নীলিমায় কালো মেঘ
পর্ব_১২
– তোর বউয়ের যে কিছু চলছে আগেই বলেছিলাম। তুই তো তখন শুনলিই না। এবার ঠেলা সামলা। আমি যখন বলেছিলাম তখনও হয়তো খুব বেশি কিছু ঘটেনি, এখন খোঁজখবর নিয়ে দেখ কতদূর কী ঘটেছে? তোর কপালটাই খারাপ, দোস্ত!
– আমার এখনও বিশ্বাস হচ্ছেনা এসব! আমার মনে হচ্ছে কেউ আমার সাথে শত্রুতা করে এ ছবিগুলো পাঠিয়েছে।
– তুই আসলেই একটা গাধা, মানুষ হবি কবে রে? এটা সাধারন একটা ছবি। এডিটিং করে যদি কেউ বানাতে চাইতো তাহলে আরো ভয়ঙ্কর কিছু বানিয়ে তোর কাছে পাঠাতো। তোর জন্য সহ্য করা খুব কঠিন হতো সেটা ! যে এই ছবিটা পাঠিয়েছে সে আসলেই হয়তো তোর শুভাকাঙ্ক্ষী!
– শুভাকাঙ্ক্ষী আবার কে হবে ওখানে? শুভাকাঙ্ক্ষীই যদি হবে তাহলে এভাবে চোরের মত লুকিয়ে কেন আমাকে মেসেজ করছে? সরাসরি কথা বললেই তো পারে!
– হয়তো ভাবনার অফিসের কেউ হতে পারে। তুই নিজেই বলেছিস ভাবনার প্রতি ওর অফিসের অনেক কলিগরা এখন জেলাস ফিল করছে । এটাই স্বাভাবিক। হঠাৎ কোথা থেকে কোথায় পৌঁছে গেছে। তাই বলা যায় ভাবনার অফিসে বন্ধুর থেকে শত্রুই বেশি। আর আজকাল মেসেঞ্জারে কাউকে খুঁজে বের করা খুব কঠিন কিছু না।
– হতে পারে! কিন্তু এখন আমি কি করবো কিছুই আমার মাথায় আসছে না। যদি সত্যি হয়? আমার তো মনে হচ্ছে সব সত্যিই!
– যা করবি ভেবেচিন্তে করবি। তোর পার্সোনাল লাইফে আমি এ ব্যাপারে তোকে কোন সাজেশান দিতে পারব না। তবে যাই করবি ভেবেচিন্তে করবি। আর অবশ্যই ভাবনার সাথে কথা কথা বলা উচিত এ ব্যাপারে তোর। বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের অন্তর্বর্তী যে নেতিবাচক চিন্তা ও অনুভূতি আমাদের যন্ত্রণা বা কষ্টের কারন হয়ে দাঁড়ায় তার নাম সন্দেহ। সন্দেহ নামক ঘূণ পোকা যার মনের ঘরে আশ্রয় নেয় তাকে একেবারে মানসিক যন্ত্রণার চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যায় এবং নিঃশেষ করে ফেলে। এজন্য বলছিলাম ভাবনার সাথে কথা বল। মনে শুধু শুধু কষ্ট পুষে রাখিস না। কথা বললে দেখবি সমাধান কিছু একটা বের হবে।
– কি বলব আর কিভাবে বলব সেটাই তো আমার মাথায় আসছে না। জীবনে এমন দিন আসবে কোনদিন স্বপ্নেও ভাবিনি। সত্যিই যদি এমন কিছু হয় জানিনা, আমি বেঁচে থাকতে পারবো কিনা!
কথাগুলি বলতে বলতে খুব ইমোশনাল হয়ে পড়লো আবির।
আজ অফিসে পৌছাবার কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা অপরিচিত আইডি থেকে পাওয়া মেসেজ পড়ার পর থেকেই খুব অস্থির হয়ে আছে আবির। অফিসের কাজে কিছুতেই মন বসাতে পারেনি। যে ভয় পুষে রেখেছিলো এতদিন, সেই ভয়ই তার দরজায় কড়া নাড়ছে। যে আইডি থেকে
মেসেজ এসেছে ওই আইডির প্রোফাইল লক করা । আইডির ছবি আর নাম দুটিই ছদ্ম। বোঝাই যাচ্ছে কেউ ইচ্ছে করেই নিজের পরিচয় লুকাতে এভাবে মেসেজ পাঠিয়েছে তাকে। এমন একটা ফেক আইডির মেসেজকে কতটা বিশ্বাস করা যায় সে বুঝতে পারছেনা। তারপরেও যে মেসেজ এসেছে সেটা হেলাফেলা করার মতও কোনো মেসেজ না। মেসেজটা এই না হলে বিশ বারের বেশি পড়েছে আবির।
“ এভাবে লাগামহীনভাবে স্ত্রীকে ছেড়ে দেয়াটা নিশ্চয়ই কোনো পুরুষের জন্য খুব সুখকর নয়। বুদ্ধিমান হলে বুঝতেই পারছেন কোন পুরুষের কথা বলতে চাচ্ছি।
আপনার সাথে কথা বলতে আগ্রহী। আপনি আগ্রহ প্রকাশ করলে নক করবেন । “ — আপনার শুভাকাঙ্ক্ষী ।
