#চুপিচুপি_ভালোবাসি
(পর্ব ১৫+১৬)
#আয়েশা_আক্তার
·
·
·
রাত ১০ টা,,
আমার ঘরে সবাই মিটিং এ বসেছে। আমার আব্বুরা ৩ ভাই,৩ বোন। আমার আব্বু সবার ছোট। দুই জেঠুর ই দুইটা করে ছেলে আর আমরাই দুই বোন। এর মধ্যে বড় জেঠুর দুই ছেলের সাথে আমার কোন মিল নেই বললেই চলে। তাদের সাথে সাড়া বছরে মাত্র একবার দেখা হয় আমার। দুজনেই বাইরে সেটেল্ড। ছোট জেঠুর দুই ছেলে জিহাদ ভাইয়া আর আহাদ ভাইয়া দুইজনের সাথেই আমাদের দুই বোনের সম্পর্ক একদম আপন ভাই বোনের মতো। ছোটবেলা থেকেই ঝগড়া, মারামারি, হাসি মজায় একসাথেই বড় হয়েছি। আজ বড় জেঠুর ছেলেরা বাদে সবাই এসেছেন আমাদের বাড়িতে। কুরবানীর ঈদ উপলক্ষে সবাইকে ডেকেছেন আব্বু। সবাই এখানেই কুরবানী করবে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আমার আব্বু। সবার জোট হলেও আব্বুর কথা সবাই শোনে। ৩ ফুপি-ফুপা, তাদের ছেলেমেয়ে মোটকথা একটা রমারমা পরিবেশ আমাদের বাড়িতে। কোন উৎসব বাড়ির থেকে কম লাগছে না। আমরা কয়েকজন কাজিন মিলে এককোণে বসে আছি। জিহাদ ভাইয়া, আহাদ ভাইয়া, নয়ন, তিশা, ইমরান ভাইয়া বাদে সবার ই বিয়ে হয়ে গিয়েছে। আপুরা তাদের জামাইয়ের পিছনে ছুটছে, আর ভাইয়ারা তাদের বউদের পেছনে ছুটছেন। আর বড়রা বসে কথা বলছে। উনাদের কথার বিষয়বস্তু যে আমি সেটা এতোক্ষণে বোঝা হয়ে গিয়েছে আমার। মেজো ফুপা আমার বিয়ের ব্যাপারে কথা তোলার পর থেকেই এনাদের মিটিং শুরু হয়েছে। বললে ভূল হবে না যে ফুপার মুখে আমার বিয়ের কথা শোনার পর থেকে আমার থেকে বেশি জেঠু ফুপিরাই বেশি রেগে গিয়েছেন। তারা কিছুতেই এতো তাড়াতাড়ি আমার বিয়ে দিবেন না। বাড়ির সবার আদরের মেয়ে আমি। কেন জানি না আমার প্রতি সবার ভালোবাসাটা বরাবরই একটু বেশিই। সেই কখন থেকে সবাই মেজো ফুপা কে কথা শুনিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বড় জেঠিমা মুখ বাঁকিয়ে বসে আছেন। কোন কারনে আমাকে পছন্দ নয় তার। এদিকে জিহাদ ভাইয়া তো আমার কানের কাছে এসে বলেই দিলেন, “দেখ শর্মি! ফুপা একবার তোর বিয়ের কথা বলেছেন কি বলেন নি তাতে সবাই যে ভাবে ফুপার পেছনে লেগে গিয়েছে তাতে যদি তোর বিয়ে হয়ে যায় তখন এরা কি করবে! দেখিস তোর জামাইয়ের কপালে খুব দুঃখ হবে।” ভাইয়ার কথা শুনে আমি কি বলবো বুঝতে পারছি না। আমি গালে হাত দিয়ে সবার মুখের দিকে তাকাচ্ছি। আব্বু, আম্মুও চুপ করে আছে। আল্লাহ এরা তো আর জানে না আমার বিয়ে হয়ে গেছে! জানলে না জানি কি লঙ্কা কাণ্ড বাঁধিয়ে বসবে কে জানে। আব্বু কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর মুখ খুললেন। তিনি বললেন,,
–“শর্মির বিয়ে হয়ে গিয়েছে।”
কথাটা যেন মুহূর্তেই বিষ্ফোরণ ঘটালো। সবাই মুহূর্তেই চুপ হয়ে গেলো। সবাই একবার আমার দিকে আরেকবার আব্বু আম্মুর দিকে তাকাচ্ছে। জিহাদ ভাইয়া তো গোল গোল চোখ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি একদম স্থির হয়ে বসে আছি। নিজেকে কেমন অনুভূতি শূন্য মনে হচ্ছে। কি হবে এবার। সবাই কি এতো সহজে মেনে নেবে ব্যপারটা। হঠাৎ বড় জেঠুর কথায় ধ্যান ফিরলো আমার। উনি আব্বুকে বললেন,,
–“কি বলছিস কি তুই এসব? বিয়ে হয়ে গেছে মানে? তুই আমাদের না জানিয়ে মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিলি?”
