একেবারে বিয়েবাড়ির আমেজ ! ফুটন্ত তেলে পেয়াজ, গরম মশলা, তার মাঝে মুরগীর টুকরোগুলো ছেড়ে দেয়া হয়েছে।মুরগীর সাথে মশলা কষলে সারা ঘরে মৌ মৌ সুবাস ছড়িয়েছে । ভালো বাবুর্চির লক্ষ্যন হলো,গন্ধেই অর্ধভোজন করানো। স্বীকার করতে হবে ক্রমশ চর্চায় বাবুর্চির হাত পাকা হচ্ছে, তবে খাবার মুখে চেখেও গৃহকর্ত্রীর মুখ ভাবলেশহীন।গম্ভীর মুখে খুনতি দিয়ে হাড়ি নাড়ছেন,
– মুরগীর ঠ্যাং আরেকটা কই?
রানুখালার কথায় নদীর বুকটা ছ্যাৎ করে উঠলো । আজ বাড়িতে মেহমান আসছে তাদের জন্যই বিশেষ রান্না। সকাল থেকে সারা বাড়ি ঘষামাজা শুরু। এত তোড়জোড়ের মধ্যে খালা রান্নাঘরে ঢুকে মুরগির টুকরো গোনা শুরু করবেন নদী বুঝতে পারেনি।
-কী রে, কথা বলিস না ক্যান, মুরগির ঠ্যাং আরেকটা কই?
-একটাই ছিলো খালাম্মা ” কাজের ঠিকেঝি দ্রুত উত্তর দিলো।
-একটাই ছিলো? ল্যাংড়া মুরগী দিয়েসিলাম রানতে?
রানুখালা চিল চিৎকার দিচ্ছেন।
সন্দেহের তীর ঘুরে আসছে নদীর দিকে কারণ রাঁধুনি সেই ছিলো । খালাকে উত্তর কী দেবে দ্রুত ভাবছে, মাংস কষানোর মাঝপথে নিশিটা থাবা দিয়ে একটা রানের পিস নিয়ে চলে গেছে।তবে নিশিকে বড়খালা কিছুই বলবেন না,সব খড়গ নামবে নদীর ওপর। সেটা খুব একটা সম্মানজনকও নয়। কিছু কিছু মানুষের প্রিয় ফেন্টাসি হলো গালিগালাজ করর গলাবাজি করা।
রানুর চোখজোড়া চকচক করছে নতুন ফ্যান্টাসির জন্য। ভালোভাবে নড়েচড়ে দাঁড়িয়েছেন। নদী মনে মনে নিজেকে প্রস্তুত করল, ” ল্যাংড়া মুরগী কোথা থেকে আসে আমি কি জানিনে ? মেয়েমানুষ যার নয়তে হয় না নব্বুইতেও হয় না। তিন বছর আগে তোর বিয়ে দি দুলি দুইবাচ্চার মা হতি, দুনিয়াদারির খবর নেই, মাথার ওপর চাল নাই, কিন্তু দিন দিন জিবলা তত বড় হতিসে। জমিদার বাপের বেটি বইলে কতা, একটু খুনতি নাড়াতে দেলাম এরমধ্যি তোমরা নোলা সামলাতি পারলিনে?