মেসেজটা যতবার পড়ছে ভয়ে যেন আত্মারাম খাঁচাছাড়া হবার উপায় হচ্ছে আবিরের। সাহস হচ্ছেনা আর কিছু জানার। ভাবতেই গলা শুকিয়ে আসছে তার। ভাবনাকে সে প্রচুর ভালোবাসে। এমন ভয় সে বেশ কিছুদিন ধরে নিজেই পাচ্ছিলো ভাবনাকে নিয়ে। পরক্ষণেই নিজেকেই নিজে সে ধমকে থামিয়ে দিতো! কিন্তু ভাবনার উচ্চ বিলাসী স্বপ্ন , নানান ধরণের পরিবর্তন এগুলি এই সন্দেহকে দিনদিন আরো বাড়াচ্ছে। আর এই মেসেজ যেনো এখন সেই সন্দেহের আগুনে ঘি ঢেলে দিলো।
আবির কী করবে বুঝতে পারছেনা। বারবার উনাকে নক করতে যেয়েও সাহস হচ্ছেনা তার। সত্যিই কী এমন করেছে ভাবনা? তাকে ধোকা দিচ্ছে? নাহ! উনি যাই বলতে চাক কিছুতেই সেগুলি সহ্য করতে পারবেনা সে। এত সাহস তার নেই। ভাবনাকে সে কিছুতেই হারাতে চায়না। ভাবনার সাথে সেই আগের মত সম্পর্কের গভীরতা না থাকলেও ভাবনার প্রতি তার ভালোবাসা মোটেও কমেনি। তার সাথে ভাবনার যে দুরত্ব তৈরি হয়েছে এর জন্য দায়ী ভাবনাই। আবিরের বুক ফেটে যাচ্ছে। সত্যিটা সে কোনভাবেই শুনতে পারবেনা। সে সিদ্ধান্ত নিলো এই অপরিচিত আইডির মেসেজে রেস্পন্স করবেনা। উনাকে ব্লক করে দিবে। কেউ হয়তো তাদের মাঝে দুরত্ব তৈরি করার জন্য এমনটা করছে। কিন্তু কে এমন হবে? তার বা ভাবনার কারোরই এমন কোনো শত্রু নেই।
অসহ্য কষ্টে নিজেকে সামলাতে না পেরে সাতপাঁচ নানান কিছু ভাবতে ভাবতে সে মেসেজের রিপ্লাই করল। যা হবার হবে ! সত্যিটা তাকে জানতে হবে! কতদিন আর এভাবে অন্ধকারে থাকবে সে? কিছুতো নিশ্চয়ই চলছে ভাবনার সাথে। আজ জানলেও জানবে না হয় আরো কয়েকদিন পরে হলেও জানবে। সত্যের কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে যত পালিয়ে থাকতে চাইবে ততই সে এক অজানা কষ্ট আর অবিশ্বাসকে সঙ্গী করে চলার পথকে ভীষণ কঠিন করে ফেলছে দিনদিন।
মেসেজ পাঠানোর বেশ কয়েক ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও ওপাশ থেকে কোনো রেস্পন্স না আসাতে খুব অস্থির লাগছে আবিরের। তবে কি সত্যিই কেউ তার সাথে ফান করছে? সারাদিন অস্থিরতায় কাটানোর পরে সন্ধ্যার দিকে মেসেঞ্জারের টুংটাং শব্দে মোবাইলের স্ক্রীণে চোখ গেলো। মেসেঞ্জার ওপেন করতেই দেখতে পেলো সেই আইডি থেকে বেশ কিছু ছবি সেন্ড করেছে। দুরুদুরু বুকে ছবি ওপেন করতেই ভয় যেন হঠাৎ করে রাগে পরিণত হলো। রাগে সে থরথর করে কাঁপছে । আটটা ছবি সেন্ড করেছে । আর কোনো কথাবার্তা নেই। আবির ছবিগুলি দেখেই সাথে সাথে উনাকে মেসেজ করলো ।
“ জানিনা, আপনি কে! নিজেকে আমার শুভাকাঙ্ক্ষী পরিচয় দিচ্ছেন অথচ লুকিয়ে আছেন। আমি আপনার সাথে কথা বলতে চাই। হয় সরাসরি নয়তোবা ফোনে। সেটা কী সম্ভব? শুধুমাত্র এমন কতগুলি ছবি পাঠিয়ে কারো বিরুদ্ধে আপনি অভিযোগ করতে পারেন না। এমন ছবি এডিটিং করে বানানো যায় “
সাথে সাথে মেসেজের রিপ্লাই আসলো ।
“ভেরি সরি! আমার পক্ষে দেখা করা বা কথা বলা কোনটাই সম্ভব না। এ ব্যাপারে আর কিছুই বলতে চাইনা। আপনি এতটুকুতে যা বোঝার বুঝে নিবেন । কিছু মিনিং বের করতে চাইলে করতে পারেন , না চাইলেও আমার অসুবিধা নেই। আর ছবি যে এডিটিং করা না এটাও বিশ্বাস করা না করা আপনার ব্যাপার। ভালো থাকবেন। “
আবির ছবিগুলিকে জুম করে দেখার চেষ্টা করছে। গত সপ্তাহের ছবি । প্রতিটি ছবিতে ডেট আর সময় উল্লেখ করা। টেবিলের উপর রাখা গ্লাসে যে রেস্টুরেন্টের নাম লেখা সেটা ভাবনার অফিসের কাছেই। ভাবনা খুব হাসি হাসি মুখ নিয়ে রায়হানের সাহেবের সাথে গল্প করছে হয়তো ! সামনে খাবার দাবার রাখা আছে। আবির তারিখটা মনে করার চেষ্টা করছে। ভাবনা সেদিন বাসায় ফিরে বলেছিলো অফিসের পার্টি ছিলো অথচ সেদিন সে তার বসের সাথে ছিলো। আবিরের পায়ের নিচের মাটি সরে যাচ্ছে যেন! কীভাবে ভাবনা এমন করলো? কেনো সে মিথ্যে বলল আবিরের কাছে? সত্যিই কী তবে ভাবনা তাকে ঠকাচ্ছে?
