#অলকানন্দার_নির্বাসন
#মম_সাহা
বিশেষ পর্ব:
ভোরটা বরাবরের মতন মিঠে নয়। আলো উঠেছে আকাশে কিন্তু রঙিন হয়নি এই সকাল। একটা দমবন্ধকর ভাব প্রকৃতিতে। ঝড় আসার আগ মুহূর্তে যেমন গুমোট থাকে প্রকৃতি ঠিক তেমন অবস্থা। হেমন্তকালে ঝড় সচারাচর আসার কথা না, কিন্তু কে জানে! অলকানন্দার দুঃখে হয়তো তারা বেশিই কাতর। অলকানন্দা নিভু নিভু চোখে দেখছে, তাকে জ্বালানোর আগেই মশালটা কেমন জ্বলছে! অলকানন্দা সে দিকেই তাকিয়ে আছে। সে তো একা আসতে চায়নি এখানে, ভেবেছিল নিজের শাশুড়িকে জানিয়েই আসবে, কিন্তু সুরবালা দেবী তো তাকে কথা বলার সুযোগই দেয়নি। তার উপর কৃষ্ণপ্রিয়ার আকুতি মিনতিতে কোনো খুঁত ছিল না। অলকানন্দা বুঝতেই পারেনি কারো ভালো করতে চাওয়াটা যে এত বড়ো অন্যায়।
অলকানন্দা ক্লান্ত হয়ে এলো। অস্ফুটস্বরে বলল,
“আমাকে জ্বালিয়ে দেওয়ার হলে এখনই জ্বালাও, পরে যদি তোমরাই জ্বলে যাও!”
গ্রামবাসী অলকানন্দার চোখ-মুখে একটা তেজ দেখতে পেল। একজন হৈ হৈ করে বলল,
“হ্যাঁ, জ্বালিয়ে দে। গ্রামে যতক্ষণ এ পাপ থাকবে ততক্ষণই সমস্যা।”
সেই একজনের কথায় সম্মতি দিল আরও কয়েকজন। অতঃপর একটা লোক মশাল নিয়ে এগিয়ে এলো। তার হাত কাঁপছে না মোটেও। সে নির্দ্বিধায় আগুনটা অলকানন্দার হাতের কাছে নিয়েছে, কিছুটা আগুনের আঁচ হাতেও লেগেছে, কিন্তু পুরোটা লাগানোর আগেই সেখানে উপস্থিত হলো অলকানন্দার আশার আলো হয়ে ভিনদেশী সেই সাহেবরা। অ্যালেন তো বিস্মিত কণ্ঠে বলে ওঠল,
“হেই, স্টপ। হোয়াট আর ইউ ডুয়িং ম্যান?”
ইংরেজি সাহেবদের দেখেই থেমে গেল লোকটা। আমতা আমতা করে বলল,
“সাহেব, এই কাজে বাঁধা দিবেন না। এই মেয়েটা অনেক বড়ো পাপ করেছে।”
অ্যালেন প্রায় ছুটেই এলো অলকানন্দার ঝিমিয়ে আসা দেহটার দিকে। বিচলিত কণ্ঠে বলল,
“পাপ! কী পাপ? কী করিয়াছে উনি?”
গ্রামবাসী এবার প্রথম থেকে সবটা খুলে বলল সাহেবদের। অ্যালেনসহ মিস্টার স্টিফেন সকলেই মনযোগ দিয়ে শুনলো সবটা। কথা শেষ হতেই অ্যালেন ডানে-বামে মাথা নাড়িয়ে বলল,
“এই মেয়েটা এটা করিতে পারেনা কখনোই। এটা অসম্ভব। আপনাদের ভুল হইয়াছে।”
অ্যালেনের নরম কথার বিপরীতে গ্রামবাসী হুঙ্কার দিয়ে বলল,
“এটাই হয়েছে। আমরা হাতে-নাতে ধরেছি। আপনারা এখানে কোনো কথা না বললেই ভালো হবে, নয়তো….”