কথাগুলো বাড়ির ঝির দিকে তাকিয়ে বললেও তীরের নিশানা অবধারিতভাবে নদীর দিকেই।
একইকথা দুইদিন আগে শুনতেও কান ঝা ঝা করতো। আজ নদী আশ্চর্য হয়ে খেয়াল করলো, তার তেমন বিকার হচ্ছে না। দীর্ঘ কড়ারোদে থেকে থেকে চামড়া পুড়ে মোটা হয়। তারো মনে হয় তাই হচ্ছে। উল্টো খালার বিশালবপু ঝাঁকিয়ে গলাবাজী দেখে মজা লাগছে। মনে হচ্ছে পানিভরা বিশাল থলি শব্দের সাথে থ্যালথ্যাল করে কাঁপছে। আজকাল রানু খালাকে এই অবস্থায় দেখতে নদীর ভালোই লাগে।
” আমি কিছু জানিনে কোত্থে থেকে মুরগির ঠ্যাং আনবি তোরা , মেহমান আসার আগে যদি…”
” ভাবি কীরাম কইরে চেচায়ে যাচ্ছ, আমি নিয়েছিলাম মুরগীর একটা ঠ্যাং । হইয়েসে? ”
“আরে তুমি কখন এলে? ”
শাহবাজের কথায় রানুর কন্ঠ কোমল হয়ে গেলো। অর্থবিত্তের একটা আলাদাই প্রতাপ থাকে। তার তাপে আশেপাশের মানুষের কন্ঠের লয়েও প্রভাব পড়ে। রানুর এই দেবরের ম্যানপাওয়ারের ব্যাবসাটা বেশ বোলবোলা যাচ্ছে। ভাইয়ের বাড়িতেও যখন আসে হাত ভরে খরচ করে। রানুর স্বামীকে সদরে আরেকটা ফার্নিচারের দোকানও কিনে দিচ্ছে৷ এমন মানুষকে মুরগীর ঠ্যাং কেন নিজের কলিজাও কেটে খাইয়ে দিতে মন চায়৷
যাহোক শাহবাজ এসে পরিস্থিতি সামাল দিলো, “এত গোছগাছ কিসের ভাবি গন্ধে মৌ মৌ করতেসে বাড়ি”
” আরে কিছু না ,পাত্রপক্ষ আসবে আজকে”
“পাত্রপক্ষ আসবে মানে? ” শাহবাজ একটু সরুচোখে তাকালো, চোখের কোণের দৃষ্টি ভাবির পিছনে দাঁড়ানো তার বোনঝির দিকে।নদীর হাঁসফাঁস লাগছে৷ কিছু লোক চোখের কোণা দিয়ে মেয়েদের বুক-নিতম্বের মাপ নেবার দারুণ ক্ষমতা রাখে। শাহবাজ চরিত্রটা তেমন ক্ষমতাধর একজন । গা গুলিয়ে ওঠে এই লোক আশেপাশে থাকলে।
” আরে নিশির জন্যি আসবে, আমার বড়পার মেইয়ে ”
” নিশির মা তো আমেরিকা থাকে, তা সে জানে? ”
” ওর মায়েরই ঠিক করে দেওয়া পাত্তর, এখন মেইয়ে যার তার কথা তো শুনতিই হয়। তুমিও থাকো নাহয়, তারা এলো বলে, এ নদী এখন ঘরে যা আমি না বললি ঘরেত্থে বেরোবি না একেবারে ”
কথোপকথনের মাঝে নদী খেয়াল করলো পাশের বাড়ির আনোয়ারা বু দরজায় উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে জানালা দিয়ে । বেচারিকে কতটা অপেক্ষা করতে হবে কে জানে। যদিও নদীর হাতের কাজ সব শেষ। নিশির জন্য আসা পাত্রপক্ষের সামনে নদীর নিষেধ। সেই ছুঁতোয় একটু বেরোনোর সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করবে আজ।
আনোয়ারা সাথে বের হবার আগে একটু তৈরি হতে হবে। এমনিতেই সকাল থেকে হেসেলে রান্না করতে করতে সারা শরীরে ঘাম লেপ্টে আছে ।নদী দ্রুত পা চালালো,