বাসায় ফিরতে ফিরতে আজ বেশ রাত হলো ভাবনার। প্রায় এগারোটা ছুঁইছুঁই । একদিকে অফিসের নানান ঝামেলা আরেকদিকে রাস্তার জ্যাম ।
বাসায় ফেরার সাথেই থমথমে মুখে আবির জিজ্ঞেস করলো , এত দেরী করলে যে!
– এই তো ! অফিসের কিছু ঝামেলা ছিলো। আর রাস্তার খবর তো জানোই। কেমন ছিল সারাদিন তোমার?
– বেশ ভালো। আর কিছু না বলেই আবির সেখান থেকে চলে গেলো।
ভাবনার সাথে খাবার টেবিলেও আর কোনো কথা হলোনা। ভাবনা বিছানায় যেতে যেতে আবির ঘুমিয়ে গেছে। আর কথাই হলোনা ভাবনার তার সাথে। অফিস থেকে ফেরার পর থেকেই খেয়াল করেছে ভাবনা আবিরের মুখটা কেমন থমথমে।
সকালে ঘুম থেকে উঠেই খুব তাড়াতাড়ি মেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো আবির। ভাবনার সাথে সকালেও কোনো কথা হলোনা তার! ভাবনার চোখের দিকে তাকাতেই তার অস্থির লাগছে। কীভাবে মেলাবে চোখ? কী জিজ্ঞেস করবে তাকে? এতটা নীচে কী করে নেমেছে ভাবনা ? সে যে প্রতিনিয়ত তার সাথে মিথ্যে কথা বলছে একথা আবির এখন নিশ্চিত। কোনো সমীকরণই যেন মিলছেনা আবিরের। ভাবনাকে বাচ্চা নেবার কথা বললে সে এভয়েড করে কেনো এবার বুঝতে পারছে সে। জারার জন্য বুকটা ফেটে যাচ্ছে যেন তার। তার কথা না হয় মন থেকে মুছে ফেলেছে তাই বলে মেয়েটার কথাও একবার ভাববেনা ভাবনা? কেমন মা সে? আবিরের দম আটকে আসছে যেন। কাল অনেকবার চেষ্টা করেছে ভাবনার সাথে কথা বলার, কিন্তু মনের সাথে পেরে উঠেনি। কি বলবে ভাবনাকে? যদি সবকিছু সত্যি হয়? যদি ভাবনা মুখের উপর বলে ফেলে সে তাকে ভালোবাসে না! সে তার সাথে থাকতে চায় না! তবে কি বলবে তখন আবির? ভাবনা এভাবে তাকে ছেড়ে চলে যাবে এটা সে চুপচাপ মেনে নিবে? ভাবনা কি জারাকে নিয়ে যাবে নাকি ওর কাছে রেখে যাবে? জারাকে নিয়ে গেলে সে এটা কিছুতেই মেনে নেবে না? নিজেই আবার ভাবে, “ধুর, এসব কি ভাবছি আমি? এমন কিছুই হবে না! ”
রায়হান সাহেবের মন মেজাজ খুব খারাপ। দিন দিন আশার ব্যবহার চরম খারাপের দিকে যাচ্ছে। কথায় কথায় এত বেশি সন্দেহ রায়হানের মানসিক অবস্থাকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে।
অবশেষে বাধ্য হয়ে ডক্টর ফারুককে পরিচয় গোপন করে তার বাসায় দাওয়াত করে আনা হয়েছে। আশা খুব যত্নআত্তি করেছে ডক্টর ফারুকের। ডঃ ফারুকের সামনে আশার ব্যবহার দেখে বোঝার উপায় নেই যে রায়হানের সাথে তার সম্পর্ক কোনভাবেই স্বাভাবিক না। এই ব্যাপারটা শুধুমাত্র ডঃ ফারুকই কেন বাইরের যেকোনো মানুষের কাছেই এটা বোঝা খুব কষ্টকর হবে। রায়হানের কাছে এই মানুষটাকে যেন সম্পূর্ণ অচেনা মনে হয়।
ফারুক সাহেব খুব আলাপি একজন মানুষ। তার সাথে বেশ কথাবার্তা আর গল্পগুজবও করেছে আশা। রায়হান ব্যস্ততার অজুহাত দেখিয়ে ফারুক সাহেবের কাছে আশাকে রেখে তার নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। টুকটাক গল্পের ছলে আশাও খানিকটা ফ্রী হয়েছে ফারুক সাহেবের সাথে। উনি আশার সাথে গল্প করার ফাঁকে ফাঁকে জরুরী বিষয় গোপনে নোট করে নিচ্ছেন।
উনি খুব ভালো করেই ট্রিটমেন্ট এর প্রসেস জানেন। কোন রোগীকে কিভাবে ট্রিটমেন্ট দিতে হবে এটা যে তার আয়ত্তে আছে খুব ভালো করেই আজকে এটা নিশ্চিত হলো রায়হান।