আব্বু উত্তর দিলেন,,
–“আমি ভূল কিছু করিনি ভাইজান! ঐ সময়ে যেটা ঠিক মনে হয়েছিল সেটাই করেছি। আর ব্যাপারটা লুকানোর কারণ হলো আমাদের এই সমাজ। ওর বিয়েটা যে আমার ইচ্ছেতে হয়েছে এটা মানুষজন এতো সহজে মেনে নিত না ভাই। ওরা বলতো আমার মেয়ে হয়তো পালিয়ে বিয়ে করেছে কিংবা ওর চরিত্রে আঙুল তুলতো। কারণ এমন হুট করে বেড়াতে গিয়ে আমি আমার মেয়েটার বিয়ে দিয়ে দিয়েছি সেটা ওদের মস্তিষ্কে কখনোই ঢুকবে না। ওরা তিল থেকে তাল করতে একপাও পিছু হটতো না ভাইজান। ওরা কোন না কোন ভাবে আমার মেয়ের নামে বাজে কথা ছড়িয়েই দিতো। আপনাদের বলি নি সবাইকে একসাথে বলবো বলে। তাই আজ এই ব্যাবস্থা। কিছুদিন পর আবার ওদের বিয়ে দিবো আমরা। ততদিন ব্যাপারটা যেমন আছে তেমনি থাক।”
আব্বুর কথাগুলো আমাকে ভাবালো। আব্বু তো ভূল কিছু বলে নি। এইতো কয়েকদিন আগে করিম চাচার মেয়ে কেয়া বাড়িতে একা ছিলো। প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছিল সেদিন। তাই নিজের ঘরে ঘুমিয়ে ছিলো। বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য মমিনুল নামের একটা ছেলে কেয়ার বারান্দায় গিয়ে উঠেছিলো। বৃষ্টি থামলে মমিনুল সেখান থেকে বের হওয়ার সময় কয়েকজন লোক ওকে দেখে ফেলে। আর তারাই ঘটনাটাকে আরো মসলা লাগিয়ে সবার সামনে তুলে ধরে। আর স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া অনুযায়ী সবাই বিশ্বাস ও করে নেয়। তারপরই শুরু হয় সবার কথার ঝুলি। ওরা তো কেয়াকে দুশ্চরিত্রা ট্যাগ লাগিয়ে দিয়েছিলো। একবারের জন্যেও সেদিন সত্যিটা জানার চেষ্টাও করেনি। মমিনুল হাজার বার বলেও কাউকে বিশ্বাস করাতে পারে নি। সবাই ওদের বিরুদ্ধেই কথা বলেছিলো। এমনকি এখনো কেয়ার দিকে সবাই ঘৃণা ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। অথচ কেয়া তো জানতই না কেউ ওর বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলো সেদিন। মমিনুল নামের ছেলেটিকেও ছাড়ে নি এই অপয়া সমাজ। কেয়ার বাবা মা কেও কত কটুক্তি শোনায়। কেয়ার কোন কথাই বিশ্বাস করেনি কেউ। এতো কটুক্তি সহ্য করতে না পেরে মেয়েটা আত্মহত্যা করেছিলো। সেদিন বুঝেছিলাম এই সমাজের মানুষজন কতটা জঘন্য হতে পারে। আমার সাথেও যে এমন কিছু হতো না সেটা কে বলতে পারে। আর কোন বাবাই তার সন্তানকে অসম্মানিত হতে দেখতে পারেন না। মুহূর্তেই চোখ দুটো ভিজে এলো আমার। হয়তো বড় জেঠুও এমন কিছু ভাবলেন। তিনিও আর কিছু বললেন না। কিন্তু বড় জেঠিমা চুপ থাকতে পারলেন না। উনি বলেই বসলেন,,
–“কার না কার সাথে বিয়ে দিয়ে দিয়েছিস কে জানে? ছেলেটা কে যে তোর এই চাপা গায়ের রং এর মেয়েকে বিয়ে করলো?”
