্টুরেন্টের ব্যাপারগুলো সাবধানে হ্যান্ডেল করে নেবে। বাবাকে সব বিষয়ে টেনে আনতে এখন আর ইচ্ছে করে না।তিনি তার জীবন নিজের মতো গোছান রমি তারটা গোছাবে।

যদিও সব সময় তা হয়ে ওঠে না,কিছু সম্পর্ক নতুন ভাবে যাত্রা শুরু কর‍তে চাইলেও মাঝপথে থেমে থাকে।আজ সকালেই একটা বড় মেইল এসেছে রম্য সেটা ওপেন করে মনোযোগ দিয়ে পড়লো,

” ডিয়ারেস্ট রমি,
আমি খুবই দুঃখিত যে তোমার সাথে যাবার আগে ঠিকভাবে বিদায় নিতে পারলাম না। পরিস্থিতিটাই এমন ছিল, আমার আন্টের বাসা থেকে কল এসেছিল, এলেনা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ছে। জার্নি আর সাইট চেঞ্জের কারণে তাঁর ডিহাইড্রেশন হয়েছে। কাজেই আমাকে যেতেই হলো। এখানে জর্জিয়ার বাড়ি এলর্টমেন্ট , ওয়ের হাউজের জব এইসব কিছু এরেঞ্জমেন্টে অনি আর তোমার অসাধারণ আন্তরিকতা ছিল। আমি তোমাকে কিভাবে ধন্যবাদ দেব এই চিন্তা করা ছেড়ে দিয়েছি। মনে যতটা জমা হচ্ছে তা শুধুই ভালোবাসা।

কখনো কখনো এমন হয় যে সময়, মানুষ, জায়গা সবকিছু সঠিক হলেও জীবনের প্রায়োরিটি অন্য কিছু হয়ে যায়।এলেনাকে নিয়ে যখন আমি উদগ্রীব, তুমিও দেখলাম তোমার নতুন প্রজেক্ট নিয়ে একটু চিন্তায় আছ। আমাকে ভুলতে নতুন দেশে যে চ্যালেঞ্জ নিয়ে তুমি এগিয়ে যাচ্ছ তার জন্য শুভকামনা। আমি নিশ্চিত তুমি তোমার লক্ষ্যে অবশ্যই পৌঁছে যাবে, এবং একদিন আমরা এক হবো। ততক্ষণ পর্যন্ত আমি অপেক্ষা করব , এলেনাকেও এখানে সেটেল হতে হবে, কিছু বোঝাপড়া আছে তার বাবার সাথেও। তাই এটাই হয়তো আমাদের জন্য সঠিক সময় ছিল না। সেই সঠিক সময়ের অপেক্ষায় ..
ভালোবাসা
মিশেল।

ফোন থেকে চোখ সরিয়ে রম্য সামনে তাকালো। তার চোখের একটা বিশাল ফ্রেমে খড়খড়ে ডাকাবুকো শহরটা দাঁড়িয়ে। একদিকে যেন সুচালো ভাবে ওপরে উঠে যাচ্ছে কাচের ইমারতগুলো, অন্যদিকে রোদে পোড়া লালচে হাইওয়েগুলোর বিশাল চলমান এক গিট ।

আমেরিকার যতগুলো স্টেট ক্যাপিটাল আছে তার মাঝে টেক্সাসের ক্যাপিটাল ডালাস অন্যতম বিশাল। এই শহরের সব কিছুই খুব বড় এবং জটিল ; তবে ডালাস ডাউনটাউনটাকে কিছু সরলরৈখিক ভাবে বিবেচনা করা যায়। যেখানে চোখে পড়ার মতো একটা স্থাপনা রিইউনিয়ন টাওয়ার।
দূর থেকে দেখে মনে হয় যেন একটা লম্বা লাঠির ওপর বিশাল বল দাঁড়িয়ে আছে। তবে ভেতরে আছে অবজারভেশন টাওয়ার।

