#অলকানন্দার_নির্বাসন
#মম_সাহা
১৫.
বিমূঢ় চিত্ত নিয়ে হতভম্বের ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে অলকানন্দা। তার দৃষ্টি অস্থির। ছুটে গিয়ে নিজের ছোটো বোনটাকে দু’হাতে জাপ্টে ধরল। সময়টা তখন রাতের শুভারম্ভ। আকাশে বাতাস গুমোট করা একটা উষ্ণতার ছোঁয়া। গ্রামবাসীর হৈ হুল্লোড় করা অনুষ্ঠান প্রায় থিতিয়ে এসেছে। অলকানন্দা নিজের বোনের ধ্বংসাবশেষ টুকু ভীষণ যত্নে বুকের মাঝে আকড়ে ধরল। ছোটো বোনের এমন দশায় সে দিক ভ্রষ্ট। ছুটে এলো সুরবালা, নবনীলও। অলকানন্দা বিচলিত কণ্ঠে বার কয়েক ডাকল নিজের বোনকে,
“অন্নপূর্ণা, এই অনু, চোখ খোল। দিদি ডাকছি তো।”
অন্নপূর্ণার বিশেষ ভাবান্তর হলো না। সে নিভু নিভু চোখে বার কয়েক তাকাল কেবল। একটা শীতল রাগ অলকানন্দার শিরদাঁড়ায় প্রবাহিত হলো। সে কিছুটা তীক্ষ্ণ স্বরে মিস্টার স্টিফেনকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আপনি আমার বোনের এ অবস্থা করেছেন! আপনি!”
স্টিফেন উত্তরে কেবল মুচকি হাসলেন। ভিনদেশী এই সুপুরুষের হাসি বড্ড চমৎকার লাগল। বেশ গভীর ভাবে খেয়াল করলে বোঝা যায় লোকটার বা’গালে একটা ছোটো গর্ত হয় হাসলে যা আরও চমকপ্রদ লাগে। সচারাচর অতিব ফর্সা রঙের পুরুষের মুখে মায়া খুঁজে পাওয়া যায় না কিন্তু স্টিফেনের মুখে একটা নিবিড় মায়া দেখতে পাওয়া যায়। অন্যান্যদের মতন তার চুল গুলো লালচে কিংবা ধূসর হলদেটে রঙের না। তার চুল কালো রঙেরই তবে সাধারণ বাঙালিদের মতন অত কুচকুচে কালো না। আর চোখের পাপড়ি গুলো বেশ ঘন। এমন চোখ পুরুষদের চেয়ে নারীদের বেশি মানায়। কারণ নারীদের চোখ কথা বলার জন্য ব্যবহৃত একটি গোপন অঙ্গ। নারীর চোখ হাসে, কাঁদে কিন্তু পুরুষদের ক্ষেত্রে তা ভিন্ন। পুরুষদের চোখ সবসময় থাকে কঠিন, তীক্ষ্ণ, খা খা মরুভূমির মতন। অথচ স্টিফেনের ক্ষেত্রে পুরো বিপরীত। বরং মনে হচ্ছে এমন ঘন পাপড়ি যুক্ত চোখ তাকে ছাড়া আর কাউকেই মানাবে না।
অলকানন্দা হয়তো আরও কিছু বলতো কিন্তু তার আগেই তাকে থামিয়ে দিল নবনীল, সাবধানী কণ্ঠে বলল,
“ভেবে করবেন কাজ, নন্দা। আপনি, আমি যত বড়ো মানুষই হইনা কেন, ওদের সামনে কিছুই না। ওদের ক্ষমতা একবার দেখানো শুরু করলে আমরা ধোপে টিকবো না।”
অলকানন্দার শরীরে তখন উপচে পড়া জেদ কিন্তু সে বরাবরই বুদ্ধিমতী, তাই সংবরণ করলো নিজের জেদ। কণ্ঠ কঠিন রেখেই সাহেবকে শুধালো,
“আপনার কোনো সমস্যা থাকলে সেটা তো আমার সাথে মিস্টার স্টিফেন, তবে আমার বোনের এমন অবস্থার কারণ?”
