#অলকানন্দার_নির্বাসন
#মম_সাহা
১২.
গাঢ় সন্ধ্যা প্রকৃতির বক্ষ জুড়ে। বিহারিণী মহলের অন্দরমহলে আজ সকলের মাঝে লুকোচুরি ফিসফিস। বাড়ির গৃহ কর্মচারীরা একজনের সাথে আরেকজন ফিসফিস করে কি যেন বলে। অলকানন্দাকে ইশারা করে করে সে কথা বলে কিন্তু যেই অলকানন্দাকে দেখে তখনই ভয়ে চুপচাপ হয়ে যায়। কথা বলে না। লুকোচুরি কথাবার্তা থেমে যায়। অলকানন্দা ব্যাপারটা খেয়াল করেও যেন করছে না। গৃহ কর্মচারীদের এমন আচরণ করাটা তার কাছে অস্বাভাবিক লাগছে না। এতদিনের প্রচলিত প্রথা থেকে বের হতে একটু তো সময় লাগবেই সকলের।
রান্নাঘরে একবার কৃষ্ণপ্রিয়াকে ছুটে আসতে দেখা যাচ্ছে আবার ছুটে নিজের ঘরে চলে যাচ্ছে। সাথে তার কাকী শাশুড়িরও ছুটোছুটি দেখা যাচ্ছে। লক্ষ্মীদেবীও আজ মনোহরদের ঘর। একটু পর পর তার হাঁক শোনা যাচ্ছে। অলকানন্দাকে ছলেবলে অভিশাপ দিচ্ছে অতঃপর আবার চুপ হয়ে যাচ্ছে হয়তো গোপন ভয়ে। মেয়েটা যা-কিছু করতে পারে। এই মেয়েকে বেশি রাগালে যে কপালে দুর্গতি আছে সেই কথা আর কারো বুঝতে বাকি নেই।
মনোহরের আর্তনাদ থেমে থেমে ভেসে আসছে। বেত্রাঘাতে বেত্রাঘাতে তার শরীরটা ক্ষত-বিক্ষত। আজকের মতন এত নিষ্ঠুর বিচারকার্য হয়তো এই গ্রামের মানুষ আগে কখনো দেখেনি। তবে সঠিক বিচার পেয়ে গ্রামবাসীদের মনে তৃপ্তির ছোঁয়া। যাক, যে বিচারে আপন পর ভেদাভেদ নেই সেই বিচারের চেয়ে উত্তম বিচার আর নেই। তার এমন বিচার পেয়ে গ্রামবাসীরা উৎসবমুখর পরিবেশে নিমজ্জিত। অথচ আজ অন্দরমহলে কেবল শুনশান নীরবতা। আর থেমে থেমে আর্তনাদ। পুরো পাঁচশ বেত্রাঘাত দেওয়ার আগেই মনোহর প্রায় আধমরা হয়ে গেছে। তাই তার বিচারকার্য সেখানেই থামানো হয়েছে। আর বিস্ময়কর একটি ব্যাপার হলো প্রথম পঞ্চাশটা বেত্রাঘাত করেছে ভুক্তভোগী সেই কন্যা। যে সারাদিন লজ্জায় ঘর ছেড়ে বের হয়নি সে কেমন দীপ্তিময় একটা উজ্জ্বলতা নিয়ে ভরা সভায় উপস্থিত হয়েছে। মনের প্রতিটা ক্ষোভ মিটিয়ে সে ইচ্ছেমতন বেত্রাঘাত করেছে। আর অলকানন্দা সবটা সময় দাঁড়িয়ে এই বিচারকার্য সম্পাদিত হতে দেখেছে। গ্রামের এমন কোনো মানুষ নেই যে আসেনি। ছেলে-মেয়ে, নারী পুরুষ, শিশু সকলেই ছুটে এসেছে সে বিচার দেখতে। অবশেষে কৃষ্ণপ্রিয়ার মাটিতে গড়াগড়ি করে স্বামীর প্রাণ ভিক্ষে চাওয়ার পর স্থগিত হলো সেই বিচার।
অলকানন্দা অন্দরমহলের আরামকেদারায় বসে আছে। মনোহরকে দেখতে ডাক্তার বৈদ্য সবই এলো। অলকানন্দা এ ক্ষেত্রে কোনো নিষেধ করেনি বরং সবচেয়ে ভালো চিকিৎসক আনার ব্যবস্থাই সে করেছে। বিচার কার্যের সময় সে ছিল বিচারক কারো আত্মীয় নয় কোনো আপন মানুষ নয় কিন্তু অন্দরমহলে সে অবশ্যই এ বাড়ির বউ, মনোহরের বৌঠান, কৃষ্ণপ্রিয়ার জা এবং এ বাড়ির পরম কাছের মানুষ। এখানে সে বিচারক নয়।
অলকানন্দার মুখোমুখি কেদারায় এসে বসলো প্রসাদ। বাড়ির সকলে যখন মনোহরকে নিয়ে ব্যস্ত তখন প্রসাদের নেই কোনো হেলদোল। সে বরং আয়েশ করেই বসলো কেদারায়। বসে বেশ প্রশংসা করে বলল,
“বাহ্, আজ কী রূপ দেখলাম আপনার অলকানন্দা! এমন তেজস্বী রূপও লুকিয়ে ছিল এত ছোটো একটা মেয়ের ভেতর!”
