ভালোবাসা আমার পর্ব ৩

0
431

#ভালোবাসা_আমার
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ০৩

আমার অসুস্থতার কয়দিন আমার বেশ খোঁজ খবর নিয়েছে ওঁ। রাত নেই, দিন নেই বাড়িতে এসে হাজির হয়েছে। আমি কিছু বললেই কটু কথা শুনিয়ে দিত। একটু সুস্থ হবার অপেক্ষা করছিল হয়তো। এখন এই কড়া কথা বার্তা শুনিয়ে আমাকে আরও অসুস্থ করে দেবে।
একদিন রাতে শোয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। হঠাৎ ফোন বেজে উঠল। ভ্রু কুঁচকে হাতে নিতেই অপরিচিত নম্বর চোখে পড়ল। সচরাচর অপরিচিত নম্বর রিসিভ করি না আমি। তবুও কি ভেবে রিসিভ করলাম।

“আসসালামু আলাইকুম। কে বলছেন?”

ওপাশ থেকে সালামের জবাব এলো না। বরং কর্কশ কন্ঠে বলল,

“আরভিনের থেকে দূরে থাকবেন।”

আমি ঠিক চিনলাম না। অবাক হলাম এমন আচরণে। জোরালো কন্ঠে বললাম,

“কে আপনি?”

“আমি তিন্নি।”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম,

“আমার নম্বর কোথায় পেয়েছ তুমি?”

“সেটা আমি আপনাকে বলতে বাধ্য নই। আপনি আমার আরভিনের থেকে দূরে থাকবেন। আপনার জন্যই আমাদের মাঝে দূরত্ব সৃষ্টি হচ্ছে। আর আপনিও কেমন নির্ল’জ্জ! জানেন ওর গার্লফ্রেন্ড আছে, তবুও ওর পেছনে ঘোরেন।”

আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। জবান যেন আটকে গেল। শক্ত কোনো জবাব দিতে যেয়েও পারলাম না। তিন্নি আরও কত কি বলল। আমি শুনলাম না, কেটে দিলাম। সারারাত ধরে ভেবে আমি দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করলাম। ওঁর থেকে দূরে থাকব। এতে যদি বেস্ট ফ্রেন্ডের তকমা মুছে যায়, তবুও।

ক্লাসের মধ্যে বসে আবারও একবার নিজের প্রতিজ্ঞার কথা স্মরণ করে নিলাম। আমি আজ দ্রুতই চলে এসেছি। ওঁ আসেনি এখনও। গিয়েছে হয়তো গার্লফ্রেন্ড কে পিক করতে। তাদের সম্পর্কের প্রায় এক বছর হতে চলল। সম্পর্ক হবার পর থেকেই ধীরে ধীরে আমার কদর কমে এসেছে। আগে রোজ আমাকে বাড়ি থেকে নিতে যেত আবার দিয়েও আসত। এখন তা অন্য জায়গায় শিফট হয়েছে।

যখন ওঁ আমার আশে পাশে থাকে তখন যেন আমার অনুভূতি গুলো লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে বেরিয়ে আসতে চায়। তো আমাকে দূরে থাকার চেষ্টা করতে হবে। হঠাৎ দেখলাম আমাদের ক্লাসের টপার সে ক্লাসে প্রবেশ করে বরাবরের মতো ফার্স্ট বেঞ্চে বসল। কিছু একটা ভেবে আমি উঠে গেলাম। গিয়ে বসলাম তার পাশে। সে ঘাড় বাঁকিয়ে আমাকে দেখে একটু হাসল,

“আরে মৌহি! তুমি!”

আসলে ক্লাসে সব সময় ওঁ আর আমি একসাথে মাঝের দিকের বেঞ্চে বসি। কখনও আমাদের সিট চেঞ্জ হয় না। তাই অবাক হয়েছে। আমি মৃদু হেসে বললাম,

“বসে পড়লাম। তোমার অসুবিধে হবে না তো?”

সে তড়িঘড়ি করে বলল,

“আরে না না, সমস্যা নেই। তুমি তো কখনও সামনে বসো না, তাই জিজ্ঞেস করলাম।”

“আচ্ছা বাদ দাও। কেমন আছ বলো?”

সে চশমা ঠেলে বলল,

“বেশ আছি। তুমি কেমন আছ?”

