অলকানন্দার নির্বাসন পর্ব ১১

0
622

#অলকানন্দার_নির্বাসন
#মম_সাহা

১১.

বিচারের আসন খানায় নতুন মুখ দেখে গ্রামবাসীরা হয়তো অমান্য করবে ভেবেছিল সকলে কিন্তু সকলের ভাবনাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে গ্রামবাসীরা অলকানন্দার কাছে হাত জোর করল, অসহায় সেই বাবা অসহায় কণ্ঠে বলল,
“তাহলে তুমিই আমার মাইয়ার বিচার করবা বউ?”

অলকানন্দা এগিয়ে গেলো, মাথা তার উঁচু। পাহারের মতন উঁচু ব্যাক্তিত্ব নিয়ে বলল, “অবশ্যই।”

নন্দন মশাই যে বড্ড অপছন্দ করলেন অলকানন্দার এই কাজটা, সেটা তার চোখ-মুখ দেখেই বোঝা গেল। সে বেশ বিশ্রী রকমের ধমকে উঠলেন,
“বাড়ির মেয়েমানুষ হয়ে, এখানে কেন এসেছ তুমি? আবার বলছো বিচার করবে! ধ্যান জ্ঞান কী সব লোপ পেয়েছে তোমার? যাও এখনই ভেতরে।”

“আমি ভেতরে যাব না কাকাবাবু। আগে মেয়েটার সুষ্ঠু বিচার করুন আপনি।”

“তুমি ভেতরে না গেলে খারাপ হবে, বউ। বেধবা মেয়েমানুষের সব ব্যাপারে বাড়াবাড়ি তো মোটেও ভালো লাগছে না।”

“আপনি বিচার করুন কাকাবাবু, আমি এখানেই থাকব।”

নন্দন মশাই উত্তেজিত হলেন। যেই না তেড়ে আসতে নিবেন তখনই পর্দার আড়াল থেকে ভেসে এলো সুরবালার গম্ভীর কন্ঠ,
“খবরদার ঠাকুরপো, ভুলেও আমার বউমার দিকে এগুবে না। এখন আমার ছেলে বেঁচে নেই। আমার ছেলের অবর্তমানে আমার বউমাকেই আমি তার জায়গায় বসালাম। তুমি ভুলেও কিছু করবে না।”

নন্দন মশাই সুরবালার শীতল হুমকিতে বোধহয় কিছুটা দমে গেলেন। বিস্মিত নয়ন জোড়া মেলে বললেন,
“তাই বলে মেয়েমানুষ তাও আবার বেধবা, সে নাকি বসবে বিচারালয়ে! আপনি বৌঠান ভেবে বলছেন তো?”

“সঠিক বিচারের জন্য বিচারালয়ে যাকেই মানাবে আমি তাকেই বসাবো। আমার পুত্র এই গ্রামকে যেভাবে আগলে রেখেছিল সেভাবে যে আগলে রাখতে পারবে সে-ই বসবে আসনে। হোক সেটা আমার পুত্র বধূ কিংবা অন্যকেউ।”

নন্দন মশাই আর কথা বললেন না। অলকানন্দা কণ্ঠ কোমল করলো, ধীর কণ্ঠে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মধ্য বয়স্ক লোকটাকে জিজ্ঞেস করল,
“আপনার মেয়ে কোথায় এখন?”

“বাড়িতে আছে, মা। যদি মেয়েটার কোনো গতি করতে না পারি তবে তাকে কেটে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া ছাড়া যে আর উপায় থাকবে না।”

“দোষ তো সে করেনি, তবে তাকে কেন ভাসাবেন? দোষ যে করেছে ভাসাতে হলে তাকে ভাসাবেন।”

“বউ!”

“আমি কথা বলছি, কাকাবাবু। আমার বিচারকার্যে অন্য কারো বাঁধা আমি মানবো না।”

নন্দন মশাই হতভম্ব চোখে কেবল তাকিয়ে দেখল এই অলকানন্দাকে। দু’দিন আগেও মেয়েটার চোখে-মুখে ছিল অসহায়ত্ব। আজ কোথায় সব?