আজ ভাবনা আর আবিরের ছুটির দিন। এই ক’দিন ধরে ভাবনা খেয়াল করছে আবির তার সাথে আবার সেই আগের মত ব্যবহার করা শুরু করেছে। খুব বেশি কথাবার্তা বলে না। এমনকি শেষ কবে তার মুখের দিকে তাকিয়েছে সেটাও মনে পড়েনা ভাবনার। যখনই সে ভাবে সবকিছু হয়তো ঠিকঠাক হয়ে যাচ্ছে ঠিক তখনই নতুন করে আবার ধাক্কা খায় ভাবনা। ভাবনার ইচ্ছে করে আবিরের কাছে তার সমস্যাগুলি জিজ্ঞেস করবে কেন তার সাথে এমন ব্যবহার করে, দিনদিন কেন তার থেকে এভাবে দূরে সরে যাচ্ছে কিন্তু কেন যেন আবার ইচ্ছে হয়না। যে নিজে থেকে দূরে সরে যেতে চায় তাকে জোর করে টেনে আনার কোনো মানেই হয় না। দু’দিন পর পর আবির তার সাথে এরকম আচরণ করবে ভাবনার জন্য এটা মানা খুব কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে ।
মাঝে মাঝে তার মনে হয় বড়দের মনে কষ্ট দিয়ে আবিরকে বিয়ে করাটাই বুঝি তার জীবনের চরম ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। মন খুলে যার সাথে দুটো কথা বলা যায়না তার সাথে সারাটা জীবন কি করে কাটাবে এটাই ভেবে পায়না সে। ক’দিন পরপর কেন এমন করে আবির নিজের কাছে শতবার প্রশ্ন করেও কোন উত্তর খুঁজে পায়না। তবে ভাবনা কিছুটা হলেও বুঝেছে যে আবির তাকে কেন আর আগের মত ভালবাসেনা।
আবির তার চাকরি করা পছন্দ করে না ; তবে সবচেয়ে বড় সমস্যা যেটা মনে হচ্ছে ভাবনার তা হল তার এত ভালো একটা চাকরি আবির কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছে না। এখানে অবশ্য আবিরকে ভাবনা দোষ দেয় না, ছেলেরা এমনই। স্ত্রীকে সারাজীবন ডমিনেট করার চিন্তা, চেতনা, মানসিকতা নিয়েই বেড়ে ওঠে পুরুষ মানুষেরা। এরা জন্মের পর থেকেই যেটা দেখে বেড়ে ওঠে এদের মানসিকতাও ঠিক সেভাবেই এগুতে থাকে।
তবে আবিরকে সে সবার থেকে আলাদা চোখে দেখত। ভাবনা ভাবতো আবির হয়তো অন্য পুরুষদের থেকে কিছুটা হলেও ভিন্ন। তার চোখে নারীর মূল্য শুধুমাত্র একজন নারীই নয়, একজন মানুষ হিসেবে। স্বামী স্ত্রীর থেকে বেশি বেতনের বা ভালো পোস্টে চাকরি করছে নাকি স্ত্রী স্বামীর থেকে ভালো পজিশনে আছে এটা কেন একজন মানুষকে মূল্যায়নের মাপকাঠি হবে? যে যার যোগ্যতা অনুযায়ী যোগ্য স্থানে থাকবে এটাই স্বাভাবিক। এই সম্পর্ক কেন প্রভাব ফেলবে স্বামী-স্ত্রীর ব্যক্তিগত সম্পর্কে এটাই মাথায় আসেনা ভাবনার। ভাবনা বুঝতে পারে আবিরও এই সমাজের অন্য দশটা পুরুষের মতোই। সেও ভাবনাকে তার মুঠোয় পুরে রাখতে চায়।
বিকেলে খাওয়া-দাওয়া শেষে বিছানায় দু দিকে মুখ করে শুয়ে আবির আর ভাবনা মোবাইল টিপছে। জারা পাশের রুমে একা ঘুমাচ্ছে। আবিরের মা কিছুদিনের জন্য গ্রামে গিয়েছে।
হঠাৎ ভাবনার ফোন বেজে উঠতেই সে সেখান থেকে উঠে ফোন হাতে বারান্দায় চলে গেল। আবিরের সন্দেহ আরো বেড়ে গেল। এই ক’দিন ধরে ভাবনার সাথে কথা বলবে বলবে করে কোনভাবে সাহস জোগাতে পারছে না। কি বলবে, কিভাবে বলবে? এসব মুখে আনতেও লজ্জা আর ঘৃণা হচ্ছে আবিরের। দিন দিন ভাবনার ব্যবহার আরো বেশি বেপরোয়া হচ্ছে। এটা দেখে আবির আজ খুব ক্ষেপে গেল। অনেক হয়েছে, এভাবে চলতে থাকলে ভাবনার এই দুঃসাহস শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে পৌঁছবে এটা ভাবতেই গা শিউরে উঠল তার। এখনই কথা বলা প্রয়োজন না হলে আরো বেশি দেরি হয়ে যাবে হয়তো !
– কার সাথে কথা বলছো?
আবিরের হঠাৎ আগমনে চমকে উঠলো ভাবনা।
– না, মানে….!