“নয়তো কী?” প্রশ্নটা ছুঁড়ে দু’কদম এগিয়ে এলো মিস্টার স্টিফেন। চোখ মুখ তার সবসময়ের মতনই রূঢ়। স্টিফেনের শক্ত প্রশ্নে আমতা-আমতা করে ওঠলো সকলে। একজন বয়োজ্যেষ্ঠ লোক এগিয়ে এসে ক্ষীণ স্বরে বলল,
”আমাদের গ্রামে এমন অন্যায় কাজ হলে আমরা শাস্তি দিয়েই থাকি, সাহেব। আপনারা তো ভিনদেশী মানুষ, এসব কিছুই জানেন না। যদি না আমরা ওকে শাস্তি দেই তবে আমাদের ঘরের বউ মেয়েরাও অন্যায় করতে পিছ পা হবেনা।”
“ও, তাই নাকি! তা এই অলকানন্দা যখন ভালো কাজ করেছে তখন আপনার বাড়ির মেয়ে বউ তা দেখিয়া কতটুকু ভালো কাজ করিয়াছে শুনি?”
স্টিফেনের কথার জালে মোটামুটি সকলেই ফেঁসে গিয়েছে। কিন্তু তারা হারবার পাত্র না। টগবগে এক যুবক তো তেড়ে এসেই বলল,
“সাহেব, আমরা ওকে পুড়িয়েই ছাড়ব।”
ছেলেটার কথা শেষ হতেই স্টিফেনের শক্ত বুটের লাথি গিয়ে পড়ল ছেলেটার বুকে। যেটা না সামলাতে পেরে ছেলেটা মুখ থুবড়ে পড়ল। স্টিফেনের চোখ-মুখ আরও ভয়ঙ্কর হলো। কাঠ কাঠ কণ্ঠে বলল,
“কে আগুন লাগাবে আসুন, আমিও দেখিব আজ উনার কথা না শুনিয়াই কীভাবে উনাকে আপনারা শাস্তি দেন।”
ছেলেটার এক লাথিই যেন গ্রামবাসীর উথাল-পাতাল করা থামিয়ে দিল নিমিষেই। কেউ আর সাহস পেল না কিছু বলার। অ্যালেন স্টিফেনের নির্দেশে এগিয়ে গেল অলকানন্দার কাছে। উৎকণ্ঠিত গলায় জিজ্ঞেস করল,
“বিউটিফুল লেডি, শুনিতেছেন? আপনার কী সেন্স আছে এখনো?”
অলকানন্দা বহু কষ্টে উপর-নীচ মাথা নাড়াল। সেটা দেখেই অ্যালেন প্রশ্ন ছুঁড়ল,
“আপনি এখানে কেন এসেছিলেন? কী কারণে? আপনি আমাদের বলিতে পারেন। ভয় পাইবেন না, আমরা আছি। বলুন আপনি।”
অলকানন্দা ভরসা পেল। নিভু নিভু চোখে অ্যালেনের দিকে তাকিয়ে অস্ফুটস্বরে বলল, “আমার জা কৃষ্ণপ্রিয়াকে এখানে আনানোর ব্যবস্থা করুন। আমি সকল প্রশ্নের উত্তর দিব।”
অলকানন্দা কথাটা বলতে দেরি অথচ স্টিফেনের নির্দেশ দিতে দেরি নেই। সে তার সাথের একজনকে দ্রুত আদেশ দিল কৃষ্ণপ্রিয়াকে যে কোনো মূল্যে এখানে উপস্থিত করার জন্য। স্টিফেনের আদেশ পেতেই ছেলেটা ছুট লাগাল। গ্রামবাসী তখন মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে। স্টিফেন মাটিতে গড়াগড়ি খাওয়া ছেলেটার মুখে নির্দয়ের মতন আরেকটা লাথি মেরে এগিয়ে গেল অলকানন্দার দিকে। গ্রামবাসী এখন মোটামুটি ভীত। সাহেবদের ক্ষমতার কাছে যে তারা নেহাৎই তুচ্ছ সেটা তাদের ভালো করেই জানা আছে।