নন্দন মশাইয়ের ভাবনার মাঝেই অলকানন্দা কণ্ঠ দৃঢ় করল,
“ঠাকুরপো, ঠাকুরপো কোথায় তুমি? নিশ্চয় বাড়িতে আছো। দ্রুত নিচে নেমে আসবে নাহয় তোমার কপালে দুর্গতি আছে। ঠাকুরপো…”

জন সমুদ্রের ঢেউ নিশ্চুপ। অলকানন্দার চোখ-মুখে একটা দারুণ সাহসিকতার রেখা ভেসে বেড়াচ্ছে। এই পুরুষের বিচার করতে পারবে ভেবেই তার নিজেকে ভাগ্যবতী মনে হচ্ছে। এই যুগে এসে পুরুষদের বিচার হবে কথাটা কল্পনাতেও কেউ ভাবেনি অথচ আজ অলকানন্দা সেটা সত্যি করার জন্য মরিয়া প্রায়।

মনোহরের কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে অলকানন্দা পর্দার দিকে দৃষ্টি দিল। যেখানে দাঁড়িয়ে আছে অন্দরমহলের সকল মহিলা বৃন্দ। সেখানে তাকিয়েই ভরাট কণ্ঠ সে ডাক দিল নিজের জা’কে,
“ছোটোবউ…”

পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা কৃষ্ণপ্রিয়ার তখন বুক কাঁপছে। নিজের নামটা শুনতেই তার আত্মার পানি শুকিয়ে গেল। কোনো মতে বলল,
“বলো বড়দি?”

“এক্ষুনি তোমার পবিত্র স্বামীকে এখানে নিয়ে আসো। আর আমি যদি আনতে যাই তবে কিন্তু খারাপ হবে।”

অলকানন্দার সতর্কবার্তায় কপাল কুঁচকে ফেলল লক্ষ্মী দেবী, মুখ ঝামটি দিয়ে সুরবালার উদ্দেশ্যে বলল,
“তোর বউ বড্ড বাড়াবাড়ি করছে। শোন, বেধবা মেয়েমানুষকে এত মাথায় চড়িয়ে ফেলিস না। পুরুষমানুষের আগে মেয়েমানুষ পা বাড়ালে তাকে বাজারি মেয়েমানুষ বলে। জানিস তো?”

“দিদি, মুখ সামলে কথা বলুন।”

তাদের বাকবিতন্ডার মাঝেই অলকানন্দার কণ্ঠ ভেসে এলো,
“ছোটোবউ, এসেছে ঠাকুরপো?”

কৃষ্ণপ্রিয়া অসহায় চোখে তাকালো একবার। যেই পা বাড়াতে নিলো নিজের স্বামীকে ডাকার জন্য, তখনই দেখল মনোহর বৈঠকখানায় উপস্থিত হয়েছে। মনোহরকে দেখে শীতল জনমানব হৈচৈ করে উঠলো। একটা গমগমে ভাব সেখানে অনুভব হলো। অলকানন্দা গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“আপনারা থামুন, আমি কথা বলছি।”

অলকানন্দার কথায় থেমে গেল সব। ষোলো বর্ষীয়া যেই মেয়েটা বিধবা হয়ে গিয়েছে বলে তার ঠাঁই হয়েছিল নোংরা, স্যাঁতস্যাঁতে একটা ঘরে আজ সেই মেয়ে আসন পেয়েছে বিচারালয়ে। এটাই বোধহয় ভাগ্যের খেলা। যেই মেয়েটাকে সকলে মানুষ ভাবতেই ভুলে গিয়েছিল আজ তার এক বাক্যে স্থির জনমানবের শোরগোল।

অলকানন্দা মনোহরের দিকে এগিয়ে গেলো, শক্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
“তুমি কী করেছ তার মেয়ের সাথে, ঠাকুরপো?”

মনোহরের চোখে-মুখ দিয়ে যেন ঝরে পড়ছে ক্রোধানল। সে নিরুত্তর। কিসের যেন একটা অহংকার তার ভেতরে। অলকানন্দা আবারও প্রশ্ন ছুঁড়লো,
“তুমি কী করেছ তার সাথে?”