– কি ঘাবড়ে গেলে! খুব অপ্রস্তুত পরিবেশে ফেলে দিলাম হয়তো! খুবই দুঃখিত!
– অপ্রস্তুত হওয়ার কি আছে? আর কথাগুলো কেমন ত্যাড়া করে বলছো মনে হচ্ছে।
– সাধারণ কথাও আজকাল ত্যাড়া মনে হয়? বেশ তো! তবে ত্যাড়াই ঠিক আছে! এবার কার সাথে কথা বলছো সেটা বল!
– অবশ্য এ আর নতুন কী? তুমি আমার সাথে সোজা করে কথা বলোই কবে?
আমার পরিচিত একজনের সাথে কথা বলছিলাম।
– কে এমন যে আমার সামনে কথা বলা গেলনা?
– ভাবনা খানিকটা বাঁকা হাসি হেসে বলল, আমাকে কি আজকাল সন্দেহ করছো নাকি? এটুকুই অবশ্য বাকী আছে!
– তোমার হাসির অর্থ কি বুঝে নিব আমি?
– যা খুশি বুঝতে পারো! তোমার মন যে ধরণের অর্থ বের করার সায় দেয় সেটাই বুঝতে পারো। আমি কিছু মনে করবোনা।
– তবে এতদূর!
– কি এতদূর?
– সত্যি কথা বলো! তোমার সাথে রায়হান সাহেবের কী সম্পর্ক? তার সাথেই কি তোমার এখন কথা হয়নি?
– ভাবনা খানিকক্ষণ থমকে থেকে এবার একটা ক্রুর হাসি হেসে বলল, তোমার কাছে এর থেকে বেশি কিছু অবশ্য আশা করা যায়না।
– বেশ উন্নতি হয়েছে তোমার চিন্তাভাবনার! অল্পতেই অনেক কিছু বোঝ দেখছি।
তাহলে আর কথা না পেচিয়ে সহজ করে উত্তরটা দিয়ে দাও। ফোনের ওপাশের মানুষটি কে ছিলো?
– তুমি যা ভাবছো তেমন কিছুই নয়।
– তবে কি রায়হান সাহেবের সাথের সেদিনের ডিনারপার্টির মত আজও মিথ্যে বলছো?
– আবির! ধমকের সাথে বলল ভাবনা। আমি মিথ্যে বলবো কেনো সেটাই বুঝতে পারছিনা।
– সেদিনের ডিনারপার্টির ব্যাপারটা যে একবিন্দুও মিথ্যে কিছু না সেটা নিশ্চয়ই অস্বীকার করবেনা।
– আমার পেছনে গোয়েন্দা লাগিয়েছো মনে হচ্ছে?
– সত্য চাপা থাকেনা। কি ভেবেছো তুমি? তোমার এতটা অধপতন হয়েছে। ছিঃ!
– আবির! চিৎকার দিয়ে উঠলো ভাবনা।
হঠাৎ কলিংবেলের শব্দে সম্বিত ফিরে পেলো যেন ভাবনা।
নিজেকে সামলে সে দরজা খুলতে গেলো।
দুজন লোক এসেছে একটা এসি নিয়ে।
এসির উপরে বড় অক্ষরে লেখা
” হ্যাপি অ্যানিভার্সারী, মিস্টার! ”
লেখাটি দেখেই চমকে উঠলো আবির। আজ কত তারিখ মনে পড়তেই সে অবাক হলো এই দিনটা সে ভুললো কী করে? মনের এই দুর্বল অবস্থা দেখে প্রথমে অবাক হলেও পরে বুঝতে পারলো এর জন্য ভাবনার পরিবর্তিত আচরণই দায়ী।
লোক দুটিকে রুমে কোন দিকটাতে এসি লাগাবে দেখিয়ে দিয়ে রুমের বাইরে দাঁড়ালো ভাবনা।
আবির এগিয়ে এসে বলল,
– এসবের মানে কি?
– আজ তোমার বিবাহ বার্ষিকী! তাই আমার পক্ষ থেকে ছোট উপহার। কিছুদিন দেখছি গরমে রাতে ঘুমাতে পারছোনা তাই আমি কিস্তিতে এই এসিটা নিয়েছি তোমার জন্য। এজন্যই আমি কিছুক্ষণ আগে এদের সাথেই কথা বলছিলাম। আর কারো সাথে নয়।
– আমি ছাপোষা মানুষ! এসিতে অভ্যস্ত নই। সামান্য সেলস এক্সিকিউটিভ! এসিতে সবসময় থাকার সৌভাগ্য কোথায়?এখন বল এসিটা কি আমার জন্য নাকি তোমার নিজের জন্য? সারাদিন এতবড় এসি কেবিনে থেকে এসে এই ছোট্ট ঝুপড়ির মত রুমে থাকতে কষ্ট হচ্ছে বুঝতেই পারছি। আমার উচিত ছিলো বিবাহ বার্ষিকী উপলক্ষে তোমাকে এই গিফট দেওয়া। কিন্তু আমার মত দু টাকার চাকুরীজীবীর এত সামর্থ্য কোথায়? আমি সত্যিই খুব ভাগ্যবান যে তোমার মত উদার মনের স্ত্রী পেয়েছি। বিভিন্ন অকেশানে এত দামী দামী গিফট পাচ্ছি।
– তুমি কী বোঝাতে চাচ্ছো, আবির?