আমি ভালো নেই। একদমই ভালো নেই। তা কি আর বলা যায়? ঠোঁটে মিথ্যে হাসি ঝুলিয়ে বললাম,

“ভালো। আসলে সাঈদ কি বলো তো? আমার একটা টপিকে সমস্যা আছে। তুমি কি একটু বুঝিয়ে দেবে?”

সাঈদ আবারও হেসে বলল,

“কেন নয়?”

ক্লাস শুরুর এখনও পনেরো মিনিট বাকি আছে। এর মধ্যে সাঈদ সব বুঝিয়ে দেবে। না বোঝাতে পারলেও আমার কোনো সমস্যা নেই, কারণ আমি বাহানা দিয়েছি মাত্র সামনে বসার জন্য। ক্লাসে মোটামুটি ভালো পারলেও আমি সামনে বসি না বলে অনেকে অনেক কথা বলে। আজ তারা আমাকে দেখে অবাক হয়েছে। ক্লাস শুরু হবার ঠিক দু মিনিট পূর্বে ওঁ ক্লাসে ঢুকল। কোনো দিকে খেয়াল না করেই মাঝের বেঞ্চে গিয়ে বসল। আমি দেখেও দেখলাম না। কিছুক্ষণ পর শুনতে পেলাম,

“এই? মৌ আসেনি?”

“এসেছে তো। ওই যে সামনে সাঈদের পাশে।”

না তাকিয়েও আমি বুঝলাম যে ওঁ অবাক হয়েছে। পরপরই পেছন থেকে ডাকল,

“মৌ? এই মৌ? সামনে কি করছিস? জায়গায় আয়।”

এমন ভাবে ডাকছে যেন ওঁর পাশে বসার জায়গাটা আমার জন্য সারাজীবনের জন্য বরাদ্দ। আমি শুনলাম না। ফিরেও তাকালাম না। এমন ভাব করলাম যে, এখন আমার চার পাশে সাঈদ ছাড়া কেউ নেই। সাঈদের বিরক্তিকর পড়া ছাড়া আমি আর কিছুই শুনতে পাচ্ছি না। ওঁ আরও ডাকল কয়েকবার। শেষের বার মনে হচ্ছিল রেগে গিয়েছে। তবে স্যার এসে যাওয়ায় তেমন কিছু করতে পারল না। পুরোটা ক্লাস আমরা দুজন দুই প্রান্তে থেকে কাটালাম।
সব গুলো ক্লাস শেষ হলো। সাঈদের সাথে আজ খুব কথা বললাম। হাসাহাসিও করলাম। ক্লাস থেকে বের হতে নিলেই ওঁ পথ আটকাল। এক পলক সাঈদের দিকে তাকিয়ে বলল,

“তোর সাথে আমার কিছু কথা আছে, মৌ। চল।”

আমি মুখের উপর মানা করে দিয়ে বললাম,

“তোর কথা পরে শুনব। আমি এখন যেতে পারব না। লাইব্রেরীতে কিছু কাজ আছে। চলো সাঈদ।”

ওঁকে সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করে আমি সাঈদের সাথে লাইব্রেরীতে চলে গেলাম। ভালোবাসা তো কমাতে পারব না, কিন্তু যোগাযোগটা আমাকে কমাতে হবে।

আজকাল যেন ওঁর কল দেওয়ার মাত্রা বেড়ে গিয়েছে। আমি রিসিভ করি না। ফোনটা বাজতে বাজতেই বন্ধ হয়ে যায়, আবার বাজে। আমি ওঁর থেকে এক প্রকার পালিয়ে বেড়াচ্ছি। হন্যে হয়ে খুঁজছে আমাকে, যেন হাতের মুঠোয় পেলেই গলা টি’পে দেবে! বাড়িতে এসেও হাজির হচ্ছে। তবে ওঁ এলে আমি রুম থেকে বের হই না। হাজার ডাকাডাকি করলেও আমি কানে তালা মে’রে পড়ে থাকি। আজ রাতে ফোন এলো। মা সামনে ছিল বলে কিছু করতে পারলাম না। রিসিভ করে কানে ঠেকালাম। কোনো শব্দ পেলাম না। কেমন যেন ঘনঘন নিঃশ্বাসের শব্দ পেলাম। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। আমি আলতো স্বরে বললাম,

“কি হয়েছে?”