“ও মাগী ধামুর ধুমুর কইরে যাস কনে? ” করিডোরের বামের দরজা থেকে রানুখালার শাশুড়ী নাহার বেগম হাঁক পাড়লেন, ওই হারাম**দী, কী নান্না কইরেসিস লো, গন্ধ ছড়াচ্ছে … ”
” তোমার বিয়ের নান্না কইরেসি লো বুড়ি, জামাই আসবে নানে.. ”
বলেই নদী দ্রুত পা চালালো। আশির অথর্ব কানে খাটো বৃদ্ধার সাথে আপাতত মস্করার সময় নেই। স্নান সারতে হবে দ্রুত।
নদী বাড়ির শেষ মাথায় তার ঘরের দিকে চলে গেল।
বাবা-মাহীন খালার বাড়িতে আশ্রিত কারো ঘর মলিন হবার কথা, তবে এইঘর ততটা মলিন নয়৷ মোটামুটি দামী সেগুন কাঠের ফার্নিচারে ঠাসা। এমনকি একটা এসিও লাগানো। এত বৈভবের কারণ হলো, নিশি। নদীর ছোট খালার মেয়ে আগে ঢাকায় একটা ইউনিভার্সিটিতে পড়তো। কোন এক অজানা কারণে গত একবছর ধরে বড় খালারবাড়ি পড়ে আছে। নিশি আমেরিকায় জন্ম নেওয়া বলে গরম সহ্য করতে পারে না।তার মা তার ঘর সুন্দর সাজিয়ে দিয়েছে। নিশি আজ সকালেই গেছে ফেসিয়াল করতে পার্লারে। ঘটা করে পাত্রপক্ষ দেখতে আসছে শুনে তারও বিরাট আগ্রহ হয়েছে। বিষয়টা খালার কাছে খুশির মনে হলেও নদীর কাছে সন্দেহজনক ছিল।
কেন সন্দেহজনক ছিল সে এক বিরাট ইতিহাস। আপাতত এখন নিশির কথা ভেবে লাভ নাই, নদী আনোয়ারা বুর সাথে বের হবে কীভাবে সেই বিষয়ে ভাবা যাক। আজ সে একটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় যাবে৷যেটার জন্য বেশ লাভজনক। স্নানের আগে মেকাপকিটসগুলো গুছিয়ে নেওয়া ভালো। দামী জিনিস সব জায়গায় ব্যবহার হয় না। এই জিনিস নিশি তার জন্মদিনে দিয়েছে। তারজন্য এইগুলো কোনো সমস্যা নয়,মেজখালা শানু প্রতিমাসে বিশাল একটা অংক মেয়েকে হাতখরচের জন্য পাঠায়।
বড় ফিল্মস্টারের মেকাপের কাজ এসেছে। আনোয়ারা পরিপাটি হয়ে যেতে বলেছে। নদীর জন্য পরিপাটি হওয়া আরেক ঝামেলা। কিন্তু টাকাটা গুরুত্বপূর্ণ।
বাথরুমে অনেকদিন পর তার বোতলে ভরা শ্যাম্পু মেশানো পানির বোতলটা দিয়ে মাথা ধুলো না। নিশির বোতলের শ্যাম্পু দিয়ে মাথা ধুয়ে নিলো। বাড়াবাড়ি ফেনায় চোখ জ্বলছে। মূলত আসল শ্যাম্পু দেবার অভ্যাসটাই চলে গেছে। এখন জামাকাপড়ের আরেক চিন্তা, গত ঈদে বড়মামার দেওয়া দু’জোড়া কাপড় ছাড়া নদীর ভালো জামা বলতে তেমন কিছু নাই। তাও বুঝে বুঝে বের করে। বারান্দায় শুকোতে দেওয়া নিশির কামিজ চোখে পড়লো। নদীর লম্বায় একটু ছোট আর ঢিলে হলেও কাজ চালানো যায়।
