বাতাসে তার সৌরভ পর্ব ৫

0
427

#বাতাসে_তার_সৌরভ–৫
প্লট নাম্বার ৫০
রোড সিক্স এ
ধানমন্ডি ঢাকা-১২০৫
(সময়কাল–২০১৮)
ফাতেমার আজ ফ্লোর ক্লিন করতে বেশ দেরি হলো।রাত দশটার মধ্যে হোটেলে বুফেট বন্ধ হয়ে যায়। আজ কয়েকটি পার্টি থাকায় বারোটার আগে হাল্কাই হচ্ছিলো না। ছুটির দিনে এই ফ্লোরে ঝড় বয়ে যায় সারাদিনের ছোটাছুটিতে একটু জিরানোর জো নেই। অথচ তার কাল সকালের গাড়ি, ছয়টায় উঠতেই হবে। হাতের কাজ সারবে, বাথরুমে গরম শাওয়ার নিয়ে ঘুমাবে কিন্তু আজ ফ্লোর প্রচন্ড ময়লা। পরিস্কার করছে আর ক্লিনার জসিম মিয়ার পিণ্ডি চটকে যাচ্ছে।সন্ধ্যার মধ্যে ডিউটি জয়েন কথা। আজও এলো না। দুই দিন ধরে দেশে, বউ না যেন তারই বাচ্চা ডেলিভারি হয়েছে।

-কীরে ফাতু,তুমি এগুলো করতেস কেন?
জসিম আজও আসে নাই?

সালেম ভাইয়ের কথায় উত্তর দিলো না ফাতেমা।মেজাজ চরম খারাপ। সালেম ভাই মনে মনে হাসলেন,টেবিল গুছিয়ে চিলে গেলেই হয়।ভোর সকালের দায়িত্ব কাসেমের। ফাতেমা নিজে করছে, সবই ম্যানেজার জেরিনের সুনজর পড়ার ধান্ধা।
ঢাকার মাটিতে হলেও এই রেস্টুরেন্টের ম্যানেজমেন্ট অনেকটাই বিলিতি আদলে চলে। ঘন্টাভিত্তিক বেতন।কাজ ঠিক মতো হলো কিনা তার শক্ত মনিটরিং আলাদা। ফাতেমা আসার পর উপার্জনের তাড়াও বেশি দেখা যাচ্ছে। তবে তার কাজের যত্ন সালেমের একটু মায়া হলো। হাজার হলেও আই এ পাস শিক্ষিত মেয়ে। সালেম মমতা নিয়ে বলল

-খাও তো নাই, সেই কখন খাবার বেড়ে রেখেছি তোমার।

– ধন্যবাদ সালেম ভাই, হয়েই গেছে। কটা বাজে? বারোটা?

– ত্রিশ মিনিট যোগ কর। সাড়ে বারো।

– বলেন কী! নাহ আর দেরি করা যাবে না।

– আমিও তাই বলছি খেয়ে নাও নয়তো সকালে উঠতে পারবে না। অনিয়ম করে ঘুমালে পরের দিনটাও শুরু হয় অনিয়মে। তুমি খেয়ে নাও, আমাকে কিচেনও ক্লোজ করতে হবে।

– আমি করে নেব আপনি যান সালেম ভাই। আপনাকেও টায়ার্ড লাগছে।

ফাতেমা তাড়াতাড়ি সব গবলেট গুলো সাজিয়ে হাত ধুয়ে কিচেনে গেল। সালেম ভাই বাকি কাজ জোর করে নিয়ে নিলো নিজের কাঁধে। তার কিচেন নিজ হাতে বন্ধ করার অভ্যাস। ফাতেমাকে খেয়ে নিতে বলল।-আমি এই ফ্লোরে আছি।তুমি বেশি দেরি কইরো না খেয়ে নাও জানো তো, গভীররাতে বাড়িটায় হুটহাট দোষ হয়। দারোয়ানরা মাঝেমধ্যে একটা বাচ্চা ছেলে আর মেয়েকে বাগানে হাঁটতে দেখে।

ফাতেমা হাসলো -হ্যাঁ সাদা শাড়ি পরা পেত্নী বাদ দিলেন কেন? সব মানুষের বানোয়াট কথা। গ্যাব্রিয়েল স্যার বললেন না,এত সুন্দর রেস্টুরেন্ট জমে গেলে অনেকেরই সমস্যা. ।

– তা তো অবশ্যই কিন্তু ঝামেলা আছে।রাত গভীর হলে আমারই ভয় লাগে। কিচেনের অন্যপাশটায় পুরাই নিস্তব্ধ হয়ে যায়। যাহোক তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ কর। রাত হইতেসে।

– আমাকে কিছু করবে না,ভূতের রুচি এত খারাপ না ফাতেমা হেসে কিচেনের দিকে গেল।

ষাট দশকের ইমারতকে ভেঙে আধুনিক ইন্টেরিয়রের পোশাক পরানো হয়েছে।পুরনো ধাঁচের বাড়ির কিচেনগুলো বড়ই হতো, এখন সেটা ভেঙে আরও বড় আর আধুনিক করা হয়েছে। একেক জায়গায় একটা রান্নার বিশাল বিশাল চুল্লি।আধুনিক তান্দুর, বেকারি ওভেন।
একপাশে সার্ভিং কাউন্টার টেবিলে যত্ন নিয়েই খাবার সাজিয়ে রাখা। পুদিনার একটা সবুজ ড্রিংক যেটা ফাতেমার খুব পছন্দ সেটাও দেখলো। সালেম ভাই আসলে সবারই পছন্দের খেয়াল রাখেন।

ফাতেমা তৃপ্তি নিয়ে চুমুক দিলো গ্লাসে
মাখনে ভাজা ফিশ ফিলেট জমে গেছে, মাইক্রোওয়েবে দিতে দিতে ফাতমার কানে কেমন চিকচিক শব্দ গেল ।যেন
পেছন থেকে কেউ যেন ঠোঁট দিয়ে আওয়াজ করছে। শরবত খেতে খেতে শুরুর দিকে ফাতেমা তেমন আমল করলো না।ওয়েরহাউজ ছেড়ে রেস্টুরেন্টের কাজে যোগ দিয়েছে প্রায় চারমাস। ফ্লোর ম্যানেজমেন্টের কাজটা ভালোই রপ্ত করে ফেলেছে। বেতনের তুলনায় কাজের চাপ বেশি হলেও কিছু ছাড় তো দিতেই হবে। চাকরির সাথে থাকার ব্যবস্থা কজনের ভাগ্যে থাকে? খরচ তুলে মাকেও কিছু বিকাশ করতে পারে। ফাতেমা মনে-মনে তাড়া অনুভব করলো। আজ স্যালারি চেক ক্যাশ করেছে। টাকা তার ক্যাবিনেটে তোলা ।রুমমেট নতুন ফ্লোরটেন্ডার মেয়েটা কেমন কে জানে। ফাতেমা খাওয়ার গতি বাড়ালো।
হঠাৎ মাছের টুকরো খেতে খেতে আবারও কানে চিকচিক আওয়াজ। কেউ যেন খুব কাছ থেকে ঠোঁট দিয়ে শব্দ করে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছে। ফাতেমা কানখাড়া করে রইলো। একটা সুক্ষ্ম অনুভূতি হচ্ছে কেউ খুব কাছাকাছি আছে। বাইরের ওয়াচম্যান শরিফ নাকি? এই লোকটাকে বেশ ফাজিল লাগে ফাতেমা। নিজের অবস্থান ভুলে সরাসরি তাকিয়ে থাকে।স্পষ্ট ছোকছোক স্বভাব।