উনার কথায় বিন্দুমাত্র খারাপ লাগলো না আমার। আমার পরিবারের সবাই একদম ফর্সা। শুধু আমিই উজ্জ্বল শ্যামা। এটা নিয়ে কখনোই আফসোস হয়নি আমার। অনেকেই বলতো কিন্তু আমার গায়ে লাগতো না আর লাগেও না। তাই আজও আমার কিছুই হলো না। কিন্তু বাকি সবার উপর এর প্রভাব ঠিকই হলো। জিহাদ ভাইয়ার দিকে তাকাতেই দেখলাম রাগী চোখে বড় জেঠির দিকে তাকিয়ে আছে। আব্বু তখন আমাদের ছোটদের উদ্দেশ্য করে বললেন,,
–“অনেক রাত হয়েছে সবাই গিয়ে ঘুমিয়ে পর। যা এখান থেকে।”
আব্বুর কথা মেনে সবাই বাইরে বেড়িয়ে এলাম। যেতে যেতে আব্বুর দৃঢ় কন্ঠ কানে এলো।
–“আমার মেয়েকে আমি যার তার হাতে তুলে দেই নি ভাবি। এমন ছেলের হাতে তুলে দিয়েছি যে ওকে ওর গায়ের রঙ এর কারনে আপনার মতো ওকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে না। যে ওর ভেতরের সত্তাটাকে সম্মান করে, ওকে ভালো,,,,
আর কিছু কানে এলো না আমার। ততক্ষণে নিজের রুমের পাশে চলে এসেছি আমি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের ঘরে চলে এলাম। বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই রাজ্যের ঘুম চলে এলো। তলিয়ে গেলাম গভীর ঘুমে।
🍁
ভোর ৪ টা বেজে ৫০ মিনিট। এখনও ভোরের আলো ফোঁটে নি। ঠান্ডা ঠান্ডা বাতাস বইছে চারিদিকে। আকাশে মেঘ খেলা করছে। ছাদের এককোণে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছি আমি। আমি একা নই, জিহাদ ভাইয়াও আছে। আমি ভাইয়ার আকাশের দিক থেকে চোখ সরিয়ে ভাইয়ার দিকে তাকালাম আমি। ভাইয়া স্থির দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। ঘুম থেকে উঠতেই ভাইয়া কল করে ছাদে আসতে বললেন। কেন ডাকলেন জিজ্ঞেস করেছি অনেক্ষণ কিন্তু ভাইয়া নিশ্চুপ। কিছুক্ষণ পর ভাইয়া বললেন,,
–“আমার এই ছোট্ট বোনটার নাকি বিয়ে হয়ে গিয়েছে। যে বোনটা কিনা সামান্য আইস্ক্রিম এর জন্য কান্না করে চোখ ফুলিয়ে ফেলতো সেই বোনের কিনা বিয়ে হয়ে গিয়েছে! কিছুদিন পর সে নাকি আমাদের ছেড়ে চলে যাবে।”
ভাইয়ার কথা শুনে চোখ ছলছল করে উঠলো আমার। আমাকে এভাবে দেখে ভাইয়া বলল,,
–“আরে কাঁদছিস কেন? একদম কাঁদবি না। এই তোর বিয়ে কার সাথে হয়েছে রে! আমাকেও তো জানতে হবে যে কে এই পেত্নীকে বিয়ে করেছে। কার কপাল পুড়ল।”
বলেই হাহা করে হেসে উঠলো। এবার আমার রাগ হলো আমি রাগী চোখে তাকিয়ে বললাম,,
–“ভাইইই!”