গোটা শহরটাকে তিনশো ষাট ডিগ্রি এঙ্গেলে দেখার দারুণ ব্যবস্থা। এছাড়াও রেস্টুরেন্ট বার চমৎকার করে সাজানো। বেশিরভাগ টুরিস্ট এখানে সাধারণত ছবি তুলতে আর গোটা শহরের ভিউ দেখতে আসে, কিন্তু রম্য এখানে আসে শুধু একান্ত কিছু সময় কাটাতে।আর এই বার থেকে থেকেই প্রতিটা জিনিসে নস্টালজিক হয়ে যাচ্ছে। চার জনের তৈরি করা একটা সরল পরিবারের সবাই আজ আক্ষরিকভাবে বিচ্ছিন্ন। হঠাৎ পরিবারের একজনের সংস্পর্শে এলে অনুভবটা অন্যরকম হয়ে যায়।

” গ্রিন কোকোনাটের কোন ব্যবস্থা হলো না?” অনি ভাইয়ের সামনে
মকটেলের গ্লাস রেখে বলল।

রম্যের মুখ অন্ধকার করে গেল, “নাহ!মলে যেগুলো আছে হাওয়াইয়ান ছোট ছোট, ওতে রান্না হবে না”

” এতদিন পর মিশেলের সাথে মেকাউট হয়নি,আর তুই রান্না নিয়ে বসে আছিস তাও কোকোনাট দিয়ে! ” ” অনি সরাসরি তাকিয়ে আছে।

রম্য চকচকে চোখে বলল ” এইবার ঢাকায় দেখেছি, খুবই ইন্টারেস্টিং একটা জিনিস, হিটে কোকোনাটটা ওভেনের মতো কাজ করে। আমি শুরুতে বুঝতেই পারিনি… ”

অর্ণব অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে, রম্যের রাঁধার প্যাশন সম্পর্কে তার অজানা নয় কিন্তু রান্নার কাছে এইবার মিশেলের আকর্ষণ যেন ম্লান। রম্যের চোখে মুখে অন্য একটা মুগ্ধতা,নিজের মতো স্মৃতিতে ডুবে গেছে, মেহরোজ হুট করেই থারস ডে চ্যালেঞ্জ নিয়ে ফেলেছিল।ততক্ষণে বেকড লবস্টার মুখে দিয়ে সবার মাথা ঘুরে গেছে, বাচ্চা মেয়েটাও কৌশল দেখে ভড়কে গিয়েছিল। রম্যের মায়াই লাগছিল।

-কী গো নদী তোমার আইটেম আনো। সালেম ভাইয়ের কথায় মোহরোজ কাচুমাচু মুখ করে ওভেন থেকে একটা বিশাল ডাব বের করলো। পুরোপুরি বেকড মুখটা সিল করা ময়দা দিয়ে। সেই ডাবের মুখের সিলটা খুলতেই কোকোনাট মিল্কের সাথে মেশানো প্রণের কী অসাধারণ সৌরভ। মাস্টার্ড পেস্ট কোকোনাট মিল্ক আর কোকোনাট ওয়াটারের কী অসাধারণ তালমেল। ঝাঁজ, ঝাল কিন্তু ইয়ামি! কী দারুণ অথেনটিক!

” রমি! আর ইউ লিসেনিং? ”
অনির ধমকে রম্যে ফিরলো বাস্তবে। অর্ণবের কথায় গুরুত্বই দেওয়া হয়নি।
” কোন চিন্তায় ঢুবে আছিস ?