সম্ভবত কিচেনের জানালা দিয়ে উঁকি দিচ্ছে। কিছু হলে সালেম ভাই তো আছেই ফাতেমা রাগের বশে একটা ছুরি নিয়ে গটগট করে এগিয়ে গেল। জানালায় ওপাশে কেউ নেই। কিচেনের ওপাশে এই দিকটা বাড়ির ব্যাকইয়ার্ড।ছায়া দেয়া বড় বড় গাছ সেখানে। জায়গায় জায়গায় ফোকাস লাইট দিয়ে আলোকিত করা হয়েছে। কিন্তু আজ যেন সেটায় ছায়ার গাঢ়ত্ব অনেক বেশি। ফাতেমার মনে হলো ঘন ঝোঁপের মাঝে কিছু যেন নড়ন চড়ন.. ইঁদুর? হবার কথা না।ছোট রেস্টুরেন্ট হলেও ফাইভস্টার মানের মেইনটেইনেন্স। জায়গায় জায়গায় ইঁদুর মারার ফাঁদ পাতা।কয়েক দিনপর পর লোক এনে পরিস্কার হয় তাহলে বিড়াল কি? চিকচিক আওয়াজ কে করছে? একটা ছয়-সাত বছরের বাচ্চাছেলে!ফাতেমা যেন একটা আবছায়া দেখলো। পাতাবাহারের ঝোপ থেকে বাধাই করা কাঠ গোলাপ গাছের আড়ালে চলে গেল।এত রাতে কী করছে ছেলেটা? কীভাবে এলো? ফাতেমা কি যাবে, না সালেম ভাইকে ডাকবে।

ভাইয়ের কথা মনে পড়লো
” এই বাড়িটাতে দোষ আছে, খুন হয়েছিল, মা দুই বাচ্চা এক ধাক্কায় সব শেষ ”

বাগানের দিকে মুখ ফেরানো ফাতেমা ষষ্ঠ স্নায়ু হঠাৎ জাগ্রত হয়ে গেলো। মুহূর্তে ঘুরে তাকাতেই পা দুটো যেন জমে গেল।কিচেনে তার দুই হাত দূরে একজন নারী দাঁড়িয়ে, লম্বাটে গড়ন ধুসর সাদা শাড়ি, মুখটা লম্বা ঘনচুলের আড়ালে। তবুও তার তীব্র দৃষ্টি সেই আড়াল ভেদ করে যেন বুক চিড়ে দেবার ক্ষমতা রাখে।ফাতেমার বাকরুদ্ধতা সামলে নিতে নিতে যেন প্রচন্ড শব্দে প্রকম্পিত হলো ঘরের বাতাস,

“চলে যাও তোমরা! ”

*******

একইদিনে
ভাদড়া সাতক্ষীরা

সারাদিনে উদ্ভট কতো রকম নাটক হলো সেটা নদীর ধারণা রাখলো না।রানুখালা আর খালুর ছেলেপক্ষের সাথে এবার বেশ বাকবিতন্ডায় জড়াতে হলো। ছেলের মা বিশাল অপমানিত হয়েছেন বলে ভালোই চিৎকার করলেন। হায়দার খালুও কাচুমাচু করছেন, নিচে শাহবাজ অবশেষে কী বলে কাজোদ্ধার করেছেন কে জানে, তবে তারা বিদায় হলেন। মেহমান বিদায় হবার পর নাহার বেগম শুরু করলেন চিৎকার–

– দুনিয়ার সব বারো ভাতা*** মাগ***ী গের নিয়ে এইসে জোটাচ্ছ। ঘরে বইসে ভাল্লাগছেল না বেরিয়েছে ধান্দায়।মুখি চুনকালি পইড়েসে এইবার?এখন তা মেইখে সং সেইজে বিড়াও। এ তোমাগের কুলেই সমস্যা।

রানুর মাথায় চট করে আগুন লেগে গেল – তা আপনাগের কুলের কি সমস্যা বউয়ির বাড়িরটা বইসে খাওয়া?আপনার অকম্মা ছাওয়াল ব্যবসা করতিসে কি আমার সতীনির ঘর থেকে এইনে? এ বাড়ির খরচ আসতিসে কোত্থে খবর রাখেন?”

রানু সারাদিন অপদস্ত হলেও শাশুড়ীর কন্ঠ বরদাস্ত করলেন না,তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন, ” এই নবাবির মতোন চপর চপর খাওয়া-দাওয়া, ওষুধ পত্তর গেলা ছাড়া কাম আছে আপনার? তা এসব আসে কোত্থে ? নিশির মা না পাঠালি চলতি পারতেন? আজ ফাঁকে সুযোগ পেইয়ে জবান বেইড়েসে।সারাদিন তো ল্যাড়া মেইরে গেলেন,আর পইড়ে পইড়ে হা*গেন,
সেটা পরিস্কারটাও তো আমার বোনঝি কইরে দেয়। আমাগের মেইয়েরা ধান্দা করলি পরে, এসব করতি বন্ধ কইরে দেই? সপ্তাহ যাবে, গু-মুতির মধ্যি পইড়ে থাকপেন নানে”

