#মিঠা_রোদ
#পর্ব:৪১
#লেখা:সামিয়া_খান_প্রিয়া
কবীর শাহ কী আদৌ তোশাকে ভালোবাসে?নাকী অন্তরালে যে অনুভূতি রয়েছে সেটা মোহ মায়া?এমন নিবিড় প্রশ্নের উদয় তোশার মনে এইতো ঘন্টা দুয়েক আগে থেকে হচ্ছে।উল্লাসের দেওয়া স্প্রে এর প্রতিক্রিয়া শেষ হতে চারটে ঘন্টা সময় লাগলো।কখন বাসায় কীভাবে এসেছে সেগুলোর হদিশ নেই।তবে তার মামীর ভাষ্যমতে উল্লাসের সেক্রিটারী এসে দিয়ে গিয়েছে।তোশা ভেবেছিল কবীর শাহ হয়তো জানেনা।ইনিয়ে বিনিয়ে অজ্ঞান হারানোর ঘটনা বলে ম্যাসেজ করলো।কিন্তু আশ্চর্য সিন করে রেখে দিলো মানুষটা।অবজ্ঞায় কান্নাও আসছেনা তোশার।
“তোশামণি,উঠো তোমার আব্বু ফোন করেছে।কথা বলে নাও।”
বাবার কথায় লাফ দিয়ে উঠে বসলো তোশা।তাহিয়া বুঝতে পারে এসব খুশি হওয়া নিছক অভিনয়।মেয়েটা কীভাবে যে মা-বাবা দুজনের মন রক্ষা করে চলল কে জানে?
“হ্যালো আব্বু।কেমন আছো?”
মায়ানের জবাব দেওয়ার পূর্বে তাহিয়া উঁচু সুরে বলল,
“তোশামণি,বাবাকে বলে দিও তোমার নিজস্ব ফোন আছে।সেখানে পরের বার কল করে যেন।”
মায়ান অস্পষ্ট কথাগুলো শোনার জন্য শুধালো,
“কী বলে গেলো তোমার মা?”
“আমার ফোনে কল দিতে বলল।”
“কেন?ওর ফোনে কী সমস্যা?”
“সমস্যা নেই।তবে পছন্দ করে না হয়তো।কেমন আছো বললে না?”
তোশা খেয়াল করলো তার বাবা মুখে মেকি হাসি তুলে কথা এগিয়ে যেতে লাগলো।কথার এক ফাঁকে মায়ান অন্যরকম একটি প্রসঙ্গ তুললো।যা মটেও মেয়ের সঙ্গে আলাপ করার মতোন নয়।
“শুনেছি তাহিয়া পুনরায় বিয়ে করবে?তুমি জানো কিছু আম্মু”
“তাই?এসব কথা কে বলল তোমাকে?কবীর শাহ?”
“না।কবীর ওরকম নয়।তাছাড়া তুমি ওকে নাম ধরে কেন ডাকছো?”
“এমনি এমনি।তাহলে আসিফ আঙকেল?”
“না।আমার মন বলল।”
বাবার কথায় প্রাণখোলা হাসে তোশা।কী সুন্দর মানুষ নিজের ধারণাকে সত্য প্রমাণের চেষ্টায় মত্ত্ব থাকে।তোশা আরেকটু ঘটনাটি উ’স্কে দিতে বলল,
“মায়ের বিয়ে আমি দিতে চাই।পাত্র ঠিক করা।আসিফ আঙকেল।কিন্তু মা তো বুঝতেই চায়না।তুমি আসবে তখন মায়ের বিয়ে ধুমধাম করে দিবো।কী বাবা আমার সাথে থাকবে তো?”
“আসিফ ভাই?সত্যি তাহিয়া পছন্দ করে তাকে?”
“করবেনা কেন?মাথা ভর্তি চুল আছে,স্বাস্থ্য ভালো।একজন ভালো লিডার।তাছাড়া ব্যাচেলরও বটে।”
“ওহ।”
মায়ানের মনটা খারাপ হয়ে গেলো।কারণ একে তো তার মাথার চুল উঠে যাচ্ছে দ্বিতীয়ত স্বাস্থ্য রোগাটে।এবং মটেও ব্যাচেলর না।দীর্ঘ এক শ্বাস বের হয়ে এলো মায়ানের বুক চিড়ে।নিজেকে মটেও মেইনটেইন করতে পারেনা অথচ কবীর,আসিফ নামের পুরুষের কীভাবে পারে?বড় প্রশ্ন।তোশা ভেতরে ভেতরে হেসে শে’ষ হয়ে যাচ্ছে।নিজের বাবার সঙ্গে এমনটা করতো না।যদি না মায়ের বিয়ে নিয়ে আগ্রহ দেখাতো।তোশার কোথাও মনে হয় মায়ান তাহিয়ার সঙ্গে বিরাট অন্যায় করেছে।আগুনে আরেকটু ঘি ঢালার জন্য তোশা বলল,
“জানো মায়ের বিয়ে নিয়ে..।”
“বুঝেছি বুঝেছি আম্মু।তোমার অনেক প্ল্যান।আমি তো আসছি কয়েকমাস পর।তখন না হয় এসব নিয়ে আলোচনা হবে।বাই দ্য ওয়ে তোমাকে অভিনেত্রী হিসেবে দেখার জন্য অনেক এক্সসাইটেড আমি।কবে টেলিকাস্ট হচ্ছে?”