তবে এটার দেখা গেল বিশাল গলা।দিন দিন নিশিটার জামা কাপড়ের যা ছিরি হচ্ছে কিছু বলেও লাভ নাই। সত্যি কথা বলতে কেউ কিছু তাকে বলতে পারেও না। যার মা আমেরিকার মতো দেশে নার্সিং করে মাসে দশহাজার ডলারের মতো উপার্জন করে, তাকে ধমকে কথা বলাটা আর একটা চরমধরনের বোকামি। আর রানু খালা বোকা নন। নিশিটার যদি বিয়ে হয়ে যায় সে এইবাড়ি থেকে মুক্তি পাবে। আজকাল এমন একটা মুক্তি নদীরো পেতে ইচ্ছা করে, কেউ যদি বুঝতো..। যেমন তেমন কেউ হোক যদি নদীকেও বিয়ে করে নিয়ে যেতো…।ভাবতে ভাবতে সাবধানে কামিজের বুকের কাছে ওড়না দিয়ে একটা কায়দা করছিল, হঠাৎ মনে হলো হৃদপিণ্ড থমকে যাচ্ছে।
শাহবাজ দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকেছে কানে মোবাইল,” আরে আমি বললাম তো এসে টাকা নিয়ে যান এইগুলা ব্যাপার না…”দীর দিকে চোখাচোখি হতে মধুর হাসি, ” আহা স্রোতস্বিনী নদী, আরে তুমি ঘরে নাকি, খেয়ালই করি নাই ”
নদী জানে এই লোক মোক্ষম সময়েই ঘরে ঢোকে।
” আমরা যখন ঘরে থাকি জামাকাপড় ঠিক থাকে না, তখনই আপনার ঢোকার সময় খেয়াল থাকে না তাই না মামা? ”
নিশির এই ঝাপড়ের পর অনেকদিন শাহবাজ বাসায় আসেনি। আজ দেখা গেল শাহবাজ চেয়ার টেনে বসেছে যেন গল্প করবে,” তা রেডি হচ্ছিলা কোথাও যাচ্ছ নাকি?
” জি না যেতাম না”
“তা এত সাজ সরঞ্জাম?তোমারি তো দেখতি আসতিসে না, আরে এইখানে কী?” শাহবাজ হঠাৎই এগিয়ে নদীর ঘাড়ের দিকের ওড়নায় হাত বাড়াতে গেলেন। নদী সরে গেল দ্রুত।
“ও নদী একটু সরিষার তেল হবে? ”
এই ফাঁকে আনোয়ারা ঘরে ঢুকে গেছেন। নদীর কেমন কৃতজ্ঞ লাগলো দুইবছর আগে মহিলা যখন পাশেরবাড়ি থাকতে এলেন, কত সহজেই আপন করে নিয়েছিলেন। বাড়িতে ভালো-মন্দ কিছু রাঁধলেই নদীর জন্য আলাদা বাটিতে নিয়ে আসতেন। ” বড় মায়া লাগে গো তোমার জন্যি আহারে কত বনেদি ঘরের মেইয়ে ছিলে, কপালের ফেরে কোথায় গিয়ে পড়েছ ”
আনোয়ারার কথায় কিছু থাকে, মনটা ভার হয়ে যায় নদীর। এত বড় কাজটাও তিনিই যোগাড় করে দিয়েছেন। সামনে এইচ এস সি রেজাল্ট। এরপর পায়ের তলার মাটি শক্ত করা খুব দরকার। যার কেউ নেই তাকে নিজ উদ্যোগেই করতে হয়। এই যুক্তি আনোয়ারারই ছিলো, না মেনে নদীর উপায় ছিলো না। শাহবাজের সামনে আনোয়ারাকে ইশারায় কিছু বলতে পারলো না নদী। তার রানুখালার জেরার মুখে পড়া লাগলো তখনই। ” আনোয়ারারে ডেকেসিস কেন? তোরে না বলেসি মেহমান আসতিসে ঘর থেকে বের হবি না।”
“না খালা আমি তো একটু কলেজে খোঁজ করতে যাচ্ছিলাম। মেহমান আসতেসে ঘরে থাকারই দরকার কী?কলেজে গিয়ে জেনে আসতা রেজাল্টের ডেট পিছিয়েছে কিনা”