নদী চিলেকোঠার একাকী ঘরে বসে বসে রানুখালার চিৎকার শুনে যাচ্ছে। এই নাটকের মধ্যে ঢুকতে ইচ্ছে হচ্ছে না।আজ ঘরেরবাইরে পাহারা ছিলো, নদীকেও নিশির কাছাকাছি যেতে দেওয়া হয়নি ; যদি সাহায্য করে বসে? এরপরেও নিশিটা মূলত কোন গায়েবি ক্ষমতায় ছাদ থেকে নামলো মাথায় ঢুকছে না। তবে কেন যেন ওর জন্য নদীর ভালো লাগছে৷ ওর জীবনটা আসলে ও বিগড়ে ফেলছে না শুধরে নিচ্ছে ওই ভালো জানে। তবে চার দেয়াল মানুষকে নিরাপত্তা দেয় এই ভুলটা সে ভেঙে ফেলছে। নিরাপত্তাই যদি দিতো তাহলে সেই চার দেয়ালের মাঝে থেকেই ধানমন্ডির সুরক্ষিত বাড়িতে নিশির মা আর ছয় বছরের ভাইটা মারা যেতো না। তাদের ছোট্টকাল থেকে কোলে পিঠে মানুষ করা রাহেলা বু পাকেরঘরের শিল পাঠা দিয়ে বাবলুর মাথাটা…!কিছুক্ষণ আগেও সে নদীর সাথে বাগানে খেলছিল।

নদী গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বসলো৷ মাথা বনবন করে কেন যেন ঘোরে।এসব মনে করতে চায় না সে। বাথরুম থেকে জোরে জোরে পানির ঝাপটা দিয়ে অন্যকিছু ভাবতে চায়, কোন সুখস্মৃতি । নিশি যেমন তার বাবা মায়ের কুৎসিত ঝগড়া ভোলার জন্য ভাবে,
” প্রথম ক্রাশের সাথে কিসিং এক্সপেরিয়েন্স কী ফাটাফাটি জানিস? তুই জানবি ক্যামনে। তুই হচ্ছিস ভেজিটেবল ! ”

” আর তুই মনে হয় তান্দুরি চিকেন? ”

” আফকর্স! আমি না আমার ক্র‍্যাশ, আই ওয়াজ কাইন্ডা ইট হিম আপ। ইউ নো হাউ ইট ফিলস? “”

নদী ফিল করতে চায় তবে সবটা শুনতে পারে না কান গরম হয়ে গেলে নিশির মুখ চেপে ধরে। বড় লজ্জা লাগে।আবার হিংসাও। নিশি ভয়ংকর একটা অনিশ্চিত জীবনে কতটা সাহসের সাথে বিচরণ করছে। আর ঢাকা থেকে আসার পর জয় করার মতো দিন নদীর শেষ কবে এসেছিল মনে করতে পারে না। ক্লাসে যখন স্যার বোর্ডে অংক করতে দিতেন, সেটা শেষ করে নদী চিন্তা করতো বাড়ি গিয়ে খালামনি বাঁসিভাত খেতে দেবে কি না। নতুন রেজাল্ট এলে স্যারের কাছে না পড়েও শতকরা সত্তুর পারসেন্ট আসতো।সবার দৃষ্টি উপেক্ষা করে নদীর চিন্তা হতো নতুন ক্লাসে ভর্তির জন্য রানুখালার মুড বিগড়ে যায় কিনা। জয়ের মধ্যে তৃপ্তি থাকে আনন্দ থাকে। নদীর এসব ধাপে কোন জয়ের অনুভূতি নেই।
তবে হাইয়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষার চার মাস আগে একটা ঘটনা তাকে তৃপ্তি দেয়। সেই দুই তিনদিনের ওই ঢাকা সফরটাই একটু অদ্ভুত ছিলো। আমেরিকা ফেরার আগে হুট করেই শানু খালা নদীকে ঢাকায় আনলেন।

” তোর বাবা আমাকে আমেরিকা যাবার সময় কিছু সাহায্য করেছিল। টাকাটা শোধ হয়নি। ন্যাশনাল আইডি যখন হয়েই গেছে চল তোকে একাউন্ট খুলে দেই।।
সামান্য কিছু টাকা মাসে মাসে জমা হবে।পরে দেখিবি অনেক হবে।

নিশির মা শানুখালা আরো অনেক কথাই বলেছিলেন। নদীর এতো মনেও নেই।অনেক দিন পর ঢাকায় এসে তার বুক ধুকপুক করছিলো অন্য কারণে। চেনা শহরে যেন অচেনা লেবাস জড়ানো। এই শহর শেষ দেখেছিল ২০১০এ।এখন ২০১৮ এই আট বছর আগে ঢাকায় কি এত ফ্লাইওভারে ঠাসাঠাসি ছিল? নিশির ঠিক মনে পড়ে না। মানুষগুলোও মুখে কেমন ধাতব ভাবলেশহীনতা। মন কেমন বিষন্ন করে দেয়। এত কিছুর মধ্যেও মন ছুটে যাচ্ছিলো রবিন্দ্র সরোবরের দিকে। নদীদের বাড়ির একেবারে কাছে। বাম দিকের একটা বাঁক নিলেই চন্দ্রমল্লিকা। ভোর বেলা বাবার সাথে হাঁটতে হাঁটতে চলে আসতো লেকের ধারে। মুক্ত মঞ্চে বাবলুর ছোটাছুটি…। তবে নিশির জন্য সেখানে যাওয়ায় বাধা।

“আরে চোর-চোট্টা গাঞ্জুইট্টা পড়ে থাকে এখন ।কত রিস্কি জায়গা জানিস। আরও ইন্টারেস্টিং জায়গায় যাই চল।প্যান প্যাসিফিক হোটেলে ফুড ফেস্টিভ্যাল হচ্ছে। আমার ভার্সিটির ফ্রেন্ডরা আছে। তোর তো পাকা হাত। একটু হেল্প করলি। ফিরতি পথে ঘুরিয়ে আনবো তোকে রবিন্দ্র সরোবর ”

নিশির কথায় অনিচ্ছা নিয়ে যেতে হয়েছিল। একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে টেক্সটাইল ডিজাইনিং দুই বছর পড়ে ছেড়ে দিয়েছিল নিশি। দেখা গেল পুরনো বন্ধুদের সাথে এখনও বেশ খাতির। আসলে সাথে ডলার থাকলে বন্ধু আন্দামানে গেলেও মনে হয় যোগাযোগ থাকে। হোটেলে ফুড ফেস্টিভ্যালে সাথে প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা। বড় মশলা কোম্পানি এর স্পনসর। জিতলে কক্সবাজার ফাইভ স্টারে তিনদিনের ট্যুরের লোভনীয় প্যাকেজ। আজ লাইভ অথেনটিক স্ন্যাকস রেডি করতে হবে।নির্দিষ্ট কিছু আইটেম তারা দিয়ে দিয়েছে সেগুলো সব ব্যবহার করতে হবে। এদিকে নিশিদের স্টলের রাধুনিই আসেনি।কোথায় নাকি এক্সিডেন্ট করেছে৷ চারিদিকে এলোমেলো রান্নারা সরঞ্জাম ছড়িয়ে আছে।

” বেইজ্জতি কারে বলে দেখ দোস্ত।মনে হচ্ছে ওয়াকাউট করি। চটপটি বানাবো ছাতার ডালও আনা হয় নাই ময়দা ডিম আলু দিয়ে কী করব? ”

” আলু আছে ডিম আছে চপ বানালেই তো হয়!”