ভাইয়া হাসি থামিয়ে বললেন,,
–“দ্যাটস লাইক মাই সিস! আচ্ছা এবার এটা বল তোর বরটা কে? তোর সাথে তাকে মাষায় কিনা? আমার পিচ্চি বোনটাকে ভালো রাখবে তো? আমার নয়নের মনিকে কষ্ট দিবে না তো!”
এবার আমি ভাইয়া কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। কিছুক্ষণ পর ছেড়ে দিলাম। এর মাঝেই আমার ফোন বেজে উঠল। ফোনের স্ক্রিনে নির্ভীকের হাস্যোজ্জ্বল মুখটা ভেসে উঠেছে। ভাইয়া ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকালো। ফোনে নির্ভীক ভাইয়ার ছবি দেখে ভ্রু উঁচিয়ে বলল,,
–“নির্ভীক তোকে ভিডিও কল কেন দিচ্ছে তাও আবার এতো সকালে?”
আমি কি বলবো বুঝতে পারছি না। নির্ভীক আমার বর এটা বলতে কেমন লজ্জা কাজ করছে। কিছুক্ষণ মুখ কাচুমাচু করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লাম। তারপর চোখ খিচে বন্ধ করে বললাম,,
–“উনিই আমার বর!”
বলেই দৌড়ে চলে এলাম ওখান থেকে। এক দৌড়ে নিজের ঘরে এসে দড়জা লাগিয়ে দিলাম। কলটা রিসিভ করতেই নির্ভীকের মুখটা দেখতে পেলাম। উনি মুখে হাসি ঝুলিয়ে বললেন,,
–“ঈদ মোবারক পিচ্চি!”
·
·
·
চলবে………………………….
#চুপিচুপি_ভালোবাসি (পর্ব ১৬)
#আয়েশা_আক্তার
·
·
·
কারোর ডাকে ঘুম ভাঙলো আমার। তখন নির্ভীকের সাথে কথা বলতে বলতে কখন যে ঘুমিয়ে গিয়েছি টের ও পাইনি। বড় একটা হাই তুলে ঘুমু ঘুমু চোখে সামনে থাকা ব্যাক্তিটার দিকে তাকালাম। আখি আপু(ফুপাতো বোন) কোমড়ে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আপু কে দেখে মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে বললাম,,
–“গুড মর্নিং অপু।”
আপু গর্জে উঠে বলল,
–“এখনও ঘুমোচ্ছিস তুই? কয়টা বাজে সে খেয়াল আছে? বলি আজকে ঈদ সেকথাও কি ভূলে গিয়েছিস নাকি? তাড়াতাড়ি ওঠ মামা নামাজে গিয়েছেন, এসে যদি দেখে তুই এখনও ঘুমোচ্ছিস তাহলে হুলুস্থুল কাণ্ড বাঁধিয়ে দিবে। তাড়াতাড়ি উঠে পর। আমি গেলাম।”