– বোঝাতে চাচ্ছি আমাকে এসব গিফট দিয়ে তুমি কি বোঝাতে চাচ্ছো? নিজেকে অনেক দামী আর যোগ্য বলে জাহির করছো বুঝতেই পারছি। অবশ্য তুমি তো তাই ই।
– আবির, তুমি অনেকক্ষণ ধরেই যেসব কথা বলছো সত্যিই আমার হজম করতে এবার খুব কষ্ট হচ্ছে। তুমি এসব কথা কেন বলছো? আমি খুব কষ্ট পাচ্ছি !
– বারবার এ ধরনের গিফট দিয়ে আমার জন্মদিনে আমাদের বিবাহ বার্ষিকীতে আমাকে ছোট করছো আর তুমি মনে করেছ আমি কিছু বুঝতে পারছিনা?
আমি যে কষ্ট পাচ্ছি সেটা তুমি বুঝতে পারো না?
তুমি আসলে এগুলো করে আমাকে যে ছোট করছো সেটা আমি ঠিকই বুঝতে পারছি। আরো আগেই বোঝা উচিত ছিল।
– তোমার যা বোঝার বুঝতে পারো। আসলেই তোমার মেন্টালিটি এতটা সস্তা হয়ে গিয়েছে মাঝে মাঝে ভেবে অবাক হয়ে যাই তোমাকে আমি ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম। আজকের দিনটা পর্যন্ত তোমার মনে নেই অবাক হয়ে যাই আমি। এতদিন আমার সাথে যে ব্যবহার করেছো আমি সব চুপচাপ সহ্য করেছি। কারণ আমি তোমাকে ভালবাসি। আমি তোমাকে কতটা ভালবাসি সেটা বোঝার ক্ষমতা মনে হচ্ছে এখন তোমার নেই।
– তোমার সেই ভালবাসা যে কর্পূরের মত উড়ে গেছে সেটা বুঝতেও আমার আর বাকি নেই।
– কার ভালোবাসা কর্পূরের মতো উড়ে গিয়েছে সেটা কথাবার্তার নমুনা দেখলেই বোঝা যায়। ছিঃ, তুমি এতটা চিপ মেন্টালিটি নিয়ে এতদিন আমার সাথে থেকেছে ভাবতেই অবাক লাগে।
– ও মনে মনে তাহলে অনেক কিছুই ঠিক করে ফেলেছো।। চিপ মেন্টালিটির মানুষটাকে ফেলে আজকাল হ্যাভি মেন্টালিটির মানুষদের সাথে বেশ জমিয়েছো দেখছি। তা এই আড্ডা কি শুধুই রেস্টুরেন্ট এর টেবিল পর্যন্তই সীমাবদ্ধ নাকি আরও কোথাও পৌঁছেছে? আজকাল তো বাসায় ফিরে অনেক রাত করে। তাই কোন কিছুই অসম্ভব মনে হচ্ছে না তোমার কাছ থেকে। মাঝখানে আমি গোবেচারা সাইনবোর্ডের মত ঝুলে আছি। এটুকুই বা ঝোলানোর কি দরকার? ছুড়ে ফেলে দিলেই তো পারো!
– মাই গড! ইউ আর সিক, রিয়েলি সিক! আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু টক উইথ ইউ এনিমোর!
ভাবনার রাগে কাঁপতে কাঁপতে সেখান থেকে মেয়ের রুমে চলে গেল। বাসায় দুইটা লোক কাজ করছে সেদিকেও খেয়াল নেই আবিরের। বাজে কথার একটা লিমিট থাকে।
আবিরের মুখে এ রকম সন্দেহজনক কথায় ভাবনা একদম থ-বনে যায়। তার মুখের ভাষা হারিয়ে ফেলে। রাগে, দুঃখে, অপমানে সে চুপ করে আছে। লজ্জায় ঘৃণায় নিজেকে গুটিয়ে ফেলতে মন চাচ্ছে নিজের ভেতর। পরক্ষণেই ভাবছে, আবির তো এমনটাই চেয়েছে সব সময়। আবির চায়, ভাবনা যেন শামুকের মতো নিজেকে গুটিয়ে পুরোটা জীবনযাপন করে। ভাবনা সেটা করেনি বলেই আজ এত কথা, এত সন্দেহ ! সে এভাবে পরাজিত হতে চায়না।
ভাবনার চোয়াল শক্ত হলো। না এভাবে আর কিছুতেই না। ভেবেছিল আবির হয়তো ঠিক হবে। কিন্তু কোথায় কি? দিনদিন আবিরের অধঃপতনই হচ্ছে! ভাবনাকে নিয়ে যেসব অপবাদ দিচ্ছে এগুলো সহ্য করার ক্ষমতা তার নেই। এর থেকে বেশি কিছু হলে খুব উল্টাপাল্টা কিছু ঘটে যাবে। তার আগেই নিজেকে শান্ত করা দরকার! আবিরের সাথে কথা বলার মতো পরিবেশ আর নেই!