কোন কুক্ষণে নদীর মুখে কথাটা চলে এসেছিলো। নিশি স্বর্গে ঢেকি পেয়ে গেল।

” রবিন্দ্র সরোবরই না তোর বাড়িতেও নেব। তোর চপ হয় ফাটাফাটি, একটু দেখিয়ে দে নদু৷

নদী দেখালো। রান্নাঘরে ছুরিবঠি চালানো আগে কখনো মহান কোন কাজ মনে হয়নি, তবে সেদিন মনে হলো।
নিশির বন্ধুরা হা করে নদীর কাজ দেখছিলো। তাদের সাথে এসে জুড়ে গেলেন জুরিবোর্ড৷ তাদের মধ্যে কিছু বড় হোটেলের শেফ , সাথে বেশ কিছু বিদেশি সম্ভবত ফুড ব্লগার । এক একটা আইটেম হাত দিয়ে নেড়েচেড়ে দেখছে। ভেঙে একজন একটু মুখে দিলো। একজন বিদেশি বাবু তো মুখও বিগড়ে ফেলল৷

” বাদ দে,তুই তো অন্তত ইজ্জত বাঁচিয়েছিস তাই যথেষ্ট। ফিরতি পথে স্টার কাবাবে নিয়ে যাবো তোকে”

” নিশি তুই বলসিলি আমাদের বাসায় নিবি”

“ও আজ হবে না। আরে আম্মা ফোন করেছিল, ওই বাসায় অনেক গ্যাঞ্জাম! তুই পুরনো মালিকের মেয়ে, তুই গেলে ঝামেলা হয়ে যাবে বলল ”

” এক্সকিউজ মি,”

নতুন আগন্তুকের কন্ঠে ঘুরে তাকিয়ে ছিল দুজন।

টকটকে ফর্সা লম্বা যুবকটা আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে।নিশি এগিয়ে গেল “এই পটেটো কাটলেটের সাথের একটা সস ছিলো, ওটাও কি এইখানেরই বানানো ”

” হ্যাঁ টেমারিন্ড সস এখানেই বানানো ”

” আমি কি কুকের সাথে কথা বলছি? ”

” না তার বোনের সাথে কথা বলছ, আমার ছোটবোন কুক ওই যে”

নদী তখন ঝড়ের গতিতে পেয়াজ কুচি করছে৷ নতুন টাস্ক এসেছে চল্লিশ মিনিটে তিহারি রান্না। শহরের শৌখিন রাঁধুনিরা দিশা হারাচ্ছে, এদিকে নদীর রান্নার নেশা পেয়ে বসেছে। হাতের কাছে সব রসদ থাকলে সামান্য দেরি হবে না।রান্নার মধ্যে সময়ের সাথে পাল্লা দিতে তার ভালো লাগে। এত কাজের মাঝে আগন্তুককে দেখেও গুরুত্ব দিলো না।
যুবকটা বিস্ময় নিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল তার দিকে, স্পষ্ট আমেরিকান উচ্চারণে ইংলিশে বলল–
” আলুর চপ কিন্তু তোমাদের অথেন্টিক রান্না নয় ”

নিশি অবাক ” আমাদের অথেন্টিক রান্না নয় মানে? সেই গ্যান্দা কাল থেকে খেয়ে আসছি ”

” না এটা জাপানের একটা ক্যুইজিন, ওখান থেকে মডিফাইড হয়ে এখানে এসেছে কিন্তু আমার একটা প্রশ্ন ”

নিশি তা শুনে নদীকে বলল ” নদু তুই ডিমের পুরের মধ্যে কী দিয়েছিলি? ”

“পুদিনার কুচি চটপটির মসলা কিছু মেখে দিয়েছিলাম ”

” জিজ্ঞেস করছে সসটাওকি তোর বানানো ”

” না ওর নানির ভূতে এসে বানিয়ে দিয়েছে” নদীর কন্ঠ থমথমে। নিশি হাসলো তবে ছেলেটাকে কিছু বলল না। ছেলেটা আরও কিছু বলল,

“জিজ্ঞেস করছে, সবুজ সবুজ ওগুলো কী ছিলো সসে ”

” ধনে পাতা ‘ নিশি তার তরজমা করে দিলো।

“নদু তোর ছবি তুলতে চাচ্ছে ”

” না! ” নদী কঠিন উত্তর, ” চপ মুখে দিয়ে যে চেহারা বিগড়ে ফেলে তার আমার ছবি তোলার অধিকার নেই ”

অদ্ভুত ব্যাপার হলো এটা নিশির ভাবার্থ করার দরকার হলো না ছেলেটা নিজেই বুঝে ফেলল,নীরবে কিছুক্ষণ দেখে লজ্জিত হয়ে হাসলো ” ওয়েল আই এম রিয়েলি সরি ইফ আই হার্ট ইউ। বাট ইট ওয়াস রিয়েলি নাইস ” ছেলেটি বিদায় নিলো।

” এই ইন্ডিয়ান ছোড়ার তো খবর হইসে।স্টমাক দিয়ে হার্টের রাস্তা বের করে ফেলসিস । মুখে মুখে ছবি তোলার কথা বলতেসে পারলে তো মনে হয় তোরে ধরে চুম্মা খাইতো… ”

নদীর ধানমন্ডির বাড়ি যাবার জন্য পাগল পাগল লাগছিল।নিশির ফাজলামোতে গা জ্বালা করে উঠল। তবে এখন হঠাৎ হঠাৎ মনে হয় গুরুত্ব দেওয়া দরকার ছিলো। আমাদের জীবনের প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো চোখের কোণা দিয়ে এড়িয়ে যায়।আর আমরা পড়ে থাকি অপ্রয়োজনীয় সবকিছু নিয়ে।
*****
কয়েক দিন পর,

নদীর সামনে পাহাড় সমান স্তুপ করে রাখা থালাবাসন। এঁটো লেগে থাকা গত রাতের তরকারি, পচে যাওয়া ডালের গন্ধে নদীর গা গোলাচ্ছে। ভুলুটা সকালথেকে ক্ষুধা পেটে ঘুরঘুর করছে। এতোগুলা এটো এক করে তাকে খেতে দেয়া যায়। কিন্তু পচা বাসি খাবার অবোধ প্রাণীকে দিতে মন টানে না নদীর।