” হ্যাঁ আমি তো সরিষার তেল নিতি এইসেছিলাম ” আনোয়ারা দ্রুত বলল৷
রানু খালা সন্দেহ নিয়ে তাকালেও আশ্বস্ত হলেন।
নদীর বাইরে বাইরে বউ সাজানোর বিষয়টা তিনি ভালো ভাবে নেন না।ভাদড়ার ছোট মফস্বল শহরে টুকটাক বাড়ি বাড়ি গিয়ে বউ সাজানোয় বেশ নাম ডাক হয়েছে নদীর। তবে গত বছর থেকে নিশির দেওয়া মেকাপের সরঞ্জাম দিয়ে ইদানীং পয়সা নিয়ে সাজাচ্ছে । এতে যদিও পাড়ার মানুষের দারুণ গোস্যা। আসলে সুবিধাগুলোর ওপর আর্থিক মূল্যমানের ট্যাগ পড়ে গেলেই বোঝা যায় কে কত স্বার্থপর। আর আনোয়ারার আনা এই কাজটায় নাকি পয়সা জুটবে,
” যাতি দেও বউ,ঘুইরে আসুক এমনিতি ওই ডিস্কো বেগমরি বাদ দিয়ে এই শাকচুন্নিরি মন ধরলি ঝামেলা হয়ে যাবে নানে। ”
শাশুড়ী নাহার বেগমের কথা ফেলতে পারলেন না রানু। নদীটার গায়ের রঙ তত মাজা না তবে বেশ লম্বা গড়ন চুলে বোঝা মাথা। ছোটকালে নাকমুখ ভোঁতা লাগলেও বড় হবার সাথে সাথে কেমন ধারালো হয়েছে। কিন্তু এইখানে নিশির বিয়েটাই জরুরি।মেনি বেড়ালে প্রতি চার মাসে যেমন পেট বাধায় কিছু মেয়েমানুষ তেমন জটিল জটিল ঝামেলা বাধায়। বড়বোনের পেটের এই লাফাঙ্গা আপদ তেমনই একজন। এখন ভালোয় ভালো বিদায় হলে বাঁচেন। রানু নদীকে কলেজ ঘুরে আসার অনুমতি দিলেন।আনোয়ারা সরিষার তেল ভরে বাড়ি গেল।
******
” ব্রাট ঝামেলা থেইকে বেইচে এইয়েসো বুঝলে? ” হেলিকপ্টারে (মফস্বলের ভ্যানগাড়িতে ) বসে দুলতে দুলতে কথাগুলো বললেন আনোয়ারা।” তোমার এই খালা রক্তের স্বাদ পেইয়েসে বুইছাও? নিশিরে বিদায় দিলিও তোমারি এত সহজে ছাড়বে নানে। তুমারি বিদায় দিলি বুড়ি শাশুড়ীর হাগা-মোতা পরিস্কার করবি কিডা? তাই বলছি এখনই আখের গোছাও। কাজ কইরে কইরে হাত পাকাতি হবে। ”
নদী আনোয়ারার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছে না।কাজটা কতটা সে ভালো পারবে জানে না। আগে তিন চারটা বউ সাজিয়েছিল। তাও নিশির ফোনে ইউটিউব ভিডিও দেখে দেখে।মেকাপে ততটা সে ভালো কিনা জানে না। এখন কী করে কে জানে। তবে এত ভাবতে ইচ্ছে করছে না। পাকের ঘরের গনগনে চুলার তাপে আজকাল দমবন্ধ লাগে। কিছুক্ষণের জন্য সেখান থেকে মুক্তি মিললে আকাশ-পাতাল চিন্তা এসে মাথায় ভর করে।
ইট বিছানো পথে বাতাসে কেমন কামিনী ফুলের ঘ্রাণ নাকে চলে আসছে। এটা আসলে নদীর দাদাবাড়ীর সৌরভ।এই সৌরভের সাথে মিলেমিশে আছে কিছু ছবি। ধানমন্ডি রবীন্দ্র সরোবরের একেবারে কাছে পাকিস্তান আমলে তোলা পুরাতন তিনতলা বাড়িটার ছবি ভাসছে চোখে। সবাই বলতো ধানমন্ডি নাকি বড়লোকের জায়গা। তবে নদীদের বাড়িটা ঠিক বড়লোকদের বাড়ির মতো ছিল না। নামটাও ছিল পুরনো চন্দ্রমল্লিকা।