স্টিফেন অলকানন্দার কাছে এসেই তার দঁড়িটা খুলে দিল। ক্লান্ত শরীরে বিধ্বস্ত মেয়েটা বসে পড়ল সেই জায়গাতেই। স্টিফেন তার সাথে আসা আরেকটা ছেলেকে নির্দেশ দিয়ে জলও আনাল। অলকানন্দার নাক-মুখে শুকিয়ে আছে রক্তের স্তূপ। স্টিফেন জলটা অলকানন্দার দিকে এগিয়ে দিয়ে কঠিন কণ্ঠে বলল,
“ড্রিংক ইট।”
অলকানন্দার শরীর এত দুর্বল হয়ে গিয়েছিল যে জলটুকু ধরার ক্ষমতাটুকু তার হচ্ছিল না। তবুও সে কম্পনরত হাতে জলটা ধরার চেষ্টা করে অবশেষে ব্যর্থ হলো। স্টিফেন অলকানন্দার এত করুণ অবস্থা দেখে নিজেই জলের পাত্রটা অলকানন্দার ঠোঁটের সামনে ধরল। জলটা পেতেই সে গটগট করে পান করে ফেলল যেন কত বছরের পিপাসু মেয়েটা! যে কারোরই মায়া হবে এই বিধ্বস্ত অলকানন্দাকে দেখে।
অলকানন্দার শরীর ধীরে ধীরে আরও খারাপের দিকে যাচ্ছিল। তা দেখে অ্যালেন ব্যস্ত কণ্ঠে বলল,
“উনাকে নিয়ে চলো স্টিফেন। উনি আর বেশিক্ষণ এমন করিয়া পড়িয়া থাকিলে বাঁচিবে না।”
গ্রামের মানুষ কথাটা শুনতেই নড়বড়ে মনে বাঁধা দিল। দু একজন সাহস করে বলল,
“ওর শাস্তি হবে, সাহেব।”
অ্যালেন ক্ষুব্ধ হলো ঠিকই কিন্তু তা প্রকাশ করার আগেই রণমুর্তি ধারণ করল স্টিফেন। তার সাথের বিশাল দেহযুক্ত ছেলে গুলোকে নির্দেশ করে বলল,
“ওদের দু’জনকে এখনই এই গাছের সাথে বাঁধো। আর এই সানশাইন আই মিন নন্দার শরীরে যত আঘাত আছে সব ওদের শরীরে ফেলো। তারপর ঠিক যতটুকু শাস্তি ওরা দিতে চেয়েছি ততটুকু শাস্তিই ওদের জন্য ধার্য করে। কুইক। গো।”
স্টিফেনের নির্দেশ পাওয়ার সাথে সাথেই ছেলেগুলোকে ধরে ফেলল স্টিফেনের দেহরক্ষীরা। কোনো বাঁধা নিষেধ মানল না। অলকানন্দা কিছু বলতে চাইল, হয়তো এ অবস্থাতেও গ্রামের মানুষদের ভালোটাই চাইতো কিন্তু স্টিফেনের ভয়ঙ্কর দৃষ্টির কাছে সে হার মেনে গেল। তন্মধ্যেই স্টিফেনের আরেক দেহরক্ষী ছুটে এলো যাকে পাঠানো হয়েছিল বিহারিণী মহলে। সে ছুটে এসে প্রায় হাঁপিয়ে ওঠা কণ্ঠে বলল,
“সাহেব, কৃষ্ণপ্রিয়া দেবীকে আনতে পারলাম না। কারণ সে বেঁচে নেই। আজ ভোরেই গলায় কলসি বেঁধে তাদের পেছনের বড়ো দিঘিটাতে ডুব দিয়েছে।”
#চলবে