অন্যদিন হলে সমস্যা ছিলো না তবে, নদীর নাক চুলকাচ্ছে রাত থেকেই।অচিরেই নাসারন্ধ্র বন্ধ হবে। এর পেছনের কারণ নাহার বেগম। গতরাতে তিনবার বিছানা ভিজিয়েছেন। রানুখালারা নাক ডাকিয়ে ঘুমালেও ঝাঁজালো গন্ধ নদীর নাক জ্বালিয়ে দিয়েছে। কয়েকদিনের বৃষ্টিতে চারদিকে ঠান্ডা পরিবেশ। রাতে কাপড় ভেজানোর ভয়ে রানুখালা শাশুড়ীকে পানি খেতে দেন না। তবুও বুড়ি মাঝেমধ্যে পানি বোতলে ভরে লুকিয়ে রাখেন, তখন মাঝরাতে এই ঘটনা ঘটে। রাতে বিছানায় নহর বইয়ে নাহার বেগম দিব্যি আছেন, কিন্তু এই শাড়ি চাদর ঘাটাঘাটি করে নদীর ঠান্ডা লেগে বসে আছে। তার ওপর সকালে একরাশ বাটিঘটির স্তুপ কলপাড়ে।

বাথরুমের বালতিতে দুইটা পেশাবের শাড়ি। রানুখালা দেখা মাত্র চিলচিৎকার শুরু করবেন। যদিও সেসব ধোয়ার বিষয়ে তার কোন ভূমিকা নেই। এদিকে কলপাড়ে নদী আগে শাড়ি ভেজাবে না থালাবাসন ধরবে বুঝতে পারছে না।

“নদী কীরে! দুঃখী লাগতিসে? ”

কবরি বেশ সেজেগুজে সাইকেলে কোথাও যাচ্ছিলো। দূর থেকে প্যান্ডেলে রাখা তার চকচকে রুপালি শান্তিপুরী চপ্পল দেখে শরীর হিংসায় জ্বলে গেল নদীর।তার স্যান্ডেলটা ছিড়ে বসে আছে সেই কবে,সেলাই করা হয়নি।নিজের কাজ করতে করতে সময় হয় না। একসপ্তাহ পার হলো ঠিকেঝিটাও কাজে আসে না।

– তুই যাবি নানে? কবরি আবার শুধালো।

– তোর সাথে ফুর্তি করতি যাই, আর থালাবাসন তোর শাশুড়ী এসে ধুয়ে দেক নাকি?

– ওমা গো! ফুর্তি করতি যাতিসে কিডা?সাড়ে এগারোটা বাজি, আজ রিজাল্ট দেবে বারোটায়। মেয়েরা সব কলিজে ভিড় করতিসে। বলতিসি গেলে চল, তা ভালো কতা ভালো লাগে না।”

নদী স্থির তাকিয়ে আছে। হঠাৎই মনে পড়লো আজ এইচ এস সির রেজাল্ট! এত বড় বিষয়টি মনে ছিলো না কী করে তা ভাবার অবসর নেই। নদীর রেজাল্ট দেখা খুব জরুরি।

” তোমার বাবা কত ভালো ছাত্র ছিল। তুমি হাইয়ার স্টাডিতে ঢাকায় পড়তে আসবে তো.. “সোহরাব লোকটার কন্ঠে কিছু ছিল।মাঝেমধ্যে মনে পড়ে কথাটা।
হায়দার খালু দাঁত ব্রাশ করতে করতে কলপাড়ে এসেছেন।

খালুর কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে নদী দ্রুত বেরিয়ে গেল। রানুখালা উঠলে গাইগুই করে বলবেন বিকেলে গিয়ে দেখে আস। কী দরকার? মাঝেমধ্যে মুক্তির স্বাদ নিতে হয়।

রেডি হয়ে সাইকেল চড়তে চড়তে রাস্তা থেকে ভেতরবাড়ি থেকে খালা চিৎকার শোনা যাচ্ছে। বুড়ির ভেজা শাড়ি না মিললেও ভেজা তোষক ধরা খাইয়ে দিয়েছে বুড়িকে। এই অবস্থায় যদি শোনে খালার স্যান্ডেল পরে নদী বেরিয়েছে কী করবেন আল্লাহই জানে। কিন্তু নদীর এখন থামলে চলবে না। কবরিকে দ্রুত যেতে বলল।

বোরখা পরে মাঠের কোণায় বিশেষ বন্ধুদের সাথে বেড়াতে যাওয়া মেয়েগুলো কলেজ প্রান্তরে দোয়া কালামের স্রোত বইয়ে দিচ্ছে। মজার ব্যাপার হলো নদীরও কেমন যেন ভয় লাগছে। এটা সম্ভবত এই জন্য যে বিচিত্রভাবেই তার পরীক্ষাটা ভালো হয়েছিলো

জীবনে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার অভিজ্ঞতা বাকিদের যতটা কঠিন চাপের মধ্যে দিয়ে হয়, নদীর জন্য ততটাই আরামদায়ক ভাবে হয়েছিল। ঘটনা হলো নদীর সিটটা পড়েছিল বাড়ির অনেকদূর ভাদরা ডিগ্রি কলেজে।।

রানু খালা শোনামাত্র হাত তুলে ফেলেন,” কলেজ পইরেছো ঢের হইয়েছে, এত দূর সম্ভব না, আমার পঙ্খিরাজ ঘোড়া নেই, রাজারভান্ডারও নেই ”

সাতক্ষীরায় থাকা মেজমামা তখনই মাসিহার অবতারে এলেন। পরীক্ষার হল মেজোমামার বাড়ি থেকে দশ মিনিটের দূরত্ব। পরীক্ষার একমাস আগে নদীকে প্রায় খালার সাথে ঝগড়া করে নিয়ে গেলেন।তবে গিয়ে আবিষ্কার হলো মামীর পা বাথরুম থেকে পড়ে মচকে গেছে। ডাক্তার প্লাস্টার করে দিয়েছেন , এক মাসের বেরেস্টে থাকতে হবে। মেজ মামী বাড়ির রান্নাটা কাজের লোকের হাতে ছাড়েননি।মামাও যার-তার হাতে খেতে পারেন না। কাজেই নদীর একটা দায়িত্ব পড়ে…। তবে তাতে নদীর বিশেষ সমস্যা হলো না।কোল্ড স্টোরেজের ব্যবসায় সিদ্দিকমামার অবস্থা ভালো ৷ বাড়িতে কাজের লোকের অভাব নেই।তাদের সাহচর্যে নদী সময় মতো রান্না বসিয়ে পড়ার যথেষ্ট সময় পেতো। মেজমামি নদীর আগমন স্বাভাবিকভাবে নিতে না পারলেও মামার ভয়ে সরাসরি কিছু বলতেন না,

” দিওয়ানা হয়ি তেল ঢালতি নিষেধ কর নাজু, পয়সা দে কিনা লাগে”

“মাছের পিস যেন ভিখিরির মতো না হয়। বড় পিস ছাড়া তোর খালু কলাম খাতি পারে না। তারি বইলে দে”

” সবজি যেন গালায়ে না ফেলে নাজু দেইখে দিস!