ভাবনার দু’চোখ বেয়ে নোনাজল বয়েই চলছে।
কিছুদিন ধরে তার শরীরটা খুব খারাপ যাচ্ছে। কিন্তু একথা সে আবিরকে কখনোই বলেনি। সে ভেবেছিল আবির হয়তো নিজে থেকেই বুঝবে। কিন্তু তেমনটা কিছুই হয়নি, আবিরের তার দিকে চোখ তুলে তাকাবার সময় কই? ঘৃণা আর সন্দেহ জমে জমে তার মনে যে ভাবনার ভালোবাসার সামনে পাহাড়সম বাধা সৃষ্টি হয়েছে সেটা বুঝতে আর বাকি রইলোনা ভাবনার।
ভাবনা জানে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে শুধু ভালবাসা থাকলেই যে সংসারের বন্ধন দৃঢ় হবে সেটা কিন্তু নয়। অনেকসময় পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে যে কোনো একজনের মনে অপরজনকে নিয়ে জন্ম নেওয়া ভয়, ঈর্ষা, হীনমন্যতা কতটা নেতিবাচক পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে তার প্রমাণ আবির! আবিরের এহেন নেতিবাচক আত্মধারণা যে পরবর্তীতে কতটা ভয়াবহরূপে প্রকাশ পাবে সেটা ভাবতেই কুকড়ে গেলো ভাবনা। এই ভয়াবহতা যে তাদেরকে কতটা মানসিক যন্ত্রণা দিবে সেটা সহ্য করার ক্ষমতা ভাবনার আর নেই।
হঠাৎ মোবাইলের মেসেজের টুং-টুং শব্দে ভাবনা স্বাভাবিক চিন্তার জগতে ফিরে এলো যেন। মেসেজ ওপেন করতেই চোখ মুছে ফেললো দু ‘হাতে।
ক’দিন ধরে শরীর খারাপ লাগায় কিছুটা সন্দেহ হয় ভাবনার। শতভাগ নিশ্চিত হওয়ার জন্য সে হাসপাতালে ব্লাড দিয়ে এসেছিলো। সেখান থেকে পরিচিত একজন নার্সকে রিপোর্ট আসামাত্র মেসেঞ্জারে রিপোর্টের ছবি পাঠাতে বলে রেখেছিলো।
ভাবনা এনিভার্সারি নিয়ে মনে মনে খুব উৎসাহী ছিলো। আবিরকে সারপ্রাইজ দেবার জন্য কেক অর্ডার করেছে। আজ সন্ধ্যায় কেক কাটার সময় নিজের মুখে আবিরকে কানে কানে দ্বিতীয় বার মা হবার সুখবরটা জানাবে। সে ভেবেছে এটা আবিরের কাছে তাকে দেওয়া সবচেয়ে মূল্যবান উপহার হবে হয়তো। সারাদিন যখন একবারের জন্যও আবির তাদের এনিভার্সারীর কথা বলছিলোনা তখন ভাবনা বুঝতে পেরেছে যে সে হয়তো ভুলে গেছে। তাই সে সবকিছু গোপণ করে আবিরকে সারপ্রাইজড করতে চেয়েছিলো।
কিন্তু বিধির কী অদ্ভুত চাওয়া!
মুহূর্তে সবই বদলে গেলো। সে নিজেই সারপ্রাইজড নাকি শকড বুঝতে পারছেনা! আবির কি করে বলতে পারলো ভাবনা রায়হান সাহেবের সাথে রেস্টুরেন্টে আড্ডার বাইরে আর কিছু করছে কিনা?
এতদিন সবকিছু সহ্য করেছে কিন্তু এটা কিছুতেই সে মেনে নিতে পারছেনা। অনেকের কাছে এটা হয়তো অনেক সহজ ব্যাপার! কিন্তু ভাবনার কাছে, একজন স্ত্রীর কাছে তার স্বামীর থেকে এর থেকে বড় অপমান আর হয়না। এতটা সন্দেহ আর এতটা অবিশ্বাস!
মুহূর্তেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো সে। মেয়েকে ডেকে তুললো। বলল, রেডি হতে। নানির বাসায় যাবে।
সে দ্রুত উঠে প্রয়োজনীয় কাপড়চোপড়, জিনিসপত্র আর জারার বইখাতা প্যাক করে ফেললো। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে আবিরকে তার প্রেগন্যান্সির ব্যাপারে কিছুই জানাবেনা। আর আগামীকাল অফিসে যেয়ে প্রথম কাজ রিজাইন নেওয়া। যোগ্যতা থাকলে অন্য কোথাও জব পেতে তার কষ্ট হবেনা। এতটুকু কনফিডেন্স তার আছে। কারণ এই অফিসে সে যতবার রায়হান সাহেবকে দেখবে ততবার আবিরের বলা এই বাজে কথাগুলি মনে পড়বে !
রুমের বাইরে বেরিয়ে দেখলো আবির বাসায় নেই। বেরিয়ে গেছে। ছোট একটা চিঠি লিখে ডাইনিং টেবিলের উপরে রেখে সে ঘরে তালা দিয়ে বাড়িওয়ালার কাছে চাবি বুঝিয়ে দিয়ে গেলো।
আবির রাতে নিজের কাছের চাবি দিয়ে ঘর খুলে লাইট অন করতেই চোখ পড়লো চিঠিটার দিকে। চিঠিটা হাতে নিতেই সে অবাক!