অ্যালেন কিছু একটা বলতে চাইলেন অলকানন্দাকে কিন্তু স্টিফেন থামিয়ে দিল তাকে। বাঁকা হেসে বলল,
“রাজার আসনে বসতে হলে রাজনীতি জানতে হয় সানশাইন। আপনি রাজনীতিতে বড্ড কাঁচা। রাজার চতুরতা থাকতে হয়, কেবল সাহসিকতা দিয়ে কিছু হয় না, নাথিং। গ্রো আপ, যুদ্ধ বাকি আপনার।”
অলকানন্দা তাজ্জব বনে তাকিয়ে রইলো। স্টিফেন এত ভালো বাংলা বলতে পারেন কেউ বুঝবেই না যে যে ভিনদেশী! খুব পরিপক্ব বাংলা বলেন উনি। আগে তেমন খেয়াল না করলেই তার মুখে বাংলাটা শুনতে বেশ সুমধুর লাগে! আর তার কথার গম্ভীর্যতা বহুদূর প্রসারিত।
অলকানন্দা ফ্যালফ্যাল নয়নে তাকিয়ে থাকতে থাকতে স্টিফেন সেখান থেকে প্রস্থান নিলেন। অ্যালেনসহ বাকিরাও তার পিছে পিছে চলে গেলেন। পিছনে রেখে গেলেন বিস্মিত কিছু নয়ন।
_
মাথার উপর নিশ্চুপ ভাবে ঘুরছে স্থির তিন পাখা যুক্ত যন্ত্রখানা। তার নিচে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে কতগুলো মানুষ। ফ্যাসফ্যাসে গলায় এক কোণায় কাঁদছে অলকানন্দার মা। থেমে থেমে সেই মিহি কান্নার স্বরই ঘর জুড়ে শোনা যাচ্ছে। তন্মধ্যেই অলকানন্দার বাবা নিতাই দাস খেঁকিয়ে উঠলেন অকথ্য ভাষা ধরে,
“মা গী মহিলা, তুই রাখতে পারিস নাই আমার মাইয়াটারে সামলাইয়া? খান কি বানাইয়া ছাইড়া দিলি। কে বিয়া করবো অহন ওরে? তার উপর কলঙ্ক মাথায় নিয়া ডুইবা না মইরা ও বিছানাতে শয্যাশায়ী হইছে। কোনো লাজ লজ্জা নাই মা গীর ভিতরে।”
নিতাই দাস আরও কিছু বলতেন কিন্তু থামিয়ে দিলেন সুরবালা দেবী। সাবধানী কণ্ঠে বললেন,
“নিতাই বাবু আপনার ভাষা সংযত করুন।”
“ভাষা সংযত করতে কইতাছেন? সংযত! এক মাইয়া কলঙ্ক পাইলো আরেক মাইয়া বেধবা হইয়া….”
“আরেক মেয়ে বেধবা হয়ে তোমার কোনো ক্ষতিই করেনি, বাবা। আর না তোমার ঘাড়ে গিয়ে উঠেছে। তাই নিজেকে দুঃখী প্রমাণ করার প্রয়োজন নেই।”
অলকানন্দার শক্ত জবাবে তাজ্জব নিতাই দাস। তার বড়ো মেয়ে মুখের উপর এমন শক্ত জবাব দিতে পারে তার এটা অবগতই ছিলো না বোধকরি। নন্দন মশাই এই যেন মোক্ষম সময় পেলেন। নিতাই দাসকে নালিশের বার্তা দিলেন,
“অবাক হচ্ছেন নাকি বেয়াই মশাই? এটা আপনার মেয়েই যে বড়োদের শাসন, আচার-আচরণ না মেনেই করছে যা ইচ্ছে তা।”
নিতাই দাস ক্ষুব্ধ হলেন। মেয়ের দিকে তাকিয়ে বাজখাঁই গলায় বললেন,
“এত অধঃপতন হইছে তোর? মাইয়া মানুষের কণ্ঠ উঁচুতে উঠলে তাকে কী বলে জানিস? তাকে বে….”