নতুন মানুষ পাকের ঘরে খুটুরখাটুরে গৃহকর্ত্রীর খাটে শুয়েও শুয়েও জোর আপত্তি চালালেন। তবে রানুখালার বাড়িতে থেকে থেকে নদী গা-সহার উপর মাস্টার ডিগ্রি হাসিল হয়ে গিয়েছিল।তার সাথে তার একটা গুণও ছিলো,

” আমাগের সেইদিনের ছোট্ট নদী, তোর রান্নার হাত তো সিরাম রে! মাশাল্লাহ। শোন তোর জন্যি টিচার ঠিক কইরেসি। নিচতালায় থাকে জুই আপা ডিগ্রি কলেজের টিচার, সাইন্সের সাবজেক্ট দেখায় দেবেনে। সন্ধ্যায় সন্ধ্যায় গিয়ে ঝালায়ে নে, পাশ তো কত্তি হবে নাকি? ”

ভারী সাবজেক্ট আগে ডাক্তার আপা দেখিয়ে দিতেন। তখন মেজমামার করা ব্যবস্থাতে অনেকদিন পর নিচ্ছিদ্রভাবে পড়তে পেরেছিল নদী৷ পড়াশোনায় খুব আগ্রহ ছিল ঠিক তা নয়, তবে সারাক্ষণ রানুখালার চিৎকার, তার শাশুড়ী গালাগাল, ময়লা থালাবাসন, বাসী ভাত আর বুড়ির ঝাঁজ গন্ধদার শাড়ি ধোয়ার চাইতে এমন পড়ার চাপ নেওয়া যেন ঢের ভালো৷ পড়ে পড়ে জজ ব্যারিস্টার হবার কোন উচ্চাশা ছিল না, শুধু সময়টা অর্থবহ করার চেষ্টা ছিলো।

“ও আল্লাহ! এই কিরাম রেজাল্ট। আমি সব এনসার কইরেসি এট্টা ছাড়িনি !তাইতে মোটে দুই পয়েন্ট পাঁচ! কিরাম হলো..

ছাত্রদের মধ্যে গুঞ্জন। রেজাল্ট আউট হয়ে গেছে। অনেকের উল্লাস, অনেকের মুখ অন্ধকার। কলেজের খোলা প্রান্তরে ভবিষ্যত জীবনযুদ্ধের নানান ধরনের ক্ষণিকের সৈনিক। হেরে যাওয়া সৈনিক আছে,মাঝারি মানের সৈনিক আছে, আর আপাত রাজা মহারাজা মানের সৈনিকও আছে। এখন সমস্ত স্পটলাইট তাদের ওপর। ফোনে উঁচু গলায় কথা বলছে অনেকে- হ্যাঁ আব্বা ফোর এইসেছে!আরে গোল্ডেন এ, হ্যাঁ আর বলসি কী!

ক্লাসের দিলকুশা মহারানীর হাসি নিয়ে ভিড় কাটিয়ে আসছে। ক্লাসে ভালোই করতো বোঝাই যাচ্ছে রেজাল্টও নজরকাড়া এসেছে।

” এ, তুই নদী না? তা এইখানে কি কত্তি? ”
” নাচতে এসেছি দেখবি? ” কথাটা নদীর মুখে এসে গেলেও সাবধানে সামলালো।

” তুই পরীক্ষা দিয়েছিলি, দেখতি পাইনি তো ”

” তুই আর কাউরি দেখিস ?”নদীর কথা মনে হয় তার কানে গেল না।

” মনে হয় পাশ কইরেসিস।শুনলাম ফেল করেনি এইবারে কেউ, তবে স্কোর তুলতি পারেনি তেমন। আমার এত কম পড়ায় গোল্ডেন এ কিভাবে এলো বুঝতে পারতিসি না ”

হাওয়ার হাত ঝাড়তে ঝাড়তে দিলকুশার ন্যাকাচন্ডি কথা শুনে নদীরই নয় আশেপাশের সবার ভেতর জ্বলে অঙ্গার।এদিকে রেজাল্ট বোর্ডের ভিড় আস্তে আস্তে কমে এসেছে। তবে নদীর রেজাল্ট বোর্ডের কাছে যেতে ভয় লাগছে। আবেগের বশে কেন এলো কে জানে। কী লাভ ফলাফল জেনে? কিছু কি বদলাবে? বাড়ি ফিরে তো সেই রাজ্যের থালা-বাসন ধুতে হবে ।

” ও নদী! এইটা নাম্বার না তোর ? থ্রি পয়েন্ট ফাইভ এইসেছে, কী সব্বনাশ ! তোর দেখি এ জুইটেছে মিষ্টি খাওয়া। “কবরি দৌড়ে আসছে। নদী কী বলবে বুঝতে পারলো না।

” কীরে তুই এত পইড়েসিলি?আমাগের সামনে ভিখিরি সেজে আসতি।”

” মাশাল্লাহ নদী! অনেক ভালো কইরেছ। বিরাট ব্যাপার। আমার মনে হচ্ছিলো তোমার হবে ”

কলেজের ইংরেজি ম্যাডাম কথা বলে যাচ্ছেন নদীর মাথা বো বো করে ঘুরছে
।ম্যাডামের চেহারা কেমন যেন মায়ের মতো দেখতে লাগছে। তার কথা গুলো মনে হচ্ছে যেন দূর থেকে ভেসে আসছে
” এইখানে কিন্তু থামলে চলবে নানে আর বড় স্বপ্ন দেখতি হবে..”
স্বপ্ন দেখা কি আসলেও সহজ?
*******

” আমি অত কিছু বুঝিনে, পাশ দিয়েসে তো কী হয়েসে। এখন কি জজ ব্যারিস্টার বানাবো। তোর কি মাথার ঠিক আছে? ”

রানুখালার ফোনের ওপাশে মেজমামা কি বলল বোঝা যাচ্ছে না। রানুখালা আরও চিৎকার করে উঠলেন, ” দায়িত্ব নেবার বেলায় কেউ আসেনি। আমার ঘাড়ে পইড়ে আছে আজকি আট বছর। এখন আমি সুবিধা দেখলেই দোষ?সব ঝামেলা তো তোমরা আমার ঘাড়েই ফেলো। ওইদিকে নিশি মুখে চুনকালি মাখিয়ে চম্পট, এরে দুনিয়া দেখিয়ে আলকাতরা মাখাবো? নিজের জ্বালায় জ্বলছি আমার এতো শখ নেই ”