সামনে বাঁধানো উঠোন পেছনে গ্যারাজ ছিলো, সেখানে এলোমেলো বাগান কামিনী,গন্ধরাজ, কনকচাপার সাথে একটা বড় কাঠ গোলাপের গাছ ছিলো গোটা উঠোন ছায়া দিয়ে রাখতো।
বাঁধানো একটা তুলসি মঞ্চ ছিলো উঠানের মাঝামাঝি । একাত্তরের আগে হিন্দু মালিকদের চিহ্ন। তবে মা গাছটার যত্ন নিতেন,ঠান্ডার ধাত থাকায় তুলসীপাতার রস খেতে হতো দুই ভাইবোনকে।
নদী যখন দশে পড়েছে,ততদিনে বাড়ির চারদিক ঘিরে উঁচু উঁচু ইমারত দাঁড়িয়ে কেমন চোখ রাঙাচ্ছিল। অথচ কিছুদিন আগেও নাকি বিশাল জায়গা নিয়ে বাড়িটা প্রতাপের সাথে দাঁড়িয়ে ছিলো।বাড়ির পেছনের বাগানটা বড় প্রিয় ছিলো নদীর। সেখানে মধ্যদুপুরে বাবলুর সাথে লুকোচুরি খেলতো ।তেমনি একদিন বাগানে গিয়েছিল দুই ভাইবোন।বাবলুটা হঠাৎ ঘরের মধ্যে চলে গেল।
হেলিকপ্টারের ঝাঁকুনিতে ঝাপসা ঝাপসা ছবিগুলো এসে পড়ছে নদীর চোখে। পেছনের দিকের উঠানে একটা বন্ধ পকেট গেট ছিলো।যেটা কোনদিন খোলা হয়নি। বাম পাশ দিয়ে একটা পুরাতন ছোট বাথরুম, দারোয়ান ড্রাইভারদের জন্য । বাবলুটা সেখানে যেতে ভয় পেতো খুব। বলতো ওখানে ভুতু থাকে। সেই দিনও ভয় পেয়েছিলো। বাথরুম থেকে ভূতের খোনা গলা যখন শুনলো, বাঁবলু তোঁর ঘাঁড় মঁটকে খাঁবো, দৌড়ে বাড়ি চলে গিয়েছিল। নদীর মনে পড়ে ওটাই ছিলো শেষবার বাবলুকে দেখা।জীবন্ত শেষবার।
” এসে গেছি ”
নদী চমকে তাকালো। টাউনের বড়বাজারের পাশে “আল-মদিনা ফাইভস্টার হোটেল”। যেটার সামনের দিকের বারান্দায় একটা শত ছিদ্র লাল আণ্ডারওয়ের ঝুলছে। মফস্বলি হোটেল ফাইভস্টারির কেতার ব্যাপারই আলাদা। গোটা বিল্ডিং চড়া হলুদ রংয়ের ডিস্টেমপার করা।
নদী কৌতুহলী হয়ে আনোয়ারা দিকে তাকালো।
আনোয়ারা মাথা নেড়ে বলল, ” আরে নাটকের শুটিং হচ্ছি গিরামের দিকি। ইউনিট থাকছে হোটেলে। ম্যাডামির ইউনিটের মেকাপম্যান আসেনি, ভালো মেকআপম্যান ছাড়া মেকআপ নেবে না।
আসো আসো তাড়াতাড়ি দেরি হয়ে যাচ্ছে। মেকাপখান নিয়ি আবার শুটিংয়ে যেতে হবে ”
নদী মাথা নেড়ে সায় দিলো। সরু চাপা চাপা করিডোর পার হতে হতে পুরুষদের দৃষ্টিগুলো কেমন শিরশিরে। একটা রুমের সাথে ষণ্ডামার্কা লোক দাঁড়িয়ে। আনোয়ারা বলল নায়িকা ম্যাডামের অ্যাসিস্ট্যান্ট নুরুল । আনোয়ারা এগিয়ে এসে পরিচয় দিলো। লোকটা ভালোমতো নিরুক্ষণ করে নদীকে ভেতরে ঢুকতে দিলো । নদীর মনে হলো সব পুরুষের দৃষ্টি এমন কেন লাগছে নাকি পরিবেশের প্রভাব?