অলকানন্দা কথা বললো না তবে ক্ষীণ একটা হাসির রেখা টানলো নিজের ঠোঁটে। প্রসাদ আবারও বলল,
“কিন্তু আপনার কী এমন ঝামেলায় যাওয়া উচিত ছিল? যদি কোনো ক্ষতি হয়!”
“প্রসাদ, তোমার মতন মানুষ এমন ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করলে চলবে বলো তো? প্রতিটি মেয়েই প্রয়োজনে ধ্বংসকারী রূপ ধারণ করতে পারে কেবল তার প্রয়োজন একটু আস্থা। যে নারী সৃষ্টি করতে পারে সে নারী ধ্বংসও আনতে পারে তা সকলের অবগত হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তোমার এমন সংশয়ের বাণ ছুঁড়লে নারীর তেজস্বী রূপ কী আর দেখতে পাবে বলো?”
নবনীলের প্রশ্নে প্রসাদের দীর্ঘ হাসির রেখাটা কিছুটা থিতিয়ে এলো। কিছুটা আমতা-আমতা করে বলল,
“যতই হোক, অলকানন্দা তো একা ওনার…..”
“অলকানন্দা একা! কোথায় একা? অলকানন্দার সাথে তো তার ছাঁই চাপা আত্মবিশ্বাস আছে। ওনি তো একা নয়।”
প্রসাদ হাসলো। তার হাতের মোটা মেটে হলদেটে রঙের খোলা বইটা বন্ধ করলো। বাঁকা হেসে বলল,
“নবনীল, শহরের সাথে গ্রাম গুলিয়ে ফেলো না। শহরে থেকে, দু একটা নারীর প্রতিবাদী চরিত্র দেখো তাই তোমার মুখে এমন কাব্য আসাটাই স্বাভাবিক কিন্তু শহরের তুলনায় গ্রাম কতটা পিছিয়ে আছে তোমার ধারণাও নেই। যে গ্রামে একটা মেয়ে বিধবা বলে আরেকটা মেয়ে তার পাশে বসে পরীক্ষা দিতে চায় না সেই গ্রামেই বৈধব্য নামক মনগড়া রোগ নিয়ে একটা মেয়ে শাসনকার্য পরিচালনা করতে পারবে এত সহজে! সব কী এতই সোজা নবনীল? তোমার দুনিয়া দেখার দৃষ্টি এখনো অভিজ্ঞ নয়।”
“আর তুমিও বোধহয় নারীর প্রতিবাদী চরিত্র আর শাসনকার্য নিয়ে স্বস্তিতে নেই কিংবা অভ্যস্ত নও।”
নবনীলের ঠেস মারা কথাটা প্রসাদের বোধগম্য হলো অবশ্যই। অলকানন্দা চুপ করে দু’জনের কথা কাটাকাটি দেখছিল বেশ উপভোগও করছিল। তাদের মাঝে যে আড়ালে সাপে-নেউলে একটা সম্পর্ক আছে তা আর বুঝতে বাকি রইলো না অলকানন্দার। কিন্তু সেই কথা কাটাকাটির দৃশ্য আর বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না তার আগেই বাহিরের পাহারাদার ছুটে এলেন, মাথা নত করে অলকানন্দাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“আসবো বউ ঠাকুরণ?”
অলকানন্দা ঘাড় ঘুরিয়ে চাইলো পাহারাদারের দিকে। লোকটার মাথা নত করা। একদিন এই পাহারাদারই বলেছিল এ বাড়ির বউয়ের ভীমরতি হয়েছে যার জন্য স্বামী মারা যাওয়ার পরও সে চুল কাটতে চায়নি, সাদা শাড়ি পরতে চায়নি। অথচ আজ তার চোখেই অলকানন্দার জন্য সম্মান। আসলে কেউ কাউকে এমনেই অধিকার দেয়না। সেটা অর্জন করতে হয় আর না হলে ছিনিয়ে নিতে হয়। নিজের জায়গা নিজেকেই গড়তে হয়।
অলকানন্দার ধ্যানের মাঝেই প্রসাদ উত্তর দিল, “আসো।”
কিন্তু প্রহরী আগের জায়গায় নিশ্চল দাঁড়িয়ে রইলো। যেন এখান থেকে নড়েচড়ে গেলেই খারাপ কিছু হয়ে যাবে। অলকানন্দা বুঝলো, সে অনুমতি না দিলে এখন এই গ্রামের একটা কাজও যে হবে না। তাই ক্ষীণ স্বরে সে অনুমতি দিল,
“আসুন।”
প্রহরী এবার ভেতরে এলো। মিটমিট করে হাসল নবনীল। প্রসাদের দিকে তাকিয়ে ঠাট্টা করে বলল,
“অলকানন্দা কিন্তু নিজের জায়গা পেয়ে গেছে। তুমি ঘর জামাই, তোমার জায়গা হেলাফেলাতেই থাকবে।”
প্রসাদ বিরক্ত চোখে চাইলো কিন্তু কিছু বললো না। তন্মধ্যেই প্রহরী ভেতরে এসে বিনীত স্বরে বলল,
“আপনার সাথে কয়েকজন দেখা করতে এসেছে। তাদের কী ভেতরে আসতে বলব এখন?”