নদীর রেজাল্টের পর রানুখালার সাথে মেজমামার কয়েকদিন ধরেই এই নিয়ে ঝামেলা চলছে৷ ফোনে চলছে বাকবিতণ্ডা। মেজোমামার খুব আগ্রহ নদীকে নিজের বাড়িতে এনে ডিগ্রি কলেজে পড়ান। রানু খালার মতে পড়ানো নামে ঝি-গিরি করাতেই মামার এত আগ্রহ।

নদীর কানে এইসব কথোপকথন শুনেও নির্লিপ্ত থাকতে চাইছে। রানুখালা দুইদিন ধরে ঠিকভাবে কথা বলছে না। অপরাধ তেমন কিছু না নদী শুধু ঢাকায় গিয়ে অ্যাডমিশন ফর্ম নিয়ে আসতে চেয়েছিল।

” লাল গালিচা পেইতে রেখেসে না তোমার জন্যি। বড় পাশ দিয়ে মনে কইরেসো সব সোজা? গিয়ে নিশির মতো লাফাঙ্গা হয়ে ফেরো আরকি। ঝামেলা করলি তোরে বাঁচাবে কিডা খেয়াল আছে?

” একবার গিয়ে দেখি এডমিশন ফর্ম..”

” ঢাকা যাওয়া ভুইলে যাও। এমনিতেই তোর বাপ মরার আগে যে ভ্যাজাল কইরে রেখেছে, তোরি পালি তারা কলাম কেইট্টে রেখে দেবে, কিছু বুইঝিস? ”

নদী আসলেই বোঝে না।তার বাবার কোন সমস্যা একটা ছিল কিন্তু সেটা নিয়ে কেউ তেমন আলোচনা করে না।কিন্তু এর কারণে সে কেন ঢাকা যেতে পারবে না তা যেন ঘোলাটে।
খালার মুখে কলেজের আগে পড়ার কোন কথাই আসে না। তবে হায়দার খালুর হাল্কা সান্ত্বনারবাণী ছিলো। খালার আপাতত মাথা গরম সময় করে তিনি ডিগ্রী কলেজে নিয়ে যাবেন ভর্তি করাতে। পাসকোর্সে ভর্তি হয়ে থাকলে নিয়মিত ক্লাস করার দরকার নাই। বাড়ির প্রতিও নদীর একটা দায়িত্ব আছে, দাদিটাও অসুস্থ থাকেন। নদীতো এই বাড়িরই মেয়ে। খালুর কথার নদী কোন উত্তর দেয়নি। শান্ত মুখে নাহার বেগমকে নিয়ে গেছে কলপাড়ে গোসল করাতে।

“ঢাকা তোর জন্যি না বুবু বুইছিস, ব্রাট ঝামেলা বেঁধে যাবে ওইখানে গেলে”

” তুমি জানো ক্যামনে? ”

” ওই জানি আরকি, বউটার তো স্বভাব খারাপ। যিরাম করে তোরি রাখে আমার কি বুক ফাটে না? জাতে উইঠেসে কার বাড়ি থেকে? আমি কিছু জানিনে? নিজে তো ডিগ্রি পইড়েসে তোর বাপের বাড়ি থেকেই.. ”

নদীর ছেড়া ছেড়া মনে পড়ে রানুখালা শানুখালা মেজমামা এরা সবাইই একসময় থাকতো তাদের ধানমন্ডির বাড়িতে। জমজমাট লাগতো তখন। রানুখালার কন্ঠস্বর কতটা মিষ্টি শোনাতো। সময় মানুষের কত অদ্ভুত রূপ দেখায়।

স্মৃতিচারণ কাটাতে হলো দ্রুত। ফোনের স্ক্রিনে অনেক দিন পর একটা নাম্বার জ্বলজ্বল করছে।

” নিশি! কই তুই?”

” তোর আশেপাশেই তবে আপাতত বাসায় আসছি না। ”

” বাসায় আসছিস না মানে… ”

” মানে পরে আপাতত তোকে একটা কাজ দিব, লক্ষ্মী মেয়ের মতো করে ফেল আমার বিছানার বাম দিকের তোষকে একটা ওয়ালেট দেখবি”

” হ্যাঁ ওয়ালেট আছে”

” ওখান থেকে চারশো ডলার বের কর, উত্তর দিকের বাঁশঝাড়ের দিকে বাবু দাঁড়িয়ে আছে তার হাতে দিয়ে আয়। ”

” মানে কি এতগুলো ডলার… ”

” আম্মু শেষ বার যাবার আগে তার পার্স থেকে ঝেড়ে দিলাম টের পাইসে ল্যান্ড করে হা হা হা”

” নিশি তুই.. ”

” তুই নিজের চিন্তা কর। আমার রাত আটটায় গাড়ি। ওই ডাইনি জীবনে তোকে ঢাকায় যেতে দেবে না। ভালো চাইলে দুটা কাপড় ভরে আমার সাথে যাবি নাকি ভেবে দেখ .. ”

” কী বলিস হাবিজাবি ”

“লজিক দেখাই তবে তোর যদি ওই হাগুরে বুড়ির গু-মুতের গন্ধের নেশায় পেয়ে থাকে তাহলে ভিন্ন বিষয়। আপাতত টাকা পার্সেল কর”

নিশির সাথে কথা বেশি আগালো না। তার কথামতো দেখা গেলো স্কুলের সরকার স্যারের ছেলে বাবু ঠিকই দাঁড়িয়ে আছে।এতগুলো ডলার নদী দোনামনা করতে করতে হাতে দিলো

” আপনার জন্যি সাড়ে সাতটার দিকি একবার এইখানে আসতি বইলেসে নিশিপু। দশমিনিট থাকপ তারপর চইলে যাবো বাকি আপনার ইচ্ছে।”

বাবু চলে গেল। নদী কী বলবে বুঝতে পারলো না। দ্রুত বাড়ি ফিরে এলো। রানুখালা জানলে আরেক কান্ড ঘটবে।নিশি কাণ্ডে এমনিতেই আমেরিকায় শানুখালার সাথেও ঝামেলা বেঁধে আছে।
রানুখালার রণচণ্ডী অবতার অবশ্য সন্ধ্যার পর দেখা গেল না। নদী খেয়াল করলো একটা ফোন কল আসার পর রানু খালার চেহারাটা কেমন যেন একটু থমথমে হয়ে গেছে। সম্ভবত মিথ্যা খুনের মামলায় ফেসে যাওয়া তাঁর ফেরারী ছেলের কোন খবর এসেছে। শাহবাজ, হায়দার খালু আর রানু খালা দরজা লাগিয়ে গুজগুজ করলেন কিছুক্ষণ। এক পর্যায়ে রানু খালা বোরখা পরে নিলেন।