“তুই আমার ফোন রিসিভ করিস না, আমার সাথে কোনো যোগাযোগ করছিস না কেন, মৌ? আমি কি করেছি?”

করুণ কন্ঠ। এলোমেলো হয়ে যায় আমার সব। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বললাম,

“আমি ফোনের পাশে থাকি না তেমন। যোগাযোগ বন্ধ করলাম কই?”

“আমি তোর বাড়িতে গেলেও আমার সামনে আসিস না। কি হয়েছে তোর?

“আরে তুই তো অসময়ে আসিস। তখন আমি ঘুমিয়ে থাকি, তাই।”

“ভার্সিটিতেও আসছিস না!”

“এমনি, ইচ্ছে করে না।”

একটু নীরব রইল। পরপরই বলল,

“তিন্নি হুট করেই বিয়ের জন্য জোরাজুরি করছিল। বললাম আমার পড়াটা শেষ হোক। কিন্তু ও রাজি হলো না। আমি নাকি দিনকে দিন কেমন হয়ে যাচ্ছি! বাবা মাকে পাঠিয়েছিলাম। তারা তিন্নিকে পছন্দ করেছে এবং বিয়ের তারিখ পাকা করে এসেছে।”

বুকের মধ্যে কামড়ে উঠল যেন। দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়ল। আমি ঢোক গিলে মৃদু স্বরে বললাম,

“তাই নাকি! এ তো অনেক খুশির খবর। তোর জন্য খুব খুশি আমি। এই খরবটা দিতেই বুঝি এতো কল করতিস? তা বিয়ে কবে?”

“সামনের শুক্রবার।”

আজ শুক্রবার। আর ওঁর বিয়ে সামনের শুক্রবার। ওঁ আবার বলল,

“তুই আসবি তো, মৌ? তুই কালই চলে আয়। মা তোকে আসতে বলেছে।”

চোখের কোণে আসা জলটুকু সন্তর্পনে মুছে নিলাম। কন্ঠে আফসোস মিশিয়ে বললাম,

“স্যরি রে। আজই গ্রাম থেকে ফোন এসেছিল। দাদী খুব অসুস্থ। আমাদের সবাইকে দেখতে চেয়েছে। সেখানে যেতে হবে। কীভাবে তোর বিয়েতে যাই বল?”

ওঁ একটু মিইয়ে যাওয়া কন্ঠে বলল,

“আমার বিয়েতে আমার বেস্ট ফ্রেন্ড আসবে না?”

“আমি নাহয় অন্য একদিন যেয়ে কব্জি ডুবিয়ে তোর বউ এর হাতের রান্না খেয়ে আসব। তোর আগামী জীবনের জন্য শুভকামনা। আচ্ছা এখন রাখি, মা ডাকছে।”

নিজের কান্না জড়িত কন্ঠ এড়িয়ে যেতে আমি ফোন কেটে দিলাম। ওঁকে শুভকামনা জানাতে যেয়ে আমার শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসছিল তা বুঝতে দিলাম না। মা রুম থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন কিছু মুহূর্ত পূর্বেই। নাহলে এতো মিথ্যে সাজিয়ে বলা সম্ভব হতো না। উঠে দাঁড়িয়ে রুমের দরজা বন্ধ করে এলাম। একান্ত সময় চাই আমার। নিজের কান্না, কষ্ট গুলো বের করতে চাই আমি। ওয়াশ রুমে ঢুকে গেলাম। তীব্র গতিতে শাওয়ার অন করে নিচে বসে পড়লাম। মুহূর্তেই চোখের জল আর শাওয়ারের জল মিশে যেতে লাগল। কাঁদলাম আমি, খুব কাঁদলাম। সে কান্নার শব্দ নেই। আছে শুধু কষ্ট, বিষাদ। তিন বছর ধরে যাকে নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবেসে এলাম, সে এখন অন্য কারো। তাকে আর ভালোবাসার অধিকার থাকবে না আমার। তাকে তো অন্য কেউ ভালোবাসবে। আচ্ছা? আমার মতো কি ভালোবাসতে পারবে? আর আমিই বা কি করে থাকব ওঁকে ভালো না বেসে?

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here