“দশদিন পরে।”
“অল দ্য বেস্ট মামুনী।আমি জানি তুমি অনেক সুন্দর কাজ করেছো।”
“না দেখে বললে?”
“আমার মেয়ের প্রতি অগাধ বিশ্বাস আছে আমার।রাখছি পরে কথা হবে।”
মায়ান ফোন রেখে দেওয়ার পর তোশা বিছানাতে শুয়ে অনেকক্ষণ হেসে নিলো।চোখের কিনারাতে জল আসার উপক্রম।একটু পরে কবীরের নাম্বার থেকে ফোন এলো।
“হ্যালো কবীর শাহ।”
“কী ব্যাপার লিটল চেরী?এতো খুশি কেন?”
“আব্বুর সাথে মজা নিয়েছি।”
“কেমন?”
পুরো ঘটনা বিস্তারিত খুলে বলল তোশা।কবীর বিস্মিত হয়ে বলল,
“অবিশ্বাস্য!তুমি সত্যি নিজের বাবার সঙ্গে এমন মজা করেছো?মায়ানের রিয়াকশন কেমন ছিল?”
“মোটামুটি ধরা পড়া লোকের মতোন।আমি বুঝিনা এক্স হলে বুঝি মানুষ ট’ক্সিক হয়ে যায়।যেখানে দেখি সেখানেই এমন।প্রাক্তনেী জীবনে এগিয়ে গেলে কী হয় তাদের?নিজেরা যেন বসে আছে।”
ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তোশা কবীরকে যে দিশাকে নিয়ে খোঁচা দিলো সেটা বেশ অনুধাবন হলো। মেয়েটা দিন দিন স্বভাবে ভিন্ন হচ্ছে।
“আমি তোমাকে কখনো সুন্দর করে ভালোবাসি বলেছি তোশামণি?”
“নাহ তো।কখনো না।ইহ জীবনে না।এতো দিনেও না।এতো সেকেন্ডও না।এতো ঘন্টায় না।”
“দেখা করবে আজ?”
তোশা গলা উঁচু করে জানালার বাহিরে তাঁকালো।রাত হয়ে গিয়েছে।এখন বের হওয়া অনেক কঠিন।
“কালকে করবো।”
“আজকেই।ধরো আমি যদি টিনেজারদের মতোন রাতে পাইপ বেয়ে ছাদে এসে দেখা করি?খুশি হবে তুমি?”
“আপনি এমনটা করবেন?হুঁ নির্বোধ নই আমি।”
কবীর স্মিত হাসলো।তোশাকে রা’গা’নো’র জন্য বলল,
“প্রেমিক হিসেবে সত্যি কবীর শাহ নিরামিষ।সঙ্গে তোশমণি নির্বোধ কন্যা।”
(***)
অসময়ে ভীষণ ঝড় এলো।শব্দ করে জানালার পর্দাগুলো উড়ছে।বৃষ্টির পানির ঝাপটা ঘরে এসে পড়ছে।তোশা উঠে বসলো।ঘড়িতে এখন রাত দুটো বাজে।মা কে পাশে না পেয়ে অবাক হলো।পরক্ষণে মনে হলো ঘুমানোর সময় তাহিয়া অন্য রুমে চলে গিয়েছিল।তোশার ঘুমটা এখনও কাঁটেনি।ধীরে ধীরে নিজের ফোনটা সামনে নিয়ে চমকে উঠলো।স্ক্রীনে কবীর শাহ এর নাম্বার।সঙ্গে ছাদে আসার জন্য অসংখ্য ম্যাসেজ।তোশার সেসব দেখে মাথায় হাত।কোনোমতে ওড়না গায়ে জড়িয়ে ছাদের উদ্দেশ্যে দৌড়ে গেলো।ছাদের মধ্যে আলো ফেলে তোশা দেখলো কবীর শাহ এখনও রেলিঙ ধরে দাঁড়িয়ে আছে।তোশা লাইটটা অফ করে একপাশে রেখে দিলো।অন্ধকারে শক্ত লোহার মতোন শরীরটাকে স্পর্শ করলো।ভিজে গেলো কবীরের সিক্ত দেহের স্পর্শে।
“আপনি সত্যি এসেছেন কবীর শাহ?কতোক্ষণ হলো এসেছেন?”