অলকানন্দা ভ্রু কুঁচকালো। তার সাথে দেখা করার মতন মানুষ বর্তমানে নেই। যদিও কোনো কিছুর বিচারের জন্য আসে তবুও এখন তো আসার কথা না। মাত্রই বিরাট একটা বিচার তারা নিজ চোখে দেখলো। এটা হজম করতে অন্তত কয়েকদিন সময় তো লাগবেই। অলকানন্দা ধ্যানে মগ্ন হয়েই প্রশ্ন করল,
“তারা কারা?”
“একজন আপনার পিতা আর একটা হলো সাহেবদের গাড়ি। ইংরেজি সাহেব এসেছে নিজে আপনার সাথে দেখা করতে।”
অলকানন্দাসহ উপস্থিত সকলেই অবাক হলো। নবনীল বিস্মিত কণ্ঠে বলল,
“এই সন্ধ্যাবেলা সাহেব এসেছেন কেন!”
“উনি বলেছেন বউ ঠাকুরণের সাথে দেখা করবে।”
অলকানন্দা নিজেকে ধাতস্থ করলো। মূলত সে নিজেকে যতটা সাহসী দাবী করে ততটা সাহসী হয়তো সে হয়ে ওঠে নি আদতে। বুক তার কাঁপছে। কম্পনরত কণ্ঠে বলল,
“সাহেবদের ভিতরে আসতে বলুন এবং তার সাথের বাকি অন্যান্য মানুষকে বাহিরের ঘরে বসান।”
অলকানন্দার অনুমতি পেয়ে প্রহরী চলে যেতে নিলেই প্রসাদ দাঁড়াল। অবাক কণ্ঠে বলল,
“আর আপনার বাবা?”
“বাবাকে আসতে হবে না। এতদিন একটা খোঁজ নেয়নি তার মেয়ে বেঁচে আছে কি-না মরে গেছে৷ আজ আমার প্রাচুর্যের কথা শোনে মনে পড়লো আমি বেঁচে আছি। তাই বাবার দরকার নেই এখানে আসা।”
অলকানন্দার শক্ত জবাবে চুপ হয়ে গেল প্রসাদ। নবনীলের মুখে তখন রাজ্য জয়ের হাসি। অলকানন্দার তেজ সে জাগ্রত করতে সক্ষম।
প্রহরী যেতেই অলকানন্দা বিরাট ঘোমটা টানলো। ঢেকে গেল তার চাঁদের মতন মুখখানা। মিনিট পেরুতেই গাড়ির শব্দ স্পষ্ট হলো এবং এর কয়েক সেকেন্ড পেরুতেই অলকানন্দার বৈঠকখানায় দেখা গেল ধবধবে সাদা চামড়ার একজন পুরুষকে। অলকানন্দা আড়ষ্ট হলো। ধবধবে সেই বিদেশি পুরুষ এসেই ঝলমলে হাসি দিয়ে বলল,
“গুড ইভিনিং, শুভ সন্ধ্যা। আ’ম অ্যালেন। ভালো আছেন আপনি?”
সাহেবের এমন বাংলা উচ্চারণ শুনে কপাল কুঁচকালো সে। হাত জোর করে বলল,
“নমস্কার। ভালো আছি আমি৷ আপনি ভালো আছেন? বসুন এখানে।”
সাহেব বাক্যব্যয় না করেই বসে পড়লো। ততক্ষণে পর্দার আড়ালে এসে উপস্থিত হলো বাড়ির সকল মহিলাবৃন্দ। নন্দন মশাইও সাহেব আসার খবর শুনে হন্তদন্ত হয়ে এলেন। আহ্লাদে গদোগদো করে বললেন,
“সাহেব এসেছে আমায় ডাকলে না কেন? আর বউমা, তুমি এখানে কী করছো? যাও ভেতরে। পরপুরুষের সামনে কীভাবে দাঁড়িয়ে আছো লজ্জা ছাড়া?”
“আমি আপনার সাথে নয়, উনার সাথেই দেখা করিতে আসিয়াছি। আপনি বরং ভেতরে চলে যান।”
নন্দন মশাই বিস্মিত হলো সাহেবের কথায়। আমতা-আমতা করে বলল, “ওর সাথে কিসের কথা….. ”
কথা সম্পন্ন হওয়ার আগেই সাহেব ওঠে দাঁড়াল, অলকানন্দার কাছে এসে হাতের বিরাট ফুলের তোড়াটা এগিয়ে দিয়ে বললেন,
“আপনার কথা আজ সকলের মুখে মুখে শুনিয়া আমি অবাক হইয়া ছুটিয়া আসিয়াছি। আপনার এমন সাহসিকতাকে ফুল দিয়ে প্রশংসা করিতেছি। আপনি এটা গ্রহণ করুন।”
)