এতো টুকু বলে আপু চলে গেল। আপুর কথা শুনে আমি তড়িঘড়ি করে ফোনের দিকে তাকালাম। ৯ টা বাজে! আল্লাহ এতো বেলা হয়ে গিয়েছে অথচ কেউ কিছু বলেই নি। তাড়াতাড়ি উঠে সোজা ওয়াশরুমে গিয়ে গোসল করে নিলাম। ঈদের দিন সকাল সকাল গোসল না করলে আম্মুর ঝাড়ি খেতে হবে আমায়। গোসল করে কি পড়বো সেটা নিয়ে চিন্তা করছি। আজ শাড়ি পড়তে ব্যাপক ইচ্ছে করছে। আচ্ছা শাড়ি পড়লে কেমন হয়? পড়েই ফেলি। তো যেই ভাবা সেই কাজ। ওয়াড্রপ থেকে একটা পেঁয়াজি রঙা শাড়ি বের করে গায়ে জরিয়ে নিলাম। চোখে কাজল আর ভেজা চুলগুলো খুলে দিয়ে বাইরে চলে এলাম। বাইরে এসেই দেখি সব আপুরা একদম হুর পরী সেজে বসে আছে। ওদের সাথে মারুফা ও আছে। একেকটাকে কি মারাত্মক দেখতে লাগছে বলে বোঝানো যাবে না। এখানে এনাদের হাসব্যান্ড গুলো থাকলে নির্ঘাত হা করে তাকিয়ে থাকতো এদের দিকে। কিন্তু আফসোস এখন বাড়ির সব ছেলেরাই ঈদের নামাজ পড়তে গিয়েছে। শুধু আপুরাই আছে। আমি যখন আমার আপুদের দেখতে ব্যাস্ত ঠিক তখনই আমার শাড়ির আঁচলে টান পড়লো। পেছনে তাকিয়ে দেখি শাম্মী হাতে লাল রঙা শাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি তাকাতেই মিষ্টি হেসে বলল,,
–“আপু! আমায় শাড়ি পড়িয়ে দিবি?”
আমিও একগাল হেসে দিয়ে ওর শাড়ি নিয়ে নিলাম। যার অর্থ ‘হ্যাঁ পড়াবো তো’। তারপর ওকে নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে শাড়ি পড়িয়ে দিলাম আর হালকা সাজিয়ে দিলাম! ব্যাস অনেক কিউট লাগছে আমার পিচ্চি বোনটাকে। শাড়ি পরে সে তো মহা খুশি। ও সোজা বাইরে চলে গেল।এখন নিশ্চয়ই সবাইকে বলে বেড়াবে, ‘আমাকে শাড়িতে কেমন লাগছে?’
।
বাইরে আসতেই মারুফা দৌড়ে আমার দিকে চলে আসলো? ও হা করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। হা এর সাইজ দেখে মনে হচ্ছে ২/৩ কেজি মাছি অনায়াসে ঢুকিয়ে দেওয়া যাবে। ও গালে হাত দিয়ে আমার চারপাশে ঘুরে ঘুরে আমাকে দেখছে। ওর এমন উদ্ভট ব্যাবহারে কপাল কুঁচকে এলো আমার। এই মেয়ে করছে টা কি? এইভাবে কেন দেখছে আমায়? ও এখনও একই কাজ করে যাচ্ছে। এসব দেখে ওকে বলেই ফেললাম,,
–“কিচ্চে? এমনভাব করতাছোস যেন আমায় প্রথম বার দেখলি তুই?”
আমার কথা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে মারুফা চেঁচিয়ে বলে উঠলো,,
–“শর্মিইই! বেবি তোকে যা লাগছে না! পুরাই ক্রাশ! মেয়ে হয়েও তোর উপর ক্রাশ খাইলাম রে!”