“এই মুহূর্তে গ্যাব্রিয়েলস কিচেন এবং তার লিগ্যাল পেপারসে ”

” উদ্ধার হয়নি? ”

” সেরাটাই আশা করছি

” আর আমি আশা করছি তুইও তোর সেরা মেকাউট করে ফেল।। তোর এইসব ভজঘট কেন হচ্ছে জানিস? দীর্ঘদিন কারো সাথে শারীরিক সম্পর্ক না থাকায়। তোর মেন্টাল স্ট্যাবিলিটি এফেক্ট পড়েছে। ঠিক ঠাক ভাবে কিছুই করতে পারছিস না। ”

রম্য বিরক্ত মুখে মকটেলের গ্লাসে মুখ দিল।

” ব্যাক করে ইমিডিয়েট কারো সাথে হুক আপে যা, মাথা ঠান্ডা হবে।

” আমি মিশেলের সাথে সট আউট করব কীভাবে ভাবছি, আর তুই ভ্যাজালের চিন্তা করছিস”

” এক অর্থে মিশেলও তোকে পেয়ে বসেছে। ও জানেই যেখানে যাক তুই গাধার মতো ওর জন্য দাঁড়িয়েই থাকবি। বাট দি আগলি ট্রুথ ইজ তোদের মধ্যে গ্যাপ চলে এসেছে।
মূলত নতুন কারো সাথে ইন্টিমেট হলে তুই পার্থক্য করতে পারবি যে ওটা ইনফেচুয়েশন ছিল না তুই মিশেলকেই চাস। তাই কারো প্রতি ফিজিক্যালি এট্রাক্টেড হলে টেক দ্যা চান্স। ”

রম্য তাকিয়ে আছে, অর্ণবের এমন উদ্ভট কথাবার্তার মধ্যে বৈধ যুক্তি কমই থাকে; তবুও যখন বলে মনে হয় এর থেকে মহান সত্য আর কিছু নেই। ছোটবেলায় জটিল জটিল সব ঝামেলায় দুই ভাই পড়েছে সব কিছু নক্সাকার অর্ণব।
বাবা তার এই পুত্রের নাম দিয়ে ছিলেন পীরবাবা। পাঁচ মিনিটের বড় ভাই থেকে আলাদা একটা সম্মোহনী ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছেন তিনি। যা বলেন সেটা ঝুঁকিপূর্ণ জেনেও বেদবাক্য মনে হয়। এখন
রম্যের মনে হচ্ছে বুদ্ধিটা খারাপ না।ওই ব্রোঞ্জের তৈরি অবয়বের সাথে গাঢ় সান্নিধ্য কেমন হবে জানতে ইচ্ছে হচ্ছে।মুহূর্তেই ঝাড়া দিয়ে উঠে নিজেকে,
ধ্যাৎ কী যা তা ভাবছে…একটা বাচ্চা মেয়ে! একেবারে বাচ্চা মেয়ে! ছিঃ!

তবে ম্যাসেঞ্জারের রিংটোন রম্যের মনের শাসনে একাগ্রতা আনতে দিলো না।
এই কলটাই আকাঙ্ক্ষিত ছিলো বলা যায় লম্বা আয়ু তার।রম্য ভাইয়ের কাছ থেকে উঠে গিয়ে ভিডিও অন করল, একটা স্নিগ্ধ মুখ কিছুটা হতচকিত।

” স্যার আস সালামু আলাইকুম, সরি স্যার আমি আসলে বুঝিনি ভিডিও কলে চলে যাবে ”

” ইটস ওকে, তুমি কেমন আছ মেহরোজ? ”

” ভালো স্যার, আমি মনে হয় পেপারসগুলো পেয়ে গেছি আর পেনড্রাইভও ” মেহরোজের মুখ হাসি হাসি।

” সত্যি? ”

” জি স্যার, এইগুলোই ছিলো ব্যাগে।”

ভিডিও স্ক্রিনে মেহরোজের হাতে কিছু কাগজ দেখা গেল, হাতে পেনড্রাইভটা। মেহরোজ কাগজ উল্টেপাল্টে বলল
” এটা কোন একটা দলীলের মতো স্যার আমি ঠিক… ”

রম্য দ্রুত বলল,” ইটস ওকে মেহরোজ, আমার মনে হচ্ছে এটাই যা আমি খুঁজছিলাম। মেক শিওর যে এই পেপারস কারো হাতে না যায় বা কেউ পড়ে ফেললে.. ”

” কারো হাতে যাবে না স্যার আর কেউ পড়েওনি সম্ভবত ”

” দ্যাটস গ্রেইট, এনিওয়ে তুমি কি কোন পার্টিতে আছ? তোমাকে দেখতে অন্যরকম লাগছে কেন?