“খবরদার, বাবা। তোমার মুখ থেকে আরেকটা অসম্মানজনক শব্দ বেরুলে তা তোমার জন্য বিপদ আনবে।”
অলকানন্দার তীক্ষ্ণ কণ্ঠের সাবধানী বাণী নিতাই দাসের রাগকে দ্বিগুণ করে তুললো। সে মেয়েকে মারার জন্য উদ্যত হতেই অলকানন্দা শক্ত কণ্ঠে বাড়ির কর্মচারীকে ডাকল,
“গোবিন্দ কাকা, গোবিন্দ কাকা।”
অলকানন্দার কণ্ঠ তখন কিছুটা উঁচুতেই। তার ডাকে গোবিন্দ কাকা নামক ষাটোর্ধ্ব মানুষটা তার স্থুলাকার দেহটা নিয়ে খুব দ্রুতই উপস্থিত হলেন। এসেই মাথা নত করে বললেন,
“জি বউমা, আদেশ করুন।”
অলকানন্দা তেজস্বিনী চোখে চাইলো নিজের বাবার পানে। কন্যার চোখে তখন উপচে পড়া ক্রোধানল। সেই ক্রোধান্বিতা কন্যা নিজের বাবার দিকে দৃষ্টি রেখেই বলল,
“গোবিন্দ কাকা, আপনি এক্ষুণি উনাকে এই বাড়ি থেকে বের করে দিবেন। আর উনাকে যেন এই বাড়ির চারপাশে না দেখা যায় সেটা সকলকে জানিয়ে দিবেন। আমার হুকুম।”
নিতাই দাস আকস্মিক মেয়ের আচরণে বাক্যহারা হয়ে গেলেন। অবাক দু’টো চক্ষু মেলে কেবল বিস্মিত ভঙ্গিতে দেখলেন তার শান্ত মেয়েটার হুট করে বিরাট পরিবর্তনের সামান্য উদাহরণ। তার ধ্বনিরা হামাগুড়ি দিয়ে যেন বারংবার মুখ থুবড়ে পড়ছে। সে চেয়েও কিছু বলতে পারল না।
অলকানন্দার মা সইলেন না মেয়ের কঠোরতা। মেয়ের কাছে ছুটে এসে মেয়ের বাহুতে ধাক্কাতে ধাক্কাতে বললেন,
“পাগল হলি নাকি, নন্দু? তোর জন্মদাতা লোকটা। তুই কীভাবে এমন আচরণ করলি উনার সঙ্গে? একটু বাঁধলো না?”
“না মা, বাঁধেনি। যে পিতা কন্যার সুখ দুঃখ না বুঝে কেবল নিজের আত্ম অহংকারকে বড়ো করে দেখে, কন্যার মনে সে পিতার কোনো স্থান নেই। বিধবা হয়েছিলাম বলে যে পিতা কন্যাকে বলেছিল অন্যায় সব মুখ বন্ধ করে সহ্য করতে, সে পিতার আসন আমার কাছে নেই। যেই পিতা নিজের কন্যার দুঃসময়ে কেবল কলঙ্কের কথা ভেবে ডুবে মরতে বলেন তাকে পিতার আসনে বসানো পৃথিবীর বৃহৎ তম ভুলের মধ্যে অন্যতম একটি ভুল।”
নিতাই দাস তখন প্রায় হতভম্ব। গোবিন্দ কাকা শুনলেন অলকানন্দার কথা। কিছুটা টেনেই মানুষটাকে বের করে নিয়ে গেলেন। অলকানন্দার চোখ টলমল করছে তবে সে কাঁদলো না। বাবাকে আজ এমন পরিস্থিতিতে না ফেললে হয়তো অন্নপূর্ণার মৃত্যুর কারণ হবে বাবা। কখনো কখনো একটু ভালোর জন্য কঠিন হতে হয়।
_
অন্নপূর্ণাকে নেওয়া হলো শহরের একটি চিকিৎসালয়ে। পুরুষ ডাক্তার চিকিৎসা করে বিধায় প্রায় অনেকের ছিল অমত কিন্তু শুনলো না অলকানন্দা সেই বাঁধা। ছুটলো শহরে। অন্নপূর্ণা তখনও জ্ঞানশূন্য। অলকানন্দা শহরের চিকিৎসালয়ে উঠতেই চিকিৎসা শুরু হয় অন্নপূর্ণার। ডাক্তার জানায় মেয়েটার জিহ্বা কেটে ফেলা হয়েছে।
#চলবে
[পর্ব ছোটো বলে চিৎকার করবেন না, বর্ধিতাংশ দিবো নে।] 🥹