মারুফার চিল্লিনিতে সবাই আমাদের দিকে তাকালো। আমাকে দেখেই সবাই আমার দিকে চলে এলো। তারপর শুরু হলো ভাষণ, ‘শাড়িতে তো বেশ লাগছে তোকে!’ ‘বাহ শর্মি একদম বউ বউ লাগছে তোকে!’ ব্লা ব্লা! আশ্চর্য তো! এরা কি আমার সাথে মজা করছে নাকি? শুধু শাড়িটাই যা পড়েছি। কোন সাজগোজ নেই, না আছে কোন গয়না গাটি! আর এনারা সবাই শাড়ি গয়না পরে যে পুরো পুতুল সেজে আছে তার বেলা। আমি সবার দিকে চোখ ছোট ছোট করে তাকালাম। কিন্তু এতে কারো হেলদোল হলো না। এর মধ্যেই আব্বুর কন্ঠ শোনা গেল। আব্বুর কন্ঠ শুনে সবাই বাড়ির মেইন গেটের দিকে তাকালো। আব্বু, বড় আব্বু বাড়িতে ঢুকছেন। আর ওনাদের পেছনে আসছে আয়াত ভাইয়া আর নির্ভীক। ওদের দেখে আমি রিতিমত অবাক! উনারা কোথা থেকে আসলেন? আয়াত ভাইয়া এক দৃষ্টিতে মারুফার দিকে তাকিয়ে আছে। আর মারুফা ভেঙচি কেটে অন্যদিকে তাকালো। এদের কি আবার ঝগড়া হয়েছে নাকি? আমাকে এইভাবে কনফিউজড হয়ে ভাবতে দেখে মারুফা হালকা ধাক্কা দিলো আমায়। আমি ওর দিকে তাকাতেই ও বললো,,
–“কিরে দোস্ত এই দুই ছেলে আজ এখানে আসলো কেন আবার! আমি শিওর এরা কিছু না কিছু একটা পাকাবেই। আজ নিশ্চয়ই এরা শশুর বাড়ির আদর খেতে আসে নি।”
–“আমিও সেটাই ভাবছি দোস্ত! কিন্তু এরা কি করবে বলতো?”
–“কি জানি কি করে!”
নির্ভীক আর আয়াত ভাইয়া হাসিমুখে সবাইকে সালাম দিলেন। সবাই উত্তর নিলো। বড় জেঠুর দিকে চোখ পড়লো আমার। উনার মুখ দেখে মনে হচ্ছে উনি খুব খুশি। মনে হচ্ছে এমন কিছু হয়েছে যাতে উনি অনেক বড় চিন্তা থেকে মুক্তি পেয়েছেন আজ। উনাকে ছেড়ে চোখ পড়লো নির্ভীকের উপর। উনি কালো রঙের পাঞ্জাবি পড়েছেন যার উপর গোল্ডেন সুতার কাজ করা। চুলগুলো সবসময়ের মতো কপালে এসে পড়েছে। হাত দিয়ে চুলগুলো সরিয়ে দিতেই আমার নজর গেল উনার কপালের ডান সাইডে একদম চুল ঘেসে থাকা কুচকুচে কালো তিলের উপর। কিছুক্ষণ পর সেটা চুলের আড়ালে লুকিয়ে গেল। আচ্ছা এই ছেলেটা কি জানে না উনার গায়ে কালো রং টা মারাত্মক লাগে? হঠাৎ কেউ আমার কাঁধে ধাক্কা দিলো মনে হলো। ঠিক তখনই শুনলাম জিহাদ ভাইয়ার গলা,,
–“এম্নে তাকায়ে থাকিস না বোইন! তোর ই তো জামাই! এম্নে তাকায় থাকলে দেখবি তোর নজরই লাইগা যাইবো!”
আমি রাগী চোখে ভাইয়ার দিকে তাকালাম। কিন্তু এতে তার কোন ভাবান্তর হলো বলে মনে হলো না। ভাইয়া ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে আবার বলতে লাগলো,,
–“এই তোরা কি আজ প্ল্যান করে ড্রেস আপ করেছিস নাকি? নাহলে তোর শাড়ির পারের কালার আর নির্ভীকের পাঞ্জাবীর কালার মিলে গেল কি করে!”
ভাইয়া কথা শুনে আমি নিজের দিকে তাকালাম। ঠিকই তো আমার শাড়ির পাড় তো কালো আর সেটার উপর গোল্ডেন জরির কাজ করা। আর উনার পাঞ্জাবি! হোয়াট আ কোইনসিডেন্স! বাড়ির সবাই নির্ভীকের দিকেই তাকিয়ে আছে। সকলের এমন দৃষ্টি দেখে আব্বু আমাকে বললেন,,
–“শর্মি! নির্ভীক আর আয়াতকে ঘরে নিয়ে যা। মারুফা তুমিও যাও।”
আমি মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে নির্ভীকদের আমার ঘরে নিয়ে এলাম। সাথে মারুফাও এলো। মারুফা আসতেই আয়াত ভাইয়া ওর হাত ধরে কোথাও নিয়ে গেলো। আর নির্ভীক ঠোট কামড়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই হেসে ফেললেন উনি।উনার হাসি দেখে মনে মনে একটা কথাই বলে উঠলাম। “উনার আঁকা বাঁকা দাঁতের মিষ্টি হাসি আমি যে বড্ডো বেশি ভালোবাসি!” এটা ভাবতেই নিজেই চমকে উঠলাম আমি। এটা কি ভাবলাম আমি? আচ্ছা আমি কি সত্যি উনাকে..!!