নদী একটু অস্বস্তি নিয়ে হাসলো উত্তেজনায় ভুলেই গিয়েছিল সে শাড়ি পরে ভিডিও কলের বাটন চেপে বসে আছে। ” মূলত একটা বিয়ের অনুষ্ঠানে এসেছি তো এইজন্য… ”

” তুমি বিয়ে করছ? মাই গড! ”

” না স্যার”মেহরোজ দ্রুত মাথা নাড়লো,” আমার কাজিনের বিয়ে, এইজন্য শাড়ি পরা.. ”

” ও আই সি, রিচুয়াল! আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। এনি ওয়ে ভালোয় ভালোয় ফিরে এসো টেক কেয়ার , এন্ড ইউ লুক ফ্যাবুলাস ইন শাড়ি, ইনজয় ”

রম্য লাইন কেটে দিলো ফোন হাতে নিয়ে অনেকক্ষণ বসে থাকলো নদী। মানুষটা এভাবে কথা কেন বলে? বুকে ব্যথা করতে থাকে। মাথার মাঝে তালবেতাল গিট লাগে।

” আয়হায় আলমারি লাগানো নেই যে”
হঠাৎ আওয়াজে নদী চমকে মনে হলো দুই হাত ওপরে উঠে গেল। শাহীন ঘরে কখন এসে বড় বড় চোখে তাকিয়ে আছে। নদী দ্রুত ব্যাগটা গুছিয়ে উঠে দাঁড়ালো।

“আম্মার কাজ, বিয়ের ছোটাছুটিতে আলমারি লাগায়নি” শাহীন এগিয়ে বিছানায় রাখা চাবি দিয়ে আলমারির দরজা লাগিয়ে দিলো৷ নদীর মনে হলো ঘাম দিয়ে জ্বর ছুটলো। শাহীন আলমারি দোর লাগিয়ে সহজ ভাবে হাসলো।
” বিয়ের মধ্যিই আসতে হইল নদী, তোমার সাথি তো গল্পই হইলো না। হুট কইরে কিরাম বড় হইয়ে গেছ। শেষবার দেখেছি ফ্রক পরা ”

” আপনিও ভালো হয়ে গেছেন মানে বড় হয়ে গেছে শাহীন ভাই.. এখন তো ভাবিও আসছে বাড়ি গল্প করা মানুষ পেয়ে গেলেন”

শাহীন লাজুক হাসলো। নদীর মনে হলো শাহীনভাইয়ের মাথা গরম সমস্যাটা সম্ভবত অনেকটাই কমে গেছে। এমনই রাগারাগির জেরে এক বৃদ্ধকে লাঠি নিয়ে দৌড়েছিলো কলেজে পড়ার সময়। বৃদ্ধের স্ট্রোক করে মারা গেলে পরিবার মামলা ঠুকে দিলো। সেই থেকে শাহীন দীর্ঘদিন ভারতে চিকিৎসাধীন থেকে অনেকটাই ভালো৷ এর মাঝে কেসকাচারির ঝামেলা কাটানো হয়েছে। এখন সময় মতো ভালো ঘরে বিয়েও হচ্ছে। শাহীনের বাবা শাজাহান খালু আর শাহবাজের মতো ধুরন্ধরদের পক্ষেই এগুলো সামলানো সম্ভব।

শাহীন মনে হয় টুকটাক গল্প করার মুডে ছিল কিন্তু নদীর ব্যাগ নিয়ে দ্রুতই সরে পড়তে হবে। তবে ঘরের বাইরে অন্য সোরগোল শোনা গেল। বড় মামা আর মামির কন্ঠ কানে যাচ্ছে, ” বিয়ে মুখে এমন বিপদ এলো!