তবে অচিরেই সন্দেহ কেটে গেল। কারণ ভেতর ঘরে ফোনে কথপোকথনরত মডেলকন্যা রোমানা বসা। নদী মহিলাকে টিভির বিরতিতে দেখেছে। আবার ফেইসবুকেও দেখা যায়।
আনোয়ারা বলে ছিলেন মেকাপ করেনি, এখন দেখা যাচ্ছে পরির মতো সেজে আছেন। নদীকে দেখে হেসে ফেললেন। এমন একজন মানুষ এমন হোটেলে? কে জানে মফস্বল শহরে এর থেকে ভালো জায়গা হয়তো পায়নি। তার এতকিছু নিয়ে না ভাবলেও চলবে। নিজের কাজের দিকে ফোকাস করলেই হলো।
“এই বাচ্চাটাকে নিয়ে এসেছো? এর তো এক্সপেরিয়েন্সই নাই মনে হচ্ছে”
” না না ম্যাডাম খুব ভালো পারে, কয়েকটা বউ সাজায়িসে”
” বউ সাজানো আর ক্যারেক্টার আর্টিস্টের মেকআপ করা এক জিনিস না। যাহোক আমার এখন ঠ্যাকা। এই মেয়ে তোমার মেকাপ কিটস দেখি, ”
নদী খুলে দেখালো৷ তার মুখ ফুটে কিছু বলার সাহস হচ্ছে না তিনি যদি সত্যিই মেকআপ করেন তো যা সেজেছেন সেগুলো সব ধুয়ে ফেলতে হবে। রোমানা সব হাত দিয়ে দেখে নিল। ঠোঁট উল্টে বলল,” এগুলো তেমন ব্র্যান্ডেড নয়। তুমি আমার মেকআপ কিটস দিয়ে সাজাবে। তবে এখন না, আমি বাইরে একটু বাইরে ফটোসেশন করে আসি৷ ”
নদী বুঝলো না ততক্ষণ সে কী করবে।
” তুমি না হয় ঘরে একটু ওয়েট করো,
আনোয়ারা মাথা নাড়লো”তাও ভালো একটু রেস্ট নাও অনেক দূর থেকে এইসেছ, খালার সংসারি সারাদিন খেইটে মইরে এখন কাজ ভালো মতো করতে পারতে না। ”
রোমানা অবাক হয়ে বলল ” আহারে এইজন্যই তোমার মুখটা শুকনো লাগছে৷
এই মেয়ে খেয়েছ তুমি।?