” তুমি সবসময়ই বলতে না তুমি আমার অযোগ্য! ইয়েস, ইউ আর টোটালি আনফিট ফর মি! ব্যাপারটা তুমি আগে বুঝলেও আমি কত বোকা যে বুঝতে বুঝতে এত দেরী করে ফেললাম। সো, একজন আনফিট পারসন এর সাথে আমি আমার বাকি জীবনটা কাটাতে চাই না।
কখনো কোনোদিন যোগাযোগের চেষ্টা করবেনা আমার সাথে। এমন কি মেয়ের সাথেও না। তাহলে আমার থেকে খারাপ পৃথিবীতে কেউ হবেনা মনে রেখ! নিজের মত কোন সেলস গার্ল খুঁজে নিও বাকী জীবনের জন্য! যাকে নিয়ে অন্ততপক্ষে হীনমন্যতায় ভোগার অবকাশ হবেনা তোমার। আজ এই মুহূর্ত থেকে আমি মুক্ত করে দিয়ে গেলাম তোমাকে। এবং আমিও মুক্ত করলাম নিজেকে।
আমি খুব ভেবেচিন্তে ঠান্ডামাথায় চিঠিটা লিখছি। অতএব আশা করছি বুঝতেই পারছো।
আমি তোমার কুৎসিত আর নোংরা চেহারা আর দেখতে চাইনা, নেভার…… এভার!!! তোমার চেহারা দেখানোর মত এমন দুঃসাহস কখনো দেখাবেনা আশা করছি।
আর একটা কথা! কখনো তোমাকে ভালবেসেছিলাম সেই হিসেবে তোমার শুভাকাঙ্ক্ষী ভাবতেই পারো। আমার মনে হয় তোমার বেশ ভালো একটা ট্রিটমেন্ট দরকার। তুমি মানসিক বিকারগ্রস্ত একজন মানুষ যার পাশে আমি থাকাটা এখন মোটেই নিরাপদ মনে করছি না। কারন আমি একজন নারী, একজন মা, সর্বোপরি আমি একজন মানুষ! আমারও আত্মসম্মানবোধ আছে। যে সম্মানটা তোমার সংসারে থাকতে গেলে ধূলোয় মিশে যেতে আর বোধহয় কাল বিলম্ব হওয়ার সুযোগ নেই।
অনেক স্বপ্ন ছিল আমার নীল আকাশকে ঘিরে। ভেবেছিলাম সেখানে পাখিরা উড়বে। চন্দ্র-সূর্য, নক্ষত্ররাজী খেলা করবে। কখনো নীলিমার এককোণে টুকরো টুকরো সাদা মেঘ জমবে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হয়ে সে মেঘ ঝরে পড়বে। কিন্তু সেটা এখন আর সম্ভব না! আমার নীলিমা জুড়েই কালো মেঘের ঘনঘটা ! এ যেন কালবৈশাখী ঝড়ের লক্ষণ! এই ঝড়টাকে আমি কিছুতেই সহ্য করতে পারবো না। তাই ঝড় শুরু হওয়ার আগেই মুষলধারে বৃষ্টি ঝরিয়ে মেঘের আস্তরণকে হালকা করতে চাই। এজন্যই এমন পথ বেছে নিলাম খুব আশ্চর্য্য হয়োনা।
যেখানে বিশ্বাসটাই মরে গেছে সেখানে আর যাই হোক, সংসার হবে না! অবিশ্বাসের দোলাচলে দুলতে থাকা সংসার আমিও করতে চাই না । নিজের জীবনটাকে নিজের মতো গুছিয়ে নিও, আমি কখনো বাধা হয়ে সামনে এসে দাঁড়াবো না।
শুভকামনা সবসময়। ”
চিঠিটা পড়তে পড়তে চোয়াল শক্ত হয়ে এলো আবিরের। মুষ্টিবদ্ধ দুটি হাত যেনো পেশি থেকে ছিঁড়ে আলাদা হয়ে যেতে চাইছে রাগে ক্ষোভে। থরথর করে কাঁপছে সে।
ভাবনা এত দুঃসাহস কী করে পেলো? ভেবেই নিজের জীবনের উপর থেকে যেন সব মায়া মুহূর্তেই চলে গেলো তার! ভাবনা তবে সত্যিই চলে গেল? পৃথিবীটা এতই নিষ্ঠুর? সম্পর্কের মূল্য এতই সস্তা? আবিরের দু’চোখ বেয়ে দরদর করে নোনা পানি ঝরছে, নাকি লাল রক্ত ঝরছে সে নিজেও বুঝতে পারছে না!
*সমাপ্ত*
প্রিয় পাঠক, জীবনের বাক হয়তো এত সহজ না। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে দুলতে দুলতে চলতে থাকে আমাদের জীবন। কখনো চলতে চলতে আর দুলতে দুলতে বিনি সুতোর এই বন্ধন ছিঁড়ে যায় অথবা কখনোবা কেটে যায় আমৃত্যু! গল্পে সবই সম্ভব! তাই গল্পের মতো করেই গল্প লিখলাম! কারো হয়তো ভালো লেগেছে হয়তোবা কারো লাগেনি!
এই গল্পটা লিখতে গিয়ে কি হয়েছে জানিনা খুব প্যারার মধ্যে রেখেছিলাম আপনাদের ক’দিন! বারবার ক্ষমা চেয়ে লজ্জিত করতে চাই না। যাইহোক খুউব অপেক্ষা করানোর পরে গল্পটা শেষ করলাম আজ। সবাই ভালো থাকবেন। আমার জন্য দোয়া করবেন। ধন্যবাদ !
পর্ব- ১২
https://www.facebook.com/111576077291737/posts/259902785792398/