এর মাঝে বড় মামার মেয়ে বেলা ঘরে ঢুকলো মুখ কালো করে,” বাবার সদরের চালের আড়তি আগুন ধইরেসে! ম্যানেজারের হাত নাকি পুইড়েছে৷ বাবা যাচ্ছে সেখানে বিয়ে পেছালো গো নদীপু, ”
“বলিস কী! ”

“তার মানে আমার বিয়ে হচ্ছে না?”
শাহীন উত্তেজিত গলায় বলল।

” ওমা তোমার বিয়ে হবে না কেন, নদীপুর বিয়েটা আর হচ্ছে না। তারা আজকে এসেছিল তো নদীপুরে দেখতি। খুব পছন্দ কইরেছে কিন্তু এখন আব্বা চলে গেল, বিয়েও পেছালো ”

নদীর মাথায় ভেতর সব জট পাকিয়ে যাচ্ছে। বেলা কী বলছে তা কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। শুধু মনে হচ্ছে সে যেন কঠিন কোন জালে জড়িয়ে যাচ্ছে।
******
সন্ধ্যাবেলা
নাজিয়া বেশ লম্বা সময় ভাষণ দিয়ে নদীর ঘর থেকে বের হলো। নদীর ঘর বলতে যে ঘরে একসময় সে আর নিশি থাকতো। মেজমাম, রানুখালা, বড় মামি সবাই পালা করে ঘরে ঢুকছে এবং বেশ কড়া গলায় নদীকে কিছু কথা বলছে।

” দেখ নদী, তোমারি বাস্তব বুঝতি হবে। তোমার নেই ঘরদোর বাপ মা৷ একটা কোন ভুল কান্ডে মাসুল তোমারিই দিতি হবে। তোমার বড় মামা যা বলছেন ভুল বলছেন না”

” মেয়েগের ছাড়া গরুর মতো ছেড়ে দিলি কী অবস্থা হয় তা যদি নিশিরে দেইখে না বোঝো, তখন আমাদেরও কঠোর হতি হবে ”

” আর পড়াশোনা কইরে হবে কী বল, যাতি তো হবে সেই স্বামীর বাড়িই। পইড়ে উল্টে দেলে দেখা গেল আর স্বামীই পেইলে না। পইড়ে থেকো মানুষের গলার কাটা হয়ে ”

“আমরা যা করছি একেবারে ঠিক করছি কোন ঝামেলা করবে না। যথেষ্ট ভালো ছেলে বুঝিছাও? এমন ময়লা রঙ তবুও তারা পছন্দ করিসে তোমারি, তোমার বড়মামা আজকালের মধ্যে ফিরলে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলাবে৷ তুমি কোন ঝামেলা করবে না। ”

নদী শুরু শুরুতে একটা দুটো প্রশ্ন করে এখন চুপ করে গেছে।ঘোর বিপদে মাথা ঠান্ডা রাখতে চেয়েও পারছে না। কেমন দমবন্ধ লাগছে। হয়ত এটাই নিয়তি ছিলো দুইচোখ শুধু শুধু একটা অবাস্তব স্বপ্ন দেখার অন্যায় করে ফেলেছিলো। কল্পনার বুদবুদ ফেটে মাটিতে আছাড় খেয়ে উচিত শাস্তি হয়েছে। হতাশা, দুঃখ, ক্ষোভে চোখ ফেটে পানি আসছে। কেউ কি সাহায্য করার নেই? সবাই ঘর ছাড়লে নদী সাবধানে কল দিলো নিশি আর শানুখালাকে দুজনের কেউই ধরে না।

” নদীপু! ” ঘরে বেলা ঢুকেছে দেখে চমকে উঠলো ” এই বিয়ে করতে চাও না? ”

” আমার চাওয়া না চাওয়া একই, কিছু আসা যায়? ”

” ঠিকভাবে বল শাহিন ভাই জানতে চাইছে উনি তোমাকে সাহায্য কর‍তে চায় উনি বলছে যদি বিয়ে না করতে চাও তাহলেও উনি এই বিয়ে হতে দিবে না ”