“কিছুই না।”

মনোহর উত্তর দিতে দেরি কিন্তু তার গালে সপাটে চ ড় পড়তে দেরি হলো না। পুরো বিচারকার্য থমকে দিয়ে অলকানন্দা কাজটা করে বসলো। মনোহর হিংস্র বাঘের ন্যায় খেপে উঠলো, তেড়ে গিয়ে কেবল বলল,
“বউ ঠাকুরণ আপনাকে….. ”

দ্বিতীয় চড়টা পড়তেও সময় নিলো না। সকলেই প্রায় হতভম্ব। অলকানন্দা দাঁত কিড়মিড় করে শীতল কণ্ঠে বলল,
“কী করেছ জানতে চেয়েছি। এত বিলম্ব করছো কেন?”

মনোহর তার বাবার দিকে তাকালো। নন্দন মশাইয় মাথা নত করা অবস্থা দাঁড়িয়ে আছে। বাবাকে নিশ্চুপ থাকতে দেখেই মনোহরের রুদ্রমূর্তি থিতিয়ে গেল। গাঢ় কণ্ঠে বলল,
“তাকে ইশকুল যাওয়ার পথে তুলে এনে আমাদের বাগান বাড়িতে রেখেছি। কেবল এক বেলা’ই ছিলাম তার সাথে। বেশি না।”

মনোহর কথাটা এমন ভাবে বলল যেন একবেলাতে তেমন কোনো মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায়নি। অলকানন্দার ঘৃণায় শরীর শিউরে ওঠল। উপস্থিত সকলের উদ্দেশ্যে বলল,
“এবার বিচার করবেন আপনারা। বলুন ওর কী বিচার করবেন?”

অলকানন্দার আশকারা পেয়ে সবাই যেন সাহসী হয়ে ওঠল। কেউ বলল- বেত্রাঘাত করতে, কেউবা বলল- চাবুক দিয়ে ক্ষত-বিক্ষত করতে তার শরীর, কেউবা বলল- তার সম্পদ কিছু লিখে দেওয়া হোক মেয়েটার নাম। একেক জনের একেক মন্তব্যে এবার দিশেহারা হলো নন্দন মশাইসহ তার পুত্র, পুত্রবধূ সকলে। কেবল ভাবলেশহীন দেখা গেল তিনজনকে- অলকানন্দা, সুরবালা আর নবনীলকে। প্রসাদের কপালেও তখন চিন্তার গাঢ় ভাঁজ৷ কী দরকার ছিল মেয়েটাকে এসবে আসার?

জন সমাগমকে থামালো অলকানন্দা। ভুক্তভোগী কন্যার পিতাকে প্রশ্ন করল সে,
“আপনি কী চান?”

লোকটা জবাব দেওয়ার আগেই আরেক বৃদ্ধ ব্যাক্তি উত্তর দিল,
“মনোহর রায়কে বিয়ে করতে হবে। একমাত্র মেয়েটার বিয়েই মেয়েটার কলঙ্ক মুছতে পারবে। আর নাহয় তাকে তত টাকা-কড়ি দিতে হবে যত টাকাকড়ি থাকলে কলঙ্ক ঢাকা যায়। এবার আপনার উপর সে ভার।”

অলকানন্দার মুখ গম্ভীর। গম্ভীর কণ্ঠে ডাক দিল কৃষ্ণপ্রিয়াকে,
“ছোটোবউ, তুমি কী চাও?”

কৃষ্ণপ্রিয়ার অবস্থা তখন করুণ। অলকানন্দার উপর তার রাজ্যসম রাগ জমা হলো আর চোখে জমলো অশ্রুর স্রোত। তবুও কোনোমতে উচ্চারণ করল,
“আমার ঘর ভাঙার এত প্রয়োজন তোমার, বড়দি?”