“দেড় ঘন্টা আগে।জানো তো সিনেমাতে নায়কেরা এরকম বৃষ্টি রাতে নায়িকার সঙ্গে দেখা করতে আসে।বৃষ্টির দিন তো শেষ হয়ে আসছে।ওয়েদার রিপোর্ট অনুযায়ী আজ অসময়ের বৃষ্টি হওয়ার কথা ছিল দেখে চলে এলাম।তোমাকে নিয়ে ভিজবো,গাইবো,আর ভালোবাসি বলবো।”
তোশার অধরযুগল প্রশস্ত্ব হয়ে গেলো।কবীর শাহ মানুষটা তো এমন নয়।অহংকারী, বদমেজাজি মানুষ।তবে আজ কী হলো?উল্লাসের কথা মনে হতে সেটা বলতে যাবে তখন কবীর শাহ নিজ থেকে বলল,
“উল্লাস আমার পরিচিত।কিছুটা পাগলাটে।তোমার সঙ্গে এমন করার কারণ তুমি ঘুরে অজ্ঞান হওয়ার কথাটি নিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলে।আমি কী এতোটা অবহেলা করেছি তোমাকে যে এভাবে প্রয়োজনীয়তা অনুভব করাতে হবে?”
“তাতে কী কাজ হয়নি?”
“নাহ।আমি আজ এসেছি তুমি কতোটা স্পেশাল সেটা অনুভব করানোর জন্য।কবীর শাহ তার মধ্য বয়সে এসে একজনকে ভালোবেসেছে।সে সবথেকে দামী।সেটা তাকে নিজের ক্ষতি করে বুঝতে হবেনা।আমি তোমাকে সরাসরি কখনো তেমনভাবে নিজের ভালোবাসার কথা বলিনি।কিন্তু আজ চাই বলতে।”
যদিও অন্ধকার কিন্তু তোশা মনে হয় স্পষ্ট দেখতে পেলো কবীরের চোখে তার জন্য ভালোবাসা।মানুষটি এগিয়ে এসে তোশাকে আলিঙ্গন করলো।মুখোমুখি দাঁড়া করিয়ে বলল,
“তোমায় আমি দেখেছিলাম ব’লে
তুমি আমার পদ্মপাতা হলে;
শিশির কণার মতন শূন্যে ঘুরে
শুনেছিলাম পদ্মপত্র আছে অনেক দূরে
খুঁজে খুঁজে পেলাম তাকে শেষে।
নদী সাগর কোথায় চলে ব’য়ে
পদ্মপাতায় জলের বিন্দু হ’য়ে
জানি না কিছু-দেখি না কিছু আর
এতদিনে মিল হয়েছে তোমার আমার
পদ্মপাতার বুকের ভিতর এসে।
তোমায় ভালোবেসেছি আমি, তাই
শিশির হয়ে থাকতে যে ভয় পাই,
তোমার কোলে জলের বিন্দু পেতে
চাই যে তোমার মধ্যে মিশে যেতে
শরীর যেমন মনের সঙ্গে মেশে।
জানি আমি তুমি রবে-আমার হবে ক্ষয়
পদ্মপাতা একটি শুধু জলের বিন্দু নয়।
এই আছে, নেই-এই আছে নেই-জীবন চঞ্চল;
তা তাকাতেই ফুরিয়ে যায় রে পদ্মপাতার জল
বুঝেছি আমি তোমায় ভালোবেসে।
–জীবনানন্দ দাশ
কবিতাটি বৃষ্টি রাতে কবীর শাহ এর কণ্ঠে অন্যরকম শোনালো।কী হতো কবি যদি আরো কয়েকটি ছন্দ মিলাতো।অবশেষে তোশার জীবনে সেই সত্য সময়টি এলো।কবীর আস্তে করে বলল,
” আমি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি তোশামণি।”
“আমিও আপনাকে ভালোবাসি কবীর শাহ।অনেক বেশী।”
দুজনের মুখে সুন্দর এক হাসি।সিক্ত সমীরণের সঙ্গে উষ্ণ শ্বাস মিলে যাচ্ছে।কিন্তু ছাদের দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা কল্লোলের মুখখানি মেঘে জড়িয়ে গেলো।তার ভালোবাসায় দেখা তোশামণি কাওকে ভালোবাসে?আর সেটা কীনা বাবা-মায়ের বন্ধু কবীর শাহ!
চলবে।
এডিট ছাড়া পর্ব।না তোশা কবীরের কোথাও শান্তি নেই।সকল পাঠক সর্বোচ্চ রেসপন্স করলে আগামীকালও দিবো।