নদী কথাটা ঠিক বিশ্বাস করতে পারেনি, কিন্তু কিছুক্ষন পর ঘরের বাইরে দরজায় শাহিনের উপস্থিতি দেখে বিশ্বাস হলো।

“তোমার পছন্দ না তাহলে এই বিয়ে হবে না নদী। আই গ্যারান্টি! ”

” পাগলের আবার গ্যারান্টি কী? “গভীর রাতের ফোনে নিশি যেন চটে গেল। ” আমি যখন বলেছিলাম আমার সাথে সাতক্ষীরা চল তুই রাজি হস নাই। এখন একা গিয়ে নাকানি-চুবানি খা। আমি থাকলে এত সাহস করে উঠতে পারতো না।”

নদী ততক্ষণে অস্থির ” মাতব্বরি না দেখিয়ে একটা সমাধান দে এরা আমাকে নজরবন্দী করে রেখেছে ”

” আপাতত তুই সাইলেন্স মুডে চলে যা। ওই পাগলের ভরসা করে লাভ নেই। যা করতে হবে তোকেই করতে হবে, সকাল বেলা ফজরের পর পর কারো অপেক্ষা না করে সোজা বাস-স্টেশন দৌড় দিবি।আমার অপেক্ষাও করা লাগবে না। আমি আসতে আসতে দেরি হবে ততক্ষনে তোর সর্বনাশ হয়ে যাবে। আপাতত ঠাণ্ডামাথায় ঘুম দে। বড় মামার আসতে আসতে দুই দিন এই দুই দিনের মধ্যে আম্মু মামাকে ফোন করে বুঝিয়ে ফেলবে। এদিকে তুই রিস্ক নিস না। সবাইকে দেখাতে আজকে রাতে আরাম করে ঘুমা।”

নিশির কথা আক্ষরিকভাবে সব মেনে না নিলেও ঘুমানোর চেষ্টা সে করেছিল। ছেঁড়া ছেঁড়া ঘুমে বাকি রাত পার হয়েছে।ঘুমের লেই পাতলা হয়ে গেল; ঘড়ির এলার্মের প্রথম শব্দ কানে যেতেই উঠে গেল নদী৷ ফজরের আজান পড়ে গেছে। দ্রুত আড়মোড়া ভেঙে কাপড় পালটে নিলো। এমন নয় যে পালানোর অভিজ্ঞতা তার আজকে প্রথম । তবে আজ সাহস করতে হবে বিশাল একটা সেনাবহরের বিরুদ্ধে । দ্রুত ব্যাগ গুছিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেল । কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, দরজা খুললো না।
নদী নব ঘোরানোর চেষ্টা করল কোন লাভ হল না। সে বুঝতেই পারছে না ।বড়রা তাকে আটকে রেখেছে? এটা কি কাল রাতের বাক বিতন্ডার ফল?

এটা কিসের ফল সেটা জানতে আমরা চলুন ঘরের বাইরের দিকে নজর দেই, এই মুহূর্তে শাহীন বসে আছে মায়ের ঘরে, মা আর মামিদের সামনে।

“একটা কিলিয়ার কাট কথা শুইনে রাখো, আমি ওই ভিম-ভবানীরে বিয়ে করব না। নদীরে বিয়ে করব, ফাইনাল ডিসিশন, রাজি হলি বল নয়তো ছেলের জানাজার জন্যি প্রস্তুত হয়ে যাও ”

রানু তাকিয়ে আছেন আতঙ্ক নিয়ে। শাহীন মাথার কাছে একটা কালো ছোট মতো পিস্তল ধরে আছে। এই জিনিস কিভাবে কোথা থেকে ছেলের হাতে আসলো রানু জানেন না, শুধু জানেন ছেলের চন্ডাল রাগ আর পাগলামি।

” বিয়ে দিবা তো ”

” হ্যাঁ দেব বাবা, নিশ্চয়ই দেব ”

(চলবে)
#শারমিন_আঞ্জুম।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here