নদী মাথা নাড়লো।
রোমানা বলল, “একটা কাজ করি তোমাকে খাবার ব্যাবস্থা করি, আমি ছবি তুলে ফিরে আসতে আসতে তুমি চটপট খেয়ে নিও কেমন? ক্ষুধার্ত মানুষকে দিয়ে কাজ করানো যায় না। ”
অনেকক্ষণ পর কারো গলায় মমতার আর্দ্রতা শুনে নদী কৃতার্থ হয়ে গেল।ম্যাডাম বেরিয়ে গেলেন, তবে একা রুমে নদীর বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না।
কিছুক্ষণ পরই একটা ট্রেতে করে গরম বিরানি আর কোল্ডড্রিংস চলে এলো।সাথে ষণ্ডামার্কা নুরুল নামক লোকটাও।
“মনুভাই! ” হোটেলবয় ছেলেটাকে সম্বোধন করতে গিয়ে নদী হোঁচট খেলো।
মনুর পলকের চোখের ইশারায় কিছু বলছে৷ এককালের প্রতিবেশীর এমন আচরণে যা নদী কারণ খুঁজে পেলো সেটা হলো তার মিথ্যা।চারবার এস এস সি ফেইল দেলোয়ার মৃধা মনু নাকি ব্যাংকে চাকরি পেয়েছে । তার মা মাঝেমধ্যে এসে গপ্পো পেড়ে আসে রানুখালার বাড়ি।উদ্দেশ্য কিছুই না ডলারওয়ালি নিশির মায়ের কানে কথাগুলো যেন ওঠে; তো এই হলো মনুর ব্যাংকের চাকরির মূল ঘটনা ।নদীর দিকে না তাকিয়ে মনু মাথানত করে টেবিলে খাবার সাজিয়ে রাখছে।
” টিস্যু কই রাখবো ম্যাডাম? ”
মনুর কথায় নদী কী জবাব দেবে বুঝলো না।
” এক জায়গায় রেখে বের হও।এত জিজ্ঞেস করার কী আছে?” নুরুলের কথায় মনু বের হয়ে গেলো। “তাইলে খান আপনে কিছু লাগলে বইলেন।”
নুরুল নড়ার নাম নেই।এদিকে নদীর বিরানির গন্ধে গা গুলিয়ে আসছে। তারপর নুরুলের স্থিরদৃষ্টি। এই লোক কি তার সামনে এভাবেই বসে থাকবে? তার সরু দৃষ্টির চাহনি দেখে একটা জিনিস বুঝল তিনি আছেন’ মূলত নদীকে পাহারা দিতে। এর কারণও বের আন্দাজ করলো,ঘরময় নায়িকা ম্যাডামের জিনিসপত্র ছড়ানো। নদী কিছু চুরি না করে বসে। এই যুক্তি খুঁজে একটু আশ্বস্ত হলো নদী।
” কই উঠেন? “নুরুল নদীকে উঠে দাঁড়াতে দেখে জিজ্ঞেস করছে।
” হাতটা ধুয়ে আসি।? ”
নদী বাথরুমে চলে গেলো। হাতই নয় মুখও ভালো মতো ধোবে৷ খিদেয় পেট চনমন করছে, যদিও সে জানে সামনে বিরানির কোয়ালিটি অতি জঘন্য।চাল ভালোমতো ফোটেনি মাংসও কাঁচা। এটাও তার বিশেষ গুণ গন্ধ নিয়ে বুঝতে পারে খাবারের মান কতটুকু ভালো। কিন্তু এখন আর ভালো মন্দ বিচারের অবস্থা নেই। খেয়ে কাজে নেমে যাবে। এক সিটিংয়ে পাঁচ হাজার টাকা পাবে। মন্দ কী? এই কাজটা উঠে গেলে অনেকটা শক্ত হয়ে দাঁড়ানো যাবে।দশজনকে বলা যাবে রোমানার মেকাপ করেছে।
“নদী কিছু খেয়ো না, বিরানি কোকে ওষুধ মিশানো। আনোয়ারার সাথে এইখানে যে মেয়ে আসে তারা ফেরত যায় না। ”
মুখ ধোবার আগে টিস্যু পেপারের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নদী৷ মনে হচ্ছে তার পা দুটো ক্রমে জমিতে ধসে যাচ্ছে।
#শারমিন_আঞ্জুম
#বাতাসে_তার_সৌরভ–১