” নদী একটু বের হচ্ছি, অপেক্ষা করিস না ফিরতে রাত হতি পারে। বুড়িরে খাওয়ায় দিয়ে ঘুমোয় পড়িস। পেছন উঠোনের দোর ভালো মতো লাগাস কলাম ”

রানুখালারা দ্রুত বের হয়ে গেলেন। নাহার বেগম সন্ধ্যায় সন্ধ্যায় বেশি একটা খেলেন না। সন্ধ্যায় সারাবাড়ি খালি।
সাড়ে আটটা বাজে নিশির গাড়ি ছেড়ে দিয়েছে হয়তো..।

” বাইরের পৃথিবীটা কি তোর ধারণা আছে? নিশি তো নষ্ট হয়েই গেছে, ওর মায়ের অগাধ টাকা। তুই নষ্ট হলি কে দায়িত্ব নেবে রে? তোর বাপ-মা নেই। তোরে একা পেল সব ছিড়েখুঁড়ে খাবে”

রানু খালার দাঁত-মুখ খিচিয়ে বলা কথাগুলো শুনতে জঘন্য কিন্তু কথাগুলো সত্যি। নদীর তো বেঁচে থাকতে হবে। আচ্ছা বেঁচে থাকার অর্থ কি শুধু নিঃশ্বাস নিয়ে যাওয়া? নাকি স্বার্থ হসিল করে আরামে থাকার চেষ্টা করাটাই বেঁচে থাকা।

এসব চিন্তায় নদীর মাথায় গিট লাগে। হঠাৎ হঠাৎ আফসোস হয় নিশির মতো তার এত সাহস নেই কেন। রানু ঢাকা যাবার জন্য খরচের কথা বলেন , তিনি জানেন না নদীর কাছে ঢাকা যাবার টাকা আছে। সেই দিন ওই সোহরাব লোকটা খামে করে কিছু টাকা দিয়েছেন তাকে৷ কয়েকটা হাজার টাকার নোট৷ এটার খবর হয়নি খালার। রেজাল্ট আউট হওয়ার পর দিনের মধ্যে একটা সময় বের করে নদী সেই খামটা খুলে দেখে।হঠাৎ কিছুক্ষণের জন্য মনে হয় গোটা পৃথিবী কিনে নেবে । এই নিয়ে দুইটা জিনিস জমলো যা দেখলে তার মন ভালো হয়ে যায়।পাঁচ হাজার টাকার নোট ভরা খাম, আরেকটা ক্রিস্টালের চাবির রিং। এটা সে পেয়েছিল সেই ফুড ফেস্টিভ্যালে সন্ধ্যায়।

” এইযে আমাদের রাধুনির জন্য একটা গিফট, ফেস্টিভ্যাল শেষে স্টার কাবাবে নিশির হাতে জিনিসটা দেখেছিল নদী। সাহায্য করার জন্য হয়তো উপহার ভেবেই নিয়েছিল। তবে শুনলো এটা সেই বিদেশি যুবকের যাবার আগে নিশিকে দিয়ে গেছে। একটা লাল বাক্সের মধ্যে
একটা ক্রিস্টালের কিউব ভেতরে থ্রিডি লেজারে ধুপছায়ার মাঝে তৈরি একটা পরি। ছোট্ট কিন্তু খুব নিখুঁত। অতি সাধারণ উপহার হলেও মন ভালো হয়ে যায়। সেই মাত্রা আরেকটু বেড়ে গেল একটা কাগজের নোটে,

” I rarely eat spice. But your cutlets made me eat two. Little girl you have magic in your hands.”
just love it

R
আর দিয়ে কত নামই তো হতে পারে।
রানুখালার ভয়ংকর কিছু দোষ থাকলেও তিনি ভালো রাধুনি। তার অধীনে থেকে নদীও রান্নার জ্ঞান ভালোই আয়ত্ত করেছে। কিন্তু তার রান্নার এত সরল ভাবে প্রশংসা আগে কেউ করেনি। বিশেষ করে যখন ভাবে এমন সুন্দর কেউ কথাগুলো লিখেছে ভেতরটা শিউরে ওঠে। মনে আপসোস হয় সেদিন কেন একটু সুন্দর করে কথা বলল না? তবে ইংরেজিতে বলছিল নদী কথা চালাতে পারতো না ইংরেজিতে এক্সপার্ট হলো নিশি। আচ্ছা নিশি কি সত্যি তাকে ঢাকায় নিয়ে যেতে চাচ্ছে?

” ঘুমায় পড়লা নাকি নদী?”

নদী বিছানা থেকে চমকে উঠে বসলো। শাহবাজ তার ঘরের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকেছে। নদী বিস্ময়ে কি বলবে বুঝতে পারছে না।শাহবাজ দরজা ভিড়িয়ে দিতে দিতে বলল, ” তুমি আর মা একা রাতে ভয় পাও কিনা এইজন্য আমি এসে পড়লাম আরকি। তোমাদের জন্য চিন্তা হয় তো… ”

শাহবাজের মুখের তেলতেলে হাসিটা প্রসারিত হচ্ছে ক্রমাগত৷

” তোমার খালার শাহিনরে নিয়ে এমনি মেলা চিন্তা, তার ওপর যদি জানে আনোয়ারার সাথে তুমি সেদিন কোথায় গিয়েসিলে কীরাম করবে বলতো? ”

নদী দ্রুত ভাবতে চাইছে। কিন্তু মাথা কেমন ফাঁকা লাগছে।শরীরের শক্তি গুলো যেন হঠাৎই ফুরিয়ে আসছে।

(চলবে)

#শারমিন_আঞ্জুম
বই নিয়ে অনেক টেন্স আছি। প্রডাকশন না দেখা পর্যন্ত অস্থিরতা কমবে না৷ এইজন্য একেক পর্ব দিতে দেরি হচ্ছে।দুইদিন পর দেব ষষ্ঠ পর্ব।অনেক দিন পর লেখায় ফিরে আনন্দও হচ্ছে৷ সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ। গল্পটা ভালো লাগলে লাইক দিন পেইজ ফলো করুন। শুধু এফ এন ধরনের কমেন্ট আমি ডিলিট করব। অযাচিত কমেন্টকারি ব্যান হবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here