অলকানন্দা হাসল। কৃষ্ণপ্রিয়া মেয়েটা কোনো কিছু বিচার করার ক্ষমতা হারিয়েছে। হারানোটাই স্বাভাবিক। দীর্ঘদিন যাবত পুরুষের পদতলে এই সমাজ শাসিত হয়েছে। সেই সমাজেই পুরুষকে শোষণ করা হবে সেটা কেউই মানতে পারবে না সেটাই স্বাভাবিক। অলকানন্দা আবার ধীর কণ্ঠে বাক্য ছুঁড়লো,
“তোমার ঘর বেঁধেছো ভুল মানুষের সঙ্গে। এবার দোষ কার? আমার না তোমার?”

কৃষ্ণপ্রিয়া আর সে কথার উত্তর দিলো না বরং স্থির কণ্ঠে বলল,
“আমি সতীন আনতে রাজি তবুও আমার স্বামী যেন অক্ষত থাকে।”

“তোর কথায় সব হবে? আমি এই ছোটো লোকের মেয়েকে বিয়ে করব? কখনোই না। ওদের বংশ কত নিচ জানিস? তোর স্বামী কী করবে সেটা তুই বলবি? তোকে তো আজ….”

মনোহর যখন তেড়ে যেতে নিল অন্দরমহলের দিকে তখন তাকে থামিয়ে দিল অলকানন্দা। তাচ্ছিল্য করে বলল,
“ছোটো বংশের মেয়ের শরীরে কালি লেপতে তো ভালোই পারলে এখন বিয়ে করতেই দোষ? সাবধান ঠাকুরপো।”

নিজের কথা শেষ করে সে মধ্য বয়স্ক লোকটার দিকে তাকালো, কোমল কণ্ঠে বলল,
“আপনি কী চান বলুন? তেমনই হবে। এই একটা অমানুষের সাথে বিয়ে দিলে যদি আপনি আপনার মেয়ের অন্যায়ের বিচার পান তবে তা-ই হবে।”

অলকানন্দার কথায় কিছু ইঙ্গিত ছিল যা হয়তো বুঝতে পারল অসহায় বাবা। তাইতো কেমন কঠিন স্বরে বলল,
“বিয়ে দিলেই অন্যায়ের বিচার হবে? বিয়ের পর মেয়েটার সাথে তো আরও অন্যায় হতে পারে। আমি কখনোই এমন পুরুষের সাথে আমার মেয়ে বিয়ে দিব না। আমি চাই ওকে কমপক্ষে পাঁচশো বেত্রাঘাত করা হোক৷ ক্ষত-বিক্ষত করা হোক ওর শরীর। যেন আর কেউ এমন করতে না পারে।”

লোকটার এহেন কথায় কেঁপে উঠলো সবাই। কেউ কেউ বলল এরচেয়ে বিয়ে দেওয়া ভালো হবে। কিন্তু শুনলো না লোকটা কারো কথা। অলকানন্দার ঠোঁটে ঝুলল বাঁকা হাসি। সে বজ্রকণ্ঠে ডাক দিল বাড়ির রক্ষাকারী কর্মচারীকে, আদেশ করলো পাঁচশ বেত্রাঘাতের তাও রাস্তায় বেঁধে লোক সমাগমের মাঝে।

মনোহর ভয় পেলো এবার। নন্দন মশাই ছেলের হয়ে কথা বলতে চেয়েও পারলো না। অলকানন্দার তেজের কাছে সব তুচ্ছ। ছুটে এলো কৃষ্ণপ্রিয়া, অলকানন্দার পা জড়িয়ে ধরে ভিক্ষে চাইল স্বামীকে। অলকানন্দা ভিক্ষে দিল না বরং তাচ্ছিল্য স্বরে বলল,
“এখন তোমার লাল শাড়ির গর্ব কই ছোটোবউ? এই আঁচল দিয়েই ঢেকো স্বামীর দাগ। তোমার শরীরের প্রতিটা দাগ আজ তার শরীরে পরবে। কী দিয়ে ঢাকবে সে লজ্জা?”

মুহূর্তেই এমন চোখ ধাধানো বিচারের খবর ছড়িয়ে গেলো গ্রাম ছেড়ে গ্রামান্তর। নবনীল মুগ্ধ কণ্ঠে বলল,
“নারী নয় সে, যেন ছাঁই চাপা আগুন। ছুঁতে এলেই পুড়বে।”

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here