–“কি ভাবছিস এতো?”
উনার কথায় ভাবনার সুতো ছিড়লো আমার। আমি বললাম,,
–“ভা,ভাবছিলাম আপনি এখানে কি করে আই মিন কখন আসলেন? সকালে তো কিছু বললেন না?”
উনার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম। উনি বললেন,,
–“তোর আব্বুই তো আসতে বলল আমাদের। তাই তো এলাম। যাই হোক এসে ভালোই হয়েছে। এতো বড় একটা সারপ্রাইজ পেলাম।”
–“সারপ্রাইজ?”
–“হুম কিন্তু তুই বুঝবি না। এই তুই চুল মুছতে পারিস না। এখনও চুল দিয়ছ টপটপ করে পানি পড়ছে। খালি চুলগুলো লম্বাই বানিয়েছিস। বাচ্চা মেয়ে কোথাকার। আমার বউটা কিন্তু এমন নয়। সে নিজের খেয়াল রাখতে জানে! আল্লাহ তোর জামাইয়ের কপাল খারাপ রে! নিজের বাচ্চা সামলে বড় করার আগে তোর মতো একটা বাচ্চা বউকে বড় করতে হবে। বেচারা তোর বরটা।”
উনার কথা আমি উনার দিকে চোখ ছোট ছোট করে তাকালাম। আমাকে বাচ্চা মেয়ে বলছে? উফ! কিন্তু আমার তাকানোতে উনার কোন ভাবান্তর হলো না। উনি গামছা হাতে নিয়ে আমার চুল মুছতে লাগলেন। আমি সরে জেতে চাইলেই দিলেন এক ধমক। উফ এই লোকটা খালি ধমকায়! ব্যাটা বেয়াদব। একে তো অভিশাপ ও দিতে পারবো না কারণ যাই বলি না কেন সেটা আমাকেও ভুগতে হবে। ধুর! উনি চুল মুছতে মুছতে বললেন,,
–“শাড়ি পরেছিস কেন? এমন শাড়ি পরে নিয়ে আমার সামনে ঘুরঘুর করছিস এই তোর মতলবটা কী রে? এমন বউ বউ লুক নিয়ে আমার সামনে ঘুরঘুর করে আমার মাথা নষ্ট করতে চাইছিস তুই! এমন করে কিন্তু কোন লাভ হবে না বলে দিলাম। কারন এই ওয়ান এন্ড অনলি নির্ভীকের জন্য তার একমাত্র বউ আছে। এখানে তোর মতো বাচ্চা মেয়ের কোন জায়গা নেই!”
উনার কথা শুনে আমি হাসবো না কাঁদবো বুঝতে পারছি না। আমি কনফিউজড হয়ে উনার দিকে তাকিয়ে আছি।
ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করলাম কিন্তু পারলাম না।
–“মানে?”
–“সেটা তুই তোর একমাত্র বাবার দুইমাত্র মেয়ের মেয়ের মধ্যে বড় মেয়ের একমাত্র শশুরের একমাত্র ছেলের একমাত্র বউকে জিজ্ঞেস কর। সে তোকে এর মানে ভালো করে ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিবে।”
উনার কথায় আমি হা করে তাকিয়ে আছি। আসলে কি বললেন উনি? আমি তো আরো বেশি কনফিউজড হয়ে গেলাম। কি সব বললেন উনি। এটা সম্পর্কের কেমন প্যাচ! আমি হিসাব করতে লাগলাম কিন্তু সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। আল্লাহ!!
·
·
